প্রবেশগম্যতা সেটিংস

অলংকরণ: ন্যুক

লেখাপত্র

বিষয়

অবৈধ বালু উত্তোলন আর তলিয়ে যাওয়া শহর— এশিয়ার গণমাধ্যম যেভাবে পরিবেশ ও জলবায়ু সংকট উন্মোচন করছে

সাধারণত বালু মানেই আমাদের কাছে সমুদ্র সৈকত কিংবা ছুটির দিনের স্মৃতি—বিশ্রাম আর বিনোদনের অনুষঙ্গ। কিন্তু এই বালুই বড় ধরনের পরিবেশগত সংকটের কারণ হয়ে উঠেছে। শহরের রাস্তা-ঘাট আর ভবন নির্মাণের জন্য প্রয়োজন পড়ে কংক্রিটের। যা তৈরির মূল উপাদান বালু। এছাড়া জমিতে বালু ভরাট করে তা ব্যবহারের উপযোগী করা হয়।

২০২৩ সালে ইন্দোনেশিয়ার সাংবাদিক বুধি নুরজিয়ান্তো ও সিঙ্গাপুরের সাংবাদিক নাবিলাহ সাঈদ তাদের যৌথ কাজের মাধ্যমে তুলে আনেন জমি উদ্ধারের প্রক্রিয়ায় কীভাবে “অস্বাভাবিক পরিমাণ বালু ব্যবহৃত হচ্ছে, যা ভয়াবহ পরিবেশগত ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে”— এবং একইসঙ্গে প্রক্রিয়াটি কীভাবে অবৈধ বালু বাণিজ্যে জড়িত আন্ত:সীমান্ত অপরাধচক্রকে সহযোগিতা করছে।

তাদের এই প্রতিবেদনটি ছিল বিনিথ দ্য স্যান্ডস নামক একটি বড় প্রকল্পের অংশ। যেটি ২০২৪ সালে সোসাইটি অব পাবলিশার্স ইন এশিয়ার পুরস্কার জিতে নেয়।

এশিয়াজুড়ে সাংবাদিকরা এখন জলবায়ু ও পরিবেশকে ধ্বংস করছে এমন আন্তসীমান্ত নির্ভর গল্পগুলোকে তুলে আনছেন— যা তাদের আরও গভীরে গিয়ে ঘটনা ও কারণ অনুসন্ধান এবং পরিবেশ ধ্বংসের নেপথ্যে থাকা শক্তিশালী স্বার্থগোষ্ঠীগুলোর সংযোগ খুঁজে পেতে সহায়তা করছে।

বিশাল ভূখণ্ড ও বিপুল জনসংখ্যার কারণে এশিয়া বিশ্বব্যাপী গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের বড় অংশের জন্য দায়ী। পাশাপাশি এখানেই এমন অনেক পণ্য—যেমন জীবাশ্ম জ্বালানি, পাম তেল, সয়াবিন—ব্যবহৃত হয়, যা জলবায়ু পরিবর্তন বা পরিবেশগত অপরাধের সঙ্গে সম্পর্কিত। তাছাড়া এসব বাণিজ্যের সঙ্গে বড় অঙ্কের আর্থিক লেনদেন জড়িত , যা এই অঞ্চলকে অবৈধ কার্যক্রম ও চোরাচালানের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছে।

পর্দার আড়ালের এই গল্পগুলো উন্মোচনের জন্য যেসব সাংবাদিক কাজ করছেন, তারা অত্যন্ত কঠিন পরিবেশের মধ্যে থেকে তা করছেন। অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের জন্য গণমাধ্যমের স্বাধীনতার অবনতি বড় সমস্যা। এশিয়ার বিভিন্ন দেশে পরিবেশ বিষয়ক সাংবাদিকতার ওপর সেন্সরশিপ চলছে। পরিস্থিতি এমন যে, রিপোর্টারস উইদাউট বর্ডারস এশিয়াকে পরিবেশ বিষয়ক সাংবাদিকদের  জন্য অন্যতম “ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা” হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।

