অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় জরিপ: যে খবর এড়িয়ে যাওয়া কঠিন
যশোরের একটি গ্রামে একজন দরিদ্র মায়ের সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন গ্রামের কাগজের রিপোর্টার উজ্বল বিশ্বাস। ছবি: গ্রামের কাগজ
আটপৌরে অফিস ঘর, দুই-তিন সারি ডেস্ক, পুরোনো কিছু কম্পিউটার, প্রিন্টার-ফ্যাক্স মেশিনের একঘেঁয়ে শব্দ আর লেখালেখিতে ব্যস্ত হার-না-মানা এক দল রিপোর্টার – কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে বাংলাদেশের স্থানীয় সংবাদপত্রগুলোর চেহারা কমবেশি একই। সাংবাদিকতায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ডেটা প্রসেসিং সফটওয়্যার বা স্যাটেলাইট ছবির ব্যবহার তাদের কাছে রুপকথার মতই। কিন্তু কখনো কখনো ছোট ছোট এইসব সংবাদপত্র এমন সব বড় খবরের জন্ম দেয়, যা হেভিওয়েট জাতীয় পত্রিকাগুলোতে খুঁজে পাওয়া যায় না। রাজধানী ঢাকা থেকে প্রায় দুইশ কিলোমিটার দূরে, যশোরের গ্রামের কাগজের ঘটনাও ঠিক একই রকম।
অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জন্য গ্রামের কাগজ স্থানীয় পাঠকদের কাছে অনেক দিন ধরেই জনপ্রিয়। মানসম্পন্ন রিপোর্টিংয়ের কারণে তারা একাধিক জাতীয় পর্যায়ের পুরষ্কারও পেয়েছে। বড় জাতীয় দৈনিকের সাথে প্রতিযোগিতায় স্থানীয় পত্রিকাগুলো যখন মার খাচ্ছে, তখন গ্রামের কাগজ, প্রতিদিন প্রায় ৪০ হাজার কপি বিক্রি নিয়ে দাপটের সাথেই টিকে আছে, যশোর ও আশপাশের এলাকায়।
মাতৃত্বকাল ভাতা নিয়ে গ্রামের কাগজের অনুসন্ধানী ধারাবাহিকের একটি কোলাজ।
সম্প্রতি পত্রিকাটির একটি অনুসন্ধানী সিরিজ গোটা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বেশ আলোচিত হয়। সেটি টাকার অংকে বড় কোনো দুর্নীতি, প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ, সরকারি কর্মকর্তা বা কোম্পানি নিয়ে নয়। তাদের প্রতিবেদনের বিষয় ছিল একটি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সার্বিক অব্যবস্থাপনা, যে কারণে গ্রামের হাজারো দরিদ্র মা, সরকারের দেয়া মাতৃত্বকাল ভাতা থেকে বঞ্চিত হন।
বাংলাদেশ তার জাতীয় বাজেটের (২০১৮–১৯) প্রায় ১৪ শতাংশ অর্থ খরচ করে সামাজিক নিরাপত্তায়। এই কার্যক্রমের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল মাতৃত্বকাল ভাতা। এর মাধ্যমে দেশের সাত লাখ হত দরিদ্র মাকে সহায়তা দেয়া হয়, যেন তারা নিজের এবং অনাগত সন্তানের পুষ্টি ও সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে পারেন।
কিন্তু অনুসন্ধান থেকে বেরিয়ে আসে, যশোরে এই ভাতা কার্যক্রমের সুবিধাভোগীদের বড় অংশই দরিদ্র নয়। এই পরিস্থিতির জন্য দুর্নীতি, দায়িত্বে অবহেলা, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং সর্বোপরি নীতিমালায় দুর্বলতা কীভাবে দায়ী সেটিও তারা খুঁজে বের করেন।
