

ছবি: জর্ডান ম্যাকডোনাল্ড, আনস্প্ল্যাশ
ইমপ্যাক্ট তৈরি: যেভাবে আপনার প্রতিবেদনকে নিয়ে যাবেন অনন্য উচ্চতায়
ছবি: জর্ডান ম্যাকডোনাল্ড/আনস্প্ল্যাশ
গত বছর, মৃত্যুদণ্ডের অপেক্ষায় থাকা সুদানি মেয়ে নুরা হুসেনের ঘটনাটি গোটা বিশ্বে দারুণ সাড়া ফেলে। স্বামীকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করার কারণে ১৯ বছরের মেয়েটির বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেওয়া হয়। নুরার অভিযোগ ছিল, তার স্বামী তাকে ধর্ষণ করেছে।
এরপর থেকে ইউরোপিয়ান জার্নালিজম সেন্টারের অর্থায়নে জেন্ডার বৈষম্য নিয়ে সিএনএন-এর বছর জোড়া প্রকল্প ‘অ্যাজ ইকুয়ালস’-সহ বিশ্বের বেশ কিছু গণমাধ্যম নুরার ঘটনা, জোরপূর্বক বাল্যবিবাহ এবং বৈবাহিক ধর্ষণের ওপর ধারাবাহিকভাবে আলোকপাত করে গেছে।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের ক্রমাগত চাপ এবং #JusticeForNoura ক্যাম্পেইনের কল্যাণে নুরার মৃত্যুদণ্ড ইতিমধ্যেই তুলে নেওয়া হয়েছে।
এই ঘটনা থেকে বোঝা যায়, পৃথিবীকে আরো সুন্দর করে তোলার কাজে সাংবাদিকতা কতটা অবদান রাখছে। বিশ্বে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায়ও সাংবাদিকতার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সমাজে এই পেশা কী পরিমাণ প্রভাব ফেলছে, তা জনগণ খুব একটা বুঝতে পারে না।
আপনি যদি আপনার স্টোরির মাধ্যমে সমাজে পরিবর্তন আনতে চান, আগে একটা কর্মপদ্ধতি ঠিক করুন। এবং পরিবর্তন আনতে সক্ষম এমন মানুষদেরকে তার সাথে যুক্ত করুন।
সাংবাদিকতা এখন দিন দিন মানুষের আস্থা হারাচ্ছে। সাথে আছে আর্থিক দৈন্যদশা। এমন ক্রান্তিকালে বার্তাকক্ষের সাথে পাঠকের সংযোগ স্থাপন এবং নতুন পৃষ্ঠপোষকদের দৃষ্টি আকর্ষণে সহায়ক হতে পারে ‘সংবাদ কতটা প্রভাব ফেলছে তা পরিমাপ’ করে, সবার সামনে তুলে ধরা।
কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান প্রভাব বা ইমপ্যাক্ট তৈরিকেই তাদের মূল লক্ষ্য হিসাবে গ্রহণ করেছে। কিন্তু সাংবাদিকতার বৃহৎ পরিসরে, বিষয়টি এখনো গুরুত্ব পাচ্ছে না।
সাংবাদিকদের কি এখন ইমপ্যাক্ট সৃষ্টি নিয়ে কাজ করা উচিৎ? কীভাবে?
সাংবাদিকরা পাঠকদেরকে যে দৃষ্টিতে দেখেন এবং নিজেদের কাজের ফলাফলকে যেভাবে বিচার করেন, সেই ধ্যান-ধারণায় পরিবর্তন আনার উপায় নিয়ে আমরা কথা বলেছি ইমপ্যাক্ট মেকার্স এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা বার্নাডেট কুইপারের সাথে। তিনি স্টোরিটেলারদের শেখান, কীভাবে গল্পের মাধ্যমে সমাজে আরো বেশি ইমপ্যাক্ট তৈরি করা যায়।
ইমপ্যাক্ট তৈরি নিয়ে কেন মাথা ঘামাবেন?
