Изображение: Shutterstock
রিপোর্টারের গাইড: সংঘবদ্ধ অপরাধীদের অর্থ লেনদেন অনুসন্ধান করবেন যেভাবে
আর্টিকেলটি পড়ুন এই ভাষায়:
সম্পাদকের নোট: আগামী নভেম্বরে, গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম কনফারেন্সে প্রকাশিত হতে যাচ্ছে সংঘবদ্ধ অপরাধ অনুসন্ধানের একটি পূর্ণাঙ্গ গাইড। সেখান থেকে কিছু কিছু অংশ আগামী কয়েক সপ্তাহজুড়ে প্রকাশিত হবে জিআইজেএন-এর ওয়েবসাইটে। এই পর্বে, নজর দেওয়া হয়েছে অর্থ পাচার সংক্রান্ত অপরাধের দিকে। লিখেছেন, অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন রিপোর্টিং প্রজেক্টের সহ-প্রতিষ্ঠাতা পল রাদু।
দুই দশক ধরে আমি যেসব অপরাধীকে নিয়ে অনুসন্ধান করেছি, তাদের অনেকেই হয়তো বিশ্বেসেরা উদ্যোক্তা হতে পারত। তাদের সব ধরনের যোগ্যতাই ছিল: সম্পদ, সৃজনশীলতা, দ্রুত চিন্তা করার সক্ষমতা, নেটওয়ার্ক তৈরি ও নেতৃত্ব দেওয়া এবং স্পষ্টতই, ঝুঁকির প্রতি আকর্ষণ। তাদের অনেকেই হয়তো আইনসিদ্ধ দুনিয়ার ইলন মাস্ক হতে পারত। কিন্তু শেষপর্যন্ত তারা বেছে নিয়েছে অপরাধের পথ এবং এসব দক্ষতা তাদের পরিণত করেছে বিশ্বের অন্যতম বিপজ্জনক ও ক্ষতিকর ব্যক্তিতে।
তারা সবসময় একটা বড় কিছু করার চিন্তা করে। তাদের ব্যবসা-পরিকল্পনাও খুব সহজ ও সাধারণ: “বেশি ভিকটিম, বেশি টাকা।” আর শীর্ষ অপরাধীরা যে বিচারের বাইরে থেকে যায়— এই তথ্য তাদের জীবনকে আরও সহজ করে দেয়। তাদের কর্মকাণ্ড চলে মহাদেশজুড়ে, এমনকি বৈশ্বিক পর্যায়েও। স্বভাবতই, সীমান্ত ছাড়িয়ে যাওয়া এই জগতে তাদের কোনো শত্রু নেই। কারণ, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো সাধারণত নিজ দেশের সীমানা ও জাতীয় স্বার্থের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে।
পর্ব ১: এটি কীভাবে কাজ করে?
অপরাধের অর্থনৈতিক নীল নকশা
অপরাধী গোষ্ঠীগুলো তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে আন্তর্জাতিকভাবে। তাই তাদের অপরাধ কর্মকাণ্ড মোকাবিলা ও সামনে তুলে আনার দায় অনেকটাই চেপে বসেছে সাংবাদিক ও অ্যাকটিভিস্ট ওপরে। কারণ, তারা সীমানা পেরিয়ে নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে পারেন এবং জনস্বার্থে কাজ করেন। কিন্তু বিশ্বের এই ক্ষমতাধর ও বিপজ্জনক ব্যক্তিদের পিছু লাগার মতো নিউজরুমের সংখ্যা হাতে গোনা এবং তাদের সম্পদও সীমিত। আশার ব্যাপার হলো, আন্তঃসীমান্ত সহযোগিতামূলক প্রকল্প পরিচালনার মাধ্যমে অনুসন্ধানী সাংবাদিকেরা উপলব্ধি করছেন: অপরাধের আচরণও অনেক দিক দিয়ে একটি পণ্যের মতো। এগুলোও সাধারণ কিছু প্যাটার্ন অনুসরণ করে, যা দিয়ে সেগুলো খুঁজে বের করা ও উন্মোচন করা যায়। সংক্ষেপে, যদি কোনো অপরাধমূলক কৌশল একটি দেশে বা একটি অঞ্চলের জন্য কাজ করে, তাহলে সেই একই মডেল বিশ্বের অন্যান্য জায়গাতেও প্রয়োগ করা হয়। একেই বলে, অপরাধের নীল নকশা। কার্যকরভাবে টাকার খোঁজ করতে গেলে এবং অপরাধীদের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড ব্যাহত করতে চাইলে, আপনাকে অপরাধ-মডেলের এই উপাদানগুলো সম্পর্কে জানতে হবে।
অপরাধীদের অবৈধ কর্মকাণ্ড নিয়ে অনুসন্ধান এবং তা উন্মোচনের জন্য আমাদের আগে শত্রুপক্ষকে ভালোমতো বুঝতে হয়। তাই, শুরুতেই জেনে নেওয়া যাক তাদের প্রধান কিছু কৌশলের কথা, যেগুলো কাজে লাগিয়ে অপরাধীরা টাকা চুরি, গোপন ও বিনিয়োগ করে। এরপর দ্বিতীয় অংশে, আমরা নজর দেব এমন অনুসন্ধান পরিচালনার কয়েকটি টুল ও কৌশলের দিকে।
অপরাধজগতে দুই ধরনের অপরাধী আছে: নতুন এবং আগে থেকে প্রতিষ্ঠিত। তারা আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পর্যায়ের অনেক অবকাঠামো নিয়ন্ত্রণ করে। এই অবকাঠামোগুলো ক্রমাগত গড়ে তোলা হয়। তারাই এসব ব্যবস্থাপনা করে। অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন রিপোর্টিং প্রজেক্ট (ওসিসিআরপি)-তে আমরা এর নাম দিয়েছি, “ক্রিমিনাল সার্ভিস ইন্ডাস্ট্রি”। এই অবকাঠামোর মধ্যে থাকে আইনজীবী, ব্যাংকার, হিসাবরক্ষক, কোম্পানি খোলার এজেন্ট, হ্যাকার, রেপুটেশন ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি, এবং অন্য আরও অনেকে— যারা অপরাধীদের জন্য অপরাধ ঘটানোর সুযোগ করে দেয়, এবং বিনিময়ে টাকা উপার্জন করে। অপরাধীদের অবৈধ টাকা অন্য জায়গায় বিনিয়োগেও তারাই সাহায্য করে। তো, অর্থের দৃষ্টিকোণ থেকে অপরাধের প্রধান উপাদানগুলো কী?