অনেক সাংবাদিক আছেন, যারা পরিবেশ বিষয়ক অনুসন্ধানে কাজ করেছেন, গ্রেপ্তার হয়েছেন বা দীর্ঘ কারাদণ্ড ভোগ করেছেন। ভারতের সাংবাদিক শুভম মণি ত্রিপাঠি ২০২০ সালে অবৈধ বালু উত্তোলনচক্র নিয়ে অনুসন্ধান করার সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। মিয়ানমারের মতো জায়গায়, যেখানে দুষ্প্রাপ্য খনিজ আহরণের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে, সেখানে সংঘাতপূর্ণ এলাকায় কাজ করা সাংবাদিকরা প্রায়ই নিজেদের নাম প্রকাশ না করার সিদ্ধান্ত নেন, কারণ সেটি হতে পারে প্রাণঘাতী ঝুঁকি।

পরিবেশ বিষয়ক অনেক গুরুত্বপূর্ণ সঙ্কট ও ঘটনাগুলো দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে সংগঠিত হচ্ছে। পুরোটা তুলে আনার জন্য একাধিক দেশে অনুসন্ধান চালানোটা তাই জরুরি। কিন্তু ভাষা, ভৌগোলিক দূরত্ব, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার সীমাবদ্ধতা ও সম্পদের অভাব—এইসব কারণে সহযোগিতা করাটা কঠিন হয়ে পড়ে। তবুও স্থানীয়ভাবে পরিচালিত যৌথ অনুসন্ধানের মাধ্যমে অবৈধ বালু উত্তোলন, মাটির গুণগত মান, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বিষয়গুলোকে একত্রে যুক্ত করা গেছে, যা তথ্য বিনিময় ও বাস্তব প্রভাব তৈরিতে সহায়ক হয়েছে।

এই বৈচিত্র্যময় অঞ্চলে সাংবাদিকদের সংযুক্ত করতে ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে যৌথভাবে অনুসন্ধান চালাতে কীভাবে প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করা যায়, তা জানতে জিআইজেএন কথা বলেছে বিভিন্ন সংগঠন, সম্পাদক ও সাংবাদিকদের সঙ্গে।

এশিয়ার জন্য সহযোগিতামূলক মডেল

আর্থ জার্নালিজম নেটওয়ার্ক (ইজেএন)-এর বিশেষ প্রকল্প সম্পাদক স্যাম শ্রামস্কি বলেন, এশিয়াতে পরিবেশবিষয়ক আন্তসীমান্ত যৌথ প্রতিবেদনের বিশাল সম্ভাবনা থাকলেও, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেক চ্যালেঞ্জও।

তিনি ব্যাখ্যা করেন, “আন্তসীমান্ত সাংবাদিকতার বেশিরভাগ উদাহরণ ঐতিহ্যগতভাবে ইউরোপ বা যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসেছে, কিন্তু নানা কারণে এই মডেলগুলো এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে সবসময় প্রযোজ্য নয়।”

যেমন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের মধ্যেই দেখা যায় অর্থনৈতিক উন্নয়ন, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে ব্যাপক বৈষম্য বিদ্যমান। আরও গভীরে গেলে বোঝা যায়, একেকটি দেশেও থাকতে পারে ডজনখানেক ভাষা, ভিন্ন ধর্ম বা জাতিগত গোষ্ঠী— যেগুলো মাঠপর্যায়ের প্রতিবেদন বা তথ্যসংগ্রহের কাজকে জটিল করে তোলে।

ইজেএন তাদের দীর্ঘমেয়াদি মিডিয়া উন্নয়ন কাজের অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে এসব বাধা মোকাবিলা করার চেষ্টা করেছে। পাশাপাশি তারা দেশভিত্তিক সমন্বয়কারী ও বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে গড়ে ওঠা সম্পর্কের শক্ত নেটওয়ার্ক ব্যবহার করেছে।

শ্রামস্কি বলেন, “আমাদের অংশীদারদের অনেকেই এতদিন যৌথ প্রতিবেদনে অংশ নিতে পারেননি— তাই আমরা মনে করেছি, এই উদ্যোগটা নেওয়া দরকার। আমাদের লক্ষ্য ছিল বিদ্যমান নেটওয়ার্ককে আরও প্রসারিত করে একটি সহযোগিতামূলক ইকোসিস্টেম তৈরি করা।”

গত এক দশকে ইজেএন বেশ কয়েকটি যৌথ অনুসন্ধান প্রকল্প পরিচালনা করেছে। তাদের সর্বশেষ প্রকল্প গ্রাউন্ড ট্রুথস ২০২৫ সালের সোপা এক্সেলেন্স ইন রিপোর্টিং অন দ্য এনভায়রনমেন্ট পুরস্কারে সম্মানসূচক স্বীকৃতি পেয়েছে। এই প্রকল্পে এশিয়ার ১১টি সংবাদমাধ্যম একত্র হয়ে ভূমি অবক্ষয় নিয়ে অনুসন্ধান করেছে।

শ্রামস্কি বলেন, “অনেক সাংবাদিকের কাছ থেকেই আমরা শুনেছি— ভূমি অবক্ষয়ের বিষয়টি সংবাদমাধ্যমে একেবারেই উপেক্ষিত থেকে গেছে।”

EJN, Ground Truths reporting on soils project

আর্থ জার্নালিজম নেটওয়ার্ক (ইজেএন) এশিয়া জুড়ে ১১টি সংবাদমাধ্যমকে একত্র করেছিল মাটির উর্বরতা কমে যাওয়ার কারণ ও এর বিস্তৃত প্রভাব খুঁজে বের করতে। ছবি: স্ক্রিনশর্ট, ইজেএন

গোড়াতে যে বিষয়টি একেবারেই স্থানীয় মনে হয়েছিল, তা শেষ পর্যন্ত গোটা অঞ্চলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। এশিয়ার নানা দেশে অপরিকল্পিত ভূমি ব্যবস্থাপনা, দ্রুত নগরায়ন, অস্থিতিশীল কৃষি, বন উজাড়, মরুকরণ, খনন কার্যক্রম এবং জলবায়ু সংকট মিলে মাটির ক্ষয়কে আরও ভয়াবহ করেছে।

ভিয়েতনামের সাংবাদিক নুয়েন থু কুইন বললেন, তার কাছে বেশ আকর্ষণীয় লেগেছে সহযোগিতামূলকভাবে কাজ করার বিষয়টি । ইজেএনকে তিনি জানান, মাটির ক্ষয় ও দূষণ জনস্বাস্থ্যের ওপর কী প্রভাব ফেলছে, তা নিয়ে খুব কমই প্রতিবেদন হয়, যদিও এতে নানা বিষয় জড়িত—যেমন রাসায়নিক সার ও কীটনাশক, মাটি। তা ছাড়া ভূ-উপরিস্থ জলও ভূগর্ভস্থ পানিকে দূষিত করছে।

ইজেএন বিভিন্ন দেশের মধ্যে বৈজ্ঞানিক ডেটাসহ নানা তথ্য ভাগাভাগি করার সুযোগ করে দেয়, যাতে তুলনামূলক বিশ্লেষণের মাধ্যমে মূল সমস্যা চিহ্নিত করা যায়। তবে প্রতিটি সংবাদমাধ্যম তাদের নিজস্ব পাঠক উপযোগী করে গল্পের কাঠামো তৈরি করতে পারে।

ভিয়েতনামে নুয়েনের প্রতিবেদনটি মাঠপর্যায়ের অনুসন্ধান, বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ এবং তথ্য সংগ্রহের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়। এতে তিনি ঘনবসতিপূর্ণ মেকং নদী অববাহিকায় কৃষি উৎপাদনশীলতা হ্রাস এবং মাটির উর্বরতা কমে যাওয়া বিষয়টি তুলে ধরেন। অন্যদিকে, ভারতের শাগুন কাপিল তার ‘ডাউন টু আর্থ’–এর প্রতিবেদনে পাঞ্জাবের কৃষিভূমিতে মাটির উর্বরতা সঙ্কট এবং খাদ্য নিরাপত্তার ওপর এর প্রভাব অনুসন্ধান করেন।