প্রতিদিন অসংখ্য গল্পের মাধ্যমে পৃথিবীটা ছুটে চলে। এভাবে আমরা একই সাথে জ্ঞান অর্জন করি এবং সামনে এগিয়ে যাই। কিন্তু আমাদের প্রতিবেদনকে ছড়িয়ে দেওয়ার গতানুগতিক প্রক্রিয়াটি বদলে যাচ্ছে। এখন শুধু ভালো গল্পই যথেষ্ট নয়। সে দিন গেছে।
আমরা এমন একটা বিশ্বে বাস করি যেখানে প্রচুর গল্প জন্ম নেয়। আপনি যদি আপনার গল্পের মাধ্যমে সমাজে পরিবর্তন আনতে চান, তাহলে সাংবাদিকরা সচরাচর যা করেন, তার চেয়ে বাড়তি কিছু করতে হবে।
এখনকার দিনে, আপনার প্রতিবেদন নিয়ে চারপাশে যা হচ্ছে, তার ওপর আপনার নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে হবে। এমন কৌশল নিতে হবে, যেন ওই বিষয়ের সাথে জড়িত মানুষদেরকে খুঁজে বের করে, তাদেরকে ইমপ্যাক্ট তৈরির কাজে যুক্ত করা যায়।
ইমপ্যাক্ট মেকার্স: প্রতিষ্ঠানের সহ-প্রতিষ্ঠাতা বের্নাডেট কুইপার বক্তব্য রাখছেন ইমপ্যাক্ট একাডেমিতে। ছবি: ইউরোপিয়ান জার্নালিজম সেন্টার
ইমপ্যাক্ট তৈরির জন্য কী পদক্ষেপ নেবেন?
প্রথম ধাপ হল লক্ষ্য নির্ধারণ এবং নিজের অবস্থান অনুধাবন। সাংবাদিক হিসেবে প্রভাব সৃষ্টির জন্য আপনার আগ্রহ কতটা দৃঢ়? আপনি কি নিশ্চিত, ইমপ্যাক্ট তৈরির জন্য এই প্রতিবেদনটির পেছনে বাড়তি সময় ও শ্রম দিতে চান? প্রতিবেদনটি ঠিক কোন বিষয়ে অথবা আদৌ কি কোনো পরিবর্তন আনতে পারবে? এই ধাপটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ, গল্পের প্রভাবকে বিস্তৃত করার জন্য যে প্রচারণা দরকার, সেটি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ না হলে করা কঠিন।
দ্বিতীয় ধাপ, হচ্ছে মাঠের ছক এঁকে নেয়া। আপনার প্রতিবেদন যেখানে দেখা বা পড়া হবে, সেই জায়গাকে মাঠ হিসেবে কল্পনা করুন। ওই জায়গায় প্রধান চরিত্র কারা? সেখানে কারা আপনার সহযোগী হবে? মাঠে প্রতিবেদনটির অবস্থানই-বা কোথায় হবে?
তৃতীয় ধাপ হচ্ছে, উদ্দেশ্যকে কেন্দ্রে রেখে প্রাসঙ্গিক মানুষদের সাথে সম্পর্ক এবং নেটওয়ার্ক তৈরি করা। অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের নিজেদের কাজের স্বার্থেই আপনার প্রতিবেদনকে ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু আপনাকেই বলে দিতে হবে, বাদ বাকি সব কিছু ফেলে কেন তারা আপনার প্রতিবেদনের পেছনেই সময় এবং শ্রম ব্যয় করবে। তাই এমন সহযোগী বেছে নিন, যাদের সাথে আপনার উদ্দেশ্য মিলে এবং যারা আপনার গল্পটিকেও পছন্দ করবে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হচ্ছে, এই প্রক্রিয়া থেকে বের হয়ে আসার পরিচ্ছন্ন একটা পথ তৈরি রাখা। আপনি ইমপ্যাক্ট তৈরির জন্য সবার সহায়তা নিলেন, তারপর হুট করে চলে গেলেন – এমনটি যেন না হয়। ঠিক করুন এর শেষ কোথায়? আপনি নতুন খবরের পেছনে ছুটলে, কাজটি কে এগিয়ে নেবে? এটি নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত নেটওয়ার্ক ছেড়ে যাবেন না।
প্রতিবেদন ছাড়ার আগে তার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে হয়। কাজটি একজন ইমপ্যাক্ট প্রডিউসারের। তিনি প্রতিবেদন প্রকাশের আগে সংশ্লিষ্ট মানুষের সাথে সম্পর্ক তৈরি করেন এবং একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন।
সবশেষে, আবার প্রথম ধাপে ফিরে যান। নিজেকে জিজ্ঞেস করুন, আপনি এখনো আপনার কৌশল এবং লক্ষ্য অনুসরণ করছেন কি না। আজকাল সাংবাদিকরা সমাজে আরো বেশি প্রভাব ফেলার কৌশল ঠিক করতে ইমপ্যাক্ট প্রোডিউসারদের সাহায্য নেন।
ইমপ্যাক্ট প্রোডিউসারদের কাজ কী?
চলচ্চিত্র নির্মাতাদের কাছে ইমপ্যাক্ট প্রোডিউসার ধারণাটি বেশ পরিচিত। তাদের কাজ মূলত চলচ্চিত্রের বৈশ্বিক সাফল্য নিশ্চিত করা। সাংবাদিকতায় এটা এখনো নতুন এবং নিউজরুমে সবেমাত্র নিজের জায়গা করে নিতে শুরু করেছে। স্পষ্ট করা প্রয়োজন, ইমপ্যাক্ট প্রোডিউসারের কাজ বিপণনকর্মীদের মত নয়। বিপণনকর্মী আপনার হয়ে প্রচার করেন এবং তার আগে জানতে চান, “আপনি কার কাছে পৌঁছাতে চান?” এবং “কীভাবে?”
ইমপ্যাক্ট প্রোডিউসার এই কাজটিকে আরেক ধাপ সামনে এগিয় নেন এবং প্রশ্ন করেন:
আপনি কেন দর্শকের কাছে পৌঁছাতে চান এবং এরপরে কী হবে? আপনি কি প্রতিবেদনের মাধ্যমে সচেতনতা তৈরি করতে চান? আপনি কি কোনো বিষয়ে মানুষের আচরণ পরিবর্তন করতে চান? আপনি কি কোনো নির্দিষ্ট কাজের জন্য একটি সম্প্রদায়কে ঐক্যবদ্ধ করতে চান? আপনি কি কোনো নীতি পরিবর্তন করতে চান? আপনি কি কোনো কাঠামোগত পরিবর্তন আনতে চান?
প্রতিবেদনকে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য কৌশলগত যত কাজ আছে, তা ইমপ্যাক্ট প্রোডিউসার করে থাকেন। তারা এমন কৌশল নির্ধারণ করেন যাতে প্রতিবেদনটি আরো গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। তারা সেই কৌশল বাস্তবায়নও করেন।
এই দায়িত্ব পালনের জন্য সময়, পরিশ্রমের সামর্থ্য, অর্থ এবং কৌশলগত দক্ষতা থাকতে হয়। সাধারণত সাংবাদিকদের পক্ষে এই কাজ করা সম্ভব হয় না, কারণ তারা প্রতিবেদন নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। আর সেটাই একজন সাংবাদিকের প্রধান মাথাব্যথা হওয়া উচিৎ। কারণ ভালো ও আকর্ষণীয় প্রতিবেদন ছাড়া সমাজে কোনো প্রভাব ফেলা যায় না।
প্রতিবেদন প্রকাশের অনেক আগে থেকেই ইমপ্যাক্ট তৈরির ক্যাম্পেইন শুরু করতে হয়। সাংবাদিক যখন তার গল্প দাঁড় করানোর কাজে ডুবে থাকেন, তখন ইমপ্যাক্ট প্রোডিউসার ব্যস্ত দর্শকের সাথে বিশ্বাস ও সহযোগিতার সম্পর্ক তৈরিতে। এভাবেই তিনি সহযোগীদের সাথে নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন। প্রতিবেদনটি প্রকাশ বা প্রচারের জন্য যথাযথ পরিবেশ ও উদ্দীপনা তৈরি করাই তার উদ্দেশ্য।
ইমপ্যাক্ট ক্যাম্পেইনের জন্য কেমন স্টোরি বেছে নিবেন?
এমন স্টোরি, যা আমাদের চারপাশের সবচে জরুরী বিষয়গুলো তুলে ধরে। বিষয় হতে হবে এমন যা নিয়ে সবাই ভাবছে, কথা বলছে বা দুশ্চিন্তা করছে। যেমন, অভিবাসন সংকট, জেন্ডার সম্পর্ক, জাতিগত বৈষম্য বা জলবায়ু পরিবর্তন।
সমাজে প্রতিবেদনের গুরুত্বকে আরো গভীরভাবে উপস্থাপণের জন্য ইমপ্যাক্ট পরিমাপ করা জরুরী। দুর্ভাগ্যজনক হলেও, এখনো বেশিরভাগই বিষয়টি সম্পর্কে জানেন না।
ইমপ্যাক্টের জন্য উদ্দীপনা তৈরির খারাপ দিক হলো, তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়ার প্রত্যাশা। কিন্তু সবসময় তার প্রয়োজন নেই। সব প্রতিবেদনের জন্য প্রভাব তৈরি করতে হয় না। কিছু গল্প এতোই গুরুত্বপূর্ণ যে, তা এমনিতেই বলা দরকার।
কোথায় সাংবাদিকতা শেষ এবং কখন প্রচারণা শুরু?
এ নিয়ে অবশ্য মতের অমিল রয়েছে। তাই সীমারেখাটা ঠিক করা উচিৎ সাংবাদিকদেরই। প্রতিবেদন তৈরির সময় স্বাধীন থাকা জরুরী। এটা নিশ্চিত করতে হবে।
যদিও আমার কাছে, এই আলোচনা তাত্ত্বিক মনে হয়। বাস্তবে, বেশিরভাগ সাংবাদিকই চান, তাদের প্রতিবেদন সমাজে কোনো অবদান রাখুক। অনেক পরিশ্রম করে একটি প্রতিবেদন তৈরি করলেন, তা প্রকাশও হলো, কিন্তু কেউ সাড়া দিলো না – এমনটা যে কোনো সাংবাদিকদের জন্যই হতাশাজনক।
এমন সহযোগী খুঁজে নিন, যার সাথে মত মিলবে। সবসময় মাথায় রাখুন, সাংবাদিক হিসেবে আপনি স্বাধীন এবং প্রতিবেদনটি কেবল আপনার, আর কারো নয়। সঠিক সহযোগীদের তা বোঝানো যায়। স্টোরিটেলার হিসাবে আপনার দক্ষতা সম্পর্কে তারা জানে এবং মূল্যায়ন করে। সৃজনশীল কাজের সময় প্রতিষ্ঠান কোনো মতামত চাপিয়ে দিয়েছে, এমন অভিজ্ঞতা আমার হয়নি বললেই চলে।
সাংবাদিকতার প্রভাব পরিমাপ করে কী লাভ?
একটি প্রতিবেদন সমাজে কী প্রভাব ফেলছে, তা পরিমাপের মাধ্যমে আমরা আরো দৃঢ়ভাবে বলতে পারবো, একটি পেশা হিসেবে সাংবাদিকতা কেন এতো গুরুত্বপূর্ণ। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এই জ্ঞান সমাজের সকলের কাছে নেই। তাই আমাদের উচিৎ, সাংবাদিকতার প্রভাবে সমাজে যে ধরণের পরিবর্তন ঘটে, তা সরাসরি এবং আরো ব্যাপকভাবে তুলে ধরা।
কিন্তু আমরা যেন সাংবাদিকের ওপর এই কাজের বোঝা চাপিয়ে না দিই, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। এই দায়িত্ব নিতে হবে সবাইকে, সম্মিলিতভাবে। এখানেই পৃষ্ঠপোষক বা দাতাদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। খুশীর বিষয় হলো, অনেক পৃষ্ঠপোষকই সাংবাদিকতার প্রভাব পরিমাপের জন্য অর্থায়ন করছে। এই কেইস স্টাডিগুলো সমাজ পরিবর্তনে সাংবাদিকতার ভূমিকা এবং এই পেশার সামাজিক মূল্য তুলে ধরবে।
ইউরোপিয়ান জার্নালিজম সেন্টার ও ইমপ্যাক্ট মেকার এখন “বলি, ললি, ঢালি – দক্ষিণ এশিয়ার চলচ্চিত্রে নারী” নামের একটি প্রকল্পের প্রভাব মূল্যায়নের কাজ করছে। সামনের মাসগুলোতে আমরা তার ফলাফল প্রকাশ করবো। সাথেই থাকুন।
এই লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয় মিডিয়াম-এ ইউরোপিয়ান জার্নালিজম সেন্টারের সাইটে এবং পরবর্তীতে অনুমতিসহ এখানে পুনঃপ্রকাশ করা হয়েছে।
ডায়ানা লুঙ্গু কাজ করেন নেদারল্যান্ডসের মাস্ট্রিখ্ট ভিত্তিক ইউরোপিয়ান জার্নালিজম সেন্টারে, যা জিআইজেএনের অন্যতম সদস্য প্রতিষ্ঠান। সেখানে তিনি গ্র্যান্ট ইমপ্যাক্ট তত্ত্বাবধান করেন। ইউরোপ এবং অন্য মহাদেশেও সাংবাদিকদের জন্য সেমিনার, কনফারেন্স, প্রেস ট্রিপসহ অনেক জটিল মিডিয়া ইভেন্ট পরিচালনা করার অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর।