প্রবেশগম্যতা সেটিংস

লেখাপত্র

কোভিড-১৯: বিশেষজ্ঞ চোখে অনুসন্ধানী অ্যাঙ্গেল

English

 

করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে এখন দেশে দেশে অভূতপূর্ব সব পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। আর এই কাজ করতে গিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার বা দুর্বলের ওপর শোষণ হচ্ছে কিনা – তা খতিয়ে দেখা আরো জরুরি হয়ে উঠেছে অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের জন্য। কিন্তু সংকটের স্বরূপ এতো দ্রুত বদলে যাচ্ছে যে, এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে, ঠিক কোন জায়গা থেকে অনুসন্ধান শুরু করবেন? খবরের গভীরে যেতে কোন কৌশল অবলম্বন করবেন, আর কী কী টুল কাজে লাগাবেন?

জিআইজেএন, এই প্রশ্নগুলো রেখেছিল কয়েকজন বিশ্বসেরা সাংবাদিকের কাছে। তাঁদের কেউ ভুয়া তথ্য যাচাইয়ে পারদর্শী, কারো কাজ সরবরাহ চেইনের জটিল জগত নিয়ে, আবার কেউবা বিশেষজ্ঞ ওপেন সোর্স অনুসন্ধানে। তারা বলেছেন, করোনাভাইরাসের এই সময়ে সন্দেহের দৃষ্টি দিয়ে কোন কোন বিষয়কে দেখতে হবে। চলুন জেনে নেয়া যাক, তারা কী পরামর্শ দিচ্ছেন।

মিরান্ডা প্যাট্রুচিচ

ডেপুটি এডিটর ইন চিফ, রিজিওনাল স্টোরিজ অ্যান্ড সেন্ট্রাল এশিয়া, অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন রিপোর্টিং প্রজেক্ট

অর্থপাচার ও অপরাধী সংগঠন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ প্যাট্রুচিচ। সারায়েভোভিত্তিক এই অনুসন্ধানী সাংবাদিক জিতেছেন নাইট ইন্টারন্যাশনাল জার্নালিজম অ্যাওয়ার্ড, গ্লোবাল শাইনিং লাইট অ্যাওয়ার্ড, আইআরই অ্যাওয়ার্ড ও ইউরোপিয়ান প্রেস প্রাইজ।

বিশ্বের দেশে দেশে জরুরি অবস্থা, সরকারগুলো হিমশিম খাচ্ছে মহামারি সামলাতে – এমন পরিস্থিতিই বাড়তি মুনাফার সুযোগ তৈরি করে দেবে অনেকের জন্যে। এখন কোটি কোটি ডলার খরচ করে জরুরি ভিত্তিতে নানা ধরণের উপকরণ কেনাকাটা চলবে, এবং অস্বচ্ছ উপায়ে অর্থ ব্যয়ের পরিকল্পনা হবে। কিন্তু সংকট, একই সাথে, ক্ষমতাকে জবাবদিহি করার নতুন পথও তৈরি করে দেয় সাংবাদিকদের জন্য। সরকার কোথায় টাকা খরচ করছে, কারা সেই পণ্য সরবরাহ করছে, কত দামে কেনা হচ্ছে, দামটা কিভাবে ঠিক হয়েছে, পণ্যটি কোথা থেকে আসছে – এখন এই দিকে নজর দিতে পারেন রিপোর্টাররা। সরবরাহকারী কোম্পানিটি আগে কখনো চিকিৎসা উপকরণ নিয়ে কাজ করেনি, তাদের মালিকানা লুকোনো অফশোর কাঠামোতে, অভিজাত শ্রেণীর সঙ্গে ওঠাবসা, আগের বছর তারা মুনাফা করেছে নামে মাত্র – এমন চিহ্ন দেখলেই সতর্ক হতে হবে। সরকারের কাছ থেকে তথ্য পাওয়া কঠিন হলে, প্রতিযোগী অথবা কাজ পায়নি এমন কোম্পানির সাথে কথা বলুন। তারাই আপনাকে অনুসন্ধানের মূলসূত্র খুঁজে পেতে সাহায্য করবে। কাজ চালিয়ে যেতে হবে, যত দিন না এই সংকট শেষ হচ্ছে। এসব কেনাকাটায় আসলে কত মুনাফা হয়েছে, তার প্রকৃত চেহারা বোঝা যাবে, আগামী বছর চূড়ান্ত হিসাব জমা হওয়ার পরে।

ম্যালাকি ব্রাউন

সিনিয়র প্রডিউসার, ভিজ্যুয়াল ইনভেস্টিগেশন, নিউ ইয়র্ক টাইমস

ব্রাউন ও তাঁর দল প্রথাগত রিপোর্টিংয়ের মিশেল ঘটিয়েছেন আধুনিক ডিজিটাল ফরেনসিকসের সাথে। তাঁরা অডিও, ভিডিও ও ছবি থেকে তথ্য সংগ্রহ ও যাচাই-বাছাই করেন। ব্যবহার করেন স্যাটেলাইট চিত্র এবং  নির্মাণ করেন অপরাধস্থলের ত্রিমাত্রিক মডেল। 

কমবেশি সবখানেই করোনাভাইরাসের প্রভাব হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে মানুষ। আর সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে গিয়ে সেই অনুভূতি প্রকাশ ও নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে তারা বেছে নিয়েছেন প্রযুক্তি ও সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মকে। বন্ধ করে দেওয়া সীমান্তে আটকে পড়াদের অস্থিরতা, জনশূণ্য হয়ে পড়া ব্যস্ত নগরীতে অদ্ভূত স্থবিরতা, হাসপাতালে বসে নিরুপায় স্বাস্থ্য-কর্মীদের নিজেদের সুরক্ষা পোশাক নিজেরাই তৈরি করে নেওয়া, বারান্দায় দাঁড়িয়ে মাঠে লড়াই করা কর্মীদের সাথে সংহতি – সাধারণ মানুষের ধারণ করা এমন অনেক ছবিতে, আমাদের চোখেও দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে দৈনন্দিন জীবনের ছন্দপতন।