কাপিল বলেন, “মাটি হলো মানুষ, প্রাণী, জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের মধ্যে একটি সাধারণ বন্ধন।” তিনি যোগ করেন, সাংবাদিকরা তাদের গল্পগুলো আরও শক্তিশালী করে উপস্থাপন করতে পারেন যদি তারা স্পষ্টভাবে দেখাতে পারেন মাটির স্বাস্থ্য এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত বৃহত্তর বিষয়গুলোর যোগসূত্র—যেমন মাটিতে জিঙ্ক ও আয়রনের মতো পুষ্টি উপাদানের প্রাপ্যতা এবং সেই অঞ্চলের মানুষের পুষ্টিগত অবস্থার মধ্যে সম্পর্ক।

কেন প্রথমে স্থানীয়ভাবে শুরু করাটাই গুরুত্বপূর্ণ

২০২০ সাল থেকে এশিয়াকেন্দ্রিক আন্তসীমান্ত সহযোগিতামূলক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে নেতৃত্ব দিয়ে আসছে ইনভায়রনমেন্টাল রিপোর্টিং কালেকটিভ (ইআরসি)। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ইয়ান ই বলেন, তারা এমন একটি অনন্য মডেল তৈরি করেছেন, যা এই জটিল ও চ্যালেঞ্জপূর্ণ অঞ্চলে কাজের বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

“আমরা প্রতিটি দেশের সেই সাংবাদিকদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করি, যারা এসব বিষয়ে আগ্রহী,” ইয়ান ই ব্যাখ্যা করেন। তিনি যোগ করেন, “তাদের সহায়তা করি, প্রয়োজনীয় উপকরণ ও তহবিল দেই যেন তারা নিজেদের গল্প নিয়ে কাজ করতে পারেন—তারপর আমরা একসঙ্গে এমন কিছু তৈরি করি, যা আরও বড় পরিসরে প্রভাব ফেলে। আমরা চেষ্টা করছি এমন একটি সংস্কৃতি গড়ে তুলতে, যেখানে সহযোগিতা বিকশিত হতে পারে। আমরা সব সময় হয়তো ঠিকভাবে করতে পারিনি, কিন্তু আমরা বিশ্বাস করি আমরা সঠিক পথে আছি।”

ইআরসি মূলত এশিয়াভিত্তিক—এর আনুষ্ঠানিক অফিস ইন্দোনেশিয়ায় হলেও, দলের মূল সদস্যরা পুরো মহাদেশজুড়ে ছড়িয়ে আছেন। এটি বৈশ্বিক অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার অন্যান্য সংগঠনের তুলনায় একেবারে ভিন্ন। কারণ অধিকাংশ আন্তর্জাতিক সংস্থা সাধারণত উত্তর আমেরিকা বা ইউরোপভিত্তিক।

Asia Focus, Beneath the Sands, Environmental Reporting Collective

পুরস্কারপ্রাপ্ত আন্তসীমান্ত অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ‘বিনিথ দ্য স্যান্ডস’ স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ওপর বালু উত্তলনের ব্যাপক পরিবেশগত প্রভাব এবং এর ভয়াবহ মানবিক মূল্য তুলে ধরেছে। ছবি: স্ক্রিনশর্ট, ইআরসি

এই দলটি প্রতি বছর একটি করে আন্তসীমান্ত যৌথ প্রকল্প নিয়ে কাজ করে। বিষয়বস্তু সাধারণত নেটওয়ার্কের বৈশ্বিক সভায় আলোচিত বিষয়কে কেন্দ্র করে ঠিক করা হয়। এখন পর্যন্ত বিনিথ দ্য স্যান্ডস-এর পাশাপাশি তারা আরও তিনটি পুরস্কারজয়ী অনুসন্ধান প্রকাশ করেছে । যেমন, প্যাঙ্গোলিন রিপোর্টস, যেখানে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া হয়ে চীন ও হংকং পর্যন্ত প্যাঙ্গোলিন বাণিজ্যের নেটওয়ার্ক উন্মোচন করা হয়; ওশানস ইনক., যা দক্ষিণ চীন সাগরে অতিমাত্রায় মাছ ধরার প্রভাব অনুসন্ধান করেছে; এবং গ্রীড অব গ্রীন, যেখানে পরিচ্ছন্ন প্রযুক্তির জন্য গুরুত্বপূর্ণ খনিজ আহরণের উত্থান থেকে উদ্ভূত পরিবেশগত ও সামাজিক প্রভাব অনুসন্ধান করা হয়।