অফশোর কোম্পানি
অফশোর ফাইন্যান্সিয়াল ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে। সেখানে উঠে এসেছে: কীভাবে বিভিন্ন কোম্পানি গোপনে অপরাধীদের বিপুল পরিমাণ অর্থ চুরি এবং অন্য দেশে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে। অফশোর ক্রাইম ও পানামা পেপার্সের মতো অনেক প্রকল্প, এমন অবৈধ অর্থ পাচার বাণিজ্যের স্বরূপ উন্মোচন করেছে। এর মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে ওসিসিআরপির চলমান ওপেনলাক্স-এর মতো বৃহৎ সহযোগিতামূলক সাংবাদিকতা প্রকল্প। এতে দেখানো হচ্ছে: কীভাবে লুক্সেমবার্গের মতো ভূ-বেষ্টিত বিভিন্ন দেশ অন্যান্য প্রথাগত অফশোর এলাকার মতোই গোপনীয়তা বজায় রাখার সুযোগ দেয় বা অতীতে দিয়েছে। অপরাধীরা কীভাবে তাদের ব্যবসা দাঁড় করায় এবং কী ধরনের ভুল করে বা করতে বাধ্য হয়, তা বোঝা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষভাবে যখন খুবই উঁচু পর্যায়ের সংগঠিত অপরাধ ও দুর্নীতি নিয়ে অনুসন্ধান করবেন।
প্রক্সি
সংগঠিত অপরাধ আড়াল করতে অন্য পরিচয় — বা প্রক্সি — প্রয়োজন হয়। যেন এই অফশোর কোম্পানিগুলো গোপনে লেনদেন করতে পারে। ওসিসিআরপিতে অনুসন্ধান করতে গিয়ে আমরা দেখেছি, তিনভাবে এ ধরনের প্রক্সি কোম্পানি গঠিত ও পরিচালিত হয়: অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের কথা পুরোপুরি না জেনে, আধা আধা জেনে এবং পুরো বিষয়টি ভালোমতো জেনে-বুঝে।
পুরোপুরি না জেনে দেওয়া প্রক্সিগুলোর ক্ষেত্রে মানুষের পরিচয় চুরি করা হয় (কখনো কখনো ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারদের কাছ থেকে খুব বড় আকারে তথ্য চুরির মাধ্যমে) এবং এই মানুষগুলোর কোনো ধারণাও নেই যে, তাদের নাম-পরিচয় ব্যবহার করে কোনো কোম্পানি গঠন করা হচ্ছে বা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা হচ্ছে। অনেকে অপরাধী কর্মকাণ্ড সম্পর্কে কিছুটা জেনে নিজের নাম-পরিচয় ব্যবহার করতে দেয় এবং বিনিময়ে অল্প কিছু অর্থ পায়। কিন্তু এর পেছনে আসলেই কত বড় অপরাধমূলক ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড ও আর্থিক লেনদেন ঘটে চলেছে – সে সম্পর্কে তাদের ধারণা নেই। আর, পুরোপুরি জেনেবুঝে প্রক্সি দেওয়ার অর্থ: তিনি এই অপরাধী চক্রের কর্মকাণ্ডটি বোঝেন এবং এখান থেকে তিনি বড় অঙ্কের মুনাফা আশা করেন। কোনো অপরাধ কর্মকাণ্ডে কী ধরনের প্রক্সি ব্যবহার করা হচ্ছে, তা জানা থাকলে অনুসন্ধানী সাংবাদিকেরা বুঝতে পারবেন যে, সেটি উন্মোচনের জন্য কী ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে।
ব্যাংক
সাম্প্রতিক সময়ে আর্থিকখাতে ক্রিপ্টোকারেন্সির মতো উদ্ভাবনী ব্যবস্থার উত্থান হলেও, এখনো বিশ্বের আর্থিক ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ জুড়ে রয়েছে ব্যাংক। এদিকেই দৃষ্টি থাকে সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রের, এবং তারা বিভিন্ন উপায়ে ব্যাংকিং খাতের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করতে এবং সেখান থেকে ফায়দা নিতে চায়। প্রক্সি অ্যাকাউন্ট খোলার ক্ষেত্রে, কিছু ব্যাংক এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে পুরোপুরি জড়িত থাকে, অনেকে না জেনেই লেনদেন করে, এবং কেউ কেউ কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে; আবার তারা এটাও চায় না যে তাদের অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে এই লেনদেন বন্ধ হোক।
ছোট, বড়, মাঝারি; অসংখ্য ব্যাংক ও তাদের বিভিন্ন সাবসিডিয়ারির মাধ্যমে এই ব্যাংকিং ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। এটি উল্লেখ করা গুরুত্বপূর্ণ যে: ছোট ব্যাংকগুলো বৈশ্বিক ব্যাংকিং ব্যবস্থায় যুক্ত হতে পারে যদি তারা অন্য বড় ব্যাংকের অ্যাকাউন্টের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ করতে রাজি থাকে। এর মাধ্যমে বৈশ্বিকভাবে আর্থিক লেনদেন নিশ্চিত হয়। আমাদের অনুসন্ধান থেকে দেখা গেছে, অনেক ছোট এবং এমনকি মাঝারি আকারের ব্যাংক পুরোপুরি বা আংশিকভাবে পরিচালনা করে অপরাধীরা। এবং সেগুলোতে তাদের মালিকানা আছে। তবে তারা এখনো বড় অঙ্কের অবৈধ অর্থ লেনদেনের জন্য বিশ্বের বড় বড় ব্যাংকগুলোর ওপরই নির্ভর করে। বুদ্ধিমান অপরাধীরা অনেক আগেই বুঝতে পেরেছিল যে, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো যেমন তাদের সীমানার বাধায় ঘেরা থাকে, তেমনি ব্যাংকগুলোর মধ্যেও বৈশ্বিক সহযোগিতা থাকে না। এবং তাদের আর্থিক কমপ্লায়েন্স সিস্টেম পরিচালিত হয় ব্যক্তি এবং অল্প কিছু সন্দেহজনক লেনদেন শনাক্ত করার দিকে। ফিনসেন ফাইলস অনুসন্ধান থেকে স্পষ্ট বোঝা গেছে: কীভাবে ব্যাংকগুলো এই বড় অঙ্কের অর্থ পাচার শনাক্ত করতে ব্যর্থ হয়। অপরাধীরা এটিকে তাদের সুবিধা হিসেবে কাজে লাগায় এবং বিপুল অর্থ বেশ কয়েকটি ব্যাংক ও ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে লেনদেন করে। ফলে কোনো একটি ব্যাংক স্পষ্টভাবে বুঝতেও পারে না যে, এই অর্থ পাচারের কর্মকাণ্ড কত বড়।
ভুয়া চুক্তি ও চালানপত্র
বিস্তৃতভাবে এসব অর্থপাচার সংক্রান্ত কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য, অপরাধীরা বিভিন্ন ভুয়া কাগজ, চুক্তিনামা ও চালান তৈরি করে। এগুলো ব্যাংকে জমা দেওয়া হয়, লেনদেনের সমর্থনে। একটি ভুয়া চালানপত্রে হয়তো বলা হলো: “এ” নামের অফশোর কোম্পানি থেকে “বি” নামের অফশোর কোম্পানির কাছে কম্পিউটার বিক্রি করা হয়েছে। কিন্তু আসলে এমন কোনো সত্যিকারের বাণিজ্যের ঘটনা ঘটেনি। যদিও এই কথা বলে দুটি ব্যাংকের মধ্যে আর্থিক লেনদেন ঘটে গেছে। এই অবৈধ কর্মকাণ্ডটিকে ডাকা হয় বাণিজ্য-ভিত্তিক অর্থ পাচার বলে। এবং বৈশ্বিকভাবে, এই পদ্ধতিতেই বেশিরভাগ অবৈধ অর্থের লেনদেন ঘটে। কোনো ব্যাংক কর্মকর্তার পক্ষে প্রতিটি শিপিং কনটেইনার যাচাই করে দেখা সম্ভব নয়। সংগঠিত অপরাধ চক্র এই দুর্বলতারই ফায়দা নেয়।
কখনো কখনো, এ ধরনের ব্যাংকিং লেনদের ক্ষেত্রে ঋণ বা অন্য কোনো সেবার নাম করেও ভুয়া কাগজপত্র দেখানো হয়। কিন্তু ফলাফল সেই একই।
বিভিন্ন অপরাধী চক্র ও দুর্নীতিপরায়ণ রাজনীতিবিদেরা এই চারটি উপাদানের সমন্বয়ে অবৈধ অর্থ লেনদেন করেন। ক্রিমিনাল সার্ভিসেস ইন্ডাস্ট্রি, এসব ভুয়া কর্মকাণ্ড পরিচালনার ম্যানুয়াল তৈরি এবং প্রচারও করে। তাতে বলা থাকে: কীভাবে ভুয়া কোম্পানি, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, প্রক্সি ও ভুয়া ইনভয়েস তৈরি করলে, ব্যাংকিং খাতের পর্যবেক্ষক বা আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার দৃষ্টি এড়ানো যাবে। লাটভিয়ার একটি ব্যাংক ঠিক এই ধরনের একটি অর্থ পাচার ম্যানুয়াল তৈরি করেছিল। ওসিসিআরপি এটি সামনে এনেছিল। সেই ম্যানুয়ালে গ্রাহকদের দেওয়া হয়েছিল এমন সব পরামর্শ:
“চুক্তি বা চালানপত্রে পণ্য সরবরাহের যে শর্তাবলির কথা বলা থাকবে, সেগুলো বাস্তবসম্মত হতে হবে: যখন আপনি নির্দিষ্ট পণ্যের কথা উল্লেখ করবেন, তখন আপনাকে ভাবতে হবে সেগুলো কীভাবে ‘জাহাজে করে পাঠানো হবে’ (কার্গোর ওজন, আয়তন, উৎপাদনকারী কারখানার ঠিকানা, কীভাবে পণ্য বহন করা হবে: সড়ক, রেল, নাকি নৌপথে)। অনেক বড় আকারের পণ্য সরবরাহের সময় রেলপথ বা বন্দর থেকে কাছাকাছি কোনো কারখানার কথা উল্লেখ করুন।”
অর্থ পাচার ব্যবস্থার এই গুরুত্বপূর্ণ কলাকুশলীদের আমরা বলি “লন্ড্রোম্যাটস” (ধোপা, যাদের কাজ কাপড়ের ময়লা পরিষ্কার করা)। এদের নেপথ্যে থাকে বিভিন্ন ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান। তারা সব ধরনের আর্থিক লেনদেনের বাহন হিসেবে কাজ করে। বলতে পারেন, সকল কাজের কাজী। অপরাধের মাধ্যমে অর্জিত অর্থ বিদেশে পাচার, সম্পদের মালিকানা গোপন রাখা, বিভিন্ন কোম্পানি থেকে অর্থ সরানো, করফাঁকি ও মুদ্রা-বিনিময় নিষেধাজ্ঞা ফাঁকি দেওয়াসহ – হেন কোনো কাজ নেই, যা তারা করে না। ২০১৪ সালে, “দ্য রাশিয়ান লন্ড্রোম্যাট” অনুসন্ধানের সময় এই শব্দটি প্রথম সামনে নিয়ে আসে ওসিসিআরপি।
লন্ড্রোম্যাট হচ্ছে আর্থিক জগতের টর নেটওয়ার্ক ব্রাউজারের (এটি দিয়ে ব্যবহারকারীরা পুরোপুরি গোপনীয়তা রক্ষা করে ইন্টারনেট ব্রাউজ করতে পারেন) মতো। লন্ড্রোম্যাটের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিভিন্ন ব্যাংকের মধ্যে দিয়ে ভাগ করে পাচার করে দেওয়া হয়। ঠিক যেমনটি টর করে থাকে। এখানে গোপনীয়তাও বজায় থাকে; কারণ একটি নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠান কখনোই পুরো ব্যাপারটি সম্পর্কে ধারণা পায় না।
বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা বেশ কিছু কোম্পানি মিলে একেকটি লন্ড্রোম্যাট গড়ে ওঠে। এই কোম্পানিগুলোকে দেখলে মনে হবে স্বাধীন; কিন্তু এগুলো আসলে একটি পক্ষ দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়। সাধারণত এটি হয় কোনো ব্যাংক। অর্থ পাচারের প্রক্রিয়া শুরু হয় যখন কোনো গ্রাহক সেই নেটওয়ার্কের একটি অংশ দিয়ে অর্থ পাঠান। এই কাজে প্রায়ই ব্যবহার করা হয় ভুয়া কাগজপত্র, যেখানে দেখানো হয় কোনো পণ্য বা সেবা কেনাবেচা হয়েছে। এখান থেকে, নেটওয়ার্কটির বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে টাকা পাঠানো হয়। এই ধাপেও অনেক ভুয়া কাগজপত্র দেখানো হয়। এভাবে, এক সময় অর্থটি পাঠিয়ে দেওয়া হয় অফশোর কোনো কোম্পানি বা গ্রাহকের পছন্দের অন্য কোনো গন্তব্যে (এখান থেকে কেটে নেওয়া হয় লন্ড্রোম্যাট কার্যক্রম পরিচালনার সঙ্গে জড়িতদের কমিশন)। এভাবে বহুবিধ লেনদেনের জালে অর্থের আদি উৎসটি এক সময় হারিয়ে যায়। এটি খুঁজে বের করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে, এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্যও। (লন্ড্রোম্যাটের কার্যক্রম সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে, দেখুন ওসিসিআরপি-র লন্ড্রোম্যাট প্রশ্নোত্তর।)
লন্ড্রোম্যাটরা কীভাবে কর্তৃপক্ষের নজরদারি এড়াতে পারে, তার সবচেয়ে স্পষ্ট উদাহরণ হতে পারে ডয়চে ব্যাংকের ফাঁস হয়ে যাওয়া অভ্যন্তরীণ নথিপত্র। এখানে বিস্তারিত বলা হয়েছে: বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থায় নানান কারসাজির সঙ্গে জড়িত রাশিয়ান লন্ড্রোম্যাটকে কীভাবে শনাক্ত করতে ব্যর্থ হয়েছিল ব্যাংকটি।
এমন আরও অনেক উদাহরণ আছে, যেখানে দেখা যায়: কীভাবে সংগঠিত অপরাধী চক্র, বিশ্ব আর্থিক ব্যবস্থাকে নিজ প্রয়োজনে ব্যবহার করছে। নিচে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলের তিনটি উদাহরণ দেওয়া হলো। এদের মধ্যে একই ধরনের প্যাটার্ন দেখতে পাওয়া যায়। এবং সব ক্ষেত্রেই কিছু বা পুরো অংশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় পাওয়া গেছে রাশিয়ান সেই লন্ড্রোম্যাটকে।
আজারবাইজানি লন্ড্রোম্যাট এবং ইরানের নিষেধাজ্ঞা-বিরোধী ‘অর্থনৈতিক জিহাদ’
আজারবাইজানি এই লন্ড্রোম্যাট মূলত কাজ করত আজারবাইজানের রাজধানী বাকুর অভিজাত গোষ্ঠীর সঙ্গে। এই চক্র তাদের মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার দেশ থেকে বাইরে পাচার করার সুযোগ করে দিয়েছিল। এজন্য তারা ইউরোপিয়ান রাজনীতিবিদদেরও ঘুষ দিয়েছিল। কিন্তু ওসিসিআরপির অনুসন্ধান থেকে বেরিয়ে আসে: যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের নিষেধাজ্ঞা এড়াতে গিয়ে অর্থ পাচারের এই পদ্ধতি ইরানও ব্যবহার করেছিল। ইরানকে সহায়তা করেছিল, রেজা জারাবের নেতৃত্বাধীন একটি সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্র। ইরানি-তুর্কি অপরাধী জারাব, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের ঘনিষ্ঠ। জারাব যেভাবে অর্থ পাচার করেছিল, তার সঙ্গে ওপরে বর্ণিত প্রায় সব পদ্ধতিই মিলে যায়। বিষয়টি তুরস্ক, যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে একটি ভূ-রাজনৈতিক কেলেঙ্কারির জন্ম দিয়েছে। এবং দেখিয়েছে: রাজনৈতিক বিভক্তি ও অস্থিরতার সময়ে কীভাবে সংগঠিত অপরাধ বেড়ে ওঠে।
ত্রয়কা লন্ড্রোম্যাট গড়ে উঠেছিল একটি জটিল আর্থিক ব্যবস্থাকে ঘিরে, যার মাধ্যমে উচ্চবিত্ত ও শীর্ষ পদে থাকা রাশিয়ান ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদেরা তাঁদের অবৈধ পথে অর্জিত বিপুল সম্পদ গোপনে অন্যত্র পাচার ও বিনিয়োগের সুযোগ পেয়েছিলেন। এগুলোর মধ্যে রয়েছে কর ফাঁকি, রাষ্ট্রীয় কোম্পানির শেয়ার ক্রয়, রাশিয়া ও বাইরে স্থাবর সম্পত্তি কেনা, এবং আরও অনেক কিছু। ত্রয়কা লন্ড্রোম্যাটকে সাজানো হয়েছিল এসব লেনদেনের পেছনে থাকা মানুষদের আড়াল করার জন্য। কিন্তু ওসিসিআরপি ও এর সহযোগীদের সতর্ক ডেটা বিশ্লেষণ ও অনুসন্ধানে তা ঠিকই উন্মোচিত হয়েছে। এই অনুসন্ধানের পেছনে ছিল ব্যাংকিং সংক্রান্ত বিপুল তথ্যের ভাণ্ডার। এখানে ফাঁস হয়ে গিয়েছিল ২ লাখ ৩৮ হাজার কোম্পানির প্রায় ১ দশমিক ৩ মিলিয়ন লেনদেনের তথ্য। গোটা প্রক্রিয়ার একটি ভিডিও ব্যাখ্যা পেতে ক্লিক করুন এখানে।
ব্যাংকিং লেনদেনের একটি কাটখোট্টা ডেটাসেট নিয়ে কাজ করতে গিয়ে উন্মোচিত হয়েছিল ত্রয়কা লন্ড্রোম্যাট। এর মাধ্যমে কী কী লেনদেন হয়েছে তা খুঁজে বের করা ও আলাদা করার জন্য আমাদের বিভিন্ন প্যাটার্ন খেয়াল করতে হয়েছে। কারা এই ব্যবস্থাটি পরিচালনা করছে এবং কারা এই ব্যবস্থার সুবিধা নিচ্ছে, ইত্যাদি। আবার এসব খুঁজে বের করার জন্য আমাদের বিভিন্ন ভুলত্রুটির দিকে নজর দিতে হয়েছে। খুব সতর্কতার সঙ্গে এই ডেটাগুলো বিশ্লেষণ করতে গিয়ে, আমরা শেষপর্যন্ত দেখতে পাই: যে ব্যাংকাররা এই সব কিছুকে এক জায়গায় এনেছে, তারা খুবই ছোট কিন্তু মারাত্মক একটি ভুল করছে: তারা কিছু ফরমেশন এজেন্টকে পেমেন্ট দেওয়ার জন্য বার বার তিনটি শেল কোম্পানিকেই ব্যবহার করছিল। এই ফরমেশন এজেন্টরা আবার বিভিন্ন জায়গায় অনেক অফশোর কোম্পানি গড়ে তুলেছে, যেগুলো আবার নিজেদের মধ্যেই বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার লেনদেন করেছে। শেল কোম্পানির মাধ্যমে করা পেমেন্টগুলো খুবই ছোট আকারের; মাত্র কয়েকশ ডলার। এগুলো মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের বড় লেনদেনের মধ্যে হারিয়ে যায়। আমাদের সেগুলো খুঁজে বের করতে হয়েছে এবং প্রমাণ করতে হয়েছে যে, এসব একটি অনেক বড় কর্মকাণ্ডের অংশ। পুরো ত্রয়কা লন্ড্রোম্যাটের বিষয়টি সামনে আসে এই সাধারণ বিষয়টি শনাক্ত করার পর।
রিভেরা মায়া গ্যাং (আরএমজি) একটি নিষ্ঠুর ও হিংস্র আন্তঃসীমান্ত সংগঠন। এদের উদাহরণ থেকে স্পষ্টভাবে বোঝা যায়, একটি সংগঠিত অপরাধ গোষ্ঠী কীভাবে আকারে বড় হতে থাকে এবং নানা ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে। আরএমজির ডাকাতদের কর্মকাণ্ড শুরু হয়েছিল ইউরোপে। ছোট পরিসরে। সেখানে তারা এটিএম বুথগুলোতে বেআইনি যন্ত্রপাতি ও সফটওয়্যার বসিয়ে মানুষের ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ডের তথ্য চুরি করত। এভাবে একপর্যায়ে, মহাদেশ পেরিয়ে তারা জোট বাঁধে একটি মেক্সিকান ব্যাংকের সঙ্গে। তাদের সঙ্গে কারসাজি করে দলটি দক্ষিণ মেক্সিকোর কানকুন ও তুলুম নামের পর্যটন এলাকায় ১০০টির বেশি এটিএম বুথে অবৈধ সফটওয়্যার বসায়। এই অপরাধী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তারা এক বছরে আয় করে ২০০ মিলিয়ন ডলার। নিজেদের এই ব্যবসা গড়ে তোলার জন্য ভুয়া নথিপত্র, ভুয়া পরিচয়পত্র এবং প্রক্সি ব্যবহার করেছে আরএমজি। একই সঙ্গে তারা অন্যান্য পলাতক আসামিকেও আশ্রয় দিয়েছে, এবং একই নেটওয়ার্ক ও অবকাঠামো ব্যবহার করে তারা মেক্সিকো থেকে যুক্তরাষ্ট্রে মানব পাচার করেছে।
পর্ব ২: কীভাবে এগুলো উন্মোচন করবেন— টুল ও পরামর্শ
ওপরের উদাহরণগুলো থেকে বোঝা যায়, সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রগুলো অর্থবিত্ত চুরি, লুকোনো ও বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে কত পারদর্শী। কিন্তু একটি জিনিসের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ নেই। তা হলো: সময়। প্রতিটি দিন যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সাংবাদিক, অ্যাকটিভিস্ট ও অন্যান্য অনুসন্ধানকারী আরও বেশি করে আন্তঃসীমান্ত রিপোর্টিংয়ের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অর্জন করছেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারও স্বচ্ছতা, কোম্পানি মালিকানা ও সম্পত্তি সংক্রান্ত নতুন নতুন আইন ও নিয়ম তৈরি করছে।
ব্যাংকিং ও আদালতের নথিপত্র
সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রের অর্থায়ন নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে ব্যাংকের রেকর্ড হাতে পেলে মনে করবেন, “হোলি গ্রেইল” পেয়ে গেছেন। কিন্তু এই ব্যাংকিং রেকর্ড পাওয়া সহজ নয়। কারণ এগুলো গোপনীয়, ব্যক্তিগত নথিপত্র। হঠাৎ কোনো তথ্য ফাঁস হয়ে যাবে অথবা ব্যাংক ও নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানগুলোর ভেতর থেকে কোনো হুইসেলব্লোয়ার এসব তথ্য জানিয়ে দেবেন— সব সময় এমনটা আশা না করাই ভালো। তবে ব্যাংকিং রেকর্ড হাতে পাওয়ার আরেকটি রাস্তা আছে। সংঘবদ্ধ অপরাধের বিরুদ্ধে মামলা করার সময় বা এমনকি বাণিজ্যিক ও দেওয়ানি বিধিতে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের সময় আদালতে এই ধরনের নথিপত্র প্রায়ই দাখিল করা হয়। কোন জায়গায় কোন নথিপত্র দায়ের করা হবে তা নির্ভর করে বিভিন্ন দেশের বিচারব্যবস্থার ওপরে। বৈশ্বিক ব্যাংকিং রেকর্ডের একটি বড় সোর্স যুক্তরাষ্ট্র। এবং এসব তথ্য এখন সবার জন্ম উন্মুক্ত হয়েছে পাবলিক অ্যাকসেস টু কোর্ট ইলেকট্রনিক রেকর্ডস (পেসার) সেবার মাধ্যমে।
যেমন, ওসিসিআরপি এমন হাজারো ব্যাংকিং নথি সংগ্রহ করেছিল পেসার ডেটাবেজ ঘেঁটে এবং যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করে। যুক্তরাষ্ট্র একটি মামলা করেছিল আজারবাইজানি লন্ড্রোম্যাটের নেতা, রেজা জারাবের বিরুদ্ধে। এর আগে, আমরা বিশ্বের বিভিন্ন জায়গার আদালত থেকে এ ধরনের নথি সংগ্রহ করেছি। এই ব্যাংকিং রেকর্ডগুলো প্রায়ই নিয়ে আসে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। এবং অনুসন্ধানী সাংবাদিকেরা যদি এগুলো কোনোভাবে হাতে পান, তাহলে সেটি তাঁদের জন্য বিশাল পাওয়া হবে।
আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সন্দেহজনক কর্মকাণ্ড সংক্রান্ত বিভিন্ন রিপোর্ট মাঝেমধ্যে ফাঁস হয়ে যায়। ঠিক যেমনটি সাংবাদিকেরা পেয়েছিলেন ফিনসেন ফাইলস অনুসন্ধানের সময়। এখান থেকে ব্যাংকিং দুনিয়ার গোপনীয়তা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। এসব বিভিন্ন ফাঁস হয়ে যাওয়া তথ্য আরও সমৃদ্ধ হয়, যখন সেগুলোকে আদালতের নথিপত্রের সঙ্গে মিলিয়ে বিশ্লেষণ করা হয়। এসব নথিপত্র অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের জন্য তো বটেই, গণমানুষের জন্যও খুবই মূল্যবান।
আদালতের রেকর্ড, এবং বিশেষভাবে দুই অপরাধী পক্ষের মধ্যে বাণিজ্যিক মামলা সংক্রান্ত নথিপত্রগুলো খুবই উপকারী হতে পারে অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের জন্য। কারণ এসব মামলার ফলে অপরাধীরা তাদের কুকীর্তির কথা সামনে আনতে বাধ্য হয়। বিবাহ-বিচ্ছেদ মামলার ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে।
সম্পত্তির দলিল
অপরাধীদের মধ্যে অনেকেই দামি দামি গাড়ি, ঘড়ি বা অন্যান্য শৌখিন পণ্য কিনতে পছন্দ করে। অনেকের এগুলো থাকতেই হবে। তবে সংঘবদ্ধ অপরাধের জগতে অবৈধ পথে অর্জিত এসব অর্থের বেশিরভাগই ব্যয় হয় স্থাবর সম্পত্তি কেনার পেছনে। যেমন অভিজাত বাড়ি, বিশাল কৃষিজমি বা বনভূমি। সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্র কী পরিমাণ অর্থ লেনদেন করছে, সেসব তথ্য উন্মোচনের জন্য অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের ভূসম্পত্তির নথিপত্রের দিকে বেশি করে নজর দেওয়া উচিত। বেশিরভাগ দেশে, এসব সম্পত্তির দলিল সবার জন্য উন্মুক্ত অবস্থায় থাকে। তাতে উল্লেখ থাকে: কোনো জমির বর্তমান মালিক কে, আগে মালিক কারা ছিল, কত টাকায় কেনা হয়েছিল এবং কী পরিমাণ কর দিতে হয়।
কোম্পানির নথি
জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন কোম্পানির যে রেজিস্ট্রিগুলো থাকে, সেখানে কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার ও বোর্ড মেম্বারদের সম্পর্কে অনেক তথ্য থাকে। এমনকি কোম্পানির আর্থিক ডেটাও পাওয়া যায়। কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে, রেজিস্ট্রিগুলোতে বিভিন্ন ব্যাংকিং লেনদেন এবং জমির দলিলও পাওয়া যায়। এমনকি কোম্পানির সুবিধাভোগী বা মালিকানা সংক্রান্ত তথ্যও পাওয়া যায়। এখান থেকে হয়তো বেরিয়ে আসতে পারে, তাদের সঙ্গে কোনো অফশোর কোম্পানি যুক্ত আছে কিনা। প্রায়ই আমরা দেখি যে, অবৈধ পথে অর্জিত অর্থ যেসব কোম্পানি বা সম্পদের মধ্যে দিয়ে বিনিয়োগ করা হয়েছে – সেগুলোর মালিকানা সংক্রান্ত তথ্য পাওয়া যায় রেজিস্ট্রি নথি থেকে। একইসঙ্গে এটিও মাথায় রাখা দরকার যে, সব তথ্যই এখনো ডিজিটাইজ হয়নি এবং এগুলো একটি ডেটাবেজে ইনডেক্স করা অবস্থায় পাওয়া যায় না। ফলে কোনো রেজিস্ট্রি অফিসে একবার ঢুঁ দিলে, কিংবা তাদের একটা ফোন করলে হয়তো আপনি অনলাইনে থাকা তথ্যের চেয়েও বেশি কিছু পেয়ে যেতে পারেন।
যেসব অর্থ পাচারের ঘটনা খুবই উচ্চ পর্যায় থেকে ঘটে, সেগুলো উন্মোচন করার একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ: ব্যাংকগুলোর মালিকানা শনাক্ত করা। ব্যাংকগুলোকেও সেভাবেই দেখুন যেভাবে আপনি অন্য যে কোনো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানকে দেখেন। খুঁজে দেখার চেষ্টা করুন সেগুলোর মালিক কারা। এগুলো বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ নতুন গড়ে ওঠা, ছোট ও মাঝারি আকারের ব্যাংকগুলোর জন্য।
ইমপোর্ট-এক্সপোর্ট ডেটাবেজ
আমদানি-রপ্তানি সংক্রান্ত কর্মকাণ্ড নজরে রাখার জন্য আমরা ইমপোর্ট জিনিয়াস বা পানজিভার মতো ডেটাবেজগুলো প্রায়ই ব্যবহার করি। এগুলো খুব ব্যয়বহুল ডেটাবেজ। যুক্তরাষ্ট্র থেকে কোনো কোম্পানি এক বছরে কী পরিমাণ আমদানি করেছে – সেই ডেটা পেতে গেলে ইমপোর্ট জিনিয়াসে আপনাকে খরচ করতে হবে ১৯৯ ডলার। কিন্তু বাণিজ্য-ভিত্তিক অর্থ পাচার এবং এর পেছনে থাকা কোম্পানিগুলো শনাক্ত করার ক্ষেত্রে এগুলো খুবই কাজে দেয়। আমরা এসব ডেটাবেজ ব্যবহার করে দেখেছি, কোনো লন্ড্রোম্যাটের সঙ্গে যুক্ত থাকা কোম্পানির অন্য কোনো জায়গাতেও এমন সন্দেহজনক কর্মকাণ্ড আছে কিনা। অফ নোট: অনেক দেশেরই বার্ষিক আমদানি-রপ্তানি সংক্রান্ত লেনদেনগুলো উন্মুক্ত করা হয়েছে তথ্য অধিকার আইনের কারণে। জাতিসংঘ কমট্রেড সাইট থেকেও বৈশ্বিক বাণিজ্যের ডেটা পাওয়া যায়। এখান থেকে আমদানি-রপ্তানি কর্মকাণ্ডের প্যাটার্নও শনাক্ত করা যায়।
আলেফ
ওসিসিআরপিতে, আমরা অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের জন্য একটি বৈশ্বিক আর্কাইভ তৈরি করেছি। আমরা এটিকে ডাকি আলেফ বলে। এখানে আমরা কোম্পানি, সম্পদ, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, আদালতের মামলা, ফাঁস হওয়া তথ্য ও অন্যান্য আরও অনেক তথ্য সাজিয়ে রাখি। তবে এটি শুধুই শুরু। জনস্বার্থে অর্থবহ অনুসন্ধান শুরুর জন্য সাংবাদিকদের যেভাবে ডেটাগুলো বুঝতে হয় এবং অপরাধের প্যাটার্ন শনাক্ত করতে হয় – সেখানেও সাহায্য করছে আলেফ। সাংবাদিকরা আলেফের ভেতরে এসে অনুসন্ধান-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ওপর বিশেষভাবে নজর রাখতে পারেন। এতে আলেফ প্রতিনিয়ত সব ডেটায় খুঁজে দেখবে সেই ব্যক্তি সম্পর্কে কী কী তথ্য পাওয়া যায়। এভাবে আমরা আমাদের অনেক কাজকে স্বয়ংক্রিয় করে ফেলেছি। যেগুলো আরও অনেক নতুন ও কার্যকরী অনুসন্ধান পরিচালনায় সাহায্য করছে।
ভবিষ্যতে কী আছে?
কয়েক দশক ধরে, বহুজাতিক সংঘবদ্ধ অপরাধ জগৎ অনেক ধাপ এগিয়ে ছিল আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা, অনুসন্ধানী সাংবাদিক ও অ্যাকটিভিস্টদের চেয়ে। কিন্তু সাংবাদিকেরা দেশের সীমানা পেরিয়ে জোটবদ্ধ হয়ে কাজ শুরু করায় ধীরে ধীরে পরিস্থিতি বদলাচ্ছে। অপরাধীরা এখনো অনেক সুযোগসুবিধা ভোগ করছে। কারণ তাদের হাতে অনেক রিসোর্স আছে। এবং তারা দ্রুত নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়। এসবের ফলে তারা সব সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চেয়ে এক ধাপ এগিয়ে থাকে।
একটি গোষ্ঠীর দিকে প্রায়ই নজর এড়িয়ে যায়। তথাকথিত ক্রিমিনাল এঞ্জেল ইনভেস্টর নামে পরিচিত এই বিনিয়োগকারীরা – অর্থ লগ্নি করে বিভিন্ন অপরাধী কর্মকাণ্ডে। কারণ, তারা জানে, এখানে মুনাফা বেশি। এবং অপরাধ কর্মকাণ্ড এই ধারার জীবনযাপনে অভ্যস্ত মানুষদের জন্য আরও সুযোগ বয়ে আনে। অপরাধ জগৎকে ঘিরে গড়ে ওঠা আর্থিক ব্যবস্থাটি ভালোভাবে বুঝতে হবে অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের, যেখানে অর্থ পাচার ও গোপন বিনিয়োগের সুযোগ করে দিতে ক্রিমিনাল সার্ভিসেস ইন্ডাস্ট্রি গড়ে ওঠে এবং বিকশিত হয়।
সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্র যে ধরনের বিকাশমান প্রযুক্তি ব্যবহার শুরু করেছে, সেগুলোর সঙ্গেও তাল মেলাতে গেলে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার প্রতিষ্ঠানকে সময় ও অর্থ বিনিয়োগ করতে হবে ক্রিপ্টোকারেন্সি, ব্লকচেইন, নন-ফানজিবল টোকেন (এনএফটি) এবং অন্য আরও নতুন সব টুল জানাবোঝার জন্য। কারণ এসব টুল ও কৌশল অপরাধীরা ব্যবহার করছে তাদের ব্যবসায়িক মডেলে।
এখনকার “ফলো দ্য মানি” দ্রুতই হয়ে যাবে “ফলো দ্য কোড” (যেমনটি অ্যালগরিদমে থাকে)। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সব কিছুই কোনো না কোনো ধরনের বস্তুগত সম্পদে রূপ নেয়। এটি হতে পারে কোনো স্থাবর সম্পত্তি বা তাদের বিলাসবহুল জীবনধারার সঙ্গে আসা দৃশ্যমান অনেক বস্তু।
আরও পড়ুন
টাকার খোঁজ: নিজ দেশের সীমানা ছাড়িয়ে অনুসন্ধান করবেন যেভাবে
এ টেন স্টেপ প্রোগ্রাম টু ফাইট ক্লেপ্টোক্রেসি অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড
জিআইজেএন সিরিজ: হাও টু আনকভার করাপশন
পল রাদু ওসিসিআরপি-র সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং চিফ অব ইনোভেশন। ড্রিউ সুলিভানের সঙ্গে মিলে ২০০৭ সালে তিনি এই সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ওসিসিআরপি-র বড় বড় অনুসন্ধানী প্রকল্পগুলোতে নেতৃত্ব দেন, আঞ্চলিক পর্যায়ে বিস্তার ঘটানোর সুযোগ তৈরি করেন এবং সংঘবদ্ধ অপরাধ ও দুর্নীতি উন্মোচনের জন্য নতুন কৌশল ও প্রযুক্তি গড়ে তোলেন।