এই সংক্রমণের শুরুর দিকে চীনের সরকার তথ্য লুকিয়ে রাখলেও, দেশটির সাধারণ নাগরিকরা সোশ্যাল মিডিয়া এবং অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে ঠিকই তুলে ধরছিলেন প্রকৃত চিত্র।

স্যাটেলাইট ছবি ও অন্যান্য ডেটার সাহায্যে আমরা এখন করোনাভাইরাসের প্রভাব পর্যবেক্ষণ করতে পারি, এবং তাকে ভিজ্যুয়ালি তুলে ধরতে পারি। আমরা সেল ফোন ডেটা বিশ্লেষণ করে ভিজ্যুয়ালের মাধ্যমে দেখাতে পারি কোন জায়গাগুলোতে শারিরীক দূরত্বের বিষয়টি সফলভাবে মেনে চলা হয়েছে। বিমান চলাচল ও যাত্রীদের ডেটা থেকে দেখা যায় দূরপাল্লার যাতায়াত কতটা কমে গেছে। দূষণ কিভাবে কমেছে, তা ভিজ্যুয়ালের মাধ্যমে দেখিয়েছে কয়েকটি বৈজ্ঞানিক সংস্থা। এখন স্যাটেলাইট ছবি ও জাহাজ-ট্র্যাকিং টুল ব্যবহার করে দেখা সম্ভব, চীনের কাছ থেকে কতগুলো উত্তর কোরীয় জাহাজ নিজ দেশে ফিরে গেছে এবং এতে তাদের অর্থনীতিতে কেমন প্রভাব পড়তে পারে। এগুলো এবং এমন আরো অনেক সূচক ও ডেটা আছে, যা দিয়ে বোঝা সম্ভব আসলে কী ঘটছে এবং কোভিডের বিস্তার কমাতে সরকারের নীতি কতটা কাজে আসছে। হয়তো ভবিষ্যতে এও খতিয়ে দেখতে পারব, জীবনযাত্রায় কতটুকু পরিবর্তন আনলে, আমরা জলবায়ু সংকট মোকাবিলা করতে পরবো।  কে জানে, এই সংকট থেকে কী কী নতুন উদ্ভাবন বেরিয়ে আসবে।

ইলিয়ট হিগিন্স

নির্বাহী পরিচালক, বেলিংক্যাট

ওপেন সোর্স অনুসন্ধানের জন্য বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান বেলিংক্যাটের নেতৃত্ব দেন হিগিন্স। ২০টি দেশে ছড়িয়ে আছেন বেলিংক্যাটের প্রতিবেদকরা। মেক্সিকান মাদক সম্রাট, সিরিয়ায় যুদ্ধাপরাধ এবং রাশিয়ার ভূপাতিত এমএইচ১৭ বিমান বিপর্যয়সহ বেশ কিছু আলোচিত অনুসন্ধান করেছে হিগিন্সের দল।

আমি লক্ষ্য করে দেখলাম, করোনাভাইরাস নিয়ে বিভিন্ন প্রতিবেদনে পাওয়া তথ্য যাচাইয়ের ব্যাপারে অনেকেই আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। কারণ সংবাদমাধ্যম, সরকার, পরিবার ও বন্ধুবান্ধবসহ নানা সূত্র থেকে  তারা বিপুল পরিমাণ তথ্য পাচ্ছেন। তথ্য যাচাই করে সত্যটা তুলে ধরা ভালো, কিন্তু আপনি যদি যাচাইয়ের প্রক্রিয়াটিও পাঠকের কাছে ধাপে ধাপে বর্ণনা করতে পারেন, তাহলে তারা আপনার সাথে আরো বেশি করে যুক্ত হবে। সম্প্রতি টুইটারের পোস্টের মাধ্যমে আমি কিছু ছবি যাচাইয়ের প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করেছি। সেটি খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল। এটি করতে গিয়ে তথ্য যাচাইয়ের বেশ কিছু টুল ও কৌশল তুলে ধরেছি পাঠকদের জন্য। এদের মধ্যে কেউ কেউ নিজেরাই নানারকম ছবি যাচাইয়ের কাজ শুরু করে দিয়েছেন। এখন অনেকেই ঘরে আটকা পড়ে আছেন। অনলাইনে অনুসন্ধানের প্রক্রিয়া শেয়ার করার মাধ্যমে আমরা তাদেরকেও এই কাজে যুক্ত করতে পারি। এটি যে অনেক বড় ও গুরুত্বপূর্ণ কোনো প্রসঙ্গেই হতে হবে, এমন নয়। এটি আপনার অনুসন্ধানী যাত্রায় আরো অনেক মানুষকে যুক্ত করার বিষয়।

পিটার ক্লাইন

প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক, গ্লোবাল রিপোর্টিং সেন্টার

বৈশ্বিক সাংবাদিকতা চর্চায় নতুনত্ব আনার লক্ষ্যে ব্রিটিশ কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অলাভজনক গ্লোবাল রিপোর্টিং সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ক্লাইন। পিবিএস ফ্রন্টলাইন ও অ্যাসোসিয়েট প্রেসের সঙ্গে জোট বেঁধে এখন তিনি অনুসন্ধান করছেন মহামারির সময়ে চিকিৎসা উপকরণের সরবরাহ চেইন নিয়ে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে সামাজিক সব কর্মকাণ্ড সচল রাখার জন্য স্বাস্থ্যকর্মী, সরকারী কর্মকর্তা, ওষুধ-খাবার সরবরাহকারীদের পাশাপাশি সাংবাদিকতাকেও পুরো বিশ্বজুড়ে বিবেচনা করা হচ্ছে “প্রয়োজনীয় সেবা” হিসেবে। আমাদের এই ভূমিকাটি খুবই গুরুত্ব দিয়ে নেওয়া উচিৎ এবং সঠিক দায়িত্ব পালন করা উচিৎ। আমাদের সামনে সুযোগ এসেছে “ভুয়া খবরের” জোয়ারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর। এটি আমাদের বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করছে। উপযুক্ত তথ্য-নির্ভর সাংবাদিকতা অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কাজেই নির্ভুল তথ্য তুলে আনুন। এবং খুব সাবধানতার সঙ্গে চিন্তা করুন, আপনি জনসাধারণের সামনে কী বার্তা তুলে আনছেন।”

এই মহামারি থেকে যে ইস্যুটি বড় হয়ে উঠে আসবে, তা হলো: চিকিৎসা সরঞ্জামের সরবরাহ চেইন এই সংকটের জন্য তৈরি ছিল না। কয়েক বছর ধরে একাধিক জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ সাবধান করছিলেন, একটি  বৈশ্বিক মহামারি আসতে যাচ্ছে এবং এটি গোটা ব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করবে। তারপরও আমরা প্রস্তুত ছিলাম না কেন? চিকিৎসা উপকরণ সরবরাহ করে কারা মুনাফা করেছে, এই সংকটে উপকরণ সরবরাহে কারা বাধা তৈরি করেছে? শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমাগত যে বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদের দিকে ঝুঁকছে, তার ভূমিকা কী? হঠাৎ করে বাড়তি চাহিদা তৈরি হওয়াতেই টলোমলো হয়ে পড়েছে যে  চিকিৎসা সরবরাহ চেইন, তার আসল চেহারা কেমন?