এই অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করতে গিয়ে গ্রামের কাগজের প্রায় এক বছর সময় লেগেছে। তাদের ১৬ জন রিপোর্টার আলাদা দলে বিভক্ত হয়ে গোটা জেলা চষে বেড়িয়েছেন এবং অন্তত ৪০০ জন মায়ের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। কিন্তু তারা কেন ৪০০ জনের সাক্ষাৎকার নিলেন? সংখ্যাটি আরো বেশি বা কম নয় কেন? তাদের অনুসন্ধানের বিশেষত্ব লুকোনো, এই প্রশ্নের উত্তরের মধ্যেই।
যেখান থেকে শুরু
স্থানীয় দৈনিক হিসেবে যশোরের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর সাথে গ্রামের কাগজের যোগাযোগ বরাবরই ভালো। অনেক দিন ধরেই তাদের অফিসে অভিযোগ আসছিল, মাতৃত্বকাল ভাতার সুবিধাভোগীদের বেশিরভাগই ভুয়া – অর্থ্যাৎ যারা ভাতা পাচ্ছেন, তাদের একটা বড় অংশই আসলে মা নন। কয়েকটি উপজেলা থেকে একই রকমের অভিযোগ আসার পর, তারা বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে নেন।
প্রাথমিকভাবে “মিথ্যে মা” শিরোনামটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের জন্য বেশ আকর্ষণীয় মনে হচ্ছিল পত্রিকাটির সম্পাদকের কাছে। এর সাথে গভীর জনস্বার্থ এবং ক্ষমতা ও সরকারি তহবিলের অপব্যবহারের মত উপকরণ থাকায় তারা মাতৃত্বকাল ভাতা কর্মসূচি নিয়ে অনুসন্ধানে নামার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু তখনও তারা জানতেন না, এই অনুসন্ধান গোটা ভাতা বিতরণ ব্যবস্থার মধ্যে নিহিত গভীর এক সমস্যাকে উন্মোচিত করতে যাচ্ছে।
গ্রামের কাগজের অনুসন্ধান শুরু হয় তথ্য অধিকার আইনের মাধ্যমে কর্মসূচির দরকারি তথ্য ও নথিপত্র চেয়ে সংশ্লিষ্ট সরকারি অফিসে আবেদনের মাধ্যমে। তারা যশোরের জেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয়ে এই কর্মসূচির সুবিধাভোগীর থানাভিত্তিক তালিকা চেয়ে আবেদন করেন। কিছু দিনের মধ্যেই প্রায় সাড়ে সাত হাজার সুবিধাভোগী এবং তাদের নাম ও ঠিকানাসহ প্রয়োজনীয় নথিপত্র তাদের হাতে আসে। “শুরুটা ভালোই ছিল”, বলেন গ্রামের কাগজের সম্পাদক মবিনুল ইসলাম। “কিন্তু তখনও আমাদের ধারণা ছিল না সামনে কী হতে যাচ্ছে এবং অনুসন্ধানটি শেষ করতে আসলে কত সময় লাগবে।”
কঠিন প্রশ্ন, সহজ সমাধান
গ্রামের কাগজ পত্রিকার বার্তাকক্ষ। ছবি: গ্রামের কাগজ
স্থানীয় পর্যায়ে, সাধারণত সাংবাদিকরা যখন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে হওয়া অনিয়ম বা দুর্নীতি নিয়ে রিপোর্ট করেন, তখন সেই অনিয়মকে “ব্যতিক্রম” বলে উড়িয়ে দেয়ার প্রবণতা দেখা যায় কর্তৃপক্ষের মধ্যে। তখন গ্রামের কাগজের অনুসন্ধানী দলের কাছে বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দেয়, ঠিক কত সাক্ষাৎকার বা তথ্য প্রমাণ যোগাড় করলে বিষয়টির ব্যাপকতা বোঝানো যাবে। এবার তারা এমন একটি প্রতিবেদন করতে চাইছিলেন, যা কেউ “বিচ্ছিন্ন ঘটনা” বলে এড়িয়ে যেতে পারবে না।
