জাহাজ, চোরাচালান ও সরবরাহ চেইন অনুসরণ করবেন কীভাবে?
আমরা যা-ই ব্যবহার করি তার প্রায় সবকিছুই এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পরিবহণ করতে হয়। এটি অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের জন্য খুব ভালো। এর মানে, প্রায় সবকিছুকেই অনুসরণ করে তার উৎস পর্যন্ত যাওয়া সম্ভব।
‘আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ব্যবস্থা কাজ করে তার নিজস্ব একটি ভাষায়’, বলছিলেন কলাম্বিয়া জার্নালিজম স্কুলের জিয়ানিনা সেগনিনি, গেল ৫-৭ অক্টোবর কোরিয়ার সিউলে অনুষ্ঠিত আইজেএশিয়া ২0১৮ সম্মেলনে। তাঁর মতে, আন্তর্জাতিক সরবরাহ চেইন নিয়ে অনুসন্ধানের জন্য তাঁদের এই ভাষা বোঝা, সাংবাদিকদের জন্য একটি শক্তিশালী অস্ত্র হতে পারে।
সেখানে সেগনিনির সঙ্গে ছিলেন অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের (এপি) দুইবার পুলিৎজার পুরস্কারজয়ী সাংবাদিক মার্থা মেন্ডোজা ও ব্রায়ান ক্রিস্টি, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক পত্রিকার সাবেক পরিচালক, স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন। শিপিংয়ের তথ্য থেকে স্টোরি খুঁজে বের করার কৌশল এবং জাহাজ, চোরাচালান ও সরবরাহ চেইন ট্র্যাকিংয়ের বেশ কিছু উপায় তাঁরা সেখানে তুলে ধরেন।
১. আমদানি-রপ্তানির তথ্য বের করুন এবং তাতে অনিয়ম খুঁজে দেখুন
বিশ্ববাণিজ্যের যেসব ডেটাবেস আছে সেখান থেকে আপনাকে তথ্য বের করতে হবে এইচএস কোড (হারমোনাইজড কমোডিটি ডেসক্রিপশন এবং কোডিং সিস্টেম নামেও পরিচিত) ব্যবহার করে। এখানে পাবেন মূলত আমদানি ও রপ্তানির প্রাসঙ্গিক ডেটা। সেই তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখুন অনিয়ম খুঁজে পান কি না। অনুসন্ধান শুরুর জন্য সেগনিনি তিনটি ডেটাবেসের নাম দিয়েছেন : জাতিসংঘ কমট্রেড ডেটাবেস, এশিয়া প্যাসিফিক এনার্জি পোর্টাল এবং কোরিয়া কাস্টমস পোর্টাল।
অবশ্য সব পণ্যেরই যে একটি ট্র্যাকিং নম্বর আছে, তা নয়। সেগনিনি দক্ষিণ আমেরিকার কোকেইন (মাদক) উৎপাদনকারী দেশ কলম্বিয়ার একটি উদাহরণ তুলে ধরেন। বলেন, ‘আপনি কোকেইনের জন্য কোনো এইচএস কোড পাবেন না, কিন্তু দেখা গেল এই মাদক তৈরি করতে পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট প্রয়োজন। জাতিসংঘ কমট্রেড ডেটাবেসটি ব্যবহার করলে দেখতে পাবেন, কলম্বিয়া কী পরিমাণ পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট আমদানির তথ্য জাতিসংঘকে জানিয়েছে।’
সেগনিনি বলেন, ‘এটা মনে রাখতে হবে, একটি দেশের জন্য যা আমদানি, আরেকটি দেশের জন্য তা রপ্তানি।’ অনিয়ম ধরার ভালো উপায় হচ্ছে মিলিয়ে দেখা, অন্য দেশগুলো কলম্বিয়ার কাছে যত পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট রপ্তানি করছে, কলম্বিয়া ঠিক ততটা আমদানি করছে কি না। আর এই ঘটনায় আমদানির সঙ্গে রপ্তানির তথ্য মেলেনি। ‘কেন কলম্বিয়া তাদের দেশে যাওয়া সব পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট রিপোর্ট করছে না? এই অসংগতি থেকে একটি গল্পের শুরু।’
কোনো কৃষিপণ্যের আমদানি বা রপ্তানি হঠাৎ বাড়ছে কি না, সেদিকেও নজর রাখতে বলেছেন সেগনিনি। বিশেষ করে সেইসব কৃষিপণ্য, যাদের ফলনের একটি নির্দিষ্ট মৌসুম আছে। ‘কখনো কখনো মাদক চোরাচালানকারীরা কৃষিপণ্য বেচাকেনার কোম্পানিগুলোকে কিনে নেয়, তাদের কারবার গোপন রাখার জন্য। ধরা যাক আলুর কথা। আপনি জানেন এই পণ্যটি কখন উৎপাদিত হয় এবং বছরের একটি সময়ে তার স্বাভাবিক ফলন কত। যদি দেখেন ওই সময় তার আমদানি-রপ্তানি হঠাৎ বেড়ে গেছে, তাহলে সেই তথ্য খুঁটিয়ে দেখুন এবং অনুসন্ধানে মন দিন।’
২. খুঁজে বের করুন বিল অব লেডিং
কোনো শিপমেন্ট বা চালান পরিবহণের জন্য বিল অব লেডিং লাগে। এতে জাহাজ, ক্রেতা, কোন বন্দর থেকে পণ্য উঠেছে, কোথায় নেমেছে, পণ্যের বিবরণ এবং এমন অনেক দরকারি তথ্য থাকে। মেন্ডোজা এবং সেগনিনি এ ধরনের নথির জন্য Importgenius, Panjiva and Enigma.io, এই তিনটি ওয়েবসাইট ঘেঁটে দেখার পরামর্শ দেন।
এ ধরনের প্ল্যাটফরমগুলোর মধ্যে কয়েকটিতে টাকা দিয়ে সাবস্ক্রিপশন নিতে হয়। তবে সেটি এড়ানোরও কৌশল আছে। উদাহরণ হিসেবে, গুগল-এ গিয়ে “site: importgenius.com busan coal,” লিখে চেষ্টা করুন। সাবস্ক্রিপশন থাকলে যত তথ্য পেতেন, এটি হয়তো আপনাকে তা দেবে না, কিন্তু এমন কিছু মৌলিক বিবরণ দেবে, যা কাজে আসবে।
৩. কোডের মাধ্যমে কনটেইনার এবং জাহাজ ট্র্যাকিং
প্রতিটি কনটেইনারের একটি আন্তর্জাতিক শনাক্তকরণ কোড আছে, যাকে বিআইসি কোড বলে। যে কনটেইনারটি সন্ধান করছেন তার BIC কোড জানলে আপনি BIC কোড রেজিস্ট্রারের মাধ্যমে তার মালিককে আবিষ্কার করতে পারেন। কোড ও মালিকের নাম আপনাকে নিয়ে যাবে পরবর্তী ধাপে, যেখানে শিপিং কোম্পানিগুলোর ট্র্যাকিং সার্ভিসের মাধ্যমে আপনি কনটেইনারের ভ্রমণপথটি খুঁজে বের করতে পারবেন।
প্রতিটি জাহাজের একটি অনন্য (ইউনিক) ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশন (আইএমও) নম্বর রয়েছে। Equasis, Global Integrated Shipping System, MarineTraffic, Vessel Tracker, or Ship Tracking. এর মাধ্যমে আইএমও নম্বর ব্যবহার করে জাহাজের প্যাসেজ শনাক্ত করা যায়। Tokyo MOU এশিয়ার জন্য বিশেষভাবে উপযোগী একটি সাইট, কারণ পরিদর্শন ও আটক এবং প্রযুক্তিগত ত্রুটি থেকে শুরু করে শ্রম আইন লঙ্ঘনের মতো কারণে আন্ডার-পারফরমিং হওয়া সব জাহাজের তথ্যও এখানে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
৪. সোশ্যাল মিডিয়া খোঁজ করুন
নাবিক বা জাহাজের কর্মীদের ফেসবুকের মতো নিজস্ব নেটওয়ার্কিং প্ল্যাটফরম আছে, যেমন : Crewtoo ও MyShip, যা তথ্য খুঁজে পাওয়ার জন্য বেশ ভালো জায়গা।
৫. সরবরাহ চেইনের শেষ কোথায় তা দেখতে ভুলবেন না
“এমন অনেক উন্মুক্ত তথ্য রয়েছে যার সৃজনশীল ব্যবহারের মাধ্যমে একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিক একটির পর একটি বিন্দুকে জোড়া দিতে পারেন। তবে সেসব তথ্য অবশ্যই যাচাই করে নেবেন।”
মেন্ডোজা জানান, বাংলাদেশের ট্যানারিগুলোতে বিপজ্জনক কর্মকাণ্ড ও শিশুশ্রম সম্পর্কে স্থানীয়ভাবে অনেক রিপোর্ট করেছে এপি। কিন্তু কোনো প্রতিকার হয়নি। কিন্তু আইএমও নাম্বার ব্যবহার করে বিষাক্ত ট্যানারির পণ্যগুলো ট্র্যাক করতে করতে যথন মাইকেল কোরস, কেট স্পেড এবং কোচের মতো বিখ্যাত ওয়েস্টার্ন ব্রান্ডের নাম চলে এলো, তখন কাজ হলো। এ ধরনের রিপোর্ট ভোক্তাদের মনে দাগ কাটে এবং বড় প্রভাব ফেলে।
‘আপনাকে সরবরাহ চেইন সম্পর্কে চিন্তা করতে হবে একদম ভোক্তা পর্যন্ত,’ মেন্ডোজার পরামর্শ। ‘সরবরাহ চেইনের একেবারে শেষ দেশে এমন কাউকে খুঁজে বের করুন, যিনি অনুসন্ধানে আপনাকে সহযোগিতা করবে, এভাবে আপনার স্টোরি আরো বড় হবে।’
৬. অবৈধ পণ্য কোথায় নামে চিহ্নিত করুন
বেশিরভাগ সাংবাদিক অবৈধ বন্যপ্রাণী চোরাচালান অনুসন্ধানের সময় মূলত নজর রাখেন উৎস দেশে অর্থাৎ যেখান থেকে পাচার হয় সেখানে। কিন্তু ক্রিস্টি মনোযোগ দেন, যারা কেনে অর্থাৎ যেখানে চাহিদা আছে সেই দেশগুলোতে। তার কৌশল হলো উলটো, অর্থাৎ চেইনের শেষে যারা বৈধভাবে অবৈধ পণ্য বিক্রি করেন তাদের সঙ্গে কথা বলা। তিনি বলেন, ‘আমার লক্ষ থাকে চোরাকারবারিরা, নিজের কাজ সম্পর্কে কী বলে, তা জানা।’
তিনি ফিলিপাইনে ধর্মীয় আচারে ব্যবহৃত হাতির দাঁত নিয়ে একটি অনুসন্ধানের উদাহরণ দেন। ফিলিপাইনের কিছু গোষ্ঠীর মধ্যে সান্টো নিনো দে সেবুর (সেবুর পবিত্র শিশু) মূর্তি সংগ্রহের রীতি আছে, যার মাথা ও হাত হাতির দাঁত দিয়ে তৈরি।
ক্রিস্টি জানান, ‘এটি এমন একটি জায়গা, যেখানে নিষিদ্ধ আইভরি বেচাকেনা বৈধ হয়ে উঠেছিল। তাই আমি সান্টো নিনো বিষয়ে পড়ালেখা করে একজন বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠি। এমন মূর্তি সংগ্রহের জন্য যেসব যাজক বিখ্যাত, তাদের সঙ্গে দেখা করতে এই জ্ঞান কাজে আসে।’ এই বিষয়টিতে এত জানাশোনা দেখে, একজন যাজক তাকে হাতির দাঁত যারা খোদাই করেন তাদের একজনের ঠিকানা এবং কীভাবে তা পাচার করে সান্টো নিনোতে আনতে হবে সেই উপায় বাতলে দেন।
৭. সৃষ্টিশীল হন
‘আমরা নিজেদের জিগ্যেস করলাম, যদি এটি কোকেন হতো, আমরা কীভাবে এটি ট্র্যাক করতাম?’ এই প্রশ্নই নকল হাতির দাঁতে জিপিএস ট্র্যাকার ঢুকিয়ে চোরাচালানের সরবরাহ চেইনে প্রবেশের ধারণা দিয়েছিল।
সব চেষ্টা ব্যর্থ করে ৫৩ দিন এবং ৯৫৩ কিলোমিটার ভ্রমণের পরে সেই জিপিএসের সিগন্যালটি অদৃশ্য হয়ে যায়। কিন্তু এই ব্যর্থতাই একটি সাধারণ-সহজ গল্পকে আরো সৃস্টিশীল করে তোলে। ক্রিস্টি বলেন, ‘চোরাকারবারীদের ট্র্যাক করার জন্য আপনি যে কৌশল ব্যবহার করছেন, একসময় তাই একটি গল্প হয়ে উঠতে পারে। তাই কল্পনাশক্তি ব্যবহার করুন।’
৮. ট্র্যাকিং প্ল্যাটফরম এবং ডাটাবেসের সঙ্গে যোগাযোগ করুন
তিনজন সাংবাদিকই মনে করেন, জাহাজ ও মালামাল ট্র্যাকিংয়ের সেরা প্ল্যাটফরমগুলো ব্যবহার করতে টাকা লাগে এবং অনেক নিউজরুমেরই তা সাবস্ক্রাইব করার মতো সামর্থ্য নেই। তার পরও তাদের পরামর্শ, সাংবাদিকরা এই প্ল্যাটফরমগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন এবং বিনা পয়সায় বা ছাড়ে তথ্য দেওয়ার অনুরোধ করতে পারেন।
‘এই প্ল্যাটফরমগুলোর কয়েকটি সাংবাদিকদের প্রতি সহানুভূতিশীল।’ জানান মেন্ডোজা। বলেন, ‘যতদূর দেখেছি তাঁরা খুব আগ্রহী। তাঁরা গর্বিত হন এই ভেবে, যে তাঁদের টুলগুলো এমন নতুন একটি কাজে ব্যবহৃত হতে পারে, এবং তাঁরাও এর সঙ্গে যুক্ত হতে চান।’
সেগনিনি বলেন, ‘এমন অনেক উন্মুক্ত তথ্য পাওয়া যায়, যাকে সৃষ্টিশীলভাবে ব্যবহার করে একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিক বিন্দুগুলিকে জোড়া দিতে পারেন।’ কিন্তু, তিনি সাংবাদিকদের স্মরণ করিয়ে দেন : ‘আপনাকে সেসব তথ্য আগে যাচাই করতে হবে, কারণ তা শতভাগ সঠিক নাও হতে পারে।’
আরো তথ্যের জন্য সরবরাহ চেইন অনুসন্ধান এবং সাগরে জাহাজ ট্র্যাকিং নিয়ে জিআইজেএন রিসোর্স ও জিয়ানিনা সেগনিনির টিপশিট দেখুন।
ইউনিস অউ, গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম নেটওয়ার্ক-এর প্রোগ্রাম সমন্বয়কারী। তিনি এর আগে মালয়েশিয়ার নিউ স্ট্রেইটস টাইমসের জেনারেল বিট রিপোর্টার এবং সিঙ্গাপুরভিত্তিক দ্য স্ট্রেইটস টাইমস-এর মালয়েশিয়া প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছেন।