প্রবেশগম্যতা সেটিংস

অনুসন্ধানী সংবাদমাধ্যম কিভাবে অর্থনৈতিকভাবে টিকে থাকতে পারে, তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে জিআইজেএন ওয়েবিনারে। ছবি: পিক্সাবে

লেখাপত্র

ভাইরাসের বছরে টিকে থাকতে যেমন পরিকল্পনা দরকার ছোট ও স্বাধীন গণমাধ্যমের

English

অনুসন্ধানী সংবাদমাধ্যম কিভাবে অর্থনৈতিকভাবে টিকে থাকতে পারে, তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে জিআইজেএন ওয়েবিনারে। ছবি: পিক্সাবে

করোনাভাইরাস মহামারির শুরু থেকেই, গণমাধ্যমের বন্ধুরা মনোযোগ দিয়েছেন খবর সংগ্রহ, ডেটা বিশ্লেষণ, বা ভুয়া খবর যাচাইয়ে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেরই নজর ছিল সাধারণ মানুষ ও তার কর্মীদের তাৎক্ষণিক প্রয়োজন মেটানোর দিকে।

জিআইজেএন রিসোর্স সেন্টারে দেখুন কোভিড-১৯ কাভারের গাইড ও রিসোর্স।

কিন্তু তারা দ্রুতই বুঝতে পারেন, দিন যত যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানকে দীর্ঘমেয়াদে টিকিয়ে রাখার ঝুঁকিও ততই বাড়ছে। এই টিকে থাকার ঝুঁকি মাথায় রেখে মিডিয়া ডেভেলপমেন্ট ইনভেস্টমেন্ট ফান্ডের প্রধান নির্বাহী হারলান ম্যান্ডেল তিনটি কৌশল বাতলে দিয়েছেন গণমাধ্যম নির্বাহীদের: নগদ অর্থ জমানো, কনটেন্টে মনোযোগ এবং কর্মীদের যত্ন। যে চিঠিতে তিনি এসব পরামর্শ দিয়েছেন, সেটি না পড়ে থাকলে পড়ে ফেলুন এখনই।

সংবাদমাধ্যম, বিশেষভাবে ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোর সামনে প্রশ্ন এখন একটাই: সুনির্দিষ্ট কোন কোন পদক্ষেপ নিলে এই তিনটি লক্ষ্য তারা অর্জন করতে পারবে। কোথায় খরচ করতে হবে আর কোথায় কমাতে হবে? কঠোর সিদ্ধান্তগুলো কখন নিতে হবে? কঠিন এই প্রশ্নগুলো উঠে এসেছে আর্থিকভাবে টিকে থাকার কৌশল নিয়ে জিআইজেএন আয়োজিত ওয়েবিনারে। আলোচনায় আমার সঙ্গে ছিলেন অভিজ্ঞ ফান্ড রেইজিং পরামর্শক ব্রিজিট গ্যালাঘার এবং মিডিয়া স্টার্ট-আপ সেন্টার স্প্লাইস মিডিয়ার অ্যালান সুন।

.

এই প্রশ্নগুলোর উত্তর সংবাদমাধ্যম ও বাজারের ধরণভেদে আলাদা হতে পারে। তাই, আমি এখানে সাধারণ ক্যাশ ফ্লো (নগদ অর্থপ্রবাহ) কাঠামো নিয়ে কথা বলেছি, আর এমন কিছু বিষয় তুলে ধরেছি যা আপনাকে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করবে।

লক্ষ্য ও কাজের সংস্কৃতি

যে কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মতোই গণমাধ্যমের সংকটকালীন পরিকল্পনাও শুরু হওয়া উচিত প্রাতিষ্ঠানিক লক্ষ্য ও কাজের সংস্কৃতি থেকে। বিশেষ করে অলাভজনক গণমাধ্যমের ক্ষেত্রে পরিচালনা পর্ষদ এবং কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে সংকট মোকাবিলার একটি অভিন্ন দর্শনকে সামনে রেখে এগুতে হবে। বিপদে আপনার কর্মীর পাশে কিভাবে দাঁড়াবেন, দাতা ও পরিচালনা পর্ষদের সাথে যে কোনো প্রয়োজনে কিভাবে যোগাযোগ করবেন, আপনাকে যারা পণ্য বা সেবা সরবরাহ করে অথবা যারা আপনার পণ্য কেনেন তাদের ব্যবস্থাপনা কেমন হবে? দীর্ঘমেয়াদে প্রতিষ্ঠানকে টিকিয়ে রাখা এবং কর্মীদের নিরাপত্তা ও উৎপাদনশীলতা ধরে রাখা – এই দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য রাখতে গিয়ে কোন ধরণের সিদ্ধান্তকে তারা অগ্রাধিকার দেবেন? এসব প্রশ্নের উত্তর আপনার সংকটকালীন পরিকল্পনায় রাখতে হবে। কখনো কখনো সাংবাদিকতার মূল মিশন চালিয়ে যাওয়ার জন্য কোনো একটি কর্মসূচি বা প্রতিষ্ঠান গুটিয়ে ফেলে, আপনার সম্পদ নিয়ে বড় কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জোট বাঁধা বেশি কার্যকর হতে পারে।