অপরাধীরা সবসময় ব্যবস্থায় নানা ফাঁকফোঁকর খোঁজে। আর বর্তমান এই সংকট নিশ্চিতভাবেই দেখিয়েছে, আমরা কত অরক্ষিত অবস্থায় আছি। জীবন বাঁচানোর জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণের চাহিদাও বিদ্যমান সরকারী ও কর্পোরেট দুর্নীতি আরো বাড়িয়ে তুলতে পারে। বিশ্বের সাংবাদিকদের জন্য আমার পরামর্শ: পুরোনো রিপোর্টিংগুলো ঘেঁটে দেখুন। অতীতে কোনো দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা বা ব্যবসায়ী যদি কোনো কেলেঙ্কারিতে জড়িত থেকে থাকেন, তাহলে এখন তারা কী করছেন? বিদ্যমান নানা বৈষম্যকেও বাড়িয়ে তুলতে পারে কোভিড-১৯-এর মতো সংকট। উচ্চকণ্ঠ ও ধনী দেশগুলোই সবার নজর কাড়বে এবং উপকরণগুলো পাবে। কম ক্ষমতাধর দেশগুলো কিভাবে এই সংকট মোকাবিলা করছে? বিশ্বনেতারা এই বৈষম্য দূর করতে কী করছে? যে দেশগুলোতে এই চিকিৎসা উপকরণ তৈরি হয়, তারা অবশ্য একটু সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবে। বিদেশে রপ্তানির জন্য জমানো উপকরণগুলো তারা এই সংকটের সময় নিজ দেশে কাজে লাগাতে পারবে। আর অন্য দেশে তার প্রভাবও হয়ে উঠতে পারে ভালো অনুসন্ধানের বিষয়।

জিনকিয়াং বিউন

প্রধান অনুসন্ধানী প্রতিবেদক, সিসাইন (দক্ষিণ কোরিয়া) 

বিউন কাজ করেন  দক্ষিণ কোরিয়ার প্রধান সাপ্তাহিক খবরের কাগজ, সিসাইনে। তিনি একেবারে সামনের সারি থেকে কাভার করছেন দেশটির করোনাভাইরাস সংকট। 

কেন এবং কিভাবে কোভিড-১৯-এর বিস্তার ঘটলো, তা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। কিন্তু কোভিড-১৯ এতো দ্রুত ছড়িয়েছে যে সাংবাদিকরা এই “কেন আর কিভাবে”র প্রশ্নে আটতে থাকতে পারছেন না। কিভাবে সূত্রপাত হলো, তা বিশ্লেষণ না করে অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের বরং মনোযোগ দেওয়া উচিৎ আগামী দিনের আসন্ন প্রশ্নগুলোর দিকে। অবশ্যই, অনুসন্ধানী সাংবাদিকরা ভবিষ্যতবিদ বা জ্যোতিষী নন। কিন্তু আমাদের অবশ্যই সামনের দিকে দেখতে হবে এবং পূর্বাভাস দিতে হবে।

করোনাভাইরাস ভবিষ্যতে কী চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে, তা বোঝার ভালো উপায় হতে পারে, অন্য দেশের অভিজ্ঞতা থেকে শেখা। আমাদের জন্য, সামনে ছিল চীন। তখন পর্যন্ত দক্ষিণ কোরিয়ার মতো ব্যাপক বিস্তার শুধু চীনেই হয়েছিল। কিন্তু চীন যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, যেমন শহর লকডাউন, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রুদ্ধ করা, চলাচলের অধিকারের ওপর নিয়ন্ত্রণ – এসব পদক্ষেপ একটি গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে দক্ষিণ কোরিয়ার জন্য উপযুক্ত ছিল না। চীনে কোভিড-১৯ সংক্রান্ত তথ্য স্বচ্ছ ও অবাধ ছিল, তা বিশ্বাস করাও খুব কঠিন। তারপরও চীনের রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমে যেসব সাফল্যের কথা প্রচারিত হয়েছে, সেগুলো থেকেও আমরা ধারণা পেয়েছি, তারা কেমন সমস্যায় পড়েছে। আমি ভেবেছিলাম, দক্ষিণ কোরিয়াও একই রকম চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে। এমন কঠিন সময়ের জন্য সবাইকে প্রস্তুত করতে আমি কিছু প্রতিবেদনও লিখেছিলাম। এই মহামারি কাভারের মধ্য দিয়ে, আমি এই উপলব্ধিতে এসেছি যে, দেশে দেশে মানুষের জীবনযাত্রা খুব একটা আলাদা নয়, এবং সবাই প্রায় একই রকম সমস্যার মুখোমুখি হয়।

কোন দেশ কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে কেমন পদক্ষেপ নিয়েছে, তার তুলনামূলক বিশ্লেষণও যোগ হতে পারে অনুসন্ধানী কাভারেজের মধ্যে। যদিও এটি খুব সহজ কাজ নয়। প্রতিটি দেশের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আলাদা। ফলে একই রকম কৌশল নিয়েও ফল হতে পারে আলাদা। কোনো দেশের সাংবাদিক হয়তো আগে থেকেই সেসব পরিস্থিতি-পরিপ্রেক্ষিত সম্পর্কে জানেন। অন্যান্য দেশের সাংবাদিকরা হয়তো সেটি নাও বুঝতে পারেন। এবং এমন উপরিতল ছুঁয়ে যাওয়া প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে হয়তো তাঁরা কোনো রায় দিয়ে দেবেন।

অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের জন্য এখন আন্তর্জাতিক সহযোগিতার সুবর্ণ সুযোগ এসেছে। আমি যেখানে কাজ করি, সেই সিসাইন একটি ছোট সংগঠন। আমরা প্রধানত দেশের অভ্যন্তরীণ নানা বিষয়ে মনোযোগ দেই। কিন্তু এই মহামারির সময়, আমরা আমাদের বিদেশে থাকা প্রতিনিধিদের বিদ্যমান নেটওয়ার্ক শক্তিশালী করেছি। একই সঙ্গে যোগাযোগ করেছি বিদেশী কাভারেজ ও বিভিন্ন সম্মেলনে পরিচিত হওয়া সাংবাদিকদের সঙ্গে। আমরা তাদের কাছ থেকে প্রতিবেদনের সূত্র খুঁজেছি। তাদের অংশগ্রহণ চেয়েছি। আমরা আন্তর্জাতিক চিকিৎসা সংক্রান্ত জার্নালগুলো ঘাঁটাঘাঁটি করেছি এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের কাছে অনেক প্রশ্ন জানতে চেয়েছি। কোভিড-১৯-এর মতো একটি মহামারির মুখোমুখি হওয়ার পর, সাংবাদিকদের খুঁজে দেখা দরকার এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিভিন্ন দেশের সরকার, চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ ও মিডিয়ার মধ্যে কী পরিমাণ আন্তর্জাতিক সহযোগিতা প্রয়োজন: সহযোগিতার ধরন কেমন হবে, সহযোগিতার নির্দিষ্ট উপায় এবং সেরা চর্চার বিষয়গুলো কী? আন্তর্জাতিক বিভিন্ন নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত থাকা অনুসন্ধানী সাংবাদিকরা এগুলো বিষয় নিয়ে কাজ করতে পারেন।

ফ্যাবিওলা তোরেস

প্রতিষ্ঠাতা,  স্যালুদ কন লুপা 

লাতিন আমেরিকার জনস্বাস্থ্য নিয়ে সহযোগিতামূলক সাংবাদিকতার ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম, স্যালুদ কন লুপার প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক তোরেস। প্রশংসিত অনুসন্ধানী সাইট ওহো পুবলিকোর প্রতিষ্ঠাতাও তিনি।

মহামারি সামলাতে গিয়ে, লাতিন আমেরিকার বেশিরভাগ দেশই জরুরি অবস্থা জারি করেছে। যেখানে জনগণের অর্থ বিলিবন্টনের ক্ষেত্রে নতুন নিয়মনীতি প্রণয়ন করা হয়েছে এবং স্বাভাবিক পর্যালোচনার প্রক্রিয়া বাদ দেওয়া হয়েছে। সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন নাগরিক অধিকার ও যাতায়াতের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা আরোপ করা হয়েছে জনগোষ্ঠীকে বাধ্যতামূলকভাবে অবরুদ্ধ করার জন্য। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জন্য সময়টি খুবই জটিল ও চ্যালেঞ্জিং। আমি মনে করি, অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন আমরা পুরো বিশ্বকে দেখাতে পারি যে, কেন জনস্বাস্থ্যের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে নেওয়া উচিৎ।  জনস্বাস্থ্যের বিষয়টি সমাজের বিভিন্ন অংশের আলোচনার বিষয়। এবং এটি অর্থনীতি, স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত। জনস্বাস্থ্যকে আমাদের স্থায়ী আলোচনার বিষয়ে পরিণত করতে হবে। যদি শুধু অসুস্থ হলে বা মহামারির সময়েই আমরা স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তা করি, তাহলে অনেক দেরি হয়ে যাবে।

প্রথমত, প্রতিদিনের কাভারেজ তৈরির সময়, আমাদের নিজেদেরই জিজ্ঞাসা করতে হবে: এই মুহূর্তে কোন জরুরি বিষয়টি আমার পাঠক-দর্শকের কাছে ব্যাখ্যা করা দরকার? আমাদের এটি মাথায় রাখতে হবে যে, সাংবাদিকতা গণমানুষকে সেবা দেওয়ার বিষয়। বিশেষভাবে সেই মানুষদের জন্য যারা দুর্বল এবং রাজনৈতিক বা কর্পোরেট শোষনের শিকার। দ্বিতীয়ত, আমাদের জিজ্ঞাসা করতে হবে: এই মহামারিতে কোন বিষয়গুলো জড়িত আছে? ফার্মাসিউটিক্যাল কর্পোরেশন, বায়োটেক কোম্পানি এবং অন্যান্য চিকিৎসা উপকরণ নির্মানের সঙ্গে জড়িত কোম্পানির কর্মকাণ্ড অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি খুঁটিয়ে দেখা প্রয়োজন। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে অর্থবাণিজ্য ও বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি আইনের জন্য যেসব নিয়ম বানানো হয়েছে, তা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থ ও মানবাধিকার বিরোধী হয়ে উঠেছে। এই মহামারির অন্যান্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার দিকেও অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের দৃষ্টি দিতে হবে। এই ভাইরাসের কারণে পুরো বিশ্ব থমকে যেতে বাধ্য হয়েছে। এমন পরিস্থিতি আরো বেশি করে দারিদ্র ও বৈষম্য তৈরি করছে। ফলে এই মহামারির অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব নিয়ে অনুসন্ধান করাটাও খুব জরুরি।

এই মহামারি দেখিয়েছে, আমাদের আরো অনেক বিষয়ে আরো ভালো সহযোগিতামূলক অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা দরকার। স্যালুদ কন লুপাতে, আমরা কাজ করছি পুরো লাতিন আমেরিকাতে ছড়িয়ে থাকা অন্যান্য সাংবাদিকদের সঙ্গে। আমরা তথ্য আদানপ্রদানের ক্ষেত্রে আরো স্বচ্ছ হয়ে উঠছি এবং শুধু যাচাই করা তথ্যই শেয়ার করছি। একই সঙ্গে অনুসন্ধানী রিপোর্টিং প্রজেক্টেও কাজ করছি ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সহায়তা করার জন্য।

মার্থা মেনডোজা

ন্যাশনাল রাইটার, দ্য অ্যাসোসিয়েট প্রেস 

সিলিকন ভ্যালি-ভিত্তিক সাংবাদিক মেনডোজা দুইবার জিতেছেন পুলিৎজার পুরস্কার। একটি পুরস্কারজয়ী প্রতিবেদনের কারণে মুক্তি পেয়েছে থাই সিফুড ইন্ডাস্ট্রিতে বন্দী হয়ে থাকা ২০০০ মানুষ। অন্যটিতে উন্মোচিত হয়েছে কোরিয়ান যুদ্ধের সময় নো গুন রি-তে সংঘটিত গণহত্যা। 

রিপোর্টারদের জন্য আমার একটি সাধারণ পরামর্শ হলো: সম্ভব হলে দল গঠন করুন, জোট বাঁধুন। এই সংকটপূর্ণ সময়ে ঘনিষ্ঠ সহকর্মীরা একজায়গায় হয়ে কাজ করতে পারলে তা আপনার কর্মকাণ্ডে গতি আনবে এবং প্রাত্যহিক যোগাযোগগুলোর মধ্যেও রসবোধ ও উষ্ণতা নিয়ে আসবে।

কণ্ঠহীনদের কণ্ঠ দেওয়ার বিষয়টি আরো গুরুত্বপূর্ণ। গৃহহীন, কারাবন্দী ও প্রান্তিক অভিবাসী জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছাতে হবে। টুলসের কথা বলতে গেলে, আমি এখন ব্যবহার করছি ইমপোর্ট জিনিয়াস, পানজিভা, ইউএসএস্পেনডিং, ট্র্যাক ডট এসওয়াইআর ডট এডু, ম্যারিনট্রাফিক, ও পিএসিইআরসহ আরো কিছু টুল।

সরবরাহ চেইন নিয়ে অনুসন্ধানের সময়, ডেটা ব্যবহার করুন এবং অতিশয়োক্তি অগ্রাহ্য করুন। কোনো একটি ঘটনাকে, নিছক একক ঘটনা হিসেবেই দেখুন। সাধারণীকরণ করবেন না। প্রকৃত পরিসংখ্যান ছাড়া অন্য কোনো কিছু থেকেই সিদ্ধান্ত টানবেন না। একই সঙ্গে এটি একটি বৈশ্বিক বিষয়। ফলে অবশ্যই আপনাকে স্থানীয় পরিস্থিতির ভিত্তিতে লিখতে হবে কিন্তু বৃহৎ বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটও মাথায় রাখতে হবে। আর অন্য সব সময়ের মতো বন্ধুদের বলছি, চলুন তথ্য অধিকার আইন ব্যবহার করি।

নাতালিয়া আন্তেলাভা

এডিটর ইন চিফ, কোডা স্টোরি

বিবিসির সাবেক প্রতিনিধি আন্তেলাভা, কোডা স্টোরির প্রতিষ্ঠাতা। উদ্ভাবনী এই অলাভজনক প্রতিষ্ঠান গভীর অনুসন্ধান করে বৈচিত্রময় সব বিষয় নিয়ে। যেমন বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, ভুয়া তথ্য, এলজিবিটিকিউ সংকট ও অভিবাসন। 

করোনাভাইরাস নিয়ে অনুসন্ধান করছেন, এমন সাংবাদিকদের প্রতি আমার পরামর্শ হলো: এটিকে অন্য যে কোনো অনুসন্ধানের মতো করেই বিবেচনা করুন। টাকার খোঁজ করুন এবং মানুষের গল্প বলুন। ভুয়া তথ্য অনেক জরুরি বিষয়। কারণ এটি আমাদের সমাজকে বদলে দিচ্ছে। অন্যান্য আরো সংকটের মতো এখানেও শিকার ও শিকারী আছে। আমাদের কাজ হলো সেগুলো খুঁজে বের করা। কোন বিষয়গুলো আরো তলিয়ে দেখা দরকার? কোয়ারেন্টিন আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে কী প্রভাব ফেলছে এবং কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে আমাদের প্রাইভেসির কী অবস্থা দাঁড়াচ্ছে?

ইং চান

অধ্যাপক, হংকং বিশ্ববিদ্যালয় 

সাংবাদিক ও শিক্ষক ইং চান হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক। তিনি বিপন্ন প্রাণীপ্রজাতি, মানবপাচার ও সংঘবদ্ধ অপরাধ নিয়ে বেশ কিছু প্রশংসনীয় অনুসন্ধানে নেতৃত্ব দিয়েছেন।

রিপোর্টাররা শুরু করতে পারেন সেই পুরোনো প্রবাদ দিয়ে: “টাকার খোঁজ।” গভীরভাবে অনুসন্ধান করে দেখতে পারেন কর্পোরেটের ভূমিকা এবং মহামারির জীবন-মরণ প্রশ্নের পেছনে কাজ করা বিশেষ স্বার্থগুলো। যেমন, টেস্ট ও চিকিৎসা উপকরণের ঘাটতি থাকার পেছনে কী কর্পোরেট স্বার্থ আছে? যুক্তরাষ্ট্রসহ পুরো বিশ্বের বাজারে অনেক ধরনের পরীক্ষা হচ্ছে। কোন প্রাইভেট কোম্পানি ও প্রস্তুতকারকরা এই পরীক্ষা উপকরণ তৈরি করছে? পরীক্ষার সংখ্যা আরো বাড়ানোর পথে বাধাগুলো কী কী? এছাড়াও আছে মাস্কের ইস্যু। আমাদের দরকার বৈশ্বিক সরবরাহ চেইনের পূর্ণাঙ্গ মানচিত্র। তলিয়ে দেখা দরকার বেসরকারি খাত, মধ্যসত্ত্বভোগী ও কর্পোরেশনগুলোর ভূমিকা। রয়টার্স এ বিষয়ে দারুন একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। নিউ ইয়র্ক টাইমস রিপোর্ট করেছিল চীনের সরবরাহ নিয়ে। কিন্তু এগুলো পুরো কাহিনীর একটি অংশ মাত্র।

সুরক্ষা উপকরণ নিয়ে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি সংবাদমাধ্যম প্রচার করেছিল, মার্চ মাসের শেষের দিকে চীন থেকে বিমানে করে প্রথমবারের মতো কিছু সরবরাহ এসেছে। পরবর্তীতে সংবাদ সম্মেলনে মার্কিন কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সেগুলো পাঠানো হয়েছে প্রাইভেট মার্কেটে। এবং তারা স্বীকার করেছে যে, “এখানে কিছু অস্বাভাবিক কর্মকাণ্ড দেখা গেছে।” কী ছিল সেই কর্মকাণ্ডগুলো? রিপোর্টাররা এখন প্রতিদিনকার পরিস্থিতি নিয়েই ব্যস্ত থাকছেন। কিন্তু আমাদের এই বিষয়গুলো এক জায়গায় জুড়তে হবে এবং পুরো ব্যবস্থার ব্যর্থতার বিষয় ধরে অনুসন্ধান করতে হবে।

সুসান কোমরি

অনুসন্ধানী সাংবাদিক, আমাবুনগানে (দক্ষিণ আফ্রিকা)

কোমরি কাজ করেন দক্ষিণ আফ্রিকার অলাভজনক অনুসন্ধানী নিউজরুম আমাবুনগানেতে। তিনি সক্রিয়ভাবে কাজ করেছেন দক্ষিণ আফ্রিকার অন্যতম বড় দুর্নীতি কেলেঙ্কারি, গুপ্তালিকস প্রজেক্টে। সানলাম, তাঁকে মনোনিত করেছিল বর্ষসেরা অর্থবাণিজ্য সাংবাদিক হিসেবে। 

জরুরি ভিত্তিতে বিভিন্ন জিনিসপত্র কেনাকাটার প্রয়োজন হওয়ায় দুর্নীতি, অনিয়ম ও মুনাফা করে নেওয়ার বড় সুযোগ তৈরি হয়েছে। ফলে এই সময়ে জরুরি ভিত্তিতে করা চুক্তি বা চুক্তির মেয়াদ বাড়ানোর বিষয়গুলোর দিকে আমি নজর রাখব। দক্ষিণ আফ্রিকায়, চিফ প্রকিউরমেন্ট অফিসারের কার্যালয় থেকে সব ধরনের চুক্তি, মেয়াদ বাড়ানো বা পরিবর্তনের ডেটা প্রকাশ করা হয় (দেখতে পারেন এখানে)। কিন্তু এগুলো পেতে লম্বা সময় লাগে। ফলে দ্রুত কিছু করার জন্য আপনাকে নির্ভর করতে হবে তাদের ভেতরের কোনো সোর্সের তথ্যের ওপর।

কোভিড-১৯-এর কারণে পরিবেশগত নীতিমালাগুলোকে পাশে সরিয়ে রাখার মত অপ্রত্যাশিত ঘটনাও ঘটতে পারে। আইনি প্রতিষ্ঠান ওয়েবার ওয়েন্টেল দুই সপ্তাহ আগে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে তারা দেখিয়েছে কিভাবে “জরুরি অবস্থার” সময় ন্যাশনাল এনভায়রনমেন্ট ম্যানেজমেন্ট অ্যাক্ট (এনইএমএ)-এর কিছু অংশ বদলে যায়। এরকম একটা সময়েই আমরা আছি। ফলে, পরিবেশগত বিষয় নিয়ে উদ্বেগ থেকে, আমি লক্ষ্য রাখব কোভিড-১৯-এর নামে কী কী বিষয়ের বৈধতা দেওয়া হয়েছে।

সৈয়দ নাজাকত

প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান সম্পাদক, ডেটা লিডস (ভারত)

ডেটা সাংবাদিকতা প্রসারের উদ্যোগ, ডেটা লিডস পরিচালনা করেন নাজাকত। ডেটা লিডস নানাবিধ প্রশিক্ষণ দেয় এবং স্বাস্থ্য বিষয়ে ভারতের প্রথম ডেটা ভিত্তিক ওয়েবসাইট পরিচালনা করে। দ্য উইকের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করার সময় নাজাকত জিতেছেন ভারতের মর্যাদাপূর্ণ রামনাথ গোয়েনকা এক্সেলেন্স ইন জার্নালিজম পুরস্কার। 

প্রতিদিনই বিরামহীনভাবে আসছে নানা সংবাদ। সেগুলো দেখতে দেখতে প্রচণ্ড চাপের মুখে আছেন সাংবাদিকরা। কিন্তু অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের প্রধান ব্যাপার হচ্ছে মনোযোগ ধরে রাখা। প্রতিদিনের এসব নানা ঘটনা ও সংবাদ সম্মেলন দিয়ে বিভ্রান্ত হয়ে পড়বেন না। অনুসন্ধান করুন। আরো ভেতরে তলিয়ে দেখুন।

এখন অনেক রকম ডেটাই পাওয়া যায়। সেসব ডেটা আমাদেরকে এই সংকটের বিস্তৃতি সম্পর্কে কী বলে? জনগণের জন্য উন্মুক্ত দলিল, নথিপত্র, সরকারী কেনাকাটার কাগজ ও চিকিৎসা উপকরণ সংক্রান্ত অডিট রিপোর্টগুলো থেকে কী জানা যাচ্ছে? কর্তৃপক্ষের দিক থেকে কী অবহেলা করা বা নিষ্ক্রিয়তা দেখানোর ঘটনা আছে? এরকম প্রশ্ন তোলা এবং উত্তর পাওয়ার জন্য সঠিক মানুষকে খুঁজে বের করতে পারার জায়গা থেকেই শুরু হয় অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা। টুল ব্যবহারের প্রসঙ্গে বলতে হয়, আমার মতে প্রধান ব্যাপারটি হচ্ছে সব কিছুর সত্যতা যাচাই করে নেওয়া। এটি করার জন্য আপনি অনলাইনের বিভিন্ন যাচাইয়ের টুল ব্যবহার করতে পারেন। যেমন ইনভিড, ইউটিউব ডেটা ভিউয়ার, ইয়ানডেক্স, ক্রাউডট্যাঙ্গল, রিভার্স ইমেজ সার্চ। অনলাইনে বিভ্রান্তিকর সব ভাইরাল কনটেন্ট সনাক্ত করার জন্য ল্যাঙ্গুয়েজ অডিও ভেরিফিকেশন টুল ব্যবহার করতে পারেন। সবসময় মনে রাখবেন, প্রকৃত তথ্য ছাড়া আমরা সত্য জানতে পারব না।

বণ্যপ্রাণীর বৈশ্বিক বাণিজ্যের দিকেও সাংবাদিকদের আরো বেশি নজর দেওয়া প্রয়োজন। বেশ কিছু রোগের উৎপত্তি হয়েছে এই বন্যপ্রাণী থেকে। বেশ কিছু বছর ধরে, এমনকি বৈধভাবেও, বন্যপ্রাণী কেনাবেচার পরিমাণ বেড়েছে। কিন্তু এটির পরিধি কতটা এবং মানুষের ওপর এর স্বাস্থ্যগত প্রভাব কতখানি, সে ব্যাপারে আমাদের কোনো পূর্ণাঙ্গ ধারণা নেই।

মুসিকিলু মজিদ

প্রধান সম্পাদক, প্রিমিয়াম টাইমস, নাইজেরিয়া

নাইজেরিয়ার অগ্রনী অনুসন্ধানী সাংবাদিক, মজিদ রিপোর্ট করেছেন দুর্নীতি, মানবাধিকার ও মানবপাচার নিয়ে। তিনি জিতেছেন গ্লোবাল শাইনিং লাইট অ্যাওয়ার্ড, ওলে সোইঙ্গা ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্টিং অ্যাওয়ার্ড ও ডেটা জার্নালিজম অ্যাওয়ার্ড। 

করোনাভাইরাস মোকাবিলার জন্য বিভিন্ন দেশে বিপুল পরিমাণ অর্থ সাহায্য-অনুদান আকারে দেওয়া হচ্ছে। আমার মনে হয় এখন রিপোর্টারদের এই টাকাগুলোর খোঁজ করা দরকার। যেমন, নাইজেরিয়াতে, বেসরকারী খাতের কিছু প্রতিষ্ঠানের জোট কেন্দ্রীয় সরকারকে ১৫ বিলিয়ন নাইজেরিয়ান নাইরা (প্রায় ৩৯ মিলিয়ন ইউএস ডলার) সহায়তা দিয়েছে আইসোলেশন সেন্টার তৈরি ও প্রয়োজনীয় পরীক্ষা উপকরণ ও ওষুধ কেনার জন্য। এরকম অনেক টাকা তোলা হচ্ছে ও খরচ করা হচ্ছে। এবং এটি খুবই সম্ভব যে, কিছু কর্মকর্তা এই পরিস্থিতিতে অবৈধভাবে নিজেদের অর্থবিত্ত বাড়িয়ে নিতে চাইবে।

আমার মনে হয় অন্যান্য দেশগুলোতেও কমবেশি একই রকম পরিস্থিতি বিদ্যমান। রিপোর্টারদের অবশ্যই কর্মকর্তাদের এসব কেনাকানা ও ব্যয়ের হিসেব রাখতে হবে।  এরকম সংকটপূর্ণ পরিস্থিতিতে জনগণের অর্থ নয়ছয় করা বা সরিয়ে ফেলার প্রবণতা কর্মকর্তাদের মধ্যে সবসময়ই দেখা যায়। কোনো কোনো দেশে অনেক অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে ওষুধ-টিকা নিয়ে গবেষণা ও পরীক্ষানিরীক্ষায়। এই খাতের খরচগুলোর হিসেব রাখতে পারলেও খুব ভালো হতো। তাহলে দেখা যেত এত এত অর্থ খরচের বিনিময়ে পুরো দুনিয়া সেখান থেকে কী উপকার পেল। গবেষণার জন্য অনেক অর্থ পেয়েও বিনিময়ে কোনো ফলাফল দিতে না পারা অলস অধ্যাপকরা যেন এই মহামারির সময় আরো বিত্তশালী হয়ে না ওঠেন, তা নিশ্চিত করতে রিপোর্টারদের সচেষ্ট হওয়া দরকার।

এখন পুরো বিশ্বজুড়ে যে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে চলেছে, সেগুলোর বিষয়েও রিপোর্টারদের নজর দেওয়া প্রয়োজন। অনেক দেশেই চলছে লকডাউন। আর মানুষের ঘরে থাকা নিশ্চিত করার জন্য রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ পুলিশ, সেনাবাহিনী ও অন্যান্য নিরাপত্তারক্ষা প্রতিষ্ঠানের সহায়তা নিচ্ছে। এমন খবর আসছে যে, কিছু দেশে এসব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নাগরিক অধিকার হরণ করছে। এই ব্যাপারগুলো লিপিবদ্ধ করে রাখাটা রিপোর্টারদের দায়িত্ব।

রাওয়ান দামেন

ডিরেক্টর জেনারেল, আরব রিপোর্টার্স ফর ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম 

মধ্যপ্রাচ্যের অলাভজনক অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার প্রতিষ্ঠান, আরিজ-এর নেতৃত্ব দিচ্ছেন দামেন। তিনি দুই দশক কাজ করেছেন চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে। আল জাজিরা নেটওয়ার্ক ও অন্যান্য আরো অনেকের জন্য প্রযোজনা ও পরিচালনা করেছেন ৩০ ঘন্টারও বেশি সময়ের তথ্যচিত্র।

২০২০ সালের তো বটেই, কোভিড-১৯ হয়তো সামনের বছরগুলোতেও অনেক বড় একটি ঘটনা হয়ে থাকবে। এটি শুধু স্বাস্থ্য বা বিজ্ঞানের বিষয় না। এটি সমাজ-রাজনীতি-অর্থনীতিরও বিষয়। বর্ণ, মানবাধিকার ও সংস্কৃতির বিষয়। আমার প্রথম পরামর্শ হচ্ছে: স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে বিষয়গুলি কাভার করতে গিয়ে আপনি নিজেই খবরের বিষয় হয়ে উঠবেন না। কোভিড-১৯ সংক্রান্ত প্রতিবেদনগুলো অনেকে পড়েন বা দেখেন। ফলে তথ্যের যথার্থতা ও স্পষ্টতা নিশ্চিত করা একান্ত প্রয়োজন। এখন সাংবাদিকদের মধ্যে আন্তসীমান্ত সহযোগিতা তৈরিরও একটি দারুন সুযোগ এসেছে। কারণ সব দেশের সাংবাদিকই এখন এই একই বিষয় নিয়ে কাজ করছে। এবং তাদের একটি বড় অংশ নিজ দেশ ছেড়ে কোথাও যেতে পারছেন না। একই সঙ্গে, নিজেকে প্রশ্ন করুন যে, কোন দিক দিয়ে আপনার প্রতিবেদনটি অনন্য হয়ে উঠছে। বর্তমান পরিস্থিতি খুব দ্রুতগতিতে বদলে যাচ্ছে। ফলে আমাদের হয়তো স্বল্পমেয়াদী কিছু অনুসন্ধান করতে হতে পারে। একই সঙ্গে প্রথাগত দীর্ঘমেয়াদী অনুসন্ধানেরও আমাদের প্রয়োজন পড়বে।

যারা ঘরে বসে অনুসন্ধান করছেন, মাঠপর্যায়ে যেতে পারছেন না; তাদেরকে বলব: বিশেষজ্ঞরা কী জানেন সেটি নয়, তারা সেটি কিভাবে জানেন সেই প্রক্রিয়াটি আমাদের জানান। শুধু কোনো একটি মডেলের বর্ণনা নয়, বরং বলুন সেই মডেল তৈরির পেছনে কী অনুপ্রেরণা কাজ করেছে। শুধু সংখ্যা নয়, সেগুলোর পরিপ্রেক্ষিতও ব্যাখ্যা করুন। স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ও রাজনীতিবিদরা কী বলছেন, তা খুব সাবধানতার সাথে বিশ্লেষণ করুন এবং তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনুন। এখনকার এই সময়ে নানা ডিজিটাল টুল ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে ওঠাটাও জরুরি। সোর্সের সঙ্গে নিরাপদে কথা বলার জন্য সিগন্যাল, জিটসি বা জুম ব্যবহার করতে পারেন। এখন নতুন ও বৈচিত্র্যময় সোর্স তৈরিরও সময়। আর সবশেষে: আক্রান্ত ব্যক্তিরা যেন কোনোভাবে হেনস্তার শিকার না হন এবং আপনার রিপোর্টিংয়ে যেন বর্ণ বা জাতিবিদ্বেষ না থাকে; তা নিশ্চিত করতে হবে।

ক্রিয়েটিভ কমন্স লাইসেন্সের অধীনে আমাদের লেখা বিনামূল্যে অনলাইন বা প্রিন্টে প্রকাশযোগ্য

লেখাটি পুনঃপ্রকাশ করুন


Material from GIJN’s website is generally available for republication under a Creative Commons Attribution-NonCommercial 4.0 International license. Images usually are published under a different license, so we advise you to use alternatives or contact us regarding permission. Here are our full terms for republication. You must credit the author, link to the original story, and name GIJN as the first publisher. For any queries or to send us a courtesy republication note, write to hello@gijn.org.

পরবর্তী

GIJN এর সদস্যপদ জিআইজেসি২৫

মালয়েশিয়াকিনি: স্বাধীন বার্তাকক্ষ যেভাবে ইটের পর ইট গেঁথে ক্ষমতাবানদের “গলার কাঁটা” হয়ে ওঠে

“মালয়েশিয়াকিনি সবচেয়ে জরুরী কাজটি করেছে। বার্তাকক্ষটি সরাসরি এবং সুস্পষ্টভাবে চ্যালেঞ্জ করেছে ক্ষমতাবানদের কর্তৃত্বকে। সাধারণ মালয়েশিয়ানদের জন্য নিষিদ্ধ বিষয় যেমন জাতি, রাজপরিবার এবং ধর্ম নিয়ে মতামত প্রকাশের একটি নিরাপদ স্থান তৈরি করেছে।”

অনুসন্ধান পদ্ধতি পরামর্শ ও টুল

নির্বাসিত লোকেদের ওপর রাষ্ট্রের হামলা: ওয়াশিংটন পোস্টের অনুসন্ধানী সিরিজ “দমন নীতির দীর্ঘ হাত” থেকে আমরা যা শিখতে পারি

দ্যা ওয়াশিংটন পোস্টের আন্তর্জাতিক অনুসন্ধানী দল রিপ্রেশন’স লং আর্ম ধারাবাহিকে তুলে ধরেছে, কীভাবে নিজ দেশের সীমানার বাইরে থেকেও নিশানা হচ্ছেন ভিন্ন মতাবলম্বীরা।

প্রতিবেদন প্রকাশ বণ্টন ও প্রচার

সাংবাদিকতায় আস্থা ধরে রাখতে ভ্রাম্যমান অনুসন্ধানী বার্তাকক্ষ কীভাবে কাজ করছে

অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে ভ্রাম্যমান অনুসন্ধানী বার্তাকক্ষ। উত্তর মেসিডোনিয়ায় এমন একটি বার্তাকক্ষ স্থানীয় বাসিন্দাদের আস্থা অর্জন করেছে। তাঁরাই বার্তাকক্ষে ছুটে যাচ্ছেন সাক্ষ্যপ্রমাণ নিয়ে। সম্পৃক্ত হচ্ছেন নিজেরাও।

Toxic Waste Pollution Factory Bank

পরিবেশ ধ্বংসের পেছনে বিনিয়োগ করছে কারা-বিনিয়োগকারীদের খোঁজ করবেন যেভাবে : দ্বিতীয় পর্ব

ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে পরিবেশের ক্ষতি করছে বা দূষণে ভূমিকা রাখছে—সরকারের পক্ষ থেকে এ ধরনের এমন অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক সহায়তা বা প্রণোদনা দেওয়া হয়ে থাকে। লক্ষ্য, নিজ দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা ও যেসব দেশে তাঁরা বিনিয়োগ করছে সেসব দেশের টেকসই উন্নয়ন। অনেক সময় খনিজ উত্তোলন ও বন উজাড় করার কাজেও বিনিয়োগ করে থাকে তারা। আর প্রচারণা চালায় উন্নয়ন বিনিয়োগ বলে। এই নিবন্ধটি পরিবেশ বিষয়ক সাংবাদিকদের জন্য অবশ্যপাঠ্য।