

ইলাস্ট্রেশন: টোমা সিলিনাতে / ক্রিয়েটিভ কমনস লাইসেন্স
ইমপ্যাক্ট এডিটর: খবরের প্রভাবকে আরো ছড়িয়ে দিতে তৈরি হল যে নতুন পদ
চাওয়াটা সবারই; তা সে পাঠক হোক, অর্থদাতা, সম্পাদক, অথবা রিপোর্টার। সবাই আশায় থাকে, প্রতিবেদন প্রকাশের পর, সমাজে তার একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব থাকবে। কিন্তু অনেক সময়ই সে আশা পূরণ হয় না।
প্রভাবের অবশ্য রকমফের আছে। কেউ সেটা মাপতে পারেন পেজ ভিউ দিয়ে, অথবা দেখতে পারেন কত সময় ধরে পাঠকরা প্রতিবেদন পড়ছেন বা দেখছেন, খবরের কারণে পরিবর্তন আসতে পারে নীতিমালায়, দেখা যায় অভাবে থাকা পরিবারকে নামপরিচয় গোপন রেখে কেউ সহায়তা করছেন, অথবা পাঠকরা টাকা খরচ করে সেই ধরণের রিপোর্ট পড়তে আগ্রহী হচ্ছেন – এমন অনেক কিছু। সংবাদমাধ্যমের ক্ষেত্রে প্রভাব (ইমপ্যাক্ট) পরিমাপ করার কোনো মানদণ্ড এখনো তৈরি হয়নি। একটি সংবাদের প্রভাব বিচারের হাজারো উপায় থাকতে পারে। শেষপর্যন্ত তা নির্ভর করবে সংবাদ প্রতিষ্ঠান, ইস্যু ও ব্যক্তির ভূমিকার ওপরে।
যুক্তরাজ্যের অলাভজনক গণমাধ্যম, দ্য ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম সম্প্রতি একজন সাংবাদিককে দায়িত্ব দিয়েছে, শুধু খবরের প্রভাব তৈরির জন্যে। ইমপ্যাক্ট এডিটর নামের সেই দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন মিরিয়াম ওয়েলস। তিনি তিন বছর আগে প্রোডাকশন এডিটর হিসেবে যোগ দেন ব্যুরোতে। তখন তার কাজ ছিল রিপোর্টারদের নিয়ে প্রতিবেদনের বিষয় ঠিক করা, সোর্স তৈরি এবং সম্পাদনা। প্রতিবেদন নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার চালানোর ভারও ছিল তার কাঁধে। “হয়তো একটু একঘেঁয়ে শোনাবে, কিন্তু আমি সাংবাদিক হতে চেয়েছিলাম পরিবর্তন আনার জন্য,” বলেছেন ওয়েলস। তিনি ব্যুরোতে যোগ দেয়ার কারণ ব্যাখ্যা করেন এভাবে: “প্রথাগত সাংবাদিকতা নিয়ে আমি কিছুটা হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। আপনি যা-ই লেখেন না কেন, তা যত শোরগোলই তৈরি করুক না কেন – সবসময় পরিবর্তন আনতে পারে না।”
.
এখন ইমপ্যাক্ট এডিটর হিসেবে তাঁর প্রধান দায়িত্ব, ব্যুরোর রিপোর্ট যেন পরিবর্তন বয়ে আনে, তা নিশ্চিত করা। তার কাজ, আরো অনেক নিউজরুমের সাংবাদিকতার প্রভাব বাড়াতে ভূমিকা রাখে। কারণ ব্যুরো প্রায়ই অন্যান্য সংবাদ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জোট বেঁধে খবর প্রকাশ করে। সহযোগিতার এই মডেলটিকে তারা বলেন ত্রিমুখী-সহযোগী মডেল। (আদর্শ ত্রিমুখী মডেলে থাকে একটি আন্তর্জাতিক মূলধারার গণমাধ্যম, সংশ্লিষ্ট দেশের একটি জাতীয় গণমাধ্যম এবং একটি বিশেষায়িত মাধ্যম। যেমন, বাণিজ্য বিষয়ক ম্যাগাজিন বা অ্যাকাডেমিক জার্নাল, জানান ওয়েলস।)
“আমরা জানি সাংবাদিকতা নিজে থেকে কোনো পরিবর্তন আনতে পারবে না। কিন্তু সেটি অন্য মানুষের কর্মকাণ্ড বা ঘটনাপ্রবাহের ওপর এমন কার্যকরী প্রভাব রাখতে পারে, যা পরিবর্তন নিয়ে আসে।”- মিরিয়াম ওয়েলস
