পাঠকের মনোযোগ লুফে নিতে লেখা শুরু করবেন যেভাবে
আর্টিকেলটি পড়ুন এই ভাষায়:
যে কোনো লেখকের জন্যই শুরুটা সবসময় কঠিন। সাংবাদিকতায় যাঁরা নতুন, তাদের জন্য সহজ পরামর্শ—শুরু করুন “নতুন” তথ্য দিয়ে। নিশ্চিত করুন তাতে যেন একটি ক্রিয়া থাকে। যেমন, কোনো ব্যক্তি কিছু বলেছে; একটি রিপোর্টে তথ্যটি প্রকাশিত হয়েছে; কর্তৃপক্ষ কারো খোঁজ করছে, কোনো কিছু নিয়ে সতর্ক করেছে, কোনো কিছু করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে; ইত্যাদি।
তবে বড় গল্প (লংফর্ম) আর ফিচার লেখার ক্ষেত্রে উপস্থাপনাশৈলী খুব গুরুত্বপূর্ণ। শুরুটা আমরা যদি “প্রকাশিত” নতুন তথ্য দিয়ে করি, তাহলে ঝুঁকি এটাই যে, পাঠকের আগ্রহে ভাটা পড়তে পারে। গল্পের শেষে কী ঘটবে—ফুরিয়ে যেতে পারে তা জানার আকর্ষণ। শেষ করার আগেই পাঠক লেখা থেকে চোখ সরিয়ে নিতে পারে।
তাই, বড় প্রতিবেদন লিখতে বসে পাঠকের আগ্রহ ধরে রাখার জন্য সাংবাদিকরা বিভিন্ন কৌশল নিয়ে থাকেন। তবে কোনোভাবেই পাঠককে হতাশ করে নয়। বরং তাকে চমকে দেওয়ার মনোভাব ধরে রেখে।
তাই, আপনারা যাঁরা দীর্ঘ প্রতিবেদন নিয়ে বসেছেন, শুরু করতে হিমশিম খাচ্ছেন। অথবা ভাবছেন আপনি যেভাবে লিখছেন, পরে তা আরো ঘষামাজা করতে পারবেন। তাদের জন্য আমি লংফর্ম রিপোর্টিং ও ফিচার লেখার সাতটি ধরন তুলে ধরছি। সহজে বুঝানোর জন্য উদাহরণসহ ব্যাখ্যা করেছি।
সূচনা: একজন ব্যক্তিকে দিয়ে শুরু করুন
দীর্ঘ ফিচার লেখার প্রচলিত একটি কৌশল হচ্ছে কোনো একজন ব্যক্তির কথা দিয়ে শুরু করা। যে আপনার লেখার সূচনা বিন্দু। এভাবে শুরু করে আপনি একের পর এক পর্দা উন্মোচন করতে থাকবেন। ঘটনার গভীরে প্রবেশ করবেন। আর কয়েকটি অনুচ্ছেদ পর পাঠককে জানিয়ে দিবেন, কেন আপনি ওই ব্যক্তিকে দিয়ে শুরু করেছিলেন এবং তাঁর সম্পর্কে কেন এতো তথ্য দিচ্ছেন।
এখানে কিছু উদাহরণ তুলে ধরছি:
দ্য গার্ডিয়ান/ অ্যামেলিয়া জেন্টলম্যান
‘No One Should Die Penniless and Alone’: The Victims of Britain’s Harsh Welfare Sanctions
“আমরা জানি ডেভিড ক্ল্যাপসন মরিয়া হয়ে কাজ খুঁজছিলেন। কেননা তাঁর মৃতদেহ থেকে কয়েক মিটার দূরেই বায়োডেটার স্তূপ পাওয়া গেছে। এগুলো তিনি নতুন প্রিন্ট করেছিলেন। মৃত্যুর কয়েক দিন আগে বোনের সাথে শেষবার আলাপের সময় বলেছিলেন, লিডি সুপারমার্কেট চেইনে চাকরির জন্য তিনি একটি আবেদন করেছেন, তাদের কাছ থেকে জবাব আসার অপেক্ষা করছেন।”
রহস্য উন্মোচন (৪ নম্বর অনুচ্ছেদে): “কী কারণে ক্ল্যাপসনের মৃত্যু হলো—তা নিয়ে বিস্তারিত পর্যালোচনা করেছেন অনেকেই। তাঁরা ক্রমবর্ধমান শাস্তিমূলক (কিংবা আপনার দৃষ্টিকোণ অনুসারে কঠোর) সরকারি নিয়ম সংস্কারের প্রচারণা চালাচ্ছেন…”
শর্টহ্যান্ড সোশ্যাল / জনি জেকবসন
