Image: Screenshot, YouTube; BBC Africa Eye
আন্ডারকভার রিপোর্টিং? আফ্রিকার অভিজ্ঞতার আলোকে কিছু পরামর্শ
আর্টিকেলটি পড়ুন এই ভাষায়:
সত্য উন্মোচনে আফ্রিকার সাংবাদিকদের মাঝে মাঝেই আন্ডারকভার রিপোটিংয়ের (ছদ্মবেশী সাংবাদিকতা) আশ্রয় নিতে হয়। অবশ্য তখনই ছদ্মবেশী সাংবাদিকতার আশ্রয় নেওয়া হয়, যখন তাদের হাতে সত্য ঘটনাকে তুলে ধরার আর কোনো উপায় থাকে না। মরিয়া হয়েই সাংবাদিকেরা ঝুঁকিপূর্ণ এ কাজে নামেন।
দেশে ও দেশের বাইরের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের রোশানলেও পড়েন তাঁরা। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারর্সের ২০২৪ বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে আফ্রিকা অঞ্চলের যে বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, নির্বাচনের সময় সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে সহিংসতা এবং গণমাধ্যমের ওপর রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ উদ্বেগজনকহারে বেড়েছে।
বিভিন্ন দেশে সাইবার অপরাধ মোকাবিলায় আইন পাশ হয়েছে, কিন্তু এই আইন প্রকাশ্যে ব্যবহার হচ্ছে সাংবাদিক নির্যাতনের হাতিয়ার হিসেবে। আইনী স্বচ্ছতার বালাই নেই। অনেক সময় তাই সত্য ঘটনা উন্মোচনের জন্য ছদ্মবেশে অনুসন্ধানে নামাটা জরুরী।
আন্ডারকভার রিপোর্টিং কৌশলগুলো কীভাবে কাজে লাগাবেন তা আরও ভালভাবে তুলে ধরার জন্য জিআইজেএন কথা বলেছে আফ্রিকার অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সঙ্গে। আন্ডারকভার রিপোর্টিংয়ের মাধ্যমে এই সাংবাদিকেরা যুগান্তকারী সব প্রতিবেদন তৈরি করেছেন। এছাড়া ঠিক কী ধরনের অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে আপনি এ পদ্ধতির আশ্রয় নিবেন কিংবা কীভাবে সিদ্ধান্ত নিবেন যে আপনার গল্পটি আন্ডারকভার রিপোর্টিংয়ের জন্য কতটা ন্যায্য— তা নিয়েও কথা বলেছেন তাঁরা।
কিছু বিতর্ক সত্ত্বেও, আন্ডারকভার রিপোর্টিং সত্যকে তুলে আনতে সাংবাদিকদের এক ধাপ এগিয়ে দিতে পারে।
‘ফিসায়ো সোয়োম্বো নাইজেরিয়ার একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিক ও অলাভজনক সংস্থা ফাউন্ডেশন ফর ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম-এর প্রতিষ্ঠাতা। তিনি আন্ডারকভার রিপোর্টিংয়ের মাধ্যমে বেশ কয়েকটি সাড়াজাগানো প্রতিবেদন তৈরি করেছেন।
তিনি তাঁর সর্বশেষ প্রতিবেদনে তুলে ধরেছেন, নাইজেরিয়ান দুর্নীতিগ্রস্ত শুল্ক কর্মকর্তারা কীভাবে কাস্টমসের সময়সূচী ও গতিবিধি সম্পর্কিত তথ্য দিয়ে চোরাকারবারিদের অবৈধ পণ্য ও অস্ত্র দেশে আনতে সহযোগিতা করেন। সোয়োম্বো গোপনে চিত্রধারণ করেছেন। এছাড়া চোরাকারবারী সেজে চোরা পথে বেনিন থেকে নাইজেরিয়ায় ১০০ ব্যাগ চালও নিয়ে এসেছেন। মোটরসাইকেলগুলোতে কীভাবে চাল বোঝাই করা হয়, কোন পথে চোরাকারবারিরা এগুলো পাচার করে, এমনকি জঙ্গলের পথ ধরে নাইজেরিয়ায় যাওয়ার সময় শুল্ক কর্মকর্তারা তাদের যখন বলেছিলেন যে, এ পথে কোনো নজরদারি বা তল্লাসি চালানো হবে না, তারা নিশ্চিতে যেতে পারে— এমন সবকিছুর ফুটেজ তিনি রেকর্ড করতে সক্ষম হন।
আপনি কী ভিডিও করবেন নাকি করবেন না?
