আপনার অনুসন্ধানী প্রতিবেদন কখন পাঠকপ্রিয় হবে?
অনেক বড় বড় অনুসন্ধান শেষ পর্যন্ত কাঠখোট্টা প্রতিবেদনে পরিণত হয়। এই সব গল্প কখনো পাঠকের বিরক্তির কারণ হয়; আবার কখনো তা বুঝাই অসম্ভব হয়ে দাড়ায়। দুঃখজনকভাবে, এই সব প্রতিবেদনে প্রতিক্রিয়া হয় নেহাত সামান্য অথবা একেবোরেই শূন্য। ফলে মাসের পর মাস ধরে অনুসন্ধানের যে কষ্ট, তা একরকম বৃথা হয়ে দাঁড়ায়।
আপনার গল্পটি পাঠযোগ্য কিনা, সেটি ধরা মোটেও কঠিন কাজ নয় — যদি আপনার নানী-দাদীর বয়সীরা এটি বুঝতে না পারে তবে ধরে নেবেন আপনি ব্যর্থ হয়েছেন। মনে রাখবেন, বিষয়বস্তুর জটিলতা কোন অজুহাত নয়। পাঠক আপনার লেখা বুঝতে পারছে না অথবা লেখাকে গুরুত্ব দিচ্ছে না, এটা তার দোষ নয়। প্রতিবেদনকে বোধগম্য করা লেখকের (এবং সম্পাদকের!) দায়। এজন্য একমাত্র সমধান ভালো এবং পাঠককে টানে এমন গল্প-লিখন। তাই গল্পটা এমনভাবে বলুন, যেন জটিল বিষয়ও হয়ে ওঠে সহজবোধ্য, যাতে স্পর্শ করা যায় পাঠকের অনুভূতিকে।
সম্প্রতি ইউক্রেইনের কিয়েভে হয়ে যাওয়া অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা উৎসব – মেঝাইরিয়াফেস্টে অনুসন্ধানী গল্প-লিখন বা স্টোরিটেলিংয়ের কিছু কৌশল বাতলে দিয়েছেন অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন রিপোর্টিং প্রজেক্ট ওসিসিআরপি’র ইলিয়াস লোজভস্কি। তার সেরা ১২টি টিপস এখানে দেওয়া হল:
১. এক বাক্যের মধ্যে আপনার গল্প ব্যাখ্যা করুন
লেখার শুরুর আগেই আপনাকে ঠিক করতে হবে প্রতিবেদনটি কী। আপনি যদি একটি মাত্র বাক্যে এটি প্রকাশ করতে না পারেন, তাহলে সম্ভবত আপনি লিখার জন্য পুরোপুরি তৈরি নন। একটু পিছু ফিরে দেখুন। হয়তো আরো রিপোর্টিং দরকার। নিজেকে জিজ্ঞাসা করুন: ঘটনাটি কেন ঘটেছে? আইনী, সামাজিক বা রাজনৈতিক পরিবেশে এমন কী পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, যে কারণে ঘটনাটি ঘটলো? কারা, কিভাবে – এর সাথে জড়িত?
২. দরকারি তথ্যগুলো আগেই বাছাই করুন
আপনি হয়তো গবেষণা করে হাজার হাজার তথ্য খুঁজে বের করেছেন। তাই বলে সবকিছু পাঠকের সামনে ছুঁড়ে দিতে পারেন না। যখন আমরা বন্ধুদের কোন গল্প বলি, যা ঘটেছে, অক্ষরে অক্ষরে বলা শুরু করি না। আগে আমরা সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক অংশ বাছাই করি, সেটাকে গুছিয়ে বলি এবং তার অর্থও তুলে ধরি। গল্পলিখনের ক্ষেত্রেও অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, সিলেক্টিভ হওয়া — প্রতিবেদনে ব্যবহার করা প্রতিটি তথ্যের পেছনে কোনও কারণ থাকতে হবে এবং পাঠক বা দর্শকের কাছে সেই কারণটি ব্যাখ্যা করতে হবে। আপনি যত তথ্য পেয়েছেন তার ৯৫ শতাংশও যদি ব্যবহার না করা যায়, ক্ষতি নেই।
সবসময় ভাবুন পাঠকের দৃষ্টিকোণ থেকে: এই বাক্যটি কি গল্পটিকে আরও ভালভাবে বুঝতে সাহায্য করছে? এটা গল্পকে আরো উন্নত করছে? একইসাথে, একটি অনুচ্ছেদে নাম ও সংখ্যার ব্যবহার দুটিতে সীমাবদ্ধ রাখার চেষ্টা করুন, তার বেশি দিলে পাঠক বিভ্রান্ত হবে।
৩. ঠিক করুন গল্পটিকে কীভাবে সাজাবেন
পাঠকের কাছে তাৎপর্য আছে এমন প্রাসঙ্গিক ঘটনার একদম বাছাই করা কিছু সিকোয়েন্সের সমষ্টি হলো একটি গল্প। সব গল্পের একটি শুরু, মধ্য এবং শেষ থাকা উচিত।
আপনি যদি ভাগ্যবান হন, তবে গল্পটি স্পষ্ট হয়ে উঠবে। মনে হবে গল্পটি নিজেই নিজেকে লিখছে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা হয় না। আপনার কাছে অনেক তথ্য আছে, কিন্তু শুধু তথ্য সাজিয়ে গল্প হয় না — যদি আপনি এভাবে লিখেন, তাহলে দিন শেষে আপনার প্রতিবেদনটি তথ্যের একটি তালিকা হয়ে দাঁড়াবে। যা অধিকাংশ লোকই কখনও পড়বে না।
কোন জটিল অনুসন্ধানী প্রতিবেদন লেখার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো ক্রোনোলজিক্যালি বা ধারাবাহিকভাবে সাজিয়ে বলা। কিছু গল্প অন্যান্য উপায়ে বলা যেতে পারে, কিন্তু সেটি বিশেষ পরিস্থিতিতে।
৪. গল্পে পাঠকের অনুভূতিকে নাড়া দেয়ার মত কারণ চাই
পাঠককে পড়ে বুঝতে হবে কেন প্রতিবেদনটি তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। অনেক সময় গল্পে সুনির্দিষ্ট ভুক্তভোগী থাকে, আবার অনেক সময় থাকে না। আপনাকে ব্যাখ্যা করতে হবে সেখানে কে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, হয় দেশের নাগরিক নয়তো তার বাজেট ক্ষতির শিকার হয়। কিন্তু ক্ষতি আরো গভীর হতে পারে। হতে পারে দেশের খ্যাতি, গণতান্ত্রিক আদর্শ ও প্রতিষ্ঠান, সমাজের ওপর বিশ্বাস; কোনটি?
যখন এটি হারিয়ে যাওয়া বা চুরি করা অর্থ হয়, তখন আপনাকে সেই সংখ্যাটির তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে হবে। আপনার দাদী জানেন না একট বিলিয়নে মানে ঠিক কত। কারণ তিনি সারাজীবনে তিনি অত টাকা দেখেননি। সেই টাকা দিয়ে কতগুলো হাসপাতাল তৈরি করা যায়, কতজন শিক্ষকের বেতন হয়, সেটা তুলনা করে তাকে বুঝাতে হবে।
৫. গল্পে চরিত্র আনুন এবং তাদের গুরুত্ব দিন
চরিত্র যে কোন মানুষ হতে হবে তা নয় — জায়গা বা জিনিসও চরিত্র হতে পারে! — কিন্তু অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় সাধারণত মানুষই চরিত্র হিসেবে উঠে আসে। মনে রাখবেন, প্রতিটি চরিত্রকে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে এবং গল্পের সাথে তাদের সম্পর্কও ব্যাখ্যা করতে হবে। তারা কে? এবং গল্পে তাদের উপস্থিতি কেন?
“তার দেখা হয় জেমস স্মিথের সাথে” এভাবে না লিখে বরং লিখুন “সেখানে তার দেখা হলো নিউইয়র্কের ব্যাংকার জেমস স্মিথের সাথে।”
৬. প্রথমে মানচিত্র দেখান, তারপর পাঠককে যাত্রাসঙ্গী করুন
সাইনপোস্টই বলে দিবে আপনার গল্প কোন দিকে যাবে। একটি সাধারণ গল্প কিভাবে সাজানো যায় দেখে নিন এখানে:
“লিড” হলো যা গল্পকে প্রতিষ্ঠিত করে এবং পাঠককে তার মধ্যে প্রবেশ করায় “নাট গ্রাফ” পাঠককে দেখায় আপনি কোন পথে যাচ্ছেন। এখানেই পাঠককে বলতে যাচ্ছেন আপনার কী বলার আছে। যে একটি লাইনে আপনার গল্পটিকে ব্যাখ্যা করবেন, সেটি এখানে কাজে আসবে। লিড এবং নাট গ্রাফ থেকেই আপনার গল্প বলা শুরু। বডি বা মধ্যভাগ – এখানে আপনি গল্পটিকে ব্যাখ্যা করবেন। এটি সাধারণত কয়েকটি বিভাগে বিভক্ত হয় যেখানে আপনি আপনার মূল পয়েন্টগুলি তুলে ধরেন এবং আপনার নাট গ্রাফে যে কথা বলেছেন তার সমর্থনে পর্যাপ্ত তথ্য যোগান দেন। শেষভাগে, আপনি পাঠককে তাই বলুন যা এতক্ষণ বলেছেন, তবে সারসংক্ষেপ টেনে।
৭. কোনো চমক নয়!
কোন কোন সাংবাদিক গল্পের দ্বিতীয় ভাগে “চমক” দিতে পছন্দ করেন। এটি “পাঠককে যাত্রাসঙ্গী” করার যে নিয়ম তার লঙ্ঘন। ধরে নিন, বেশিরভাগ পাঠকই ওই (দ্বিতীয় ভাগ) পর্যন্ত পড়বেন না! যখন নতুন নতুন কোন বিষয় নিয়ে আসছেন, তখন আগের বিষয়ের সাথে তাদের সংযোগটি পরিষ্কার হওয়া উচিত। যেমন, যখন কোন ফৌজদারী মামলা নিয়ে বলছেন, পরিস্কার করুন এটি কী আগের ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট, নাকি ভিন্ন একটি মামলা? উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, যদি গল্পের শুরুতে লিখেন কোন ব্যক্তি “ঘুষ নেয়ার দায়ে তিনবার অভিযুক্ত” এবং আপনি পরে কোথাও লিখেন তিনি “ঘুষের জন্য গ্রেপ্তার”, তাহলে পরিস্কার করুন যে ঘটনায় গ্রেপ্তার তা আগে বলা তিনটি অভিযোগের মধ্যে একটি কিনা।
৮. আপনার গল্পকে রঙিন করুন
কোন কিছু দেখতে কেমন; কে কেমন আচরণ করল; গন্ধ, রং এবং শব্দ; এমন সব কিছু সম্পর্কে লিখুন। মানুষ আর জায়গাকে বিবরণ দিয়ে জীবন্ত করে তুলুন। যদিও মনে হতে পারে “বাহুল্য”, কিন্তু এরও একটি উদ্দেশ্য আছে। যদি গল্পই না থাকে তাহলে গল্পলিখন আসলে অর্থহীন।
৯. বিশেষজ্ঞকে নিয়ে আসুন
মন্তব্যের জন্য আপনার গল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট স্বাধীন বিশেষজ্ঞকে খুঁজে বের করুন। কোন জটিল বিষয়কে সহজে ব্যাখ্যার জন্য তিনি সাহায্য করতে পারেন; আপনি যা বলতে পারেন না, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিশেষজ্ঞ তা বলতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ, আর্থিক লেনদেনের একটি জটিল অংশ বর্ণনা করার পরে, যদি কোন বিশেষজ্ঞ ব্যাখ্যা করে বলেন “এটি সম্ভবত একটি ঘুষ,” তাহলে গল্পটি দুর্দান্ত হয়ে ওঠে।
১০. সহজ ভাষা ব্যবহার করুন
ভাসাভাসা কথা না বলে সুনির্দিষ্ট ভাষা ব্যবহার করুন। জারগন বা টেকনিক্যাল শব্দ এড়িয়ে চলুন। ভাববাচ্যে না বলে সরাসরি কথা বলুন। ক্রিয়া এবং বিশেষ্য বেশি এবং বিশেষণ কম ব্যবহার করুন। ক্রিয়াবিশেষন একদম এড়িয়ে চলুন! বৈচিত্র্য: ছোট বাক্যের সঙ্গে লম্বা বাক্য মিশিয়ে ব্যবহার করুন।
১১. গল্পের গতি ঠিক রাখুন, টেক্সট কমাতে সৃজনশীল হোন
চার্ট এবং গ্রাফ ইনফোগ্রাফিকস বক্স সাইডবার
১২. গল্পের শেষ নিয়ে বেশি ভাববেন না
গল্পটি কীভাবে শেষ হবে? বাস্তবতা হল, এটি তত বড় বিষয় নয়, যতটা আপনি মনে করেন। লেখা দীর্ঘ হলে, অধিকাংশ পাঠকই শেষ পর্যন্ত পড়বেন না; আপনার শ্রমের ৮০ ভাগই দেয়া উচিত গল্পের শুরুর ২০ শতাংশের জন্যে। আসলেই তাই! প্রকাশের একঘন্টা আগে যদি গল্পের খসড়া যদি দেয়া হয়, সম্পাদক শুধু লিড আর নাটগ্রাফই মনোযোগ দিয়ে দেখবেন।
এখানে সম্পাদকের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কিছু বোনাস টিপস:
লিখতে বসার আগে একটি বিরতি নিন। সবসময় নতুন চোখ দিয়ে লিখুন। “ইচ্ছেমত লিখুন। ধীর-স্থিরে সম্পাদনা করুন। ” জোরে জোরে পড়ুন – গল্প কোথায় ধাক্কা খাচ্ছে দেখুন- সেই জায়গাগুলো ঠিক করুন। সম্পাদক আপনার বন্ধু। তারা এমন জিনিস দেখবেন, যা আপনার চোখ এড়িয়ে গেছে।
ওলগা সিমানোভিচ জিআইজেএন-র রাশিয়ান ভাষার সম্পাদক। তিনি এসটিবি’র ভিকনা-নভিনিতে চিত্রনাট্যকার, প্রশিক্ষক, ব্যবস্থাপনা সম্পাদক এবং টিভি সংবাদ প্রতিবেদক হিসেবে কাজ করেছেন এবং স্কুপ ম্যাগাজিনের একাধিক আন্তর্জাতিক অনুসন্ধানে অংশ নিয়েছেন। তিনি ইউক্রেনীয়, রাশিয়ান, ইংরেজি এবং গ্রিক ভাষায় পারদর্শী।