The Big Issue: A Hand Up from the Streets
দ্য বিগ ইস্যু: আ হ্যান্ড ফ্রম দ্য স্ট্রিটস
“নোয়েল কুলিনেইন, ৫০, বার্মিংহামে জন্ম ও বেড়ে ওঠা।
“’বিগ ইস্যুতে (যুক্তরাজ্যের খবরের কাগজ) কাজের আগে আমাকে নদীর পাড়ে থাকতে হয়েছে, আমি সেনাবাহিনীতে সৈনিক ছিলাম।”
রহস্য উন্মোচন (অনুচ্ছেদ ৮, যদিও এগুলো ছোট ছোট অনুচ্ছেদ!): “নোয়েল এবং তার মতো শত শত মানুষের জীবন রক্ষাকারী কবচ, দ্য বিগ ইস্যু।”
আইকিউ৪ নিউজ / ইয়েমিসি আকিনবোলা, পল ব্র্যাডশ এবং ওগেচি একেনিয়াও
Follow the Money
অর্থের উৎস অনুসরণ
“২০১৪ সালের জানুয়ারি।
৩০ জন যুবকের একটি দলের মধ্যে রয়েছেন লেগোসের এবুকা ওগবুয়েহি এবং জোয়েল ইজেহ, তাদের বয়স ১২ বছরের মতো। তারা দক্ষিণ-পূর্ব নাইজেরিয়ার কালাবার সমুদ্রবন্দর থেকে একটি নৌকায় উঠতে যাচ্ছে, গন্তব্য ক্যামেরুন। সঙ্গে আছেন দুইজন ফুটবল কোচ—একজন তাদের কোচ, এমা (উচ্চারণ: ইমা) নামে পরিচিত — একজন সেবিকা, একজন ধোপা এবং ফুটবল এজেন্ট এরিক ফ্রেড টুমি।”
এই গল্পে রহস্য উন্মোচন করা হয় অধ্যায় ২-এ, বাক্যটি “Player trafficking” দিয়ে শুরু করা হয়েছে:
“প্যারিসভিত্তিক দাতব্য সংস্থা ফুট সলিডাইরির ২০১৩ সালের গবেষণায় দেখা যায়, প্রতি বছর প্রায় ১৫ হাজার কিশোর পশ্চিম আফ্রিকা থেকে ইউরোপ এবং অন্যান্য দেশে পাড়ি জমায়।”
ওই কিশোরদের অভিজ্ঞতার গল্পগুলো এতটাই রোমাঞ্চকর যে, বিস্তারিত প্রেক্ষাপট না বলেও বেশকিছু সময়জুড়ে পাঠকের মনোযোগ ধরে রাখা যায়। তবে বিকল্প পদ্ধতিতে তাদের গল্পের কিছু অংশ পরেও তুলে ধরা যেতে পারত। পাঠক যেন তথ্যভিত্তিক পটভূমি (ফ্যাক্টচুয়াল ব্যাকগ্রাউন্ড) পড়ার সময় ওই কিশোর এবং এজেন্টের ভাগ্যে কী ঘটেছিল তা জানার অপেক্ষায় থাকেন।
ফিনান্সিয়াল টাইমস / জেমস কিনজ, লাইলা হাদৌ, এবং মাইকেল পিল
How China Bought Its Way into Cambodia
চীন কীভাবে কম্বোডিয়ায় প্রবেশের সুযোগ তৈরি করলো
“কম্বোডিয়ার চীনা ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ে পরিচিত নাম ‘বিগ ব্রাদার ফু’। তিনি চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মির একজন প্রাক্তন কর্মকর্তা। পেশীবহুল শরীর ও ভারী কণ্ঠস্বর তাঁর ব্যক্তিত্বকে আরো আকর্ষণীয় করে তুলেছে। তবে শারীরিক শৈলীর তুলনায় তাঁর রাজনৈতিক সংযোগের ওজন বেশি।”
কাজের মাধ্যমে শুরু
ব্যক্তির কাজের বর্ণনার মাধ্যমে গল্পের বুনন দ্রুত আগাতে থাকে। শুরুটা করতে পারেন ব্যক্তির সঙ্গে কারো কথোকথন থেকে (আপনার কিংবা তাঁর কোনো সহকর্মীর সাথে); কিংবা স্মৃতিচারণা, রান্না করা, বা তাঁর কাজের সঙ্গে সম্পর্কিত কিছু দিয়ে।
একটি ভালো উদাহরণ হচ্ছে দ্য লইয়ার হু টেইকস দ্য কেসেস নো ওয়ান ওয়ান্টস শিরোনামের প্রতিবেদনটি। শুরুটা করা হয়েছে এভাবে :
“মাসের মধ্যে দুই বা তিনবার অ্যাবিংডনের বাড়ি থেকে স্ত্রী এবং তিন সন্তানকে বিদায় জানিয়ে টম গাইলস গাড়ি চালিয়ে উত্তর দিকের অক্সফোর্ডশায়ারের অভিবাসন কেন্দ্র ক্যাম্পসফিল্ডে যান।”
এখানে দেখুন, তাঁর গাড়ি চালানোর বর্ণনাটি একটি আবহ তুলে ধরে:
“এটি টোরিদের শক্ত ঘাঁটি—ধান ক্ষেত, পরিচ্ছন্ন গ্রাম আর চার-চাকার গাড়ি চলাচল করে। ক্যাম্পসফিল্ড গ্রামের শেষ সীমানায় অবস্থিত অক্সফোর্ড বিমানবন্দরের প্রাইভেট জেটগুলো যেখানে নামে এবং প্রশিক্ষণ বিমানগুলো যেখানে রাখা হয় তার বিপরীতে। নির্বাচনী মানচিত্র অনুযায়ী এটি টোরি শাসিত ডেভিড ক্যামেরনের উইটনি অঞ্চলের শেষে এবং বরিস জনসনের পুরানো হেনলি অঞ্চলের নিচে অবস্থিত।
লেখার এ কৌশলটিতে যদিও সাধারণ মানুষের গল্প দিয়ে শুরু করা হয়। তবে চরিত্রের চেয়ে পরিবেশ বা পটভূমি কিংবা ঘটনার স্থল বা পরিস্থিতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এরা গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রের মতো কাজ করে।
বিবিসি/ রুস্তম কোবিল
“খোজাবায় একজন জেলে, থাকেন মরুভূমিতে।
একটা সময় তাঁর গ্রামের প্রায় সবাই মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করত। কিন্তু ১৯৭০-এর দশকে সমুদ্র শুকিয়ে মাছ মারা যেতে শুরু করে।
গত ৪০ বছরে প্রায় ৬০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃর্ণ জলরাশি ক্রমশ হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে, যার গভীরতা ছিল ৪০ মিটার।
ক্যাস্পিয়ান সাগর, লেক সুপিরিয়র এবং ভিক্টোরিয়ার পর মধ্য এশিয়ায় আরাল সাগর একসময় পৃথিবীর চতুর্থ বৃহত্তম হ্রদ হিসেবে পরিচিত ছিল। এখন এর মাত্র ১০ শতাংশ অবশিষ্ট আছে।”
এখানে দেখুন, প্রতিবেদনের শুরুতে এ বর্ণনাটি দারুণভাবে মানিয়ে যায়। কারণ এখানে “জায়গা” বা ”পরিবেশ” নিজেই একটি গল্প বা চরিত্র।
অপেক্ষা কিন্তু কেন/ টিম আরবান
From Muhammad to ISIS: Iraq’s Full Story
মোহাম্মাদ থেকে আইএসআইএস: ইরাকের পুরো ঘটনা
“ আগস্ট ২, শনিবার সকালে, ইরাকের কুর্দি আঞ্চলের রাজধানী এরবিল থেকে আমি একটি ট্যাক্সিতে চড়ি এবং চালককে খাজির শরণার্থী শিবিরে যেতে বলি।
কাজটি ছিল ভীতিকর।
‘ভীতিকর‘ এই কারণে যে, খাজির শিবির স্বায়ত্তশাসিত কুর্দি অঞ্চলের সীমা—যা দেশের একমাত্র নিরাপদ অংশগুলোর একটি—এর খানিক বাইরে অবস্থিত।”
এখানে, আমাদের প্রোটাগনিস্ট (প্রতিবেদক এবং চালকের কথা বলা হচ্ছে) রয়েছে। কিন্তু ঘটনার পটভূমি বা জায়গার বর্ণনা এখানে গুরুত্বপূর্ণ। পাঠক হিসেবে যা আমাদের মনে দাগ কেটে যায়। আমরা ভয় পেতে শুরু করি—আতঙ্কিত হই। প্রতিবেদনের শুরুতেই একটা চ্যালেজিং পরিবেশের কথা বলা হয়; আমরা ভাবতে থাকি, রিপোর্টার কী এখানে নিরাপদ থাকতে পারবে?
একশ রিপোর্টার/খাদিজা শরীফ
Trade Secrets: Coca-Cola’s Hidden Formula for Avoiding Taxes
ব্যবসায়িক গোপনীয়তা: কর এড়ানোর জন্য কোকা–কোলার গোপন সূত্র
“হোটেলের দরজাটি ছিল বিভাজন রেখা, দুটো ভিন্ন জগতকে সম্পূর্ণ আলাদা করে রেখেছিল। দরজার ভেতরে স্বপ্নময় পরিবেশ—লোকেদের গায়ে সুন্দর পরিপাটি পোশাক, তাঁরা নিচুস্বরে কথা বলছেন, ঠান্ডা বাতাস; আর বাইরেটা রঙচটা উত্তপ্ত, ফুটপাথে বিক্রেতাদের সোরগোল—অন্তর্বাস, চিনাবাদাম, সানগ্লাস বিক্রি হচ্ছে। আমি আমার বাবার কাঁধে বসা, তার কান ধরে আছি। বলছি, ১৯৮০-এর দশকের শেষের দিকের লুসাকার কথা। জনসেবা বাজেটে ব্যাপক কাটছাঁটের ফলে জাম্বিয়া তখন ক্ষুধা, দাঙ্গায় জর্জরিত। আফ্রিকার অধিকাংশ দেশ একই পরিস্থিতির শিকার। যে সময়টাকে আমরা এখন ডাকি ‘হারানো দশক‘ নামে। ওয়াশিংটনের অর্থনৈতিক সংস্কার নীতির কারণে একটির পর একটি দেশ খেলনা ডমিনোর মতো ধসে পড়ছিল। আমার বাবা উপসাগরীয় উন্নয়ন ব্যাংকের বোর্ডে ছিলেন, যাঁরা আফ্রিকার দেশগুলোতে দারিদ্র্য নিরসনের লক্ষ্যে সহায়তা কর্মসূচী পরিচালনা করতো—অন্তত তাঁরা এটা মনে করতেন। লুসাকার হোটেল, যেখানে আমরা ছিলাম এর ভেতর ও বাইরের দরজাগুলো যতটা না বাস্তব তার চেয়েও প্রতীকী ছিল; যা অর্থ, জাতি, এবং সামাজিক ব্যবধানকে তুলে ধরে। তবে ভেতরের সঙ্গে বাইরের কেবল একটিই মিল: কোকা–কোলা। পানীয়টিকে চটকদার রেস্তোরাঁয় কেতাদুরস্তভাবে যেমন পরিবেশন করা হতো, তেমনি ছোট ঠেলাগাড়িতে করে রাস্তার পাশেও বিক্রি করা হতো।”
লেখার প্রথম কয়েকটি শব্দই মনোযোগ টেনে নেয়: “হোটেলের দরজাটি ছিল বিভাজন রেখা“—যা কেবল একটি জায়গার চিত্রই তুলে ধরে না বরং সমস্যা ও বিভাজনের কথাও বলে— কিন্তু কিসের বিভাজন?
এ পদ্ধতিটি প্রকৃতপক্ষে একটি প্রতীকী উপস্থাপনার উদাহরণ। কোনো গল্পে যখন সমাজের বিভাজনের বিষয়গুলো প্রতিফলিত হয়, অথবা কাঠামোগত জটিলতা থাকে—তখন তা এভাবে রূপক অর্থে তুলে ধরা যায়। (অনেকটা এসচারের প্রিন্টের মতো, যেখানে বিভিন্ন জটিলতা থাকে, কিন্তু সম্পর্কিত বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়।)
বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে শুরু করা
আপনার গল্পে যদি আকর্ষণীয় বা কৌতূহল উদ্রেককারী বিষয় থাকে, তবে তা দিয়ে শুরু করতে পারেন। দ্য চিলড্রেন, হিডেন হোমলেস অ্যান্ড দ্য উইমেন হু হ্যাভ সাফারড ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স– দিস আর দ্য স্টোরিজ ফ্রম ইনসাইড আ ম্যানচেস্টার ফুডব্যাংক ইন ২০১৮— শিরোনামের প্রতিবেদনটি যেমন।
“ছোট একজোড়া জুতা আর নবজাতকের কিছু ন্যাপি রাখা হয়েছে ম্যানচেস্টারের কেন্দ্রীয় ফুডব্যাংকের স্টোররুমের তাকে।”
গুদামঘরটি বেশ গোছানো এবং গৃহস্থালীর বিভিন্ন জিনিসপত্র দিয়ে ঠাসা।”
যা মেটোনিমি বা সিনেকডোক (রূপক বা আলংকারিক শব্দ) হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে– যেখানে কোনো কিছুর একটি অংশ পুরো বিষয়টিকে উপস্থাপন করে। যেমন ব্যবস্থা বা সিস্টেমের রূপক হিসেবে জটিল কোনো খেলনার কথা বলা যেতে পারে, যা আপনি খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন।
আপনি যদি এভাবে শুরু করেন, সেক্ষেত্রে পাঠকের কাছে আপনার অব্যক্ত প্রতিশ্রুতি হচ্ছে, লেখার কোনো না কোনো পর্যায়ে গোটা বিষয়টা পরিষ্কারভাবে তুলে ধরবেন। যেমন উপরের গল্পে পরবর্তী লাইনটি হচ্ছে: “যা কেবল ম্যানচেস্টারের সাধারণ মানুষের উদারতার প্রমাণ নয়, জরুরি সহায়তা চাহিদা বৃদ্ধির সাক্ষ্য বহন করে।”যা দ্রুত পাঠকের কৌতূহল মিটিয়ে দেয়। আপনি যদি টানতে থাকেন, পাঠক হাল ছেড়ে দিতে পারে, হতাশ হতে পারে এবং দোটানায় পড়তে পারে যে, এর মাধ্যমে আপনি অন্য কিছু বলতে চাইছেন কিনা।
যুদ্ধের প্রতিবেদনের ক্ষেত্রে যেমন” শিশুদের টেডি বিয়ার” নিয়ে আসা হয়— যা সবচেয়ে সস্তা উপস্থাপন। এখানে যেমনটা করা হয়েছে—স্যাটিরাইজড ইন দ্য নিউজরুম সিটকম ড্রপ দ্য ডেড ডঙ্কি।
লেখার শুরুতে আপনি যদি কোনো ব্যক্তি, জায়গা বা কাজের বর্ণনা দিয়ে শুরু করেন তাহলে তা অন্তর্নিহিত প্রশ্ন উত্থাপন করে। পাঠক মনে মনে ভাবতে থাকেন, “ওই ব্যক্তি, জায়গা বা পরিস্থিতি কেন এখানে গুরুত্বপূর্ণ?” কখনও কখনও আপনি সরাসরি পাঠককে প্রশ্ন ছুড়ে দিন।
আফটার দ্য আইস বাকেট চ্যালেঞ্জ: দে রেইজড $১১৫মিলিয়ন ফর দ্য ফাইট এগেইনস্ট এএলএস। সো হাউ ডিড দে স্পেন্ড ইট?— ডেভিড কক্সের প্রতিবেদনে যেমনটা করা হয়েছে:
“অসুখটি সম্পর্কে জানাবোঝার ঘাটতি থাকলেও, অনেকেই যখন অর্থ তুলতে আইস বাকেট চ্যালেঞ্জে সাড়া দেয়, তখন বিপুল পরিমাণ তহবিল জমা হয়। প্রথম ধাপে ওই অর্থ কোথায় কী খরচ হয়েছে তা প্রকাশের পর ডেভিড কক্স পরের ধাপ সম্পর্কে প্রশ্ন ছুড়ে দেন—তিনি জানতে চান রোগীদের ভাগ্যে কী ঘটেছে।
যা গল্পের সারসংক্ষেপ। কিন্তু এখানে সমস্যা আর ব্যক্তিকে তুলে ধরা হয়েছে। অনুসন্ধানের মাধ্যমে যে সমাধান (বা রহস্য) উদঘাটন করবে।
এখানে লক্ষ্যনীয় বিষয় হচ্ছে, গল্পের প্রথম অনুচ্ছেদে চরিত্র, পটভূমি এবং সমস্যাকে কৌশলের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে:
“ওয়াশিংটন ডিসির এএলএস অ্যাসোসিয়েশন (এএলএসএ )-এর সদর দপ্তর। ক্যারি মঙ্ক আজও স্পষ্টভাবে সেদিনের ফোন কলের কথা মনে করতে পারেন। সেদিন কেউ তাকে প্রথমবারের মতো আইস বাকেট চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন। ‘আগস্টের প্রথম সপ্তাহের কথা। অফিসের বাইরে আমি একটি মিটিংয়ে ছিলাম,’ বলেন মঙ্ক, তিনি এএলএসএর প্রধান যোগাযোগ কর্মকর্তা। ‘আমি ফোন ধরলাম। ফোনটি এসেছিল আমাদের ম্যাসাচুসেটস কেন্দ্রের একজন নির্বাহীর কাছ থেকে। তিনি বললেন, ‘আপনাদের জানাতে চাই যে, বড় কিছু ঘটছে।’ আমরা দ্রুত আমাদের ফান্ডরাইজিং পরিসংখ্যান খুলে দেখলাম। আগের বছরের তুলনায় প্রায় ৫০ হাজার ডলার বেশি অর্থ জমা পড়েছে। কিন্তু কোথা থেকে এসেছে – কেউ জানে না।’”
সমস্যার কথা দিয়ে শুরু করুন
প্রোপাবলিকা / লেনা গ্রোগার
ক্রুজ কন্ট্রোল (জাহাজ নিয়ন্ত্রণ)
“প্রতি বছর ২ কোটি ২০ লাখেরও বেশি যাত্রীর জন্য বিলাসবহুল জাহাজে চড়ে অবকাশজাপন অনেকটাই স্বপ্নের মতন, যেখানে সমস্ত ধরনের আনন্দ-ফূর্তির পাশাপাশি আছে অলস সময় কাটানোর বন্দোবস্ত।
তবে, শত শত মানুষের জন্য এটা স্বপ্নাতীত। গত বছর ১ হাজার ৭শর বেশি যাত্রী এবং ক্রুজ সদস্য নোরোভাইরাস সংক্রমণের ফলে অন্ত্রের রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। ২০১২ সালের পর থেকে অন্তত সাতজন শিশু ক্রুজশিপের পুলে ডুবে গেছে। সবসময়ের জন্য লাইফগার্ড না থাকাতে ডুবে যাওয়ার ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। এ বছর, ২১ বছর বয়সী একজন কলেজ শিক্ষার্থী জাহাজ থেকে পড়ে যায়। তাকে আর কখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, এটি গত দুই বছরে ঘটে যাওয়া অন্তত দুই ডজন ঘটনার মধ্যে একটি। আগেও জাহাজ থেকে যাত্রী বা ক্রুজ সদস্যদের পড়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে।”
এখানে হুক-অ্যান্ড-টুইস্ট পদ্ধতির দিকে লক্ষ্য করুন: প্রথমে পাঠকের আগ্রহ ধরে রাখতে আকর্ষণীয় পটভূমি বা তথ্য তুলে ধরা (যা “হুক” হিসেবে কাজ করে), এরপর সেই দৃশ্য বা তথ্যের সাথে অপ্রত্যাশিত বা বিপরীতমুখী ঘটনা যোগ (যা “টুইস্ট” হিসেবে কাজ করে)।
প্রথম অনুচ্ছেদের শুরুটা হয়েছে ‘ইতিবাচক’ ভাবে। পাঠক হিসেবে আমরা বুঝতে পারি— বা অনুমান করতে পারি, যে মনোরম গল্পের কথা বলা হচ্ছে, সেখানে আসলে একটা ”কিন্তু” আছে। দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে পাঠকের সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়: “কিন্তু…”
আর এই “কিন্তু”টা গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি তথ্যবহুল ও সত্য: যেখানে অনুমানের মাধ্যমে “অনেক মানুষ” এভাবে শুরু করা হয়নি। বরং স্পষ্টভাবে ১ হাজার ৭০০ জন মানুষের সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে। ক্রমাগত সুনির্দিষ্ট তথ্য দেওয়া হয়েছে: যা দ্রুতই ১ হাজার ৭০০ জন মানুষ থেকে “সাতটি শিশু” এবং “একটি ২১ বছর বয়সী কলেজ শিক্ষার্থী”র কথা বলে।
আর এ তথ্যগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ: যা তুলে ধরে যে প্রতিবেদক সত্যিই বাইরে গিয়ে কাজটি করেছে। তথ্যগুলো যদি অস্পষ্ট এবং সাদামাটা হয়, তবে অবিলম্বেই পাঠকের মনে সন্দেহ জাগে: প্রতিবেদক কী কোনো বিষয়কে এড়িয়ে যাচ্ছে? যেগুলো নিয়ে তাঁরা সত্যিকার অর্থেই কোনো অনুসন্ধান চালায়নি।
এটি অনেকটাই পাঠকের কাছে প্রতিবেদকের অব্যক্ত প্রতিশ্রুতি: যার মাধ্যমে তাকে বলা হয়, এখানে অনেক বড় ঘটনা আছে— একে একে আমরা তা তুলে ধরবো।
শুরু করুন নতুন কোনো উদঘfটন দিয়ে
প্রতিবেদনের গল্পে দীর্ঘ প্রতিবেদনের চেয়ে এই পদ্ধতিটি বেশি প্রচলিত। যেখানে মূল তথ্যের ওপর ভিত্তি করে আপনার অনুসন্ধান শুরু হয়, যেমন “একটি অনুসন্ধানে বলা হয়েছে” বা “পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে” বা “তথ্য প্রকাশিত হয়েছে।” যেমন:
বিবিসি / সামান্থা পোলিং
Bankrupts Enjoy ‘Lavish Lifestyles’
“দেউলিয়া ব্যবস্থার দুর্বলতাকে পুঁজে করে অপরাধী ও অসৎ দেনাদাররা তাদের ধন–সম্পদ ধরে রাখছে— এ তথ্যে উঠে এসেছে বিবিসির অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে।”
যা পাঠকের আগ্রহ তৈরি করে— তাঁরা আরো জানার তাগিদ বোধ করে। ঘটনার গভীরে নিয়ে যাওয়ার আগে এ পর্যায়ে দর্শক বা পাঠকের সামনে বিভিন্ন উদাহরণ হাজির করা হয়। এরপর নির্দিষ্ট ব্যক্তি ও ঘটনার সাথে জড়িতদের বিস্তারিত তথ্য দেওয়া হয়।
লক্ষ্য করুন, এ পদ্ধতিটি চারপাশের জটিলতার তুলনায় প্রকাশিত তথ্যের ওপর বেশি জোর দেয়। এর উল্টো পিরামিড কাঠামোটি পাঠকের কথা বিবেচনায় নিয়ে প্রথমেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি দিয়ে দেয়। তবে তা জানার পর পাঠক হিসেবে আপনি যদি লেখাটি পড়া থামিয়ে দেন, সেক্ষেত্রে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। কারণ আপনি খুব গুরুত্বপূর্ণ কোনো তথ্য মিস করেননি।
লক্ষ্য করুন, এ কৌশলের মাধ্যমে বিষয়বস্তুর গভীর বা জটিল দিকগুলো তুলে ধরার চেয়ে বরং প্রকাশিত তথ্য বা গুরুত্বপূর্ণ সত্যের ওপর জোর দেওয়া হয়।পাঠক সাধারণত ধৈর্য ধরে পড়তে চান না— এ চিন্তা থেকে উল্টানো পিরামিড কাঠামোটি ব্যবহার করা হয়। তাই প্রথমেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি বলে দেওয়া হয়। পাঠক পড়া থামিয়ে দিলেও যেন মূল ঘটনা বুঝতে পারেন।
এই পদ্ধতির সুবিধা হচ্ছে—পাঠক সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেওয়া হবে— যা একই সঙ্গে একটি দুর্বলতাও: অনেক পাঠক আবার পুরোটা পড়তে আগ্রহী হতে পারেন।
পাঠকের ধৈর্যের উপর আস্থা রেখেই উপরে বর্ণিত অন্যান্য পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করা হয়। এভাবে কখনও কখনও গল্পের গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলো নিচে চাপা পড়ে।
তবে সুবিধা হচ্ছে, এটি পাঠকের সম্পৃক্ততাকে উৎসাহিত করে। অসুবিধা হলো, আপনি পাঠককে হতাশ বা বিরক্ত করতে পারেন। কারণ তাদের গল্পের মূল পয়েন্টটি চটজলদি দিচ্ছেন না। এই চাপের সঙ্গে সমঝোতা করাই সম্পাদনার শিল্পের একটি অংশ।
পরীক্ষা-নিরীক্ষা
কীভাবে শুরু করবেন—এ পদ্ধতিগুলো নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা আপনাকে আপনার গল্প বলতে সাহায্য করতে পারে: আপনার গল্পটি কি একজন ব্যক্তি নিয়ে, নাকি একটি স্থান ঘিরে? কোনো কিছুর বিস্তারিত বর্ণনা কি আপনার মনে দাগ কাটে—যা গল্পের গুরুত্বপূর্ণ দিককে তুলে ধরে?
গল্প বলার ক্ষেত্রে আপনি কোন পদ্ধতি বেছে নিবেন—সে বিষয়ক যৌক্তিক ভিত্তি দিতে পারে। আপনি কীভাবে অগ্রসর হবেন— দিতে পারে সে বিষয়ক দিকনির্দেশণাও। যদি কোনো ব্যক্তির কথা দিয়ে শুরু করেন—তাহলে আপনি কী পাঠককে দেওয়া অব্যক্ত প্রতিশ্রুতি পূরণে সফল হবেন? অচিরেই প্রমাণ করতে সক্ষম হবেন যে, ওই ব্যক্তি কেন গুরুত্বপূর্ণ? প্রতিবেদনটি পড়া বা দেখার পর পাঠক/দর্শক কী জেনেছিলেন শেষমেশ ওই ব্যক্তির কী হয়েছিল (অথবা কী ঘটার কথা ছিল)?
পাঠক, আপনি যদি দীর্ঘ গল্প এবং ফিচার শুরুর আরো কোনো পদ্ধতি সম্পর্কে জেনে থাকেন, তবে অনুগ্রহ করে মন্তব্যের ঘরে লিখুন অথবা টুইটারে @paulbradshaw-এ আমাকে জানান।
এ নিবন্ধটি প্রথম প্রকাশিত হয় পল ব্র্যাডশ’র অনলাইন জার্নালিজম ব্লগে। অনুমতি নিয়ে এখানে পুনঃপ্রকাশিত হলো।
পল ব্র্যাডশ বার্মিংহাম সিটি ইউনিভার্সিটিতে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ডেটা সাংবাদিকতা এবং মাল্টিপ্ল্যাটফর্ম অ্যান্ড মোবাইল জার্নালিজম বিভাগ পরিচালনা করেন। অনলাইন সাংবাদিকতা এবং ইন্টারনেট সম্পর্কিত বিভিন্ন বই লিখেছেন। এর মধ্যে রয়েছে অনলাইন জার্নালিজম হ্যান্ডবুক, ফাইন্ডিং স্টোরিজ ইন স্প্রেডশিটস, ডেটা জার্নালিজম হেইস্ট এবং স্ক্রেপিং ফর জার্নালিস্টস।