কর্মক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা: উঠতি অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের জন্য পরামর্শ
আর্টিকেলটি পড়ুন এই ভাষায়:
অনুসন্ধানী সাংবাদিক হিসেবে চাকরি জোগাড় করা কখনোই সহজ ছিল না, কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে তা আরও কঠিন হয়ে উঠেছে। পুরো মিডিয়া ইন্ডাস্ট্রিতে চাকরির বাজার ক্রমশ ছোট হচ্ছে, এবং বিপুলসংখ্যক সংবাদকর্মী নিয়ে বিজ্ঞাপনসমৃদ্ধ প্রকাশনার যুগ গত হয়েছে অনেক আগেই। তবু ওয়াচডগ সাংবাদিকতার মতো আকর্ষণীয় বা অপরিহার্য কাজের ক্ষেত্র কমই আছে।
সত্তর দশকের ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি থেকে শুরু করে আজকের দিনে শিরোনামে জায়গা করে নেওয়া প্যান্ডোরা পেপার্স পর্যন্ত, দুর্নীতি ও অপরাধ উদ্ঘাটনের মতো ঘটনায় অনুসন্ধানী সাংবাদিকেরা সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। যেকোনো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় তারা অপরিহার্য অংশ, এবং স্বৈরতান্ত্রিক ও দমনমূলক শাসনব্যবস্থায় তাদের উপস্থিতি বেশি প্রয়োজন। অনেক বাধার পরও অসংখ্য তরুণ এই পেশায় আসতে আগ্রহী। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম কনফারেন্সে উপস্থিত ৪৪ শতাংশের বয়স ৩৫ বছরের নিচে।
কিন্তু এই পেশায় আসার উপায় কী? সব সময় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাই কি একমাত্র উপায়, নাকি স্বশিক্ষিত রিপোর্টার হিসেবেও আপনি সফল হতে পারেন? আর বিশ্বব্যাপী রিপোর্টাররা যখন ভয়ভীতি ও সেন্সরশিপ, গ্রেপ্তার ও ধরপাকড়, হয়রানি ও নির্যাতন এবং ব্যয়বহুল ও দীর্ঘদিন ধরে চলা স্ল্যাপ মামলার (স্ট্র্যাটেজিক লস্যুটস অ্যাগেইনস্ট পাবলিক পার্টিসিপেশন) শিকার হচ্ছেন, তখন পেশা হিসেবে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার চ্যালেঞ্জগুলো কী?
আসলে একজন নতুন অনুসন্ধানী সাংবাদিক হিসেবে কর্মক্ষেত্রে জায়গা করে নেওয়ার কোনো একমাত্র “সঠিক” উপায় নেই। কেউ কেউ শুরু করেন স্থানীয় পত্রিকায় শিক্ষানবিশ হিসেবে, আর অন্যরা শেখেন স্বাধীন রিপোর্টার হিসেবে আঞ্চলিক প্রকাশনায় পিচ করে করে। অনেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা পড়েন, আবার আইন বা কম্পিউটার বিজ্ঞানের মতো অন্য ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ নেন। অনেকেই অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় আসার আগে রিপোর্টার হিসেবে প্রশিক্ষণ নেন অন্য কোনো ক্ষেত্রে।
বিষয়টি নিয়ে বিশ্বের ছয় তরুণ রিপোর্টারের সঙ্গে কথা বলেছে জিআইজেএন। জানতে চেয়েছে, এই পেশায় আসার ক্ষেত্রে তাঁরা প্রথম সুযোগটি কীভাবে পেলেন এবং নতুনদের জন্য তাঁদের কী পরামর্শ থাকবে। আনুষ্ঠানিকভাবে বয়সের মাপকাঠিতে তারুণ্যের সীমারেখা টানা না হলেও তাঁদের অধিকাংশের বয়স ত্রিশের কোঠায় এবং অভিজ্ঞতা এক দশকের কম। এখানে রইল তাঁদের দেওয়া কিছু পরামর্শ:
মাহিমা জেইন, ভারত
মাহিমা একজন স্বাধীন সাংবাদিক এবং তিনি পরিবেশ, জেন্ডার, স্বাস্থ্য ও আর্থসামাজিক বিষয় নিয়ে রিপোর্ট করেন। তাঁর কাজে ভারতজুড়ে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবন ও পদ্ধতিগত ইস্যুগুলো উঠে আসে। তিনি থমসন ফাউন্ডেশন ইয়ং জার্নালিস্ট অ্যাওয়ার্ড ২০২১ এর ফাইনালিস্ট, এবং তাঁর বেশ কিছু বাইলাইন স্টোরি ভারতীয় এবং দ্য গার্ডিয়ান, ডের স্পিগেল, দ্য ফুলার প্রজেক্ট ও মোঙ্গাবের মতো আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। এর আগে তিনি দ্য হিন্দু গ্রুপ, ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব হিউম্যান সেটেলমেন্ট ইন ইন্ডিয়া ও যুক্তরাজ্যের লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের সাউথ এশিয়া সেন্টারের সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন।
অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা করার প্রথম সুযোগ কীভাবে পেলেন?
আশপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা পদ্ধতিগত অসমতা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপনের মধ্য দিয়ে অনুসন্ধানে আমার আগ্রহের সূত্রপাত। সাড়া জাগানো কেলেঙ্কারি, করপোরেট অনিয়ম ও দুর্নীতির মতো বিষয়গুলোর গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে আমি এই বিষয়গুলোর পরিবর্তে সমাজ, সরকার ও সরকারি প্রতিষ্ঠান কীভাবে ও কেন নির্দিষ্ট ধরনের অসমতা তৈরিতে অবদান রাখে ও মেনে নেয় এবং আমাদের চারপাশের বিধিব্যবস্থায় যে বিষয়গুলো আছে, সেগুলো নিয়ে অনুসন্ধানে আগ্রহী ছিলাম।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতাকে ভারত যেভাবে ফৌজদারি বিচারযোগ্য বিষয় হিসেবে দাঁড় করিয়েছে, তার প্রভাবে সাধারণ মানুষও নারীদের প্রতি সহিংসতাকে নিছক অপরাধ ও শাস্তিযাগ্য বিষয় ভাবতে শিখেছে। কঠোর আইন ও বেশি বেশি শাস্তি—সাধারণ মানুষ ও রাজনীতিকদের মধ্যে বেশ স্বাভাবিক একটি প্রতিক্রিয়া হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। এই নিয়ে রিপোর্ট করার সময় দেখতে পাই, বিষয়টি স্বাস্থ্যসেবায় নারীর প্রবেশাধিকার ক্ষুণ্ন করে এবং জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাও বিষয়টি মোকাবিলায় অতটা গুরুত্ব দেয় না ।
এই পেশায় আগ্রহী উঠতি অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের জন্য আপনার পরামর্শ কী?
আমি মনে করি, ভালো গল্পে গভীর সংলাপ থাকতে হয়, এবং অনেক জিজ্ঞাসার মাধ্যমে গতানুগতিক প্রথাকে প্রশ্ন ও বিনির্মাণ করতে হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে, যারা মূলধারায় অবহেলিত তাদের সঙ্গে কথা বলাই অন্যায় ও অসমতার না-বলা গল্প খুঁজে বের করার সবচেয়ে ভালো উপায়। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সাধারণ মানুষের গল্পগুলো অসাধারণ, কিন্তু আমাদের জানতে হবে চাঞ্চল্য তৈরির প্রবণতা বাদ দিয়ে কীভাবে সমানুভূতি ও সংবেদনশীলতার সঙ্গে রিপোর্ট করতে হয়।
মনীষা গাঙ্গুলি, যুক্তরাজ্য
মনীষা একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিক ও তথ্যচিত্র নির্মাতা। তিনি সাংবাদিকতা ও চলচ্চিত্রে যুদ্ধ ও সহিংসতায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা উন্মোচন করতে ওপেন সোর্স ও প্রথাগত অনুসন্ধানী রিপোর্টিং কৌশল ব্যবহার করেন। বিবিসির জন্য তাঁর অনুসন্ধান অ্যামনেস্টি মিডিয়া অ্যাওয়ার্ডসহ বেশ কিছু আন্তর্জাতিক পদক জিতেছে এবং পদকের জন্য মনোনীত হয়েছে। তিনি বর্তমানে ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টমিনস্টারে পিএইচডি গবেষণায় যুক্ত। তাঁর গবেষণার বিষয়বস্তু অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় স্বয়ংক্রিয় ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন (এআই) ওপেন সোর্স টুল ব্যবহারের প্রভাব।
অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা করার প্রথম সুযোগ কীভাবে পেলেন?
