জিআইজেসি২৩-র একটি প্যানেলে স্ল্যাপ-বিরোধী প্রকল্প, রিপোর্টার্স শিল্ড নিয়ে আলোচনা করছেন সাইরাস আর. ভ্যান্স সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল জাস্টিসের নির্বাহী পরিচালক আলেকজান্ডার পাপাক্রিস্টো (সবার বামে)। ছবি: জিআইজেএন ইউটিউব
স্ল্যাপ মামলা ও অন্যান্য আইনি হুমকি থেকে সাংবাদিকেরা যেভাবে নিজেদের সুরক্ষিত রাখবেন
আর্টিকেলটি পড়ুন এই ভাষায়:
সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জন্য হুমকিগুলো শুধুমাত্র স্বৈরশাসক ও সমগ্রতাবাদী রাষ্ট্রগুলো থেকেই আসে না— আসে কূটকৌশলে জনসমর্থন আদায়ে পটু জননেতাদের কাছ থেকেও, বলেন নেপালভিত্তিক প্রকাশক কুন্ডা দীক্ষিত। সুইডেনে ১৩তম গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম কনফারেন্সের (জিআইজেসি২৩) একটি প্যানেলে তিনি স্ল্যাপস (স্ট্র্যাটেজিক ল’স্যুটস অ্যাগেইনস্ট পাবলিক পার্টিসিপেশন) ও অন্যান্য আইনি হুমকির বিরুদ্ধে কিভাবে লড়াই জারি রাখতে হয় সে সম্পর্কিত একটি প্যানেল সঞ্চালনা করেন।
দীক্ষিত নিজেও স্ল্যাপের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছেন। জিআইজেসি২৩-র প্যানেল আলোচনায় তাঁর সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন সাইরাস আর. ভ্যান্স সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল জাস্টিসের নির্বাহী পরিচালক আলেকজান্ডার পাপাক্রিস্টো; মিডিয়া ডিফেন্সের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কার্লোস গ্যালো— সংস্থাটি সাংবাদিকদের আইনি সহায়তা প্রদান করে; এবং হাঙ্গেরিভিত্তিক মানবাধিকার বিষয়ক আইনজীবী বিয়া বোদ্রোগি, একাধিক স্ল্যাপ মামলা নিয়ে কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে তার।
স্ল্যাপ এমনই এক আইনি অস্ত্র যা ক্ষমতাধর ও প্রভাবশালী ব্যক্তি বা সংস্থাগুলো ব্যবহার করে তাদের সমালোচকদের কণ্ঠরোধ করতে, যেন তারা সমালোচনামূলক বলে বিবেচিত হবে– এমন কিছু প্রকাশ করতে না পারেন। স্ল্যাপ মামলার মূল লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যই হলো সাংবাদিক ও অ্যাক্টিভিস্টদের হুমকি দেওয়া, হয়রানি করা বা ভয়ভীতি দেখানো এবং কণ্ঠরোধ করা, ব্যাখ্যা করেন বোদ্রোগি।
সাংবাদিকদের জন্য স্ল্যাপস কতটা বিপজ্জনক হতে পারে তা উল্লেখ করে বোদ্রোগি বলেন, ২০১৭ সালে মাল্টার অনুসন্ধানী সাংবাদিক ড্যাফনে কারুয়ানা গালিজিয়াকে তার গাড়ির সিটের নীচে লুকিয়ে রাখা বিস্ফোরক দিয়ে হত্যা করা হয়, গাড়িটি মাল্টার বিডনিজায় তার বাড়ির বাইরে বিস্ফোরিত হয়েছিল। মৃত্যুর আগে কারুয়ানা ৪৮টি মানহানির মামলার মুখোমুখি হন। তার মৃত্যুর পর ওই মামলাগুলোর কয়েকটি টানতে হয় তার পরিবারের সদস্যদেরও।
“কোনো জায়গাই আর নিরাপদ নয়,” যোগ করেন দীক্ষিত। “[নির্বাচিত সরকারী কর্মকর্তাদের] এখন আর সাংবাদিকদের হত্যা করা বা নির্বাসনে পাঠাতে হয় না। সাংবাদিকের নামে শুধু মামলা করলেই চলে। ওই সাংবাদিক যে দেশ থেকে এসেছেন সেই বিচারব্যবস্থার অধীনে যদি অভিযোগকারী মামলা না করতে পারেন, তাহলে অন্য দেশের বিচারব্যবস্থায় এটি করার জন্য স্রেফ একটি মানহানির মামলা খুঁজে নিতে হবে।”
সাংবাদিকেরা স্ল্যাপ মামলাগুলো কিভাবে সনাক্ত করবেন