“আমরা চাই গল্পগুলো ওই অঞ্চলের নিজস্ব সংবাদমাধ্যমেই প্রকাশিত হোক। সেটাই যথেষ্ট ভালো,” বলেন ইয়ান ই।

২০২৩ সালে প্রকাশিত বিনিথ দ্য স্যান্ডস ভিয়েতনাম, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ফিলিপাইন ও ভারতের বালু উত্তোলন সম্পর্কিত অপরাধ তুলে ধরে। প্রতিবেদনটি এশিয়ার ছয়টি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। এটি দেখিয়েছে, কীভাবে সৈকত বা নদী থেকে বালু তোলার মতো স্থানীয় সমস্যা আসলে দেশের সীমানা পেরিয়ে এশিয়ার বড় শহরগুলোর মেগা নির্মাণ প্রকল্পের অপরিহার্য উপাদানে পরিণত হয়েছে।

চীনের ভূমিকাকে তুলে ধরা

এশিয়ার বড় একটি চ্যালেঞ্জ হলো—চীন নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি। বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বাধিক জনবহুল দেশটি এশিয়ার সবচেয়ে বড় অর্থনীতি, বাণিজ্যিক অংশীদার এবং বিনিয়োগকারী হলেও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে এটি বিশ্বের তৃতীয় সর্বনিম্ন অবস্থানে রয়েছে। এখানে কোনো প্রকৃত স্বাধীন গণমাধ্যম নেই। তাই অনেক ক্ষেত্রেই যৌথ অনুসন্ধানী প্রকল্প ঘিরে চীনের বাইরের সাংবাদিকদের ওপর নির্ভর করতে হয়। কারণ এতে করে দেশটির অভ্যন্তরে অবস্থানকারী সাংবাদিকরা বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে পড়েন। বিদেশি সাংবাদিকদেরও মাঠপর্যায়ে কাজ করার সুযোগ খুব সীমিত।

বিশেষ করে, উইঘুরদের আবাসভূমি শিনজিয়াং—যা সৌরশক্তি উৎপাদন উপাদানের একটি প্রধান কেন্দ্র এবং তিব্বত—যেখান থেকে চীন বিপুল পরিমাণ লিথিয়াম আহরণ করে ও বড় বড় খনন প্রকল্প পরিচালনা করে। এই অঞ্চলগুলো নিয়ে প্রতিবেদন করা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে। বিদেশি বা স্বাধীন চীনা সাংবাদিকদের জন্য এই অঞ্চলগুলো কার্যত অপ্রবেশযোগ্য। আর স্থানীয়দের ক্ষেত্রেও সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলা বা তথ্য ভাগ করে নেওয়ার মতো কাজের জন্য প্রতিশোধের ঝুঁকি থেকে যায়।

ইআরসি ও ইজেএনের নেতৃত্বে পরিচালিত অনেক যৌথ প্রকল্পই তাদের চীনা ভাষার অংশীদার দি ইনিশিয়াম–এর সঙ্গে হচ্ছে। বর্তমানে সিঙ্গাপুরভিত্তিক এই সংবাদমাধ্যমটি ২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সারা বিশ্বের চাইনিজ ভাষাভাষী পাঠকদের জন্য দীর্ঘ ও অনুসন্ধানধর্মী প্রতিবেদন প্রকাশে মনোযোগ দেয়।