প্রথম সুযোগ করে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ জানাই টেলিগ্রাফের অনুসন্ধানী সম্পাদক ক্লেয়ার নিউয়েলকে। এই মেধাবী সম্পাদক আমার ফ্রিল্যান্স কাজগুলো দেখে তাঁর পত্রিকায় ইন্টার্নশিপের সুযোগ দেন এবং পরবর্তীকালে অনুসন্ধানী সাংবাদিক হিসেবে আমি চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাই। আগে মূলত আমি নিজ উদ্যোগে ছোটখাটো কিছু প্রকাশনা ও আমার ব্লগের জন্য অনুসন্ধানী রিপোর্টিং করতাম ও লিখতাম। কারণ, শুধু শুরুর বাধা ও একজন অভিবাসী হিসেবে প্রতিকূলতার ভয়ে আমি অনুসন্ধানী সাংবাদিক হওয়ার স্বপ্ন দেখা বন্ধ করিনি।
এই পেশায় আগ্রহী উঠতি অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের জন্য আপনার পরামর্শ কী?
প্রত্যাখ্যান এই চাকরির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং “না” কে “হ্যাঁ” তে আনার উপায় জানা গুরুত্বপূর্ণ, হোক সেটা অন দ্য রেকর্ড সোর্স বা তথ্যচিত্রের গুরুত্বপূর্ণ কোনো নির্দেশনার ক্ষেত্রে। আর এ ক্ষেত্রে সফলতার মূল চাবিকাঠি হলো লেগে থাকা। তাই হাল ছাড়বেন না! আরও চেষ্টা করুন এবং সৃষ্টিশীল চিন্তা করুন। যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া না হলেও কল্পনা হলো অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার অবিচ্ছেদ্য অংশ।
কারিনা শেড্রোফস্কি, বসনিয়া-হারজেগোভিনা
কারিনা আটটি দেশে বিস্তৃত একটি গবেষক দল পরিচালনা করেন। এই দল অরগানাইজড ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন রিপোর্টিং প্রজেক্টের (ওসিসিআরপি) সাংবাদিকদের বিশ্বব্যাপী ব্যক্তি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও সম্পদ ট্র্যাক করতে সাহায্য করে। তিনি আজারবাইজানের ক্ষমতাসীন পরিবারের গোপন সম্পদ উদঘাটনে সহায়তার মাধ্যমে প্যারাডাইস পেপার, ড্যাফনে প্রজেক্টসহ ওসিসিআরপির বেশ কিছু অনুসন্ধানী প্রকল্পে গবেষণায় অবদান রেখেছেন। ওসিসিআরপিতে যোগদানের আগে কারিনার কর্মস্থল ছিল ইউএস টুডে। সেখানে তিনি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও ২০১৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে রিপোর্ট করেছেন।
অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা করার প্রথম সুযোগ কীভাবে পেলেন?
নিউইয়র্কের একটি আইনবিষয়ক অনলাইন সংবাদমাধ্যমে আমার যোগদান প্রায় নিশ্চিত ছিল। এমন সময় সারায়েভোতে ওসিসিআরপির ডেইলি নিউজ ইন্টার্নশিপের খবর জানতে পারি এবং সেখানে যোগদানের সিদ্ধান্ত নিই। ইন্টার্নশিপটি অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার না হলেও বিশ্বের বেশ কয়েকজন সেরা অনুসন্ধানী সাংবাদিকের সঙ্গে একই কক্ষে বসার সুযোগ করে দেয়। যতটা পারতাম, তাঁদের সাহায্য করার চেষ্টা করতাম এবং ইন্টার্নশিপ শেষে আমার চাকরি হয় এই প্রতিষ্ঠানের গবেষণা দলে। এই দল মূলত ওসিসিআরপি আইডি নামে অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের জন্য গবেষণা হেল্প ডেস্ক পরিচালনা করত। এই পদে আমি অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার মৌলিক বিষয়গুলো জানতে পারি এবং তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, ওসিসিআরপির ৫০টির বেশি সদস্য কেন্দ্রের সাংবাদিকদের সঙ্গে কাজ করতে পারি।
এই পেশায় আগ্রহী উঠতি অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের জন্য আপনার পরামর্শ কী?
অনুসন্ধানী গবেষণার দৃষ্টিকোণ থেকে আমি বলতে চাই, পাবলিক ইনফরমেশনের সঙ্গে আপনার পরিচিত হওয়া উচিত। এই ডেটা আপনার অঞ্চলেও পাবেন এবং আপনার জানতে হবে এই ডেটার সবটা কীভাবে জানা যায়। ওসিসিআরপিতে আমরা যে কাজ করি, তার পরিধি বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে এবং ক্রমাগত আমরা সারা বিশ্বের সাংবাদিকদের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছি। আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে ডেটা পেতে আমাদের ভাষাগত ও আঞ্চলিক দক্ষতা আছে। তবে আমার মতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, অনুসন্ধানী গবেষণা একরকম ধাঁধা।
মার্টিন লিয়ান্দ্রো আমায়া কামাচু, পেরু
আমায়া কামাচু নুবে রোহা (বাংলায় অর্থ হয় লাল মেঘ) নামের বর্ণনামূলক একটি ডিজিটাল ম্যাগাজিনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং থমসন ফাউন্ডেশন ইয়ং জার্নালিস্ট ২০২০ বিজয়ী। এ ছাড়া তিনি মালোস আবিতোস নামের একটি সাংস্কৃতিক ম্যাগাজিনের প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক ছিলেন। বর্তমানে তিনি পেরুর নির্বাচন, কৃষি রপ্তানি শিল্প ও পরিবেশবিষয়ক দুর্নীতি নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করছেন।
অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা করার প্রথম সুযোগ কীভাবে পেলেন?
আমি সব সময় সাংবাদিকতাকে জনগণের সেবা হিসেবে দেখি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সংবাদমাধ্যম সমাজের নেতিবাচক দিকগুলোতে পরিবর্তন আনতে পারে। যেমন; দুর্নীতি একটি ভয়াবহ বিপদ হিসেবে লাতিন আমেরিকার ক্ষতি সাধন করে আসছে। একই কারণে আমি শহরের সবচেয়ে বড় সংবাদপত্র পিউরার চাকরি ছেড়ে দিয়েছি এবং ফ্রিল্যান্স রিপোর্টার বনে গিয়ে এমন সব বিষয় নিয়ে কাজ করছি, মূলধারার গণমাধ্যম যা নিয়ে কাজ করে না। বাধাহীনভাবে কাজ করার ইচ্ছা নিয়ে আমি শুরু করি ম্যাগাজিন নুবে রোহা।
তরুণ সাংবাদিকদের সমন্বয়ে আমার বেশ বড় একটি দল আছে এবং আমার এই প্রকল্প ইতিমধ্যে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পদক জিতেছে। পেরুতে প্রভাবশালী সংবাদপত্রের অনুসন্ধানী ইউনিট হয় হারিয়ে গেছে, নয়তো নামের প্রতি সুবিচার করতে পারছে না। তাই স্বাধীন গণমাধ্যম হিসেবে আমরা সেই শূন্যতা পূরণের চেষ্টা করছি। আমরা মূলধারার বাইরের অনুসন্ধানী প্রকল্পগুলো করার লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি, যা ক্ষমতাসীনদের মাথাব্যথার কারণ হতে পারে। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা বলতে আমি বুঝি সত্যের অনুসন্ধান এবং ব্যবস্থা ও গণতন্ত্রকে গণমানুষের কাছাকাছি নিয়ে আসা।
এই পেশায় আগ্রহী উঠতি অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের জন্য আপনার পরামর্শ কী?
কোনো কিছুর অফিশিয়াল ভার্সন কখনো নেবেন না; কারণ, সব সময় সবকিছুর একাধিক ব্যাখ্যা থাকে। আমাদের বোঝা উচিত, মানসম্পন্ন সাংবাদিকতা বলতে কেবল রিপোর্টিং বোঝায় না, এটা একই সঙ্গে ডেটার ব্যাখ্যা এবং মানুষের ছবির সঙ্গে পরিসংখ্যানের ব্যবহার। কারণ, আমরা যা তুলে ধরি তা মানুষকে প্রভাবিত করে। সব সংস্কার পেছনে ফেলে রিপোর্টারদের একটি ঘটনাকে বিভিন্ন দিক থেকে দেখতে হয় এবং বিভিন্ন বিষয় ও ক্ষেত্র সম্পর্কে জানতে হয়। পাঠকের সামনে নির্ভরযোগ্য ও সত্য ডেটা তুলে ধরতে পরিসংখ্যান ও গণিতের মতো বিষয়ও জানতে হয়।
আন্দিসোয়া মাতিকিঙ্কা, দক্ষিণ আফ্রিকা
পরিবেশবিষয়ক রিপোর্টিং ও ডেটা সাংবাদিকতায় আগ্রহী আন্দিসোয়া একজন পদকজয়ী সাংবাদিক। তিনি কোড ফর আফ্রিকা ওয়ানাডাটা ফেলো এবং বর্তমানে অক্সপেকার্স ইনভেস্টিগেটিভ এনভায়রনমেন্ট জার্নালিজম প্ল্যাটফর্ম #মাইনএলার্ট নিয়ে কাজ করছেন। এই প্ল্যাটফর্মের তত্ত্বাবধানে ও জোগান দেওয়া ডেটার ভিত্তিতে তিনি বেশ কিছু অনুসন্ধান পরিচালনা করেছেন, যা তাঁকে ২০১৯ সালের ভোডাকম রিজিওনাল ইয়ং জার্নালিস্ট অ্যাওয়ার্ড ফর দ্য কোয়াজুলু-নাটাল রিজিওন এনে দিয়েছে।
অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা করার প্রথম সুযোগ কীভাবে পেলেন?
২০১৮ সালে স্নাতকের পরপর অক্সপেকারের সঙ্গে অনুসন্ধানী সংবাদিকতায় আমার প্রথম সুযোগ আসে। প্রতিষ্ঠানটি তাদের #মাইনএলার্ট নামে জিও-জার্নালিজম প্ল্যাটফর্মের জন্য একজন ইন্টার্ন খুঁজছিল। এই প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারকারীদের দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রযোজ্য ও অনুমোদিত খনি অনুসন্ধানের লাইসেন্স এবং খনি অনুসন্ধানসংশ্লিষ্ট পানি ব্যবহারের লাইসেন্স ট্র্যাক ও শেয়ার করতে সাহায্য করে। #মাইনএলার্ট ম্যাপের জন্য সংগৃহীত ডেটা অনেক অনুসন্ধানে কাজে লাগে। একই বছর আমি এই প্ল্যাটফর্মের প্রজেক্ট ম্যানেজার হই।
এই পেশায় আগ্রহী উঠতি অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের জন্য আপনার পরামর্শ কী?
আমি মনে করি, যেকোনো তরুণ ও উঠতি অনুসন্ধানী সাংবাদিককে পেশাগত জীবন ও কর্মপন্থা নির্ধারণে সদা সক্রিয় হতে হবে। কারণ, পেশাগত জীবনে যা-ই আসুক না কেন, এই সদ্গুণের কল্যাণে আপনি উতরে যেতে পারবেন। সোর্স আপনাকে হতাশ করবে, গুরুত্বপূর্ণ গল্প নিয়ে কাজের মাঝে পথ হারানোর মতো অনেক বাধা আসবে, তবে আপনি যদি সক্রিয় হন, শত বাধা সত্ত্বেও তা সামলে আপনি সেরাটা দিতে পারবেন।
ব্যাঞ্জো দামিলোলা, নাইজেরিয়া
অনুসন্ধানী সাংবাদিক দামিলোলা শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক বিচার নিয়ে রিপোর্ট করেন। তিনি ২০১৮ সালের ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালস ইয়ং জার্নালিস্টদের অন্যতম। তিনি জামফারা প্রদেশে ডাকাতদের হত্যাকাণ্ড ও অপহরণ নিয়ে অনুসন্ধান করেন, যা এই অঞ্চলে নিরাপত্তা জোরদারের দাবিতে দেশজুড়ে হওয়া প্রতিবাদে ভূমিকা রাখে। বিচার ব্যবস্থায় দুর্নীতি নিয়েও তিনি অনুসন্ধান করেন এবং পুলিশ, আদালত ও জেলখানার অনিয়ম তুলে ধরেন। দেশটির প্রধান প্রধান সংবাদমাধ্যম ও বিবিসির মতো আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে তাঁর কাজ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি জিআইজেএনের সঙ্গে ২০২১ সালের গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম কনফারেন্স নিয়ে কাজ করেছেন।
অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা করার প্রথম সুযোগ কীভাবে পেলেন?
অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় উৎসাহী এমন একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এই কাজে আসতে পেরে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি। দক্ষিণ-পশ্চিম নাইজেরিয়ার একটি প্রদেশের সরকারি স্কুলের জীর্ণদশা নিয়ে আমার প্রথম অনুসন্ধানী রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। গণমাধ্যমে প্রদেশটির গভর্নরের মিথ্যাচার নিয়ে আমি খুব বিরক্ত ছিলাম। প্রদেশের সরকারি শিক্ষাব্যবস্থায় তাঁর অবদান নিয়ে তিনি নিজেকে খুব জাহির করেন। আমার মনে হয়েছিল, সাধারণ মানুষের সামনে প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরতে সত্যটা বলা দরকার। তাই বাস্তব অবস্থা তুলে ধরতে আমি আত্মগোপনে চলে যাই। রিপোর্ট প্রকাশিত হলে খুব আগ্রহ নিয়ে প্রতিক্রিয়া দেখার অপেক্ষায় ছিলাম। পরে প্রাদেশিক সরকার একটি স্কুলের অবস্থান পরিবর্তন করে। প্রথম অনুসন্ধানের প্রভাব বেশ জোরালো ছিল, ঠিক যেমনটা চেয়েছিলাম।
এই পেশায় আগ্রহী উঠতি অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের জন্য আপনার পরামর্শ কী?