“আমরা এর আগেও সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রমে নানা ধরনের অনিয়ম নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছি। কিন্তু বড় ধরনের কোনো ইমপ্যাক্ট দেখতে পাইনি” বলেন মবিনুল ইসলাম। “ব্যাংক জালিয়াতি আর বড় বড় দুর্নীতির খবরের ভিড়ে জেলা পর্যায়ে হওয়া ছোট ছোট এসব অনিয়মের খবর হারিয়ে যায়। পাঠকরাও এসবে খুব একটা গুরুত্ব দেন না।”
কিন্তু তারা চাইছিলেন মাতৃত্বকাল ভাতার এই রিপোর্টে “ইমপ্যাক্ট” হোক। তাই তারা অনুসন্ধানের পরিধি বড় করার সিদ্ধান্ত নেন – এত বড় যা কারো নজর এড়াবে না। “আমাদের প্রশ্ন ছিল, যদি কোনো গবেষণা প্রতিষ্ঠান অল্প কিছু মানুষের সাক্ষাৎকার নিয়ে, জাতীয় পর্যায়ের জরিপ প্রকাশ করতে পারে, তাহলে যশোরে আমরা কেন পারব না?” বলেন গ্রামের কাগজ সম্পাদক।
সমাধানের জন্য তারা শরণাপন্ন হন গবেষক মোস্তাফিজুর রহমানের, যিনি বর্তমানে রেসিন্ট নামের একটি বহুজাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সিনিয়র রিসার্চ ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত আছেন। তাঁর উত্তর ছিল সহজ, “একটা জরিপ করে ফেলেন।” কিন্তু বিষয়টি নিয়ে দ্বিধা ছিল পত্রিকাটির রিপোর্টারদের। অনেকেই প্রশ্ন করেন, প্রথাগত অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার সাথে জরিপের কৌশলকে তারা কীভাবে মেলাবেন। তখন মোস্তাফিজুর রহমান বলেছিলেন, “এজন্য একটি মেথোডোলজি (গবেষণা পদ্ধতি) দরকার, আর কিছু নয়। ”
দৈবচয়ন, দৈব নয়
এরপর গ্রামের কাগজ দলের সাথে মিলে একটি কার্যকর গবেষণা পদ্ধতি তৈরির কাজে হাত দেন মোস্তাফিজ। ধারণাটি ছিল এরকম: রিপোর্টাররা তাদের অন্যসব অনুসন্ধানের মতই সাংবাদিকসুলভ সাক্ষাৎকার নেবেন এবং ছবি, ভিডিও ও নথিপত্রসহ দরকারী প্রমাণ সংগ্রহ করে আনবেন। কিন্তু জরিপের অংশ হিসেবে সাক্ষাৎকারের সময় তারা প্রত্যেকে নির্দিষ্ট কিছু প্রশ্ন অবশ্যই করবেন। সেইসব প্রশ্নের উত্তর একটি স্প্রেডশিটে লিপিবদ্ধ করা হবে, বিশ্লেষণের জন্য।
২০১৭ সালের অক্টোবরের সেই প্রস্তুতি সভায়, জরিপ বিশেষজ্ঞের পরের বক্তব্যটির জন্য ঠিক তৈরি ছিলেন না অনুসন্ধানী দলের সাংবাদিকরা। “আপনারা যাকে ইচ্ছা, তার সাক্ষাৎকার নিতে পারবেন না।” বলেন মোস্তাফিজ। “কাদের সাক্ষাৎকার নেয়া হবে, তা ঠিক হবে দৈবচয়নের মাধ্যমে। আর দৈব মানে দৈব নয়। গবেষণা পদ্ধতিই ঠিক করে দিবে, আপনারা কার সাথে কথা বলবেন।”