“যেহেতু আমাদের মূলভূখণ্ড চীন, হংকং এবং তাইওয়ানের সঙ্গে গভীর শিকড় গাঁথা তাই অনেক সময় দেখা যায় কোনো প্রকল্পে যদি চীনা দৃষ্টিকোণ থেকে কোনো বিষয় অন্তর্ভুক্ত করার কথা ভাবা হয়, তবে তারা সাধারণত দি ইনিশিয়াম-এর কথাই ভাবে,” বলেন দি ইনিশিয়াম-এর দীর্ঘদিনের সম্পাদক ও বর্তমান প্রকাশক লুলু নিং হুই।

তিনি উল্লেখ করেন, “আমরা যদি এমন কোনো বিষয় খুঁজে পাই যা আমাদের মতে গুরুত্বপূর্ণ এবং আমাদের পাঠকদের আগ্রহের, তখন আমরা তাতে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেই।”

দি ইনিশিয়াম চীনে কাজ করার জটিলতাগুলো কিছুটা দক্ষতার সঙ্গে সামাল দিতে পারে এবং তাদের ফ্রিল্যান্সারদের একটি নেটওয়ার্ক রয়েছে, যারা বিভিন্ন যৌথ প্রকল্পে অংশ নিয়েছেন। জলবায়ু ও পরিবেশ সংক্রান্ত প্রতিবেদন তাদের অন্যতম প্রধান আগ্রহের বস্তু, যা প্রায়ই অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে মিশে যায়।

“জলবায়ু পরিবর্তন আমাদের অন্যতম মূল প্রতিবেদনের ক্ষেত্র, কারণ এটি আমাদের অন্যান্য কাভারেজ—যেমন লিঙ্গ, প্রযুক্তি, অভিবাসন, রাজনীতি বা সমাজের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত,” হুই আরও যোগ করেন।

চীনের ডুবে যাওয়া শহর ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ঝুঁকি নিয়ে সম্প্রতি দি ইনিশিয়ামে প্রকাশিত ডেটাভিত্তিক একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন চলতি বছর সোপা অ্যাওয়ার্ড জিতেছে। এই ধরনের প্রতিবেদনের কথা হুই সবচেয়ে গর্বের সঙ্গে উল্লেখ করেন।

Asia Focus, Initium Media sinking Chinese cities

সিঙ্গাপুরভিত্তিক চীনা সংবাদমাধ্যম দি ইনিশিয়াম সম্প্রতি চীনের ডুবে যাওয়া শহর ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ঝুঁকি নিয়ে তাদের প্রতিবেদনের জন্য সোপা অ্যাওয়ার্ড জিতেছে। ছবি: স্ক্রিনশট, ইনিশিয়াম মিডিয়া

“আমার মনে হয়, এটি এমন একটি বিরল উদাহরণ যেখানে জটিল একটি বিষয়কে আমরা এমনভাবে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছি যেন তা আমাদের পাঠকদের কাছে সহজবোধ্য হয়ে ওঠে,” বলেন হুই।

তবে সীমিত সম্পদ ও ছোট পরিসরের সংবাদমাধ্যমে হিসেবে দ্য ইনিশিয়াম চীনের অভ্যন্তরে এবং বিশ্বজুড়ে তাদের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে।

হুই  বলেন যে, “আমি বুঝতে পারি চীনের রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতায় আমাদের কাজ ও বোঝাপড়া হয়তো খুবই সীমিত। আমি সত্যিই চাই, চীনা সাংবাদিকদের সঙ্গে বিশ্বের অন্য সাংবাদিকদের আরও বেশি সহযোগিতার সুযোগ তৈরি হোক—আমরা সেই প্রচেষ্টাই চালিয়ে যাচ্ছি।”


Nithin Coca

নিতিন কোকা একজন ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক, যিনি মূলত এশিয়া নিয়ে গভীরতর প্রতিবেদন ও অনুসন্ধানধর্মী লেখা প্রকাশ করেন। তিনি সাধারণত  আন্তঃসম্পর্কিত বিষয় নিয়ে কাজ করেন—যেমন জলবায়ু পরিবর্তন ও মানবাধিকার, কিংবা সরবরাহ শৃঙ্খল ও পরিবেশ ধ্বংসের পারস্পরিক সম্পর্ক। তিনি সলিউশনস জার্নালিজম নেটওয়ার্ক, পুলিৎজার সেন্টার এবং জার্নালিজম ফান্ড ইইউ–এর ফেলোশিপ প্রাপ্ত। তার লেখা ভক্স, দ্য ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস, ফরেন পলিসি, আল জাজিরা, দ্য নেশন এবং কোডা স্টোরিতে প্রকাশ হয়েছে।