আন্ডারকভার রিপোর্টিং পদ্ধতিতে যে সমস্যাগুলো রয়েছে তার প্রতি সোয়োম্বো সংবেদনশীল । এ বিষয়ক বিতর্ক সম্পর্কে বলেন, “এটি একটি চিরায়ত সমস্যা, এর সমাধান সহজে মিলবে না”।
তিনি আরও জানান, জনগণের কাছে কোনো অন্যায়কে তুলে ধরতে যদি তাঁকে কোনো কৌশলের আশ্রয় নিতে হয়, সেখানেও তিনি ভারসাম্য বজায় রাখেন।
সোয়োম্বো বলেন, “যতক্ষণ অন্যায়ভাবে কাউকে [কোনও] ফাঁদে না ফেলা হচ্ছে, আর তা জনস্বার্থ সম্পর্কিত—ততক্ষণ পর্যন্ত গোপনে ভিডিও করাটা অনৈতিক কিছু নয়।”
তিনি মনে করেন, “নৈতিকতার প্রশ্নটি তখনই বৈধতা পায়, যখন কাউকে ফাঁদে ফেলে জোরপূর্বক কিছু করানো হয়। স্বাভাবিক অবস্থায় ওই ব্যক্তি হয়তো তা করবেন না। কিংবা যখন ব্যক্তিগত লাভ বা অন্য উদ্দেশ্য থাকে, জনস্বার্থ থাকে না।”
একবার ভাবুন তো, কারারক্ষী ও আদালতের কর্মকর্তারা আমার কাছেই ঘুষ চাইছে, যে কিনা একজন আত্মগোপনকারী সাংবাদিক। নাইজেরিয়ার বিচার ব্যবস্থার ওপর সেই সাংবাদিক আবার কি না আন্ডারকভার প্রতিবেদন তৈরি করছে। ম্যাজিস্ট্রেটের রায় অনুযায়ী আজ আমাকে কারাগারে রাত কাটাতে হবে। কিন্তু ঘুষ দিলে বাড়িতে থাকতে পারবো। আমি গোপনে ঘুষ চাওয়ার কথাগুলো ভিডিও করেছি। প্রশ্ন হলো কোনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। গোপন চিত্রধারণের নীতি নৈতিকতা না জনসাধারণের জানার অধিকার?”
চোরাচালানকারীর ছদ্মবেশে করা আন্ডারকভার প্রতিবেদন প্রকাশের পর সোয়োম্বোকে মৃত্যুর হুমকি দেওয়া হয়। এটিই প্রথম নয়। তাঁর কাছে আগেও এ ধরনের হুমকি এসেছে। তাই প্রতিবেদন প্রকাশের পর কী ধরনের হুমকি আসতে পারে তা নিয়ে আগে থেকে ভাবুন, ঝুঁকিগুলো বিশ্লেষণ করুন।
এ সম্পর্কে সোয়োম্বো বলেন “এগুলো এখানেই শেষ হবে না, ভবিষ্যৎ ঝুঁকির কথাও মাথায় রাখুন। প্রতিবেদন প্রকাশের পর অনেক দিন পর্যন্ত হুমকি বহাল থাকতে পারে। অনুসন্ধানী কাজের মানেই হচ্ছে আপনি এমন কিছু প্রকাশ করছেন যা কেউ না কেউ গোপন রাখতে চায়। জনসমক্ষে আসতে দিতে চায় না। তাই আপনার লেখা প্রকাশের পর তারাও কিন্তু হাত পা গুটিয়ে ঘরে বসে থাকবে না, বা আপনাকে আপনার কৃতকর্মের জন্য বাহবা দিবে না।“
গল্পকে ‘অনুসরণ’ করুন, স্থানীয় সংস্কৃতির সঙ্গে মানিয়ে চলুন
আন্ডারকভার রিপোর্টিং সাংবাদিকদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে। কখনও কখনও মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সমর্থন পাওয়াটাও কঠিন হয়ে ওঠে।
২০১৯ সালে বিবিসি আফ্রিকা আই-এর জন্য তথ্যচিত্র “সুইট, সুইট কোডেইন” এর ওপর কাজ করছিলেন নাইজেরিয়ার অনুসন্ধানী সাংবাদিক রুওনা জে. মেয়ার এবং অ্যাডেজুওন সোয়েংকা। তথ্যচিত্রটিতে দেখানো হয়, লোকেরা কীভাবে ক্রমশ কাশির সিরাপ কোডেইনে আসক্ত হয়ে পড়ছে। এমি অ্যাওয়ার্ডের জন্য এটি নাইজেরিয়ার প্রথম কোনো তথ্যচিত্র হিসেবে মনোনীত হয় । কিন্তু উত্তর নাইজেরিয়ায় মাদক পরিস্থিতি দিয়ে ভীষণভাবে প্রভাবিত হন মেয়ার।
পাশাপাশি আন্ডারকভার রিপোর্টিংয়ের শারীরিক ঝুঁকির মধ্য দিয়েও যেতে হয় মেয়ার ও সোয়েংকাকে। যেমন, কোডেইন ডিলার হিসাবে গ্যাং সদস্যদের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া।
একজন ব্যবসায়ী সেজে গ্যাং সদস্যদের কাছে গিয়ে সোয়েকা বলেন যে তিনি শিক্ষার্থী আর অল্প বয়স্কদের কাছে কাশির সিরাপ বিক্রি করতে আগ্রহী। মেয়ার হন তার সহযোগী। তাঁরা গোপনে গ্যাং সদস্য আর ওষুধ শিল্পের কর্মকর্তাদের মধ্যকার বৈঠকের ভিডিও করেন। এই লোকগুলো অবৈধভাবে কালোবাজারে সিরাপ বিক্রি করেন।
প্রতিবেদনটি নিয়ে কাজ করার সময় সতীর্থ সাংবাদিকদের কাছ থেকে দিকনির্দেশনা ও সহযোগিতা নেন মেয়ার। এ নিয়ে তিনি বলেন “আমার কাজের নিজস্ব একটি পদ্ধতি রয়েছে। আমি আমার প্রতিষ্ঠানের বাইরে দু’জন [বিশ্বস্ত]জ্যেষ্ঠ সহকর্মীর সঙ্গে সার্বক্ষণিক আলোচনা করি। তাঁরা আমাকে নিরপেক্ষভাবে পরামর্শ দেন।”
“আমি কোথায় যাচ্ছি— সবসময় তাদের জানিয়ে রাখতাম। আমার অবস্থান। কখন, কী শুটিং করছি। তারা আমাকে পক্ষপাতহীনভাবে সমস্যা চিহ্নিত ও মোকাবেলা করতে সাহায্য করেছেন। কাজ শেষ করে ফিরে আসার পরও আমি আমার অভিজ্ঞতাগুলো তাদের বলেছি। যেন তারা সাহস যোগানোর পাশাপাশি আমাকে প্রয়োজনীয় সমর্থন দিতে পারেন।”
তিনি বলেন, গল্পকে “অনুসরণ” করুন— জনস্বার্থে কাজ করুন।
তিনি আরও বলেন,“গল্পের প্রয়োজনীয়তা সবসময় ব্যক্তিকে ছাপিয়ে যায়। কিছু অনুসন্ধান সরকারি সংস্থার বিরুদ্ধে যাবে। আবার কিছু কাজে তাদের সহযোগিতারও প্রয়োজন হবে। পরিবর্তিত পরিস্থিতির [সহযোগিতা] সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার প্রয়োজন পড়লে, সাংবাদিকদের তাই-ই করতে হবে।”
আপনি যে এলাকা ও গোষ্ঠীর ওপর কাজ করছেন তাদের সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার গুরুত্বের ওপর জোর দেন তিনি। তিনি বলেন, “মনে আছে সোর্স আমাকে বলেছিল, আমি যদি একা একজন নারী কোডেইন ডিলার হিসাবে যাই তবে আমাকে ঘিরে সন্দেহ তৈরি হতে পারে। পুরুষতান্ত্রিক পৃথিবীতে আমাকে তাই আমার পুরুষ সহকর্মীর সঙ্গ নিতে হয়। শরীরে লুকানো ক্যামেরা পরে আমি [সোয়েংকার সেক্রেটারি] হিসাবে কাজ করি। গল্পের প্রয়োজনেই আমাকে তা করতে হয়েছে।”
পরিকল্পনায় ব্যর্থ হওয়া, ব্যর্থ পরিকল্পনা
দ্য ফোর্থ এস্টেটের হয়ে গত বছর একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরি করেন অনুসন্ধানী রিপোর্টার ইভান্স আজিয়ামর-মেনসাহ এবং অ্যাডোয়া অ্যাডোবিয়া-ওসু। যেখানে তাঁরা ঘানার প্রথম সারির উচ্চ বিদ্যালয়গুলোতে কম্পিউটারাইজড জালিয়াতির মাধ্যমে অবৈধভাবে শিক্ষার্থী ভর্তির “ব্যবসা” উন্মোচন করেন।
প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর গ্রেপ্তারের বন্যা বয়ে যায়। কিন্তু সরেজমিনে প্রতিবেদনটি নিয়ে কাজ করার সময় ইভানের কাছে থাকা রেকর্ডারটি হঠাৎ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
এরপর তিনি অ্যাডোবিয়া-ওউসুর সঙ্গে ওই ভবনের শৌচাগারে ঢুকে পড়েন। সেখানে গিয়ে তিনি তাঁদের পরবর্তী করণীয় ঠিক করেন। আগাম প্রস্তুতি হিসেবে তাঁরা একটি অতিরিক্ত রেকর্ডিং ডিভাইস সঙ্গে রেখেছিলেন।
আজিয়ামর-মেনসাহ বলেন, “ব্যাকআপ পরিকল্পনার কথা ভাবুন।”
তিনি বলেন, “হঠাৎ কোনো ডিভাইস কাজ করা বন্ধ করে দিলে বা হারিয়ে গেলে আপনাকে আগে থেকেই তথ্য সংগ্রহের বিকল্প পরিকল্পনা করে রাখতে হবে। ব্যাকআপ হিসেবে থাকতে পারেন একজন ব্যক্তিও। হঠাৎ কোনো অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতি তৈরি হলে [তারা] আপনাকে সুরক্ষা দিতে পারেন কিংবা উদ্ধার করতে পারেন।”
স্থানীয় পরিবেশ ও সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার গুরুত্ব প্রসঙ্গে মেয়ারের সঙ্গে একমত প্রকাশ করে তিনি আরও বলেন, আন্ডারকভার প্রতিবেদন তৈরির সেরা পন্থা হচ্ছে, আপনি যাদের নিয়ে কাজ করছেন তাদের মতো হওয়া।