বোদ্রোগি এমন ১০০ জনের বেশি সাংবাদিকের সঙ্গে কাজ করছেন, যাদের বিরুদ্ধে স্ল্যাপ মামলা করা হয়েছে। কোনো সাংবাদিক স্ল্যাপের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছেন কিনা তা শনাক্তে সাহায্য করার জন্য কিছু পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
১. কোনো বেসরকারী প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি পর্যায় থেকে যদি আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হয়, তাহলে তা স্ল্যাপ মামলা হবে। তবে সাংবাদিকদের মনে রাখা উচিত যে সরকারী কর্মকর্তারাও একজন সাধারণ ব্যক্তি হিসেবে মানহানির অভিযোগ আনতে পারেন, তাই সাংবাদিকদের দৃষ্টি শুধুমাত্র বেসরকারী সংস্থা ও ব্যক্তির দিকে থাকা উচিত নয়।
২. জন-অংশগ্রহণমূলক কর্মকাণ্ডকে স্ল্যাপের লক্ষ্যবস্তু করা হয়। সাধারণত যারা স্ল্যাপ মামলা করেন তারা জানেন যে, সাংবাদিক, সমাজকর্মী বা তাদের সমর্থকেরা জন-অংশগ্রহণমূলক কাজের মাধ্যমে সমাজের গুরুত্বপূর্ণ প্রহরী বা ওয়াচডগের ভূমিকা পালন করেন। তারা তাই সুনির্দিষ্টভাবে সমাজের এ ধরনের ব্যক্তি এবং তাদের প্রকাশিত লেখা বা কর্মকাণ্ডকে লক্ষ্যবস্তু করে থাকেন।
৩. যদি মামলাটি জন-অংশগ্রহণকে রুখে দেওয়া, বন্ধ করা বা নিরুৎসাহিত করার উদ্দেশ্যে করা হয়, তবে তা স্ল্যাপ। কোনো একটি প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তে স্ল্যাপে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে অভিযোগ দায়ের করা হয়।
৪. অভিযোগে উপস্থাপিত যুক্তি যখন আইনগত ও বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনায়; উভয় দিক থেকেই ভিত্তিহীন হয়।
৫. বাদী পক্ষের উদ্দেশ্য যদি মামলায় জয়ী হওয়া নয় বরং সাংবাদিককে (আর্থিকভাবে কিংবা অন্য কোনোভাবে) বাধা দেওয়া বা তাদের কাজ থেকে মনোযোগ সরিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে করা হয়।
সাংবাদিকদের স্ল্যাপ মামলার বিরুদ্ধে লড়তে সহায়তা করে যেসব সংগঠন
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক এবং ছোট আকারের মিডিয়া সংস্থাগুলো স্ল্যাপ মামলার বিরুদ্ধে নিজেদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারে না। তাই এমন একটি ব্যবস্থা থাকা জরুরী, যা সাংবাদিকদের তাদের রিপোর্টিং বা দৈনন্দিন কাজগুলো চালিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি আইনি সহায়তা প্রদান করবে ও মামলা লড়তে সহায়তা করবে। “স্ল্যাপ” মামলাকারীদের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সাংবাদিকদের তাদের কাজ থেকে দূরে সরিয়ে রাখা এবং আদালতের দ্বারে দ্বারে ঘুরিয়ে সময় নষ্ট করানো।
স্ল্যাপ মামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হওয়া সাংবাদিক ও সমাজকর্মীদের সুপারিশ, প্রশিক্ষণ, এবং বিনামূল্যে আইনি সহায়তা প্রদানের সম্ভাবনা নিয়ে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন সংস্থা। বিশ্বের অনেক দেশেই সাংবাদিকেরা এই সুযোগ পান না। তবে কিছু সংস্থা এই কাজগুলো করার দায়িত্ব নিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অলাভজনক প্রতিষ্ঠান রিপোর্টার্স শিল্ড গড়ে উঠেছে ওসিসিআরপি (অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন রির্পোটিং প্রজেক্ট)-এর অনুসন্ধানী সাংবাদিক এবং সাইরাস আর. ভ্যান্স সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল জাস্টিসের আইনজীবীদের উদ্যোগে। এটি বিশ্বজুড়ে অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের আইনি হুমকি থেকে সুরক্ষা প্রদান করে। বিভিন্ন সংস্থা বা আউটলেটগুলো নির্দিষ্ট ফি দিয়ে নাম নিবন্ধনের পর আইনি পরামর্শ এবং আইনজীবিদের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ পায়। (রিপোর্টাস শিল্ডের সদস্য হওয়ার শর্ত হচ্ছে সংস্থা বা আউটলেটগুলোকে অবশ্যই জনস্বার্থমূলক কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হতে হবে অথবা প্রিন্ট ও অনলাইন মিডিয়াতে অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করতে হবে — এখানে রূপরেখা দেওয়া হয়েছে।) রিপোর্টার্স শিল্ডের সহায়তামূলক তহবিলের পরিমাণ ৫ লাখ মার্কিন ডলার, এ অর্থ সদস্যদের আইনি পরিষেবা প্রদানের কাজে ব্যবহার করা হয়।
“তবে আপনি মামলায় হেরে গেলে রির্পোটার্স শিল্ড আপনাকে অর্থ সহায়তা প্রদান করবে না,” সতর্ক করে বলেছেন পাপাক্রিস্টো। “সুতরাং আদালত যদি ন্যায্য বা অন্যায্যভাবে আপনার বিরুদ্ধে রায় দেয়, সেক্ষেত্রে সম্পূর্ণ খরচ আপনার উপর বর্তাবে— তবে মামলা পরিচালনার খরচ বহন করা হবে।” পাপাক্রিস্টো জানিয়েছেন, রিপোর্টার্স শিল্ড তাদের ২০ মিলিয়ন ডলার লক্ষ্যমাত্রার ১৩ মিলিয়ন ডলার উত্তোলন করেছে ইউএসএআইডি ও অন্যান্য দাতাদের কাছ থেকে। এই প্রকল্পটি এখনো আছে এর প্রথম পর্যায়ে, যেখানে এটির কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে শুধু উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায়ে তাদের কর্মকাণ্ড সম্প্রসারিত হবে সাব-সাহারার আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়ায়।
পেশাগত কাজের জন্য মামলার মুখে পড়েছেন– এমন সাংবাদিকদের অনুদান প্রদান করে মিডিয়া ডিফেন্স। অথবা তাদের সঙ্গে এমন আইনজীবীর সংযোগ ঘটিয়ে দেওয়া হয়, যারা প্রয়োজনীয় আইনি সহায়তা দিতে পারবেন। “দক্ষ আইনজীবীদের নিয়ে গঠিত দারুণ একটি অভ্যন্তরীণ আইনি দল আছে আমাদের, যারা কাজগুলো তদারকি করেন এবং আন্তর্জাতিক আদালতে ক্লায়েন্টদের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন,” বলেন সংস্থাটির প্রধান নির্বাহী কার্লোস গ্যালো। তিনি আরো যোগ করেন যে, মিডিয়া ডিফেন্স বিশ্বের সব অঞ্চলের ২৩টি দেশে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলা পরিচালনায় সহায়তা দিয়ে থাকে। ২০২২ সালে, মিডিয়া ডিফেন্স মোট ১৮৮টি মামলায় আইনগত সহায়তা প্রদান করেছে, যার মধ্যে ৪০ শতাংশই ছিল স্ল্যাপ মামলা— উল্লিখিত সংখ্যাটি বিশ্বব্যাপী স্ল্যাপ মামলা দায়েরের হার বৃদ্ধিকে প্রতিফলিত করে।
“আমরা রুখে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি, সাংবাদিকদের মধ্যে যারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছেন বা স্ল্যাপ মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন তাদের পক্ষে জবাবদিহি আদায়ের চেষ্টা করছি,” বলেন গ্যালো। তিনি আরো জোর দিয়ে জানান যে, মিডিয়া ডিফেন্স আঞ্চলিক পর্যায় কিংবা জাতিসংঘের চুক্তিবদ্ধ সংস্থাগুলোর সঙ্গে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আইনি উপায় ব্যবহার করে মামলাগুলো সমাধান করার চেষ্টা করছে।
স্ল্যাপ মামলা ও অন্যান্য আইনি হুমকির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো নিয়ে অনুষ্ঠিত জিআইজেসি২৩ প্যানেলের সম্পূর্ণ ভিডিওটি দেখুন।