আফগানিস্তানে মার্কিন বিমান হামলা নিয়ে ব্যুরোর অনুসন্ধানগুলো প্রকাশ হয়েছিল নিউ ইয়র্ক টাইমসে। তারা পারিবারিক সহিংসতা নিয়ে অনুসন্ধানটি করেছিল বিবিসির ভিক্টোরিয়া ডার্বিশায়ার ও লন্ডনের দ্য টাইমসের সাথে। বিশ্বজুড়ে গরুর মাংসের বাণিজ্য অ্যামাজন বনের ওপর কী প্রভাব ফেলছে, তা নিয়ে একটি অনুসন্ধান করেছিল ব্যুরো। সেটি প্রকাশ হয়েছিল গার্ডিয়ানে। কিন্তু রিপোর্টটির প্রভাব ছিল আরো বিস্তৃত। এই অনুসন্ধানের ফলাফল প্রকাশিত হয়েছিল ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল ও ভেটেরিনারি রেকর্ড জার্নালে। সরকারি শুনানিতেও তাদের প্রতিবেদন প্রমাণ হিসেবে হাজির করা হয়। (নিউ ইয়র্ক টাইমসের স্বাস্থ্যসেবা বিষয়ক অনুসন্ধানী সাংবাদিক সারাহ ক্লিফের রিপোর্টও সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে একটি মেডিকেল জার্নালে।)
আমার কাছে পাঠানো প্রথম ইমেইলে ওয়েলস লিখেছিলেন, “আমরা জানি সাংবাদিকতা নিজে থেকে কোনো পরিবর্তন আনতে পারে না। কিন্তু সেটি অন্য মানুষের কর্মকাণ্ড বা ঘটনাপ্রবাহের ওপর এমন কার্যকরী প্রভাব রাখতে পারে, যা পরিবর্তন নিয়ে আসে।”
ব্যুরোর ২০১৭ সালের ইমপ্যাক্ট রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে: “বিভিন্ন প্রতিবেদন দিয়ে যে ধরণের প্রভাব তৈরি করা গেছে, তার মধ্যে আছে: সবার অগোচরে হওয়া অপরাধ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি, পার্লামেন্টে বিতর্ক উস্কে দেওয়া, সমাধানের জন্য চাপ তৈরি, এবং আইনী পরিবর্তন।” নতুন দায়িত্ব পাওয়ার পর, ইমপ্যাক্টের এই সংজ্ঞাকে আরো প্রসারিত করতে চাইছেন ওয়েলস।
তিনি বলেছেন, “আমাদের জন্য সংবাদের প্রভাব মানে, একটি প্রতিবেদন নিয়ে শুধু উচ্চপর্যায়ে আলোচনা-সমালোচনা বা নীতিমালা পরিবর্তন নয়; বরং সাংবাদিকতার সাথে কমিউনিটির গভীর মিথষ্ক্রিয়া। আপনি যে বিষয়ে রিপোর্ট করছেন, তার সঙ্গে জড়িত গোষ্ঠী ও নেটওয়ার্কগুলোকে যদি শক্তিশালী করে তুলতে পারেন, তাহলে সেই সাংবাদিকতা সমাজ ও ইস্যু-সংশ্লিষ্ট কমিউনিটির কাজে লাগবে। নীতিমালায় পরিবর্তন আসা যতটা গুরুত্বপূর্ণ, এটাও ঠিক ততটাই।”
ইমপ্যাক্ট তৈরির জন্য আলাদা পদ সৃষ্টির বিষয়টি নতুন কিছু নয়। তথ্যচিত্র নির্মানের জগতে অনেক বছর ধরেই ইমপ্যাক্ট প্রোডিউসার নামের পদ আছে (২০১৮ নিম্যান ল্যাব প্রেডিকশন-এ উল্লেখ করা হয়েছে)। এই পদে থাকা ব্যক্তির দায়িত্ব হলো প্রকল্প ব্যবস্থাপনা, তহবিল সংগ্রহ ও প্রচার-প্রচারণা। স্পেনের ডেটা সাংবাদিকতার প্রতিষ্ঠান সিভিও-র ব্যবস্থাপনা সম্পাদক একাই কাজ করেন ইমপ্যাক্টের জন্য। তাদের অনুসন্ধান এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সংশ্লিষ্ট কিছু আইন পরিবর্তনের প্রস্তাব নিয়ে তিনি নিজেই ছুটে বেড়িয়েছেন আইনপ্রণেতাদের কার্যালয়ে। কিন্তু সংবাদমাধ্যমে, শুধুই ইমপ্যাক্ট নিয়ে কাজ করবে এমন একটি পাকাপাকি পদ নিয়ে চিন্তাভাবনা এখনো বিকাশমান অবস্থায় রয়েছে। আর সেই ইমপ্যাক্ট এডিটর হিসেবে ওয়েলস তার নতুন ভূমিকা পাঠকদের কাছে তুলে ধরেন এভাবে:
“আমাদের সাংবাদিকতা বাস্তব জীবনে কী প্রভাব ফেলছে, আমার মনোযোগ থাকবে সেদিকে। আমি দেখবো: আমাদের প্রতিবেদন বা রিপোর্টাররা কাঙ্খিত পরিবর্তন আনার জন্য অন্যদের সাথে কীভাবে যোগাযোগ গড়ে তুলছে, তা সে রিপোর্টিং প্রক্রিয়ার শুরুতেই হোক, মধ্যখানে বা রিপোর্ট প্রকাশের পরে। সেই যোগাযোগকে কিভাবে আরো কার্যকর করে তোলা যায়, তার জন্যেও আমি কাজ করব। সাংবাদিকতায় আমাদের সহযোগী এবং অংশীজনদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করব, এবং যখন প্রয়োজন, সাংবাদিকতা ও অ্যাডভোকেসি জগতের মধ্যে সংযোগ-সেতু হিসেবে কাজ করব। শেষপর্যন্ত আমাকে নতুন করে ভাবতে হবে কমিউনিটির সঙ্গে (ব্যুরোর) সম্পর্ক এবং আমাদের গল্প বলার ধরণ নিয়ে। প্রথাগত সাংবাদিকতার মডেল যেখানে মৃত্যুশয্যায়, সেখানে টিকে থাকা এবং বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর স্বার্থে কাজ করার জন্যেই এটি করতে হবে।”
এটা কী এনগেজমেন্ট এডিটর পদের অতিরঞ্জন? এখানে অ্যাক্টিভিস্ট ভূমিকা কি অনেক বেশি হয়ে যাচ্ছে? বিষয়টি তারপরও কি অস্পষ্ট থেকে যাচ্ছে? আবার বলি – বিষয়টি ইমপ্যাক্টের, যা শেষ পর্যন্ত নির্ভর করবে আপনার সংজ্ঞায়নের ওপর।
প্রোডাকশন এডিটর থেকে এই নতুন পদ সৃষ্টি হয়েছে একটি গবেষণার সূত্র ধরে; যেখানে ওয়াটারগেট থেকে শুরু করে ড্রোন যুদ্ধ নিয়ে অনুসন্ধান পর্যন্ত সময়ে, সাংবাদিকতার প্রভাব বিশ্লেষণ করেছেন ব্যুরোর একজন পরিচালক। গবেষণায় এমন একটি পদ তৈরির সুপারিশ করা হয়, যা সামাজিক পরিবর্তন নিয়ে কাজ করা সংগঠন ও রিপোর্টারদের মধ্যে মেলবন্ধন তৈরি করবে, যাতে আরো গভীর প্রভাব সৃষ্টি করা যায়। এই পদ ও তার কর্মকৌশল তৈরিতে সহায়তার জন্য পিয়েরে ওমিডায়ারের লুমিনেট থেকে ৯ লক্ষ ডলার অনুদান পেয়েছিল ব্যুরো।
প্রোডাকশন এডিটরের দায়িত্ব থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে সরে গেছেন ওয়েলস। কিন্তু ইমপ্যাক্ট এডিটরের দৈনন্দিন কাজের ধরণ নিয়ে এখনো চিন্তাভাবনা চলছে। এই পদের কর্মপরিধি নির্ধারণ করার জন্য তিনি কাজ করছেন লিন্ডসে গ্রীন-বার্বারের সঙ্গে, যিনি সেন্টার ফর ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্টিংয়ের জন্য ইমপ্যাক্ট ট্র্যাকার তৈরি করেছেন। ওয়েলস বিষয়টি নিয়ে ব্যুরোর পাঠকদের সঙ্গেও আলোচনা করে যাচ্ছেন। যেমন, ব্যুরোর স্থানীয় সাংবাদিকতা উদ্যোগের মাধ্যমে কিভাবে স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সংগঠিত করা যায়, কীভাবে রিপোর্টিংয়ের মাধ্যমে সমাজে আরো গভীর প্রভাব রাখা যায় – এমন বিষয় নিয়ে তিনি কেস স্টাডি শেয়ার করছেন তাদের সাথে।
ওয়েলস বলেন, “বর্তমানে দাঁড়িয়ে, আমি এমন সম্ভাবনাও দেখতে পাই যেখানে প্রতিটি অনুসন্ধানের জন্য একজন করে কমিউনিটি সংগঠক রাখা হয়েছে।”
লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয় নিম্যান ল্যাব-এ। অনুমতি নিয়ে এখানে পুনঃপ্রকাশ করা হলো। দ্য ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম, জিআইজেএন-এর সদস্য সংগঠন।
ক্রিস্টিন স্মিট কাজ করছেন নিম্যান ল্যাবের স্টাফ রাইটার হিসেবে। ২০১৭ সালে তিনি ছিলেন এর গুগল ল্যাব ফেলো। এর আগে তিনি কাজ করেছেন ডালাস মর্নিং নিউজ, লস অ্যাঞ্জেলেসের এনবিসি৪, হার্টফোর্ড কোরান্ট এবং অল্প সময়ের জন্য স্ন্যাপচ্যাট-এ।