 

অলংকরণ: ন্যুক ২০০০ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বর্তমানে সিওলের হানইয়াং বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাপ্লাইড আর্ট এডুকেশন বিভাগের ছাত্র এবং একই সঙ্গে ইলাস্ট্রেটর হিসেবে কাজ করছেন। ২০২১ সালে হিডেন প্লেস এ প্রদর্শনীর পর থেকে তিনি বিভিন্ন ইলাস্ট্রেশন প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেছেন। তার প্রধান আগ্রহ হলো হ্যান্ড ড্রইং, যা শিল্প জগত নিয়ে তার চিন্তাকে তুলে ধরে।

ক্রিয়েটিভ কমন্স লাইসেন্সের অধীনে আমাদের লেখা বিনামূল্যে অনলাইন বা প্রিন্টে প্রকাশযোগ্য

লেখাটি পুনঃপ্রকাশ করুন


Material from GIJN’s website is generally available for republication under a Creative Commons Attribution-NonCommercial 4.0 International license. Images usually are published under a different license, so we advise you to use alternatives or contact us regarding permission. Here are our full terms for republication. You must credit the author, link to the original story, and name GIJN as the first publisher. For any queries or to send us a courtesy republication note, write to hello@gijn.org.

পরবর্তী

এশিয়া ফোকাস

‘প্রভাব অনেক সময় অদৃশ্য থাকে’: নেপালি সাংবাদিক কুন্দা দীক্ষিতের পেশাগত উত্থান-পতনের গল্প

সবচেয়ে বড় হুমকি আসে প্রতিশোধপরায়ণ রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে, যারা সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ তোলে, মানহানির মামলা করে, কিংবা আর্থিক অনিয়মের অভিযোগে জেলে পাঠায়। জেলার রিপোর্টাররা বেশি ঝুঁকিতে থাকে, কারণ তারা ঘটনাস্থলের কাছাকাছি থাকে। প্রাকৃতিক সম্পদ লুটের সঙ্গে যুক্ত স্থানীয় অপরাধীরাই অনেক সময় সাংবাদিক হত্যা পর্যন্ত করে থাকে।

এশিয়া ফোকাস

এশিয়ায় অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা: চ্যালেঞ্জের মধ্যেও প্রতিরোধ, রূপান্তর, সংহতি

রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্সের ২০২৫ সালের বিশ্ব গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচক অনুযায়ী, এশিয়ার অধিকাংশ দেশেই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা “অত্যন্ত সংকটপূর্ণ” অবস্থায় রয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ দশটি দেশের মধ্যে সাতটিই এখন এশিয়ায়: রাশিয়া, ভিয়েতনাম, তুর্কমেনিস্তান, আফগানিস্তান, ইরান, সিরিয়া, চীন এবং উত্তর কোরিয়া।

এশিয়া ফোকাস

রাষ্ট্র-ঘনিষ্ঠ ওলিগার্ক এবং সরকারি অর্থ আত্মসাৎ: এশিয়ায় অবৈধ অর্থপ্রবাহ অনুসন্ধান

সীমান্ত অতিক্রম করে নিয়মিতভাবেই অবৈধভাবে অর্থপাচার করা হচ্ছে, আর এর উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়ছে এশিয়াতেও। এই অঞ্চলের অনুসন্ধানী সাংবাদিকরা এমন সব প্রতিবেদন উন্মোচন করেছেন যেখানে অর্থনৈতিক অনিয়মের বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়েছে। লুটেরা স্বৈরশাসক, নতুন জুয়া কেন্দ্র, এবং চুরি করা অর্থ গোপন রাখার বিশাল নেটওয়ার্কের কর্মকাণ্ডকে সাংবাদিকরা সামনে এনেছেন।