তিনি আরও বলেন, “আপনি যদি নিজেকে [সৈন্যদের মধ্যে] অন্তর্ভূক্ত করতে চান, আপনার একই রকম ইউনিফর্ম দরকার। আপনি যদি ভিন্ন কিছু পরেন, আলাদা হয়ে যাবেন।”
চলচ্চিত্রের শক্তি
কোভিড-১৯ মহামারীর প্রকোপ যখন শীর্ষে, কেনিয়ার সরকার তখন জনসাধারণকে বাড়িতে থাকার নির্দেশ দিয়েছিল। এই নির্দেশ কার্যকর করতে মরিয়া হয়ে ওঠে পুলিশ। বাড়ির বাইরে কাউকে দেখতে পেলেই পুলিশ তাদের মারধর করে। কারফিউ জারি করা হলে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটে। এতে জনমনে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। চলচ্চিত্র নির্মাতা ও সাংবাদিক এলিজা কানি নাইরোবিতে পুলিশের বর্বরতার গোপন ভিডিও ধারণ করেন। বিবিসি আফ্রিকা আইয়ের হয়ে তিনি আন্ডারকভার প্রতিবেদন তৈরি করেন “দ্য বুলেট অ্যান্ড ভাইরাস” শিরোনামে।
কানি বিশ্বাস করেন চলচ্চিত্র এমনভাবে গল্প বলতে পারে যা অন্য মাধ্যমে সম্ভব নয়। তিনি বলছিলেন, “লোকেরা কথা বলছে, তা দেখানোর একটা শক্তি আছে। আর [মানুষেরা] যা দেখে, তা বিশ্বাস করে।”
তিনি আরো বলেন যে, “দ্য বুলেট অ্যান্ড ভাইরাস নিয়ে কাজ করার সময় আমি নিজেকে একটি কৌশলগত জায়গায় দাঁড় করাই। পরিস্থিতির ওপর একটি সাধারণ রিপোর্ট করার কথা বলি। [পুলিশকে] রিপোর্ট বিষয়ক কোনো ধারণা না দিয়েই আমি তাদের অন্যায়গুলো তুলে ধরতে চেয়েছি। এভাবেই আমি রাতে তাদের সঙ্গে ক্যাম্পে অবস্থান করে পুরো ঘটনা তুলে ধরতে সমর্থ হই। আমি যদি আগেভাগে এ সম্পর্কে তাদের কানাকড়িও জানাতাম, তারা আমাকে কখনও তাদের কাছে ঘেঁষতে দিতো না।“
আন্ডারকভার রিপোর্টিংয়ে সঠিক দলের সঙ্গে কাজ করাটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেছেন কানি। কাজ করার পরামর্শ দিয়েছেন স্থানীয় ব্যক্তি বা প্রতিনিধির সঙ্গে। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, “যাদের এলাকাটি সম্পর্কে বোঝাপড়া আছে, যারা আপনার চেয়ে ভাল বোঝে, স্থানীয় লোকেদের সম্পর্কে ধারণা রাখে এবং সহজে তাদের সঙ্গে মিশে যেতে পারে— এমন লোকেদের সাহায্য নিন।”
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, আফ্রিকার দেশগুলোতে সাংবাদিকদের ওপর সরকারি সংস্থাগুলোর ডিজিটাল নজরদারি রীতিমতো নিয়মে পরিণত হয়েছে। কেনিয়া-উগান্ডা সীমান্তে সিগারেটের চোরাচালান নিয়ে কাজ করার সময় কেনি টের পান যে তাঁর ফোন ট্র্যাক করা হচ্ছে।
বিপজ্জনক বা সংবেদনশীল এলাকা নিয়ে প্রতিবেদন তৈরির সময় তিনি তাই সাংবাদিকদের দলীয়ভাবে কাজ করা এবং আন্ডারকভার রিপোর্টিংয়ের পরামর্শ দিয়েছেন। যেন তাঁরা যেকোনো ফোন ট্র্যাকিং বা অস্বাভাবিক গতিবিধি চিহ্নিত করতে পারে এবং ডিভাইসগুলোকে বাইরের অযাচিত আক্রমণ থেকে সুরক্ষিত রাখতে পারে।
এ সম্পর্কে মেয়ার বলেন “ডিজিটাল নিরাপত্তা সম্পর্কে সচেতন হন, বিকল্প প্রযুক্তিকে কাজে লাগান। একজন সাংবাদিক হিসেবে অনলাইনে আমরা আমাদের নিজস্ব নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ঠেলে দেই— তা নিয়েও সচেতন থাকা প্রয়োজন।”
তথ্যে প্রাপ্তির স্বাধীনতা (অভাব): সরকার যখন সাড়া দেয় না
লাইবেরিয়ার সাংবাদিক বেটি কেমাহ জনসন-এমবায়ো। তিনি জ্যাম ম্যাগাজিনের হয়ে লাইবেরিয়ার রাজনৈতিক নেতাদের গোপন সম্পদের তথ্য উন্মোচনে কাজ করছিলেন ।
রাজনীতিবিদদের সম্পদের তথ্য পেতে লাইবেরিয়া দুর্নীতি দমন কমিশনের (এলএসিসি) কাছে তিনি ফোয়া (তথ্য প্রাপ্তির স্বাধীনতা আইন) মারফত অনুরোধ পাঠান। উত্তর আসেনা। এরপর তিনি জাতীয় নির্বাচন কমিশনের রেকর্ড খুঁজতে থাকেন। এই কাজের জন্য তাঁকে পরিচয় গোপন করে কাজটি করতে হয়েছিল।
রাজনীতিবিদদের সম্পদের পরিমাণ যাচাইয়ের জন্য তিনি কখনো বিভাগীয় কর্মকর্তা বা কখনো গবেষণা শিক্ষার্থী হিসাবে নিজের পরিচয় দিয়েছেন।
জনসন-এমবায়ো বলেন, “লাইবেরিয়াতে একটি সক্রিয় ফোয়া আইন রয়েছে। যদিও তাদের কাছ থেকে খুব একটা সাড়া মেলে না। আইনে আছে তথ্য চেয়ে অনুরোধের ৩০ দিনের মধ্যে উত্তর দিতে হবে। কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই অনেক পরে জানানো হয়।”
জনসন-এমবায়ো আরও বলেন, “সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে তথ্য পাওয়া সবসময়ই চ্যালেঞ্জের। একটি নির্দিষ্ট সময় পরে আমি তাই সাংবাদিকদের পরিচয় গোপন করে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করি। তাদের অবশ্যই গল্পটকে সম্পূর্ণ করার জন্য অন্যান্য প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করতে হবে।”
লাইবেরিয়ার মতো নাইজেরিয়াতেও তথ্যের স্বাধীনতা আইন অমান্য করা হয়। যা জনস্বচ্ছতার বিষয়টিকে ব্যাহত করে। এমনকি সংবাদ মাধ্যমগুলোর পক্ষ থেকে পাঠানো ফোয়া অনুরোধের বিপরীতেও কোনো সাড়া দেওয়া হয় না।
আইন সম্পর্কে জানুন
পুলিৎজার সেন্টারের আফ্রিকা সম্পাদক ম্যাডেলিন এনগেউঙ্গা সাংবাদিকদের পরিবেশগত অপরাধ অনুসন্ধানে মনোযোগ দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
এটি একটি দারুন বিট। এখানে অনেক কিছু উন্মোচন করা যায়। সে জন্য আইন সম্পর্কে জানাটা সহায়ক হয় বলে তিনি উল্লেখ করেন।
বারো মাস ধরে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন নিয়ে কাজ করেছেন তিনি। যা ইনফোকঙ্গো, লে মন্ডে এবং পুলিৎজার সেন্টারে যৌথভাবে প্রকাশিত হয়। ক্যামেরুনের রেইনফরেস্ট থেকে স্থানীয়দের সহায়তার ব্যবসায়ীরা অবৈধভাবে কীভাবে বন থেকে কাঠ সংগ্রহ করছে— তা তুলে ধরা হয় ওই প্রতিবেদনে। তিনি কাঠ পরিবহনকারি ট্রাকের গোপন ফুটেজ রেকর্ড করেন। অবৈধ লগিং বা আইন লঙ্ঘন করে কাঠ কাটা, পরিবহন, ক্রয় বা বিক্রয় সম্পর্কিত স্থানীয় আইন সম্পর্কে ধারণা ছিল বলে প্রতিবেদনের অ্যাঙ্গেল খুঁজে পাওয়াটা তার জন্য সহজ হয়েছিল।
এ সম্পর্কে এনগেউঙ্গা বলেন, “বিষয় সম্পর্কে বোঝাপড়াটা আপনাকে সমস্যার একটি নির্দিষ্ট দিকে নজর দিতে সাহায্য করে। আপনি যদি মাঠে নামেন তাহলে আপনার কাজ আরও সহজ হয়ে যায়।”
তিনি আরও বলেন, ”কোনো সোর্সকে খাটো করে দেখবেন না। তিনি কী করেন বা কোথায় থাকেন —তার উপর ভিত্তি করে মূল্যায়ন করবেন না। “আপনার সোর্সটি হতে পারেন একজন গাড়ি চালক, কিন্তু তিনি হয়তো বুঝতে সক্ষম যে আপনি ঠিক কোন বিষয়টি নিয়ে কাজ করতে চান। তাই আপনার অনুসন্ধান কাজের সঙ্গে জড়িত সবাইকে গুরুত্ব দিন।”
সোয়োম্বো পরামর্শ দিয়েছেন যে আন্ডারকভারে যাওয়ার সিদ্ধান্তটিকে মোটেও হালকাভাবে নেওয়া উচিত নয়। তিনি বলেন, “আপনি যদি মানসিক ও মনস্তাত্ত্বিকভাবে পুরোপুরি প্রস্তুত না হন তবে আন্ডারকভার রিপোর্টিংয়ে যাবেন না। তবে আন্ডারকভারের আশ্রয় না নিয়ে আপনি যদি অনুসন্ধানটি করতে পারেন, তাহলে এটিই আপনার প্রথম পছন্দ হওয়া উচিৎ।“
তিনি আরো বলেন, “আন্ডারকভার রিপোর্টিং ছাড়াও আমি অনেক প্রতিবেদন তৈরি করেছি। তাই যখন আর কোনো উপায় থাকে না, একমাত্র তখনই এ পদ্ধতির আশ্রয় নিন।”
“প্রকাশিত হওয়ার পর এ ধরনের প্রতিবেদন গোটা বিশ্বকেই নাড়িয়ে দেয়। তবে একজন সাংবাদিককে যে ধরনের শারিরিক ও মানসিক শ্রমের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়, তার প্রভাব চিরন্তন” বলে মনে করেন সোয়োম্বো।
মোহাম্মদ তাওহীদ নাইজেরিয়ার একজন ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক। কাজ করেন সংঘাত, অপতথ্য, জলবায়ু পরিবর্তন, ভূরাজনীতি, উন্নয়ন এবং সামাজিক গতিশীলতা সম্পর্কিত বিষয়গুলো নিয়ে। ইন্টারন্যাশনাল জার্নালিস্ট নেটওয়ার্ক, মিডিয়া ডাইভারসিটি ইনস্টিটিউট ইউকে, ইন্টারন্যাশনাল পলিসি ডাইজেস্ট, প্রিমিয়াম টাইমস, ফাউন্ডেশন ফর ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজমসহ বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে তার লেখা প্রকাশিত হয়েছে। তিনি মিডিয়া ফেলোশিপ পেয়েছেন। এছাড়া সেন্টার ফর জার্নালিজম, ইনোভেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (সিজেআিইডি), ওলে সোয়িংকা সেন্টার ফর ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম (ডব্লিউএসসিআইজে), ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্টিং (আইসিআইআর), এবং লিবারেলিস্ট সেন্টার ফর এডুকেশন থেকে রিপোর্টিং অনুদান জিতেছেন।