সম্পাদকের বাছাই: রুশ ও ইউক্রেনিয় ভাষায় ২০১৯ সালের সেরা অনুসন্ধান
বিশ্বের রুশ ভাষাভাষী অঞ্চলটি কৃষ্ণসাগর থেকে কাস্পিয়ান পর্যন্ত বিস্তৃত। পূর্ব ইউরোপ, মধ্য এশিয়া ও ককেশাসের এই দেশগুলো থেকে সেরা অনুসন্ধান নির্বাচন করার কাজটি সহজ নয়। তাই জিআইজেএনের রুশ-ভাষা সম্পাদক ওলগা সিমানোভিচ ব্যক্তিগত পছন্দ ভুলে গিয়ে নজর দিয়েছেন সেসব প্রতিবেদনের দিকে, যেখানে নতুন কিছু করার চেষ্টা ছিল; ছিল নতুন টুলের ব্যবহার; অথবা আলোকপাত করা হয়েছে এমন নতুন কোনো বিষয়ে যা আগে দেখা যায়নি।
পড়ুন বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চল থেকে ২০১৯ সালের সম্পাদকের বাছাই
তার বাছাই করা প্রতিবেদনের একেকটিতে ছিল একেকরকমের কৌশলের ব্যবহার। কোনো রিপোর্টের বিশেষত্ব ছিল আন্তসীমান্ত সহযোগিতা ও সাংবাদিকদের জোট বাঁধায়; কোথাও দেখা গেছে ওপেন ডেটা, রেজিস্ট্রি ও উন্মুক্ত তথ্যের ব্যবহার; কেউ রিপোর্ট করেছেন হুইসেলব্লোয়ারের ফাঁস করা তথ্য দিয়ে; কোথাও ব্যবহার হয়েছে বিমান সনাক্তকরণ টুল, কেউ নিয়েছেন ছদ্মবেশ, আর কেউ কাজ করেছেন জেন্ডার ও পরিবেশের মত বৈশ্বিক ইস্যুু নিয়ে।
প্রতিবেদন বাছাইয়ের আরেকটি মানদণ্ড ছিল ভাষা। এদের মধ্যে একাধিক রিপোর্ট রুশ বা ইউক্রেনিয় ভাষার পাশাপাশি ইংরেজিতেও প্রকাশ হয়েছে। কয়েকটিতে টেক্সটের সাথে সাথে ছিল ভিডিওর ব্যবহার।
সংঘাতময় অঞ্চলে ক্রেমলিনের বাবুর্চির বিমানভ্রমণ — নোভায়া গেজেটা এবং ওসিসিআরপি
ছবি: ম্যাক্সিম কারদোপোলস্তেভ। স্ক্রিনশট: নোভায়া গেজেটা
রুশ ব্যবসায়ী ইয়েভগেনি প্রিগোঝিন পরিচিত ক্রেমলিনের বাবুর্চি নামে। কারণ, তার প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধানে বিদেশী অতিথিদের সাথে ক্রেমলিন কর্তাদের নৈশভোজ অনুষ্ঠিত হতো। সেই ব্যবসায়ীর একটি বেসরকারি বাহিনী আছে, যার সদস্যরা ইউক্রেন, সিরিয়া ও আফ্রিকায় ভাড়ায় যুদ্ধরত।
নোভায়া গেজেটার ডেটা টিমকে সঙ্গে নিয়ে রিপোর্টার ইরিনা ডোলিনিনা ও আলেসয়া মারোকোভস্কায়া ২৬ মাস ধরে অনুসরণ করেছেন প্রিগোঝিনের বিভিন্ন বিমানভ্রমণ। লিপিবদ্ধ করেছেন তিনি এই সময়ে কতবার সিরিয়া, মধ্যপ্রাচ্য বা আফ্রিকা সফর করছেন। আরো গভীরে গিয়ে জানার চেষ্টা করেছেন, এসব সফরের কারণ।
উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক সফরের কথা। তার মালিকানাধীন কোম্পানিগুলো সেখানকার স্বর্ণ ও হীরক খনিতে বিনিয়োগ করেছিল। সফরের কারণ খুঁজতে গিয়ে সাংবাদিকরা একটি চুক্তিপত্র খুঁজে পান। তাতে বলা আছে, রাশিয়ানরা চাইলে দেশটির সরকারী কর্মকর্তাদের নগদ টাকা দিতে পারবে। আর এই নগদ লেনদেন “শুধুমাত্র কোনো ব্যক্তিমালিকানার বিমানেই করা যাবে।” বলা বাহুল্য, প্রিগোঝিনের সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলো সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক, সুদান ও লিবিয়া থেকে স্বর্ণ, হীরা ও অন্যান্য খনিজ উত্তোলনের অনুমতি পেয়েছিল। আর এসবই হয়েছে রাশিয়ার জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায়।