ক্যাশ-ফ্লো ব্যবস্থাপনা

বেশিরভাগ সংবাদমাধ্যমই ইনকাম স্টেটমেন্ট ও ব্যালান্স শিটের সঙ্গে পরিচিত। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি কাজে আসবে ক্যাশ ফ্লো স্টেটমেন্ট। অর্থ্যাৎ, কত টাকা কোথা থেকে আসছে, এবং কত টাকা কোথায় যাচ্ছে, তার বিবরণী। এটি দেখে আপনি সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন, সংগঠনের লক্ষ্য অনুযায়ী কাজ চালিয়ে যেতে কেমন পরিকল্পনা দরকার। একটি সহজ মাসিক ক্যাশ ফ্লো বিবরণী ধরে এখন আমরা দেখার চেষ্টা করবো সংটককালীন পরিকল্পনায় কোন কোন বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে। এরকম একটি বিবরণীতে মোটাদাগে তিনটি বিষয় থাকে: মাসের শুরুতে আপনার হাতে নগদ কত টাকা আছে, রাজস্ব আয় হিসেবে মাসে কত টাকা আসছে, এবং সেখান থেকে খরচ বাদ দিয়ে মাস শেষে নগদ কত থাকছে। বেশিরভাগ অলাভজনক সংবাদমাধ্যম টাকা পায় অনুদান থেকে। অনুদানের মেয়াদ শেষ হওয়া পর্যন্ত তারা ধীরে ধীরে সেই টাকা খরচ করেন। নগদ আয়ের আরেকটি উৎস বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড। পরিকল্পনার যে রূপরেখা নিচে দেয়া হয়েছে, তার উদ্দেশ্য হলো, আপনি যাতে আগে থেকেই চিন্তা করতে পারেন, মহামারির সময় প্রতি মাসে এই হিসেবগুলো কিভাবে বদলে যাবে এবং নগদ টাকা ফুরিয়ে যাওয়ার সময়টাকে আরেকটু পিছিয়ে দিতে কী কী করতে হবে।

সাধারণ একটি মাসিক ক্যাশ ফ্লো স্টেটমেন্টের নমুনা

 

১. নগদ জমা

অনুদানের ওপর নির্ভরশীল প্রতিষ্ঠানে নগদ জমার বেশিরভাগটাই মূলত অনুদানের খরচ না করা অর্থ। অনুদান দুই ধরনের হতে পারে। প্রাতিষ্ঠানিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য, এবং প্রকল্পভিত্তিক, যা নির্দিষ্ট একটি কাজের জন্যই দেওয়া হয়েছে। ক্যাশ ফ্লো নিয়ে পরিকল্পনার জন্য, আপনাকে স্পষ্টভাবে জেনে নিতে হবে, প্রকল্পের টাকা অন্য কোথাও ব্যবহার করায় নিষেধাজ্ঞা আছে কিনা? দাতাদের অনেকেই ইতিমধ্যে এসব নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নিয়েছে। কিন্তু তারপরও, পরিষ্কার হয়ে নেওয়া ভালো। এমন কোনো নিষেধাজ্ঞা বা সীমাবদ্ধতা যদি থাকে, তাহলে সেই পরিমাণ টাকা আলাদা করে পাশে সরিয়ে রাখুন।