এভাবেই ঠিক হয় তালিকা থেকে কোন কোন মায়ের সাক্ষাৎকার নেয়া হবে। “ধরুন, আপনার হাতে ৫০টি কার্ড আছে। আপনি চোখ বন্ধ করে সেখান থেকে একটি বেছে নিলেন। তারপর অন্ধের মত আরো একটি বেছে নিলেন। এভাবে নিতেই থাকলেন যতক্ষণ না আপনার স্যাম্পল সাইজে পৌঁছাচ্ছেন। গবেষণায় এটাই র্যান্ডম মেথড, যা একটি কম্পিউটার প্রোগ্রামের মাধ্যমে ঠিক করা যায়”, এভাবেই সুবিধাভোগী বাছাইয়ের পদ্ধতি ব্যাখ্যা করেন এই সামাজিক জরিপ বিশেষজ্ঞ।
যশোর জেলার মানচিত্র। সূত্র: এলজিইডি
পরিসংখ্যানের একটি সূত্র ব্যবহার করে নির্ধারিত হয়, গোটা যশোরে সাড়ে সাত হাজার সুবিধাভোগীর মধ্য থেকে ৩৮৪ জনের সাক্ষাৎকার নেয়া হলে, সেটি সার্বিক চিত্র তুলে ধরবে। “এই সংখ্যাকে রাউন্ড করে স্যাম্পল সাইজ ৪০০ ঠিক করা হয়”, বলেন মোস্তাফিজ। এরপর যশোর জেলাকে আটটি প্রশাসনিক ভাগে বিভক্ত করে, জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রতিটি উপজেলায় কত মায়ের সাক্ষাৎকার নিতে হবে, সেই নমুনা সংখ্যা ভাগ করে নেয়া হয়।
যখন উপাত্তই প্রমাণ
ডেটা থেকে যে চিত্র বেরিয়ে এল, তা রীতিমত অপ্রত্যাশিত ছিল গ্রামের কাগজের অনুসন্ধানী দলের জন্য। দেখা গেল, তারা প্রাথমিক যে অনুমান নিয়ে অনুসন্ধানে নেমেছিলেন, সেটি ভুল!
একটি মাত্র অনুসন্ধানের জন্য ৪০০ সাক্ষাৎকার নেয়া গ্রামের কাগজের জন্য বেশ কঠিন ছিল। কারণ তাদের রিপোর্টারের সংখ্যা মাত্র ১৮ জন। এদের প্রতিবেদন দিয়েই প্রতিদিনের পত্রিকা ছাপা হয়। কিন্তু পিছপা হননি সম্পাদক। তিনি বলেন, “রিপোর্টারদের মধ্যে এই কাজ নিয়ে ব্যাপক আগ্রহ ছিল। আমরা রিপোর্টারদেরকে আটটি দলে ভাগ করলাম। প্রতি দলে দুই জন সদস্য ছিলেন। একেক দলের দায়িত্ব ছিল একেক উপজেলায়। ঠিক হল, একেক দিন একেক দল সাক্ষাৎকারের জন্য বের হবে।”
এই অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে সাক্ষাৎকারের পাশাপাশি অসংখ্য ছবি, ভিডিও এবং অন্য তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করে দলটি। এর পরের ধাপ ছিল, তাদের আনা তথ্যকে একটি স্প্রেডশিটে নথিবদ্ধ করা। কিন্তু এর আগে তাদের কেউই মাইক্রোসফট এক্সেলে এত বেশি ডেটা নিয়ে কাজ করেননি। এবারও তাদের সাহায্যে এগিয়ে এলেন মোস্তাফিজ।
“তাদেরকে গবেষণা পদ্ধতি এবং সঠিকভাবে ডেটা সংগ্রহের কাজে প্রশিক্ষিত করে তোলা বেশ চ্যালেঞ্জিং কাজ ছিল” বলেন তিনি। “কীভাবে তথ্য সংগ্রহ করতে হবে, তথ্য সঠিক কিনা কীভাবে যাচাই করতে হবে – এসব বিষয় নিয়ে আমরা ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলেছি। তারা সফলভাবে কাজটি শেষ করতে পেরেছেন, তাদের সত্য বের করে আনার সহজাত ক্ষমতার মাধ্যমে।”