আর্মি! বন্ধু! টাকা! — বিহুস ডট ইনফো (ইউক্রেন)
স্ক্রিনশট: বিহুস ডট ইনফো
ইউক্রেন সরকারের মালিকানাধীন সামরিক সরঞ্জাম নির্মাণ কারখানা থেকে দুর্নীতির মাধ্যমে এক কোটি ডলার হাতিয়ে নেওয়ার এই ঘটনা উন্মোচন করেন সাংবাদিক লেসা ইভানোভা। সরকারী নথি, আন্তর্জাতিক ডেটাবেজ ও ফাঁস হওয়া কিছু বার্তা বিশ্লেষণ করে তিনি প্রমাণ করেন, কিভাবে কারখানাটিতে নিম্নমানের স্পেয়ারপার্টস তিন থেকে চারগুণ দামে বিক্রি করেছেন তিন তরুণ। এসব পার্টসের কিছু চোরাচালানের মাধ্যমে আনা হয় রাশিয়া থেকে, আর কিছু চুরি করা হয় ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর গুদাম থেকে। তারা পণ্যগুলি বিক্রি করেন সরকারী কর্মকর্তাদের ঘুষ দিয়ে। ইউক্রেনের মতো দেশের জন্য বিষয়টি ছিল বেশ পীড়াদায়ক। কারণ এখানে সাধারণ মানুষ, শিক্ষার্থী, এমনকি অবসরে যাওয়া ব্যক্তিরাও সেনাবাহিনীকে অর্থসাহায্য দেয়, যেন তারা রাশিয়ার কাছ থেকে পূর্ব ইউক্রেনকে রক্ষা করতে পারে।
এই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত তিনজনের একজন ছিলেন ইউক্রেনের ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যান্ড ডিফেন্স কাউন্সিলের প্রথম ডেপুটি সেক্রেটারির (যিনি ইউক্রেনের সাবেক প্রেসিডেন্ট পেত্রো পোরোশেঙ্কোর বন্ধু ও ব্যবসায়িক পার্টনার) বড় ছেলে। সাংবাদিকরা ছেলের দুর্নীতির সঙ্গে পিতার জড়িত থাকার প্রমাণও পেয়েছেন। অনুসন্ধানে উঠে আসে – আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, জেনারেল প্রসিকিউটরের কার্যালয়, সিকিউরিটি সার্ভিস, ন্যশনাল অ্যান্টি-করাপশন ব্যুরো – সবাই এই দুর্নীতির বিষয়ে অবগত ছিল, কিন্তু কিছুই করেনি।
দ্য ত্রয়কা লন্ড্রোম্যাট — ওসিসিআরপি, ফিফটিন মিনিট, এবং সহযোগী আন্তর্জাতিক দল
স্ক্রিনশট: ওসিসিআরপি
ওসিসিআরপি ও তার সদস্যরা আন্তর্জাতিক অর্থ-পাচারের নতুন নতুন পদ্ধতি উন্মোচনের জন্য বিখ্যাত। তাদের এসব অনুসন্ধানের নেপথ্যে আছে, ব্যাংকিংখাত থেকে ফাঁস হওয়া বিপুল তথ্য ও নথিপত্র। ত্রয়কা লন্ড্রোম্যাট ব্যাংকিং ইতিহাসের সবচেয়ে বড় তথ্যফাঁসের এমনই এক ঘটনা। এখানে ৪৭০ বিলিয়ন ডলার সমমানের ১৩ লাখ লেনদেনের তথ্য ছিল। “ত্রয়কা ডায়ালগ” নামে রাশিয়ার একটি বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে মুদ্রাপাচারের এই প্রক্রিয়া চলতো। সেখান থেকেই ঘটনাটি লন্ড্রোম্যাট ত্রয়কা নামে পরিচিতি পায়। এই পদ্ধতি ব্যবহার করে রাশিয়া থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার করেছেন বড় বড় ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদরা। বেনামে শেয়ার কিনেছেন রাষ্ট্রীয়-মালিকানাধীন বিভিন্ন কোম্পানির। জমিজমা কিনেছেন রাশিয়া ও রাশিয়ার বাইরে, কিনেছেন বিলাসবহুল জাহাজ, ব্যক্তিগত পার্টিতে কনসার্ট আয়োজনের জন্য অর্থ ঢেলেছেন সুপারস্টারদের পেছনে।
সাংবাদিকরা বের করেছেন, ভ্লাদিমির পুতিনের পুরোনো বন্ধু, চেলোবাদক সের্গেই রোলডুগিনের সঙ্গে সম্পর্ক আছে অন্তত ৭৫টি বিদেশী প্রতিষ্ঠানের। এই অনুসন্ধানের একটি অধ্যায় ছিল আইনজীবী এরিক রেবাসোকে ঘিরে। তিনি মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার পাচারে সহায়তা করার কথা, অস্ট্রিয়ান কর্তৃপক্ষের কাছে স্বীকার করেন। পরবর্তীতে তিনি রহস্যজনকভাবে মারা যান।
রাশিয়ায় ডেটা চুরি: তথ্য বিক্রির অন্ধকার জগত — বিবিসি (রাশিয়া)
স্ক্রিনশট: বিবিসি
রাশিয়ায় ব্যক্তিগত তথ্য কেনাবেচার কালোবাজার নিয়ে কাজ করেছেন সাংবাদিক আন্দ্রে জাখারভ। তার অনুসন্ধানে দেখানো হয়, অল্প টাকা খরচ করেই আপনি কিভাবে পাসপোর্ট, টেলিফোন কলের বিস্তারিত, মোবাইল ব্যবহারকারীর অবস্থান, এমনকি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের ব্যালান্স বা ক্রেডিট কার্ডের কোডের মত স্পর্শকাতর তথ্য কিনতে পারবেন। জাখারোভ কয়েক ঘন্টার মধ্যে দুই জন মোবাইল নম্বর ব্যবহারকারীর তথ্য কিনতে পেরেছিলেন ১০ হাজার রুবল (প্রায় ১৫০ ডলার) খরচ করে। একই সঙ্গে ছবি ও অন্যান্য আবেদনপত্রসহ রাশিয়ান পাসপোর্ট কিনেছেন ২০০০ রুবল (৩৫ ডলার) দিয়ে।
আদালতের বিভিন্ন রায় পর্যালোচনা করে সমস্যাটির বিস্তৃতি সম্পর্কে ধারণা পেয়েছেন জাখারোভ। সরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মী, মোবাইল অপারেটর ও ব্যাংকের কর্মচারীরা বিভিন্ন অবৈধ ফোরামের দালালদের হাতে এসব তথ্য তুলে দিতেন। পরে, এসব ফোরাম থেকে রাশিয়াজুড়ে বিক্রি করা হতো নাগরিকদের তথ্য।
ট্রান্সনিস্ট্রিয়ায় বর্জ্য-লোহা বিক্রি — রাইজ মলদোভা এবং স্কিমস (ইউক্রেন)
মালদোভার সাবেক প্রধানমন্ত্রী পাভেল ফিলিপ ও ইউক্রেনের সাবেক প্রেসিডেন্ট পেত্রো পোরোশেঙ্কো। স্ক্রিনশট: রাইজ মলদোভা
এই অনুসন্ধানে উঠে এসেছে কিভাবে ইউক্রেন থেকে অবৈধভাবে স্ক্র্যাপ মেটাল রপ্তানি করা হচ্ছে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি না পাওয়া দেশ ট্রান্সনিস্ট্রিয়াতে, যেটি আগে মলদোভার অংশ ছিল। ইউক্রেনের সাংবাদিক ভ্যালেরিয়া ইগোশিনা ও মলদোভার সাংবাদিক ভ্লাদিমির থোরিক উন্মোচন করেছেন, এই গোপন চুক্তির সাথে দুই দেশের শীর্ষপর্যায়ের ব্যক্তিরা জড়িত।