২. অনুদান থেকে আয়

আপনি কি বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে দাতাদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন? করোনাভাইরাস মহামারির সময় মিডিয়াকে সহায়তার ক্ষেত্রে তাদের মনোভাব কী, তা জানতে পেরেছেন? সীমাবদ্ধতা নেই এমন অনুদানের ক্ষেত্রে, আপনাকে এটিও জানতে বা বুঝতে হবে যে, দায়বদ্ধতার জায়গায় কী পরিবর্তন আসবে এবং এখন কোনো জরুরি তহবিল থেকে অনুদানের ব্যবস্থা আছে কিনা। প্রাতিষ্ঠানিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য নেয়া অনুদান কত তারিখ থেকে শুরু হয়েছে, তা-ও নিশ্চিত হয়ে নিন। এই অর্থ যদি কোনো “রিপোর্ট ও মনিটরিং”-এর সাপেক্ষে দেওয়া হয়, তাহলে স্পষ্ট করে নিন, নতুন কোনো ধরণের রিপোর্টিং প্রয়োজন কিনা। আপনি নিশ্চয়ই চাইবেন না এসব কারণে টাকা পেতে দেরি হোক।

৩. বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন থেকে আয় আসে মূলত দু’টি খাত থেকে: সরাসরি এবং বিজ্ঞাপনী নেটওয়ার্ক (যেমন গুগল অ্যাডসেন্স)। দুই ধরনের উৎস নিয়েই আপনার সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা থাকতে হবে।

সরাসরি বিজ্ঞাপন: প্রতিষ্ঠান সরাসরি যেসব বিজ্ঞাপন নেয়, বেশিরভাগ বিজ্ঞাপনদাতা ও এজেন্সি সেগুলোর অর্থ পরিশোধ করে ৯০ দিনে। ফলে এরই মধ্যে আপনি যেসব বিজ্ঞাপন চালিয়েছেন, সেগুলোর জন্যও আপনার অর্থ পাওনা থাকবে। এটা মাথায় রাখুন যে, স্থানীয় বিজ্ঞাপনদাতারাও নগদ অর্থ জমা করা শুরু করবে। এতে আপনার পাওনা পরিশোধের ক্ষেত্রেও তারা বিলম্ব ও দীর্ঘসূত্রিতা তৈরির চেষ্টা করতে পারে। যেসব এজেন্সি বিজ্ঞাপন তৈরি করে বা স্পট কেনে, তাদের ওপরও প্রভাব পড়বে; যা শেষপর্যন্ত আপনার পাওনা আদায়ের ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলবে।

বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞাপনের চাহিদায় ধ্বস নামায়, এখন বিজ্ঞাপন বিপণন দলের সবচে ভালো কর্মপন্থা হবে পাওনা অর্থ সংগ্রহে নামা। সেজন্য এমন কিছু কৌশল ব্যবহার করা যেতে পারে:

১. দ্রুত/অগ্রিম অর্থ পরিশোধে ছাড়ের ব্যবস্থা: অগ্রিম অর্থ পরিশোধ করলে বিজ্ঞাপনদাতা বা এজেন্সিগুলোকে কিছু ছাড় দিন।

২. ফি মওকুফ: যথা সময়ে অর্থ পরিশোধ করলে বিজ্ঞাপন তৈরি বা অন্যান্য কিছু জায়গায় ফি মওকুফ করার অফার দিতে পারেন।  

৩. যৌথ / জোটবদ্ধ উদ্যোগ: প্রায়ই এজেন্সিগুলো তাদের বিজ্ঞাপনদাতা ক্লায়েন্টদের কাছে জিম্মি  হয়ে থাকে। এজেন্সির সাথে জোট বেঁধে পাওনা টাকা দেয়ার কথা বলতে পারেন বিজ্ঞাপনদাতাদের। এজেন্সি বা সংবাদমাধ্যমগুলোর ওপর কী প্রভাব পড়তে পারে, তা বিন্দুমাত্র না ভেবেই অর্থ প্রদানে গড়িমসি করে বেশিরভাগ বিজ্ঞাপনদাতা। এতে কী প্রভাব পড়ে, তা স্পষ্ট করে দিন। 

বিজ্ঞাপনী নেটওয়ার্ক: বেশিরভাগ সংবাদমাধ্যম শুরু করে গুগল অ্যাডসেন্স, ইউটিউব অ্যাড ও ফেসবুক অডিয়েন্স নেটওয়ার্ক দিয়ে। এই বিজ্ঞাপনী প্ল্যাটফর্মগুলো সাধারণত বিজ্ঞাপন চালানোর ৩০ দিনের মধ্যে বকেয়া পরিশোধ করে। রাজস্ব হিসাব চূড়ান্ত হলে, কী পরিমাণ টাকা জমা হয়েছে তা ড্যাশবোর্ডে দেখানো হয়। নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা জমা হলে সেটি নিবন্ধিত ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পরিশোধ করা হয়।

১. টাকা নিয়ে নিন: অনেক ছোট সংবাদমাধ্যম এই বিজ্ঞাপনী নেটওয়ার্কগুলোর ড্যাশবোর্ডে জমা হওয়া টাকাকে “সঞ্চয়ী ব্যাংক” হিসেবে বিবেচনা করে। আপনিও যদি এমনটি করে থাকেন, তাহলে বলবো: এখনই টাকাগুলো আপনার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা করে ফেলুন।

২. অন্য দেশে একাউন্ট: বাজার ছোট বলে অনেক দেশেই নেটওয়ার্ক বিজ্ঞাপনের কর্মকাণ্ড থাকে না। ফলে কৌশল হিসেবে অনেক প্রতিষ্ঠানই নেটওয়ার্ক-অ্যাডের বাজার আছে এমন দেশের পরিচয় দিয়ে একাউন্ট খুলে থাকেন। এমন পরিস্থিতিতেও আপনার বাইরের একাউন্টে যত টাকা জমা হয়েছে, তা যেভাবেই হোক প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে নিয়ে আসুন।

বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞাপনের চাহিদায় ধ্বস নামায়, এখন বিজ্ঞাপন বিপণন দলের সবচে ভালো কর্মপন্থা হবে পাওনা অর্থ সংগ্রহে নামা।

অন্যান্য বিজ্ঞাপন: বকেয়া আদায়ে আপনি যে উদ্যোগই নেন না কেন, তার সাফল্য নির্ভর করবে টাকা আদায় করতে কত সময় লাগবে, সেখান থেকে কত টাকা আসবে এবং সেই টাকা আদায়ে সেলস কর্মীদের প্রতি আপনার দায়বদ্ধতা কতটুকু – এই তিনটি বিষয়ের ভারসাম্যের ওপর। বিজ্ঞাপনের পাওনা অর্থের পেছনে ছোটা অনেক সময়সাপেক্ষ ও প্রায়ই হতাশাজনক। অর্থের পরিমাণ, বিজ্ঞাপনদাতা বা এজেন্সির গুরুত্ব ও আদায়ের সক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে পাওনা টাকার গুরুত্ব নির্ধারণ করুন। কী পরিমাণ অর্থ পাওনা আছে এবং সেগুলো পাওয়ার জন্য আপনার কী পরিমাণ সময় ও অর্থ খরচ হবে, তার মধ্যে ভারসাম্য করতে হবে।

সেলস বিভাগের কর্মীদের প্রতি প্রতিষ্ঠানের দায়বদ্ধতাকে গুরুত্ব দিতে হবে সবার ওপরে। বিশেষজ্ঞরা এখনই আভাস দিচ্ছেন, বিজ্ঞাপনের বাজারে বড় ধরনের ধস নামবে, কারণ যাদের জন্য বিজ্ঞাপন, সেই দর্শক-পাঠকরা এখন ঘরে বন্দী। এর ফলে বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর তৈরি পণ্য বেচাকেনা যেমন কমছে, তেমনি কমছে বিজ্ঞাপনও। কিন্তু একই সময় বিজ্ঞাপন আনার পেছনে আপনার প্রতিষ্ঠানের যে খরচ তা আগের মতই রয়ে গেছে। প্রশ্ন হলো, আয় ও ব্যয়ের এই অসমতা আপনি কত দিন টেনে যাবেন?

৪. মেম্বারশিপ/সাবস্ক্রিপশন থেকে আয়

করোনাভাইরাস সংকটে, অনেক সংবাদমাধ্যমই তাদের সাবস্ক্রিপশন প্রোগ্রামগুলো পুরোপুরি বা আংশিক উন্মুক্ত করে দিয়েছে। যেন তাদের সব, অথবা করোনাভাইরাস সম্পর্কিত প্রতিবেদনগুলো পাঠকরা বিনামূল্যে পড়তে পারেন।

মেম্বারশিপ থেকে আয়ের ওপর যেসব প্রতিষ্ঠান নির্ভর করে, তারা এখন পাঠকের সাথে বেশি করে যুক্ত হচ্ছেন, যেন মহামারির খবর সংগ্রহে তারা আরো বেশি সাহায্য করেন বা অন্তত আগের মতই সাহায্য চালিয়ে যান। এই মহামারির শুরুতে, মেম্বারশিপ প্রোগ্রাম থেকে আয় বেড়ে গিয়েছিল অনেক সংবাদমাধ্যমের। এখান থেকে বোঝা যায়, পাঠকরা সাহায্য করতে আগ্রহী। তখনো অন্যান্য জায়গা থেকে সাহায্যের আহ্বান ততটা দেখা যাচ্ছিল না। কিন্তু মাথায় রাখুন, যত দিন যাবে, দাতব্য বা ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে মানবিক সাহায্যের আবেদনও ততই বাড়তে থাকবে। জনস্বার্থে সাধারণ মানুষও দাতব্য প্রতিষ্ঠানগুলোর সাহায্যে এগিয়ে আসবে। এর অর্থ হচ্ছে, সামনে সংবাদমাধ্যমের মেম্বারশিপ এনগেজমেন্ট ও আয়, দুটোই কমতে পারে।

মেম্বারশিপ থেকে আয়ের ওপর নির্ভরশীল প্রতিষ্ঠানগুলো এখন পাঠকের সাথে বেশি করে যুক্ত হচ্ছে, যেন মহামারির খবর সংগ্রহে তারা আরো বেশি সাহায্য করেন বা অন্তত আগের মতই সাহায্য চালিয়ে যান।

মেম্বারশিপ: করোনাভাইরাসের এই সংকটেও সদস্য নিবন্ধন ও সেখান থেকে আয় বাড়তে পারে। আপনার যদি কয়েক ধাপের মেম্বারশিপ ব্যবস্থা থাকে, যেখানে শুরুতে বিনামূল্যে রেজিস্ট্রেশন করে, পরবর্তীতে অর্থের বিনিময়ে মেম্বারশিপ নিতে পারবে; তাহলে এখন মোক্ষম সময় সাইটে নিবন্ধন করা ব্যবহারকারীদের সদস্যে পরিণত করে ফেলার। এই সংকটপূর্ণ সময়ে সবচে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হবে, পাঠকদের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ। একটি স্বচ্ছ ও নিয়মিত যোগাযোগ-পদ্ধতি গড়ে তুলতে পারলে সদস্য সংখ্যা ক্রমাগত বাড়িয়ে নিতে পারবেন। অনেক নিবন্ধিত ব্যবহারকারী টাকা দিয়ে সদস্য হবে, যা আপনার মোট আয় বাড়িয়ে দেবে।

সাবস্ক্রিপশন: সাবস্ক্রিপশন পেওয়াল থেকে আয় ধরে রাখবেন, নাকি কঠিন সময়ে সাংবাদিকতাকে সবার কাছে পৌঁছে দিতে টাকা দিয়ে রিপোর্ট পড়ার বাধ্যবাধকতা উঠিয়ে দেবেন – এই দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য রেখে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আপনাকে নিজ দেশের পরিস্থিতি এবং আপনার প্রতিষ্ঠানের নীতিমালা বিচার করতে হবে। যেহেতু আপনার কনটেন্ট সবার জন্যই বিনামূল্যে উন্মুক্ত করে দিচ্ছেন, ফলে এরই মধ্যে যারা সাবস্ক্রাইবার আছেন, তাদের সাবস্ক্রিপশনের মেয়াদ সমপরিমাণ সময় বাড়িয়ে দেওয়াই হচ্ছে সাধারণ নিয়ম। এই পরিস্থিতিতে এই বিষয়গুলো বিবেচনা করতে পারেন:

১. করোনাভাইরাসের কাভারেজ বিনামূল্যে উন্মুক্ত করে দেওয়া: এমনটা করলে সাবস্ক্রাইবারদের মেয়াদের সময়সীমা একই থাকবে। ফলে মেয়াদ নবায়ন ও নতুন নিবন্ধন; দুই জায়গা থেকেই অর্থপ্রাপ্তির সুযোগ থাকবে।

২. সাবস্ক্রাইবারদের সদস্যে পরিণত করুন: অর্থের বাধ্যবাধকতা তুলে দেওয়া হলে, সাবস্ক্রাইবারদের এই নতুন পরিবর্তন সম্পর্কে অবহিত করুন এবং তাদের অনুরোধ করুন এসময়ের এই সাবস্ক্রিপশনের অর্থ দান করতে। এর ফলে আপনার সংবাদ প্রতিষ্ঠান প্রত্যাশা অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ে সবার সাবস্ক্রিপশন নবায়ন করাতে পারবে।

৫. বিভিন্ন সেবা থেকে আয়

প্রশিক্ষণ, সম্পাদকীয় গবেষণা, ডেটা বিশ্লেষণ ইত্যাদি কর্মকাণ্ড থেকে আসা আয়ও আর্থিকভাবে বিজ্ঞাপনী আয়ের মতোই। যেসব ছোট সংবাদমাধ্যম এজাতীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে, তাদের বেশিরভাগই টাকা পায় কাজটি শেষ হওয়ার পর (বিজ্ঞাপনের মতোই), অথবা কিছু অর্থ পরিশোধ করা হয় কাজটি শুরুর জন্য অথবা প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে, জায়গাটি ধরে রাখার জন্য।

যেসব কাজ শেষ করার পর টাকা পাবেন, সেখানে কাজের ক্ষেত্রে ওপরে বিজ্ঞাপনের জন্য যেসব বিবেচনার কথা বলা হয়েছে, বিশেষভাবে টাকা সংগ্রহ নিয়ে, সেগুলো সবই প্রযোজ্য হবে। যেসব কাজের জন্য আগেই টাকা দিয়ে দেওয়া হয়েছে বা পর্যায়ক্রমে কাজের ভিত্তিতে দেওয়া হবে; সেসব কাজের ক্ষেত্রে প্রথমেই বিবেচনা করতে হবে, কাজটি নতুন পরিস্থিতিতে করা সম্ভব কিনা। যদি করা সম্ভব হয়, তাহলে আবারো বলব পাওনা টাকাগুলো সংগ্রহ করে ফেলার কথা। আর যদি সেই কাজটি আপনি না করেন, তাহলে টাকা দ্রুত ফিরিয়ে দেওয়া উচিৎ হবে। কারণ যে সংগঠনের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন, তারাও হয়তো এখন ক্যাশ ফ্লো নিয়ে একই ধরনের পরিস্থিতিতে আছে।

৬. খরচে লাগাম

বেশিরভাগ অলাভজনক সংবাদ প্রতিষ্ঠানের জন্য, প্রধান খরচের জায়গা হয় কর্মীদের বেতন ও ফ্রিল্যান্সারদের কমিশন। এর বাইরে বেশিরভাগ খরচই ছোট ধরনের এবং বন্ধ রাখা যায়। তারতম্য হতে পারে, এমন খরচ; যেমন ওয়েব হোস্টিং বা রিপোর্টিংয়ের যাতায়াত ইত্যাদি খরচগুলো খুব সাবধানে সামলাতে হবে। রিপোর্টিং মিশন ক্ষতিগ্রস্থ না করে যতটা সম্ভব নগদ অর্থ জমা রাখতে হবে। যেমন, অনেক বড় জায়গাজুড়ে রিপোর্টিং করে, এমন সংবাদমাধ্যম কিছু সময়ের জন্য রিপোর্টিং যাতায়াত খরচ দেওয়া বন্ধ করেছে। এটি প্রধানত করা হয়েছে কর্মীদের বাড়ি থেকে কাজ করতে উৎসাহিত করার জন্য।

কিভাবে আপনি এই অর্থ ব্যবস্থাপনা করবেন এবং আপনার দলের (নিজস্ব ও ফ্রিল্যান্স কর্মী) পাশে দাঁড়াবেন; এটিই দীর্ঘমেয়াদে ঠিক করে দেবে আপনার সংবাদ প্রতিষ্ঠান টিকে থাকতে পারবে কিনা।

ব্যয় সংক্রান্ত সিদ্ধান্তগুলো নেওয়ার ক্ষেত্রে একটি বড় জায়গাজুড়ে থাকবে এই চিন্তা: কাদেরকে আগে দেওয়া দরকার, কতখানি দেওয়া দরকার এবং কখন দেওয়া দরকার। ওয়েব হোস্টিং বা কর্মীদের বেতন সব কিছু গতিশীল রাখার ক্ষেত্রে জরুরি। কিন্তু অফিস ব্যবস্থাপনার কিছু বিষয়ে আপনি বিলম্ব করতে পারেন। আপনি কাকে আগে অর্থ পরিশোধ করবেন, তা নির্ধারন করতে পারেন। ফোন বা বিদ্যুৎ বিলের মতো বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর আগে ছোট ব্যবসায়ীদের পাওনা পরিশোধ করে দিতে পারেন। খরচের গুরুত্ব নির্ধারণ করতে পারলে আপনি তার ভিত্তিতে ধাপে ধাপে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। আপনার কিছু বড় আকারের ব্যয় হয়তো ক্রেডিট কার্ড বা ব্যাংকের মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে হয়ে থাকে। এ ব্যাপার সতর্ক থাকুন। যদি এই ব্যয় অনেক বড় আকারের হয় তাহলে আপনি হয়তো এটি নিজের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার কথা বিবেচনা করতে পারেন। এতে করে আপনি সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন যে কোনটা একটু দেরিতে পরিশোধ করা যাবে বা আংশিক পরিশোধ করা যাবে।

কর্মীদের বেতন ও ফ্রিল্যান্স কমিশন: নগদ অর্থ ও রিসোর্সের পরিমাণ সঙ্কুচিত হতে থাকায় আপনার সংবাদ প্রতিষ্ঠানকে কর্মীদের বেতন ও ফ্রিল্যান্সারদের কমিশনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বড় অঙ্কের নগদ অর্থ হাতে আছে, এমন অলাভজনক মিডিয়া কোম্পানি হয়তো এই সংকটকালে স্বল্পমেয়াদে কোনো চাপ অনুভব নাও করতে পারে। কিন্তু বিজ্ঞাপনী আয়ের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল, এমন বাণিজ্যিক সংবাদ প্রতিষ্ঠান এরই মধ্যে এই চাপ অনুভব করছে। যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়ার সংবাদপত্রগুলো কর্মীদের বিনাবেতনে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠিয়ে দিচ্ছে। নির্বাহীদের বেতন কমিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছে বাজফিড এবং অস্ট্রেলিয়ায় অন্তত দুটি ছোট কমিউনিটি সংবাদপত্র তাদের কর্মকাণ্ড বন্ধ ঘোষণা করেছে।

অনেক ছোট অলাভজনক সংবাদ প্রতিষ্ঠান ব্যাপকভাবে নির্ভর করে ফ্রিল্যান্স প্রদায়ক ও প্রশিক্ষকদের ওপর। এই স্বাধীন কর্মীরা এখন আর্থিক ঝুঁকির মুখে থাকবেন। কোনো কনটেন্ট বা প্রশিক্ষণের কাজ শেষ হওয়ার পর কত দ্রুত তাদের পাওনা পরিশোধ করা যায়, সে ব্যাপারে আপনাকে পরিকল্পনা করতে হবে। নিজস্ব কর্মী ও ফ্রিল্যান্স প্রদায়কদের নিয়ে গড়া দলটির ব্যবস্থাপনা কিভাবে করবেন, তা দীর্ঘমেয়াদে একটি সমস্যা হয়ে উঠবে। কারণ মহামারির স্থায়িত্ব যত বাড়বে, নগদ টাকার ঘাটতিও ততই তীব্র হতে থাকবে। কিভাবে আপনি এই অর্থ ব্যবস্থাপনা করবেন এবং আপনার দলের (নিজস্ব ও ফ্রিল্যান্স কর্মী) পাশে দাঁড়াবেন; এটিই দীর্ঘমেয়াদে ঠিক করে দেবে আপনার সংবাদ প্রতিষ্ঠান টিকে থাকতে পারবে কিনা।

এখনকার পরিস্থিতি বেশ হতাশাজনক। করোনাভাইরাস মহামারি এখন পর্যন্ত কেবল অল্প কয়েকটি দেশ ও অঞ্চলে প্রভাব ফেলেছে। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, এই সংকট আরো বেশ কয়েক মাস থাকবে। এসময় মিশন ঠিক রেখে হাতে থাকা রিসোর্সগুলো (অর্থ ও মানুষ) আপনি কিভাবে ব্যবস্থাপনা করছেন, তার ওপরই নির্ভর করছে আপনার প্রতিষ্ঠানের দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকা। ক্যাশ ফ্লো স্টেটমেন্ট সামনে থাকলে আপনি বুঝতে পারবেন কোন জায়গায় সমস্যা আছে এবং সামনে কোথায় সমস্যা আসতে যাচ্ছে। এরকম পরিবেশে নিয়ম হচ্ছে: কোনো কিছু নিয়ে সংশয়ে পড়লে, আগে সঞ্চয় করুন, দেরিতে খরচ করুন।