গৎবাঁধা সংবাদচক্রে হারিয়ে যাওয়া খুব স্বাভাবিক। তাই অনুসন্ধান প্রত্যাশিত তরুণ সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে সময় ব্যবস্থাপনা খুব জরুরি। নিউজরুমের নতুন সদস্য হিসেবে সংবাদ সম্মেলন ও ইভেন্ট নিয়ে ছোটাছুটিতেই আপনি হয়তো হাঁপিয়ে যাবেন। আগ্রহের বিষয় খুঁজে বের করুন এবং অবসর সময়ে গবেষণা করুন। আপনার অনুসন্ধানী কাজে প্রতিদিন দুই ঘণ্টা সময় ব্যয় করুন। নিউজরুমের পরিবেশ যতই ব্যস্ত হোক, একটা সময় সব শান্ত হয়, সেদিন সংবাদের চাপ কম থাকে। এই সময়টা আপনার অনুসন্ধানের তথ্য উদ্ঘাটনে কাজে লাগান।
পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিন। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা সহজ নয়। শত বাধা আসবে, সোর্স নিশ্চুপ থাকবে, আপনার পরিচিতজনেরা হঠাৎ আপনাকে এড়িয়ে চলবে, সরকার সময়মতো আপনার অনুরোধে সাড়া দেবে না এবং এমন হাজারো বিষয় আপনাকে হতাশ করবে। এমন প্রতিকূলতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এক পা পেছনে যান, এবং আপনার সম্পাদক বা আরও অভিজ্ঞ অনুসন্ধানী সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলুন। অভিজ্ঞ সহকর্মী ও সম্পাদকের অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারে অনেক কিছু আছে। সেখানে টোকা দিন।
সাহসী হোন, তবে বোকা নয়। “জীবনের চেয়ে রিপোর্টের গুরুত্ব বেশি নয়,” এই বাক্যের উত্তরে আমার এক অভিজ্ঞ সহকর্মী বলেন, “ভাগ্য সাহসীদের সহায় হয়।” প্রবাদ দুটির সত্যতা থাকলেও অনুসন্ধানী সাংবাদিককে ভারসাম্য খুঁজতে হবে। অনুসন্ধানী রিপোর্টে পরিবর্তনের সম্ভাবনা থাকে, তবে একই সঙ্গে সাংবাদিককে বিপদের মুখেও ঠেলে দিতে পারে। বেপরোয়া ঝুঁকি নেবেন না।
দক্ষতা অর্জন করুন। অনেক কিছু করার উপায় জানুন। ভালো লেখক হওয়াই যথেষ্ট নয়, ভিডিও ধারণ ও সম্পাদনা করাও জানা উচিত, ভালো শব্দ ধারণের কৌশল শিখুন, ডিজিটাল টুলের ব্যবহার জানুন, সর্বোপরি কিছু শেখানোর মানসিকতা রাখুন।
আরও পড়ুন
দ্য কোলাবোরেশন দ্যাট ম্যাচড অ্যাওয়ার্ড-উইনিং রিপোর্টার্স উইথ ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্টস
দ্য টিনেজ ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্টার্স টেকিং অন করাপশন ইন কিরগিজস্তান
জিআইজেএন রিসোর্স সেন্টার: গ্রান্টস অ্যান্ড ফেলোশিপস ফর জার্নালিস্টস; এবং অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার যত ম্যানুয়াল
এমিলি ও’সুলিভান জিআইজেএনের একজন এডিটোরিয়াল অ্যাসিস্ট্যান্ট। সিটি ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় স্নাতকোত্তর শুরুর আগে তিনি বার্মিংহামভিত্তিক মিডিয়া গ্রুপের ডেপুটি এডিটর হিসেবে কাজ করতেন। এ ছাড়া অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার বেশ কিছু প্রকল্পে তিনি গবেষণা সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন।