অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা: ডিজিটাল নিরাপত্তা
জিআইজেএনের রিপোর্টারস গাইড টু ইনভেস্টিগেটিং ওয়ার ক্রাইমসের একটি অধ্যায়ে গ্লোবাল জার্নালিজম সিকিউরিটির কৌশলগত পরিচালক ম্যাট হ্যানসেন লিখেছেন, “যুদ্ধাপরাধ নিয়ে অনুসন্ধান করছেন এমন সাংবাদিকদের জন্য কাজ শুরুর প্রথম দিন থেকে প্রতিবেদন তৈরির পুরো সময় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে নিরাপত্তার দিকে । কেননা আমরা এমন একটি সময়ে বাস করছি যেখানে নজরদারি, স্পাইওয়্যারসহ অন্যান্য হুমকি বেড়েই চলেছে। তা আপনি যুদ্ধাপরাধ, জলবায়ু পরিবর্তন, রাজনীতি, দুর্নীতি বা অন্য যে কোনো বিটে কাজ করুন না কেন। আপনাকে এ সত্য মেনে নিতেই হবে।
আশার কথা আপনার তথ্যকে সুরক্ষিত রাখার জন্য রয়েছে বেশকিছু টুল। সঠিক সময়ে টুলগুলো উপযুক্ত ব্যবহারের মাধ্যমে আপনি আপনার তথ্যকে সুরক্ষিত রাখতে পারেন। শুধু প্রয়োজন, আপনার কাজের জন্য কোন টুলগুলো উপযুক্ত সে সম্পর্কে ধারণা রাখা। আর আপনার কাজের পদ্ধতির সঙ্গে মিলিয়ে টুলগুলো নির্বাচন করা। শুরুতে ডিজিটাল নিরাপত্তার বিষয়গুলো খানিকটা জটিল লাগতে পারে। তবে নিরাপত্তা টুলগুলো আপনার বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সোর্স, সহকর্মী এবং মিডিয়া অংশীদারদের আস্থা গড়তে এবং তাদের সুরক্ষিত রাখতে সাহায্য করবে।
এই অধ্যায়ে ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট, কম্পিউটার ও ফোন, নেটওয়ার্ক এবং ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষিত রাখার পরামর্শসহ বিভিন্ন টুল সম্পর্কে বলা হয়েছে। নির্দিষ্ট টুল ও সেটিংয়ের পাশাপাশি কাজ নিয়ে পরিকল্পনার সময় ডিজিটাল নিরাপত্তার গুরুত্ব বোঝাতে আমরা কিছু কেস স্টাডিও জুড়ে দিয়েছি। এ লেখাতে আপনি অনেক তথ্য পাবেন। তাই আমাদের পরামর্শ হলো আপনি লেখাটি এক থেকে দুইবার পড়ুন। তারপর যেসব অংশ আপনার জন্য সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক সেগুলোতে ফিরে যান। এভাবে আপনি আপনার ডিজিটাল এবং মৌলিক নিরাপত্তা পদ্ধতিগুলোও উন্নত করতে সক্ষম হবেন। আপনি অনেক কিছু জানতে পারবেন এবং আপনার জন্য সবচেয়ে কার্যকরী উপায়টি খুঁজে পাবেন। টুলগুলো যত বেশি ব্যবহার করবেন, ততই আপনার কাছে তা সহজ হয়ে উঠবে। এ নিয়ে জিআইজেএনও বিভিন্ন প্রশিক্ষণ, কর্মশালা এবং পরামর্শ দিয়ে থাকে।
কৌশল ও পরামর্শ
নিচের বিভাগগুলো আপনাকে আপনার অ্যাকাউন্ট, কম্পিউটার ও ফোন, নেটওয়ার্ক ও ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষিত রাখার জন্য নির্দিষ্ট টুল আর সেটিং সম্পর্কে ধারণা দিবে।
অনলাইন অ্যাকাউন্টগুলো কীভাবে সুরক্ষিত রাখবেন
সবচেয়ে সুরক্ষিত পাসওয়ার্ড তৈরি এবং সংরক্ষণ করতে একটি পাসওয়ার্ড ম্যানেজার (password manager) ব্যবহার করুন। এ টুলটি একটি ভল্টের মতো কাজ করে। পাসওয়ার্ড ম্যানেজার ব্যবহার করলে আপনাকে ভিন্ন ভিন্ন পাসওয়ার্ড আর আলাদা করে মনে রাখতে হবে না। কেননা এখানে একটি “মাস্টার পাসওয়ার্ড” সেট করা হয়। তাছাড়া পাসওয়ার্ড ম্যানেজারে সংরক্ষিত রাখতে পারেন অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও। যেমন security questions বা নিরাপত্তা সম্পর্কিত প্রশ্নগুলোর উত্তর (যেগুলো সত্যি হওয়ার দরকার নেই !)। পাসপোর্টের তথ্য আর ফোন নম্বরও সংরক্ষণ করতে পারেন। অ্যান্ড্রয়েড ও আইওএসে পাসওয়ার্ড ম্যানেজার ফাংশনটি বিল্টইন আছে। তবে 1Password, Dashlane, এবং Bitwarden-এর মতো এতে সবগুলো ফিচার নাও থাকতে পারে। কিন্তু একজন সাংবাদিক হিসেবে, আপনি 1Password-এর জন্য একটি ফ্রি লাইসেন্স পেতে পারেন।
যতটা সম্ভব দুই ধাপ প্রমাণীকরণ বা two-factor authentication (2FA) চালু করুন। বিশেষ করে ইমেইল, ডকুমেন্ট স্টোরেজ এবং সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টগুলোর জন্য। এটি আপনার অ্যাকাউন্টকে সুরক্ষিত রাখতে সাহায্য করবে। বাইরের কেউ যদি আপনার বর্তমান পাসওয়ার্ড উদ্ধার করতে সক্ষম হয়, তাহলেও আপনার অ্যাকাউন্টে ঢুকতে পারবে না। 2FA বা দুই-ধাপ প্রমাণীকরণের সবচেয়ে সাধারণ উপায় এসএমএস-এর মাধ্যমে যাচাই করা। যদিও এটি কম সুরক্ষিত। কারণ বার্তাগুলো এনক্রিপ্ট করা না। তাই যে কেউ সেগুলো পড়তে পারে। এর পরিবর্তে তাই দুই ধাপের কোড তৈরি করতে একটি মোবাইল অ্যাপ ব্যবহার করা ভালো। যেমন Google Authenticator। এটি অনেক বেশি সুরক্ষিত। যদিও কম প্রচলিত। আর সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে “ফিজিক্যাল সিকিউরিটি কী” (একটি ছোট হার্ডওয়্যার ডিভাইস) ব্যবহার করা। যেমন Yubikey। যদি আপনি ইমেইলের জন্য গুগল ব্যবহার করেন, তাহলে Advanced Protection Program-এ নাম নিবন্ধনের কথা ভাবুন। এটি একটি ফ্রি সিকিউরিটি ফিচার, যা সাংবাদিক ও অন্যান্য উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিদের কথা মাথায় রেখেই চালু করা হয়েছে।
আপনার অনলাইন অ্যাকাউন্টগুলোর গোপনীয়তা এবং নিরাপত্তা সেটিং নিয়মিত যাচাই করুন, বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টগুলোর। এর উদ্দেশ্য সোশ্যাল মিডিয়া এবং অন্যান্য সাইটে শেয়ার করা থামানো নয়, বরং আপনি যা শেয়ার করছেন, কখন শেয়ার করছেন, ও কার সাথে শেয়ার করছেন সে সম্পর্কে সচেতন থাকা এবং নিয়ন্ত্রণ রাখা। প্রাইভেসি পার্টি (Privacy Party) একটি ফ্রি ব্রাউজার এক্সটেনশন। যা একাধিক সাইটের সেটিংগুলো পর্যালোচনা এবং সে অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের কাজকে সহজ করে তোলে।
আপনি যদি কোনো অ্যাপল ডিভাইস ব্যবহার করেন, তবে আই ক্লাউড (iCloud)-এর জন্য অ্যাডভান্স ডেটা প্রোটেকশন (Advanced Data Protection) অপশনটি চালু করুন। এতে সেখানে রাখা ডেটাগুলো এনক্রিপ্ট (তথ্য বা ডেটাকে কোডে রুপান্তর করা) হবে। এক্স (টুইটার)-এর ক্ষেত্রে “পাসওয়ার্ড রিসেট” চালু করুন, যাতে কেউ আপনার অ্যাকাউন্টের পাসওয়ার্ড রিসেট করতে না পারে। ফেসবুকের ক্ষেত্রে চালু করুন লগইন অ্যালার্টস (Login alerts)।
সিস্টেম ও সফটওয়্যার আপডেটগুলো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ইনস্টল করার বিষয়টি নিশ্চিত করুন। এই আপডেটগুলো শুধু নতুন ফিচার এবং উন্নত সুরক্ষা পদ্ধতি নয়, সিকিউরিটি হোলগুলোও (কম্পিউটার নিরাপত্তার ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত দুর্বলতা) সমাধান করে। হ্যাকাররা এ ধরনের দুর্বলতার সুযোগ নিতে পারে। আপনার হার্ড ড্রাইভের তথ্যকে সুরক্ষিত রাখতে, উইনডোজের ক্ষেত্রে বিটলকার (BitLocker ) এবং ম্যাকওএসের ক্ষেত্রে ফাইলভল্ট ( FileVault) ব্যবহার করতে পারেন। এগুলো গোটা ডিস্ককে এনক্রিপশন করতে পারে। আপনি এই টুলগুলো ব্যবহার করে এক্সটার্নাল হার্ড ড্রাইভ এবং ইউএসবি স্টিকসও এনক্রিপ্ট করতে পারেন। আপনি যদি ম্যাক ও পিসি দুটো দিয়েই ড্রাইভটি ব্যবহার করেন, তাহলে ভেরাক্রিপ্ট (VeraCrypt) ব্যবহারের কথা ভাবুন। উইনডোজের ক্ষেত্রে মাইক্রোসফট ডিফেন্ডার (Microsoft Defender) আপনার ডিভাইসটিকে সাধারণ আডওয়্যার এবং মালওয়্যার থেকে সুরক্ষিত রাখতে সাহায্য করতে পারে।
সাংবাদিকদের প্রায়ই অজানা উৎস থেকে পাওয়া নথিপত্র নিয়ে কাজ করতে হয়। হয়তো কোনো ফোরাম থেকে আপনি একটি পিডিএফ ফাইল পেয়েছেন। অথবা অজ্ঞাত কোনো ব্যক্তির পাঠানো ওয়ার্ড ডকুমেন্ট। এসব ডকুমেন্টে ম্যালওয়্যার থাকতে পারে। তাই আপনি ডেনজারজোন ব্যবহার করে সুরক্ষিত সংস্করণ তৈরি করতে পারেন। যা আপনি পর্যালোচনা করতে পারবেন। আপনি যদি বড় ডকুমেন্ট সেট নিয়ে কাজ করেন, তবে সেগুলো যাচাই করতে অফলাইন কম্পিউটার ব্যবহার করার কথা ভাবুন। সাংবাদিকতায় বড়সড় ডেটাসেট নিয়ে কাজ করার বিষয়ে আরও জানতে, মিকা লির হ্যাকস, লিকস, অ্যান্ড রেভেলেশন বইটি পড়তে পারেন।
ফোনের সুরক্ষা
যতটা সম্ভব, কম্পিউটার, ট্যাবলেট, এবং অন্যান্য ইলেকট্রনিক ডিভাইসের মতোই আপনার ফোনেও সিস্টেম এবং সফটওয়্যার আপডেটগুলো দ্রুত ইনস্টল করুন। যদি আপনার ফোন নতুন আপডেট ইনস্টল করতে সক্ষম না হয়, তবে আমরা জোর পরামর্শ দিচ্ছি , আপনি একটি নতুন মডেল কিনুন। আপনার ফোনের গোপনীয়তা এবং নিরাপত্তা সেটিংস পর্যালোচনা করুন। এর মধ্যে স্থানীয় তথ্য এবং লকস্ক্রীন নোটিফিকেশন অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এভাবে আপনি বুঝতে পারেন আপনার ফোনে কী হচ্ছে। আপনি কী শেয়ার করছেন। কাদের সাথে শেয়ার করছেন। অ্যান্ড্রয়েডের জন্য গুগল প্লে প্রোটেকটর (Google Play Protect) ব্যবহার করুন, যাতে অ্যাপ এবং ডেটা সুরক্ষিত থাকে। আইওএসের (iOS) এর জন্য লকডাউন মোড (Lockdown Mode) ব্যবহার করুন যেন উন্নত স্পাইওয়্যার, যেমন পেগাসাস (Pegasus), থেকে সুরক্ষা পাওয়া যায়। (এই ফিচারের সম্পর্কে আরও তথ্য পড়ুন)। লকডাউন মোড macOS, iOS, iPadOS, এবং watchOS-এ সমর্থিত।
আপনার নেটওয়ার্কের সুরক্ষা
এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপশন সমর্থনকারী মেসেজিং অ্যাপ ব্যবহার করুন, যেমন সিগনাল (Signal), হোয়াটসঅ্যাপ (WhatsApp), এবং ফেসবুক ম্যাসেনজার (Facebook Messenger)। গ্রুপ কল করার জন্য Signal এবং WhatsApp এর পাশাপাশি জিটসি (Jitsi), গুগল মিট (Google Meet), এবং জুম (Zoom) ব্যবহার করা যেতে পারে। এটা মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে এই অ্যাপগুলো কল এবং মেসেজের বিষয়বস্তু এনক্রিপ্ট করবে, কিন্তু মেটাডেটা নয় — যেমন, আপনি কাদের সাথে যোগাযোগ করছেন, কখন, কত সময়, এবং কতবার। টেলিগ্রাম (Telegram) গোপন চ্যাটে মেসেজ এনক্রিপ্ট করতে পারে, তবে আপনাকে এই ফিচারটি চালু করতে হবে। সিগনালের জন্য একটি পিন এবং ইউজার নেম তৈরি করুন। আপনার লকস্ক্রীনে নোটিফিকেশন কীভাবে দেখতে চান তা নির্বাচন করুন। এবং ডিসঅ্যাপেয়ারিং ম্যাসেজেস (disappearing messages) অপশনটি ব্যবহার করুন। হোয়াটঅ্যাপর জন্য two-factor authentication (দুই-ধাপ প্রমাণীকরণ) ও security notifications (নিরাপত্তা নোটিফিকেশন) ব্যবহার করুন। আপনি যদি আপনার চ্যাটগুলোর ব্যাকআপ নেন, তাহলে আপনার ব্যাকআপের জন্য এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপশন সক্ষম করুন। ফেসবুক মেসেজ সুরক্ষিত রাখতে, আপনার অ্যাকাউন্টের জন্য two-factor authentication (দুই-ধাপ প্রমাণীকরণ) চালু করুন।
ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা
যদি আপনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাস করেন, তবে DeleteMe, Optery, কিংবা কনজুমার রিপোর্টসের Permission Slip অ্যাপ ব্যবহারের কথা ভাবুন। যা আপনাকে আপনার ব্যক্তিগত তথ্য ডেটা ব্রোকার এবং অন্যান্য সাইট থেকে মুছে ফেলতে সাহায্য করতে পারে। আপনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে বাস করলেও এই টুলগুলো কাজে লাগতে পারে। পাশাপাশি গুগলে নিজের নাম খোঁজার মাধ্যমে দেখতে পারেন যে আপনার সম্পর্কে কী ধরনের তথ্য সহজেই পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়া স্থানীয় ডিজিটাল রাইটস গ্রুপগুলো আপনাকে এমন কিছু টুল সম্পর্কে পরামর্শ দিতে পারে যা আপনার বাসস্থান এবং কাজের স্থান অনুযায়ী উপযুক্ত।
কিন্তু… কী হবে…
মনে রাখবেন, এখানে দেয়া নির্দেশনাগুলো আপনার সুরক্ষা নিশ্চিত করবে এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। তবে নিরাপত্তা এবং গোপনীয়তা সুরক্ষার জন্য আপনি যদি ফিচারগুলো ব্যবহার করা শুরু করেন তাহলে আক্রমণকারীদের জন্য আপনাকে নিশানা করা অনেক কঠিন হয়ে যাবে। যেমন আপনি যদি, “password” হিসেবে “123456” এর মতো সহজ কিছু ব্যবহার করেন এবং কোনো দুই-ধাপ প্রমাণীকরণ না থাকে তাহলে আপনার ইমেইল অ্যাকাউন্ট অনেক কম সুরক্ষিত। কিন্তু একটি শক্তিশালী, “ইউনিক পাসওয়ার্ড” এবং “সিকিউরিটি কী”সহ দুই-ধাপ প্রমাণীকরণ করা থাকলে আপনার অ্যাকাউন্ট অনেক বেশি সুরক্ষিত। সঠিক টুল, সঠিক উপায়ে, সঠিক সময়ে ব্যবহার নিশ্চিত করা আপনার গুরুত্বপূর্ণ তথ্যকে সুরক্ষিত রাখার ক্ষেত্রে অনেক সাহায্য করবে।
কেস স্টাডিজ
ছবি এবং ভিডিওর মধ্যে মেটাডেটা (ডেটার একটি সেট; ডেটা সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য দেয়) থাকতে পারে, যেমন তারিখ, সময়, ডিভাইসের তথ্য, এবং লোকেশন ডেটা। এছাড়া সব ধরনের অ্যাপ, সাইট বা প্রকাশনা পদ্ধতিগুলো সংক্রিয়ভাবে এসব তথ্য মুছে দেয় না।
স্নোডেন রেভেলেশনস, পানামা পেপারস এবং পেগাসাস প্রজেক্ট তুলে ধরেছে যে আপনার প্রতিবেদন পরিকল্পনা এবং রিপোর্টিংয়ের প্রতিটি ধাপে ডিজিটাল নিরাপত্তা অন্তর্ভুক্ত করা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। ডিজিটাল নিরাপত্তাকে সাংবাদিকরা যদি তাদের কাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ না মনে করতেন, তবে তাঁরা এসব গল্প নিয়ে নিরাপদভাবে রিপোর্ট করতে পারতেন না। আমাদের জোর পরামর্শ হলো আপনি এই সাংবাদিকদের কাজের ধরন সম্পর্কে পড়ুন। তাদের কাজের প্রক্রিয়া ও ধারাগুলো আপনার নিজের কাজে লাগাতে পারেন কিনা তা দেখুন। নিচে আমরা তিনটি কেস স্টাডি অন্তর্ভুক্ত করেছি। যেখানে তুলে ধরা হয়েছে অতীতে সাংবাদিকরা কী ধরনের ডিজিটাল নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিলেন।
ভাইস ম্যাগাজিনের পক্ষ থেকে ২০১২ সালে প্রযুক্তি নির্বাহী ও কোটিপতি জন ম্যাকফিকে অনুসরণ করা হয়। তিনি পালিয়ে ছিলেন মধ্য আমেরিকায়। উই আর উইথ জন ম্যাকফি রাইট নাউ, সাকার্স শিরোনামের লেখার সাথে সাংবাদিকরা একটি সেলফি প্রকাশ করেন। ওই সেলফির মধ্যে ছবি আকারে মেটাডেটা জুড়ে দেয়া হয়। মেটাডেটার সে তথ্য দেখায় যে তাঁরা ছিলেন গুয়াতেমালায় একটি জায়গায়। এরই জের ধরে ম্যাগাজিন ওয়্যারড চটজলদি একটি ফলোআপ প্রতিবেদন প্রকাশের মাধ্যমে প্রশ্ন করে, ওপস! ডিড ভাইস জাস্ট গিভ অ্যাওয়ে জন ম্যাকফি’স লোকেশন উইথ মেটাডেটা? তাই ছবি এবং ভিডিওগুলোর মধ্যে মেটাডেটা থাকতে পারে, যেমন তারিখ, সময়, ডিভাইস সম্পর্কিত তথ্য, এবং লোকেশনের তথ্য। কারণ সব অ্যাপ, সাইট, বা প্রকশনা পদ্ধতি স্বয়ংক্রিয়ভাবে এইসব তথ্যগুলো মুছে দেয় না। তবে কিছু তথ্য আপনি নিজেই মুছে ফেলতে পারেন।