কিন্তু ডেটা থেকে যে চিত্র বেরিয়ে এল, তা রীতিমত অপ্রত্যাশিত ছিল গ্রামের কাগজের অনুসন্ধানী দলের জন্য। দেখা গেল, তারা প্রাথমিক যে অনুমান নিয়ে অনুসন্ধানে নেমেছিলেন, সেটি ভুল! তাদের জরিপে “নকল মা” খুব একটা পাওয়া যায়নি। মায়েরা আসল, কিন্তু তাদের বেশিরভাগই দরিদ্র নয় – এবং ভাতাভোগী পরিবারের এক তৃতীয়াংশই গ্রামীণ সমাজকাঠামোর বিচারে রীতিমত ধনী।
ডেটা নিয়ে গেল নতুন পথে
অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা এবং জরিপ কৌশলের মেলবন্ধন ঘটানোর কারণে সমস্যার ব্যাপকতা যেমন ফুটে উঠেছে, তেমনি সংখ্যা দিয়েও তাকে প্রকাশ করা সম্ভব হয়েছে।
সমাজে দরিদ্রদের মধ্যেও যারা দরিদ্র, তাদের জন্যেই সরকারের এই সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি। কিন্তু ডেটা বিশ্লেষণ করে দেখা গেল, মায়েদের ৯২ভাগই নীতিমালায় দেয়া শর্ত অনুযায়ী দরিদ্র নয়। তারা দেখলেন, স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি বা রাজনৈতিক দলের নেতারা স্বজনপ্রীতি বা ঘুষের বিনিময়ে ভাতাভোগী নির্বাচন করছেন। এই জরিপ ফলাফল থেকে ভুয়া স্বাস্থ্য সনদ, তাদরকিতে নিযুক্ত নাম-সর্বস্ব এনজিও, ভুয়া সইয়ে ব্যাংক একাউন্ট খোলা এবং সভাবিহীন কমিটিসহ একাধিক নতুন প্রতিবেদন জন্ম দিল।
দেখা গেল: অনেক মা-ই জানেন না ভাতাভোগী হিসেবে তাদের আবেদনের সাথে স্বাস্থ্যসনদ জমা দেয়া হয়েছে; কোনো ভাতাভোগীই এক বছরে তাদের ঘরে কোনো এনজিও প্রতিনিধি আসতে দেখেননি; অনেকেই মনে করতে পারেননি তারা ব্যাংকে গিয়ে একাউন্ট খুলেছেন; এবং স্থানীয় কমিটিতে ভাতাভোগী প্রতিনিধি থাকা বাধ্যতামূলক হলেও কেউই কোনো সভায় ডাক পাননি।
ঢাকার সিনিয়র সাংবাদিক আমিনুর রশিদ এই অনুসন্ধানী প্রকল্পে গ্রামের কাগজ দলের সাথে “মেনটর” হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি বলেন, “যদি অনুসন্ধানটি জরিপের মত করে চালানো না হত, তাহলে হয়ত কিছু ভুয়া ভাতাভোগী আর ছোটখাট দুর্নীতির চিরাচরিত গল্পই বেরিয়ে আসত। গোটা ব্যবস্থার দুর্বলতাটা আড়ালে থেকে যেত। কিন্তু অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা এবং জরিপ কৌশলের মেলবন্ধন ঘটানোর কারণে সমস্যার ব্যাপকতা যেমন ফুটে উঠেছে, তেমনি সংখ্যা দিয়েও তাকে প্রকাশ করা সম্ভব হয়েছে।”
এখানেই শেষ নয়
ডেটা বা উপাত্ত যখন নতুন নতুন স্টোরির দিকে নিয়ে গেল গ্রামের কাগজ দলকে, তখন আরো অনুসন্ধানের প্রয়োজন দেখা দিল। এবার তারা কমিটির সভার বিবরণী, তদারকিতে নিয়োজিত এনজিওর তালিকা এবং ভাতাভোগীদের আবেদনের সাথে জমা দেয়া দলিলসহ দরকারী সব নথির জন্য আবেদন করলেন তথ্য অধিকার আইনে।
তারপর সেই আটটি দল ফের সরেজমিন অনুসন্ধানে গেলেন মাঠে। কিন্তু এবার তারা জানেন কী স্টোরি নিয়ে কাজ করতে যাচ্ছেন, কাদেরকে জবাবদিহির আওতায় আনবেন এবং অভিযোগ প্রমাণের জন্য আর কোন কোন দলিল সংগ্রহ করবেন। এই দফায় তারা অভিযুক্ত রাজনীতিক ও কর্মকর্তাদের শনাক্ত করে তাদের বক্তব্য সংগ্রহ করলেন, ঠিকানা ধরে প্রতিটি এনজিওর অফিসে গিয়ে অস্তিত্বহীন বা নাম সর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের প্রমাণ পেলেন এবং এমনও একটি ঘটনার সন্ধান পেলেন যেখানে মাতৃত্বকাল ভাতার টাকা জমা হয়েছে একজন পূরুষের ব্যাংক একাউন্টে।
“এই প্রতিবেদন নিয়ে আমাদের অনেক চাপ সইতে হয়েছে,” বলেন মবিনুল ইসলাম। “কারণ স্থানীয় পর্যায়ের এইসব নেতারাই কোনো না কোনো ভাবে প্রভাবশালী রাজনীতিকদের সাথে সংশ্লিষ্ট। অনেকেই অনুরোধ করেছেন স্টোরি না ছাপাতে। এটা জাতীয় নির্বাচনের ঠিক আগের সময়টার কথা। আর ভোটের রাজনীতিতে স্থানীয় এসব নেতা বেশ গুরুত্বপূর্ণ।”
কেউ বলেনি ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’
মানসিকতায় এই পরিবর্তন এসেছে, কারণ অনুসন্ধানের ফলাফলকে কেউ বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে উড়িয়ে দিতে পারেননি।
২০১৮ সালের ডিসেম্বরে গ্রামের কাগজ পত্রিকা, মাতৃত্বকাল ভাতা নিয়ে তাদের এই অনুসন্ধানী ধারাবাহিক প্রকাশ করে। এতে ১০টির বেশি রিপোর্ট ছিল। সেখানে তুলে ধরা হয় দুর্বল ও অকার্যকর নীতিমালার সাথে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি মিলে, কীভাবে দরিদ্র মায়েদের সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ে আনার মহৎ উদ্যোগকে কলুষিত করছে। একই সাথে তারা সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তর, এনজিও এবং জনপ্রতিনিধিদেরও জবাবদিহির আওতায় আনেন।
এই ধারাবাহিক প্রকাশের পর যশোরের প্রত্যন্ত্য অঞ্চল থেকে ব্যাপক সাড়া আসতে থাকে। গ্রামের মানুষেরা কখনো টেলিফোনে, কখনো বা সশরীরে এসে অন্যান্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে অনিয়মের তথ্য দিতে থাকেন। এর মধ্যে স্থানীয় কর্তৃপক্ষও গোটা কর্মসূচিতে সুবিধাভোগী বাছাই প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনার ঘোষণা দেন।
“আমি বলব এই অনুসন্ধানের প্রভাবটা অনেক বেশি সামাজিক” বলেন পত্রিকাটির সম্পাদক। “প্রতিবেদন প্রকাশের পর আমরা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এবং জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে এক ধরনের সচেতনতা দেখতে পেয়েছি। তারা অনুধাবন করতে পারছেন, গরীবের ভাতা ধনীদের দেয়াটা কত গভীর এক অন্যায়। এই সত্যটাই তারা উপেক্ষা করে গেছেন দিনের পর দিন। চিন্তার এই পরিবর্তনই আমাদের সবচে বড় অর্জন।”
তিনি মনে করেন, মানসিকতায় এই পরিবর্তন এসেছে, কারণ অনুসন্ধানের ফলাফলকে কেউ বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে উড়িয়ে দিতে পারেননি। কারণ জরিপের উপাত্ত যে সত্য তুলে ধরেছে তাকে চ্যালেঞ্জ করা যায়নি।