করোনাভাইরাসে আর্থিকভাবে টিকে থাকা নিয়ে আরো পড়তে পারেন:

কোভিড-১৯: বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকদের জন্য যতরকম অর্থ সহায়তা

লোকসান কমিয়ে গণমাধ্যমের ব্যবসাকে টিকিয়ে রাখবেন যেভাবে

জিআইজেএন রিসোর্স

 

রস সেটলস হংকং ইউনিভার্সিটির জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজের অধ্যাপক। তিনি বিশেষভাবে শেখান ডিজিটাল মিডিয়া ও উদ্যোক্তা হওয়া নিয়ে। যুক্তরাষ্ট্র ও পূর্ব এশিয়া ও লাতিন আমেরিকাতে প্রায় তিন দশক ধরে  কাজ করেছেন মিডিয়া কোম্পানিগুলোর স্ট্র্যাটেজি, মার্কেটিং ও প্রোডাক্ট উন্নয়ন নিয়ে।

লেখাটি পুনঃপ্রকাশ করুন


Material from GIJN’s website is generally available for republication under a Creative Commons Attribution-NonCommercial 4.0 International license. Images usually are published under a different license, so we advise you to use alternatives or contact us regarding permission. Here are our full terms for republication. You must credit the author, link to the original story, and name GIJN as the first publisher. For any queries or to send us a courtesy republication note, write to hello@gijn.org.

পরবর্তী

প্রতিবেদন প্রকাশ বণ্টন ও প্রচার

সাংবাদিকতায় আস্থা ধরে রাখতে ভ্রাম্যমান অনুসন্ধানী বার্তাকক্ষ কীভাবে কাজ করছে

অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে ভ্রাম্যমান অনুসন্ধানী বার্তাকক্ষ। উত্তর মেসিডোনিয়ায় এমন একটি বার্তাকক্ষ স্থানীয় বাসিন্দাদের আস্থা অর্জন করেছে। তাঁরাই বার্তাকক্ষে ছুটে যাচ্ছেন সাক্ষ্যপ্রমাণ নিয়ে। সম্পৃক্ত হচ্ছেন নিজেরাও।

Toxic Waste Pollution Factory Bank

পরিবেশ ধ্বংসের পেছনে বিনিয়োগ করছে কারা-বিনিয়োগকারীদের খোঁজ করবেন যেভাবে : দ্বিতীয় পর্ব

ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে পরিবেশের ক্ষতি করছে বা দূষণে ভূমিকা রাখছে—সরকারের পক্ষ থেকে এ ধরনের এমন অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক সহায়তা বা প্রণোদনা দেওয়া হয়ে থাকে। লক্ষ্য, নিজ দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা ও যেসব দেশে তাঁরা বিনিয়োগ করছে সেসব দেশের টেকসই উন্নয়ন। অনেক সময় খনিজ উত্তোলন ও বন উজাড় করার কাজেও বিনিয়োগ করে থাকে তারা। আর প্রচারণা চালায় উন্নয়ন বিনিয়োগ বলে। এই নিবন্ধটি পরিবেশ বিষয়ক সাংবাদিকদের জন্য অবশ্যপাঠ্য।

জিআইজেসি২৫ ওয়েবসাইট এবং গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম কনফারেন্সের তারিখ ঘোষণা করেছে জিআইজেএন

অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার বৃহত্তম আসর বসছে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে। সম্মেলনের তারিখসহ, অংশগ্রহণের খুঁটিনাটি থাকল এই প্রতিবেদনে। এবারই প্রথম এই সম্মেলন এশিয়ায় অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। আর জিআইজেএন এ যাত্রায় সঙ্গে পেয়েছে মালয়েশিয়ার স্বাধীন সংবাদপত্র মালয়েশিয়াকিনিকে।

অনুসন্ধান পদ্ধতি

আবাসন খাত নিয়ে মেক্সিকোর পুরস্কারজয়ী প্রতিবেদন : যা শিখতে পারি

পানির মতো মৌলিক পরিষেবার সংকট থেকে মেক্সিকোর সিটির দক্ষিণে সান সেবাস্তিয়ান জোকোর মানুষ আবাসন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এককাট্টা হন। আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলো আসলে এই এলাকায় কী সঙ্কট সৃষ্টি করেছিল, তা অনুসন্ধানের পদ্ধতি সম্পর্কে জানা যাবে এই নিবন্ধে।