তারা কিছু নথিপত্র খুঁজে পান। তাতে দেখা যায়, ট্রান্সনিস্ট্রিয়ায় অবস্থিত মলদোভিয়ান মেটালারজিক্যাল প্ল্যান্ট (এমএমপি)-এর ওপর থেকে গোপনে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছিলেন ইউক্রেনের তৎকালিন প্রেসিডেন্ট পোরোশেঙ্কো। তিনি এটি করেছিলেন মলদোভার প্রধানমন্ত্রী পাভেল ফিলিপের অনুরোধে। এমএমপি, মলদোভার বিচারব্যবস্থার অধীনেই ছিল। কিন্তু এখন তা চলে গেছে ট্রান্সনিস্ট্রিয়ান রিপাবলিক সরকারের নিয়ন্ত্রণে। ট্রান্সনিস্ট্রিয়ার অন্যান্য অনেক স্থানীয় কোম্পানির মতো, এমএমপিও মলদোভাকে কোনো কর বা আমদানি-রপ্তানি শুল্ক দেয় না। ইউক্রেনের এই নিষেধাজ্ঞা বাতিলের বিষয়টি মলদোভা, ইউক্রেন; দুই দেশেরই রাষ্ট্রীয় স্বার্থের পরিপন্থী।
বিয়ের পোশাকে ফিকে হয় জীবনের স্বপ্ন — ওপেন ককেশাস মিডিয়া
সানুবার ও তার মেয়ে। ছবি: গুলনুর কাজিমোভা। স্ক্রিনশট: ওসি মিডিয়া
আজারবাইজানের সাংবাদিক গুলনুর কাজিমোভার রিপোর্টে উঠে এসেছে ককেশাস অঞ্চলের দেশগুলোতে বাল্যবিবাহ ও ঘরোয়া সহিংসতার ব্যাপকতা। জর্জিয়ায় আজারবাইজানি কমিউনিটির নারীদের যন্ত্রণার কাহিনী বলেছেন এই সাংবাদিক। ১৩ থেকে ১৬ বছর বয়সী কন্যাশিশুদের জোর করে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে আনা হয় এবং বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয় এমন মানুষদের সঙ্গে, যাদের তারা ভালোবাসে না। কেউ কেউ মারধরের শিকার হয় এবং জোরপূর্বক যৌনসম্পর্ক বা গৃহস্থালী কাজ করতে বাধ্য হয়। কমবয়সী এই মেয়েরা পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগের মরিয়া চেষ্টা করলেও কোনো লাভ হয় না। পুলিশ এই বাল্যবিবাহ ও সহিংসতাকে ঘরোয়া বিষয় বলে বিবেচনা করে এবং কোনো ফৌজদারি মামলা নিতে রাজি হয় না।
জর্জিয়াতে বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে আইনকানুন কঠোর করা হলেও, জাতিগত সংখ্যালঘু নারীদের এক তৃতীয়াংশেরই বিয়ে হয়ে যায়, বয়স ১৮ বছর হওয়ার আগেই।
ককেশাসের সোনার খনি: কর্পোরেট মুনাফার চড়া মূল্য — হেটকিউ (আর্মেনিয়া)
স্ক্রিনশট: হেটকিউ
সাংবাদিক ক্রিস্টিন আগালারিয়ান অনুসন্ধান করে বের করেছেন, জর্জিয়া ও আর্মেনিয়ার সবচেয়ে লাভজনক স্বর্ণখনিগুলো বিদেশীদের নিয়ন্ত্রণে। আর তার পেছনে আছে চীন ও রাশিয়ার সরকারী প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিরা। হেটকিউ-এর তথ্য অনুসারে, এই খননের সঙ্গে জড়িয়ে আছে লাখ লাখ ডলারের কারবার। যেমন, আর্মেনিয়ার সোত্ক অঞ্চলে খনিজ উত্তোলন করে বছরে প্রায় আট কোটি ডলার উপার্জন করেছে জিওপ্রোমাইনিং গোল্ড এলএলসি, যার মূল মালিকরা থাকেন রাশিয়ায়। এই অর্থ আর্মেনিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর, গুমরির বাৎসরিক বাজেটের চেয়ে ১০ গুন বেশি।
সাংবাদিকরা আরো বের করেন, কিভাবে সেখানকার শ্রমিকরা কাজ করেন নিরাপত্তা ঝুঁকি মাথায় নিয়ে, কিভাবে তারা বঞ্চিত হচ্ছেন অসুস্থতাজনিত ছুটির জন্য বেতনসহ বিভিন্ন ন্যায্য অধিকার থেকে। একই সঙ্গে তারা দেখিয়েছেন, সোত্কসহ খনিজসমৃদ্ধ অঞ্চলগুলোতে বায়ু ও পানিদূষণের চিত্র, বিষাক্ত আবর্জনা ফেলা এবং এমন আরো কিছু পরিবেশ সংকট।
মস্কোর গোরস্তানের মালিক কারা — মেডুজা ও রাশিয়ার নয়টি গণমাধ্যম
ছবি: দিমিত্রি সেরেব্রায়কোভ / শাটারস্টক। স্ক্রিনশট: মেডুজা
মস্কোয় যত সমাধিস্থল আছে, তাদের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিবাদ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার চিত্র উঠে এসেছে এই অনুসন্ধানে। এই দ্বন্দ্বের শুরু বিতর্ক থেকে। তারপর গোলাগুলি। আর শেষ হয় নতুন সুবিধাভোগীদের আবির্ভাব দিয়ে। এই নতুন সুবিধাভোগী ছিলেন রাশিয়া সরকারের কেন্দ্রীয় সিকিউরিটি সার্ভিসের সাথে ঘনিষ্ট ব্যবসায়ীরা।
এই অনুসন্ধানের সময় দেখা গেছে রাশিয়ান সাংবাদিকদের অভূতপূর্ব সংহতি। প্রতিবেদনটি নিয়ে কাজ করার সময়, মাদক বিক্রির ভুয়া অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয় সাংবাদিক ইভান গোলুনোভকে। এরপর তাঁর সাথে সংহতি জানিয়ে অনুসন্ধানে যোগ দেন রাশিয়ার শীর্ষ গণমাধ্যমগুলোর (ফোর্বস, দ্য বেল, ভেডোমোস্তি, নোভায়া গেজেট,আরবিসি, বিবিসি রাশিয়ান, ফোনটাঙ্কা, ওসিসিআরপি) সাংবাদিকরা। একই সময়ে পুরো রাশিয়াজুড়ে প্রতিবাদ শুরু হয়, গোলুনোভের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রত্যাহারের দাবি নিয়ে। পাঁচ দিন পর, পর্যাপ্ত প্রমাণের অভাবে সব অভিযোগ প্রত্যাহার করে দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এদিকে, সাংবাদিকরা জোটবদ্ধভাবে অনুসন্ধান চালিয়ে যেতে থাকেন। অন্তত ৩০টি রাশিয়ান গণমাধ্যম এই বিষয়ে আলাদা আলাদাভাবে প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
ইউক্রেনের ট্রল কারখানার অভ্যন্তরে — স্লিস্তভো এবং রোমাদ্স্কে (ইউক্রেন)
স্ক্রিনশট: স্লিস্তভো
এই অনুসন্ধানী তথ্যচিত্রে কাজ করতে গিয়ে, স্লিস্তভো ডট ইনফো-র সাংবাদিক ভাসিল বিদুন ছদ্মবেশে চাকরি নিয়েছিলেন কিয়েভের একটি বট ফার্মে। এটি এমন এক ধরনের “এজেন্সি”, যারা গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী সামাজিক গণমাধ্যমে প্রশংসা বা বিদ্বেষপূর্ণ কমেন্ট লেখে। ভাসিলের দায়িত্ব ছিল বিভিন্ন ভুয়া ফেসবুক প্রোফাইল ব্যবহার করে প্রতিদিন ২০০-৩০০টি কমেন্ট লেখা। তিনি এগুলো লিখতেন সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়া ইউক্রেনের বিভিন্ন রাজনীতিবিদের সমর্থনে অথবা বিপক্ষে। দুই সপ্তাহের মধ্যে, এই দল ২৪ হাজার পোস্ট করেছিল আনাতোলি গ্রিটশেঙ্কোর সমর্থনে। আর তার পরের সপ্তাহে ৬ হাজার পোস্ট করেছিল সিয়াতোস্লাভ ভাকারচুক ও তার রাজনৈতিক দল “দ্য ভয়েস”-এর সমর্থনে।
স্লিস্তভোর সাংবাদিকরা বের করতে পেরেছিলেন, এই ধরণের কাজের জন্য প্রতি বছর ব্যয় করা হয় লাখ লাখ ডলার। এখানকার কর্মীরা কাজ করেন গোপনে আর বেতন পান নগদে। ভাসিল এই কাজ করে যে ৯ হাজার রিভনা (প্রায় ৩৮০ ডলার) উপার্জন করেছিলেন, তা দিয়ে দিয়েছেন দাতব্য প্রতিষ্ঠানে। তথ্যচিত্রটি প্রকাশিত হওয়ার দুদিন আগে এই প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ড প্রকাশ পায়, এবং ফেসবুক সেটিকে ব্লক করে। (তথ্যচিত্রটি ইংরেজিতে দেখা যাবে এখানে।)
সরকারি জমি, বেসরকারি মালিক — ক্লুপ (কিরগিজস্তান) এবং ওসিসিআরপি
স্ক্রিনশট: ওসিসিআরপি
কিরগিজস্তানের রাজধানী বিশকেকের বাসিন্দাদের অবসর কাটানোর প্রিয় জায়গা ছিল আতার্তুক পার্ক। এটি ছিল আইন দিয়ে সংরক্ষিত। কিন্তু ২০০০ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে, এই পার্কের একটি বড় অংশ গোপনে ধনী ব্যক্তিদের হাতে তুলে দেয় স্থানীয় কর্তৃপক্ষ। তাদের মধ্যে ছিলেন ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী ও তাদের আত্মীয়স্বজনরা। পার্কটিতে ব্যক্তিগত স্থাপনা নির্মান শুরুর পরই কেবল এ সম্পর্কে জানতে পারেন বিশকেকের বাসিন্দারা।
পুরো বিষয়টি কিভাবে ঘটলো, তা জানার জন্য ক্লুপ ও ওসিসিআরপির সাংবাদিকরা বিশ্লেষণ করেন তফসিলভুক্ত হাজারো নথিপত্র, স্থানীয় সরকারের নেওয়া সিদ্ধান্ত, আদালতের রায় ও প্রাসঙ্গিক আরো নানা কাগজপত্র। তথ্য অধিকার আইন প্রয়োগ করেও তারা পাঠিয়েছেন ৬০টির বেশি আবেদন। কথা বলেছেন অনেক মানুষের সঙ্গে। এমনকি অনুসন্ধানের স্বার্থে তারা ছদ্মবেশও নিয়েছেন। সদ্য নির্মিত একটি ভবনের ক্রেতা সেজে কথা বলতে গেছেন। এভাবে তাঁরা সংগ্রহ করেছেন পার্কের বেহাত হয়ে যাওয়া ১৮১টি জায়গার তথ্য। আর সেগুলো এক জায়গায় এনে দেখিয়েছেন একটি ইন্টারঅ্যাকটিভ ম্যাপের সাহায্যে।
ওলগা সিমানোভিচ জিআইজেএন-এর রুশ-ভাষা সম্পাদক। তিনি এসটিবি’র ভিকনা-নভিনিতে চিত্রনাট্যকার, প্রশিক্ষক, ব্যবস্থাপনা সম্পাদক এবং টিভি সংবাদ প্রতিবেদক হিসেবে কাজ করেছেন এবং স্কুপ ম্যাগাজিনের একাধিক আন্তর্জাতিক অনুসন্ধানে অংশ নিয়েছেন। তিনি ইউক্রেনিয়, রুশ, ইংরেজি এবং গ্রিক ভাষায় পারদর্শী।