২০১৫ সালে মার্কিন আদালতের নথিতে উল্লেখ করা হয় যে, নিউইয়র্ক টাইমসের একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের তথ্য আগেই ফাঁস হয়ে গিয়েছিল। কারণ নিউজরুমের আইপি ঠিকানা বারবার একটি ওয়েবসাইটের লগে দেখা যাচ্ছিল। বড় নিউজরুমগুলোর আইপি ঠিকানা আলাদা হওয়ায় সেগুলো সহজে চেনা যায়। তাই সাংবাদিকদের তাদের ভিপিএন ঠিকানা লুকাতে IVPN, Mullvad এবং ProtonVPN এর মতো ভিপিএন ব্যবহার করা উচিত। বেশি গোপনীয়তা চাইলে Tor Browser ব্যবহার করতে পারেন।
২০২২ সালের ফিফা বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হওয়ার আগের ঘটনা। ২০২১ সাল থেকে দুইজন নরওয়েজিয়ান সাংবাদিক কাতারে অভিবাসী শ্রমিকদের পরিস্থিতি নিয়ে অনুসন্ধানে নেমেছিলেন। ফ্লাইটের ঠিক আগে কাতারের পুলিশ তাদের গ্রেফতার করে এবং ৩০ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে আটক রাখে। কর্তৃপক্ষ দাবি করে সাংবাদিকেরা ইচ্ছাকৃতভাবে ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে প্রবেশ করেছেন। সাংবাদিকদের আলাদা কক্ষে আট ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়, এবং তাদের সরঞ্জাম জব্দ করে ভালভাবে তল্লাশি চালানো হয়। গ্রানিট-এর প্রতিষ্ঠাতা এবং এই অধ্যায়ের লেখক রুনা স্যান্ডভিক এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে লেখেন, ডিজিটাল নিরাপত্তার গুরুত্ব এবং নিজেদের কাজগুলোকে রক্ষা করার জন্য পরিকল্পনার প্রয়োজনীয়তা কতটা গুরুত্বপূর্ণ— বিশেষ করে ডিজিটাল ডেটা সুরক্ষার জন্য এনক্রিপশন ব্যবহার করার ক্ষেত্রে—এই ঘটনাটি তা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।
অতিরিক্ত সহায়তা
যদি আপনি মনে করেন যে কোনোভাবে ডিজিটাল নজরদারির লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছেন, তাহলে অ্যামনেস্টি সিকিউরিটি ল্যাব (Amnesty Security Lab)-এর সাথে যোগাযোগ করুন।
অ্যাক্সেস নাউ (Access Now) একটি অলাভজনক সংস্থা, যেটি ঝুঁকিতে থাকা জনগণ ও সম্প্রদায়ের ডিজিটাল অধিকার রক্ষায় কাজ করে। এটি সাংবাদিক এবং সিভিল সোসাইটির সদস্যদের জন্য চব্বিশ ঘন্টাই বিনামূল্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা হেল্পলাইন পরিচালনা করে। এই সংস্থাটি নিরাপত্তা চর্চার জন্য সহায়তা এবং জরুরি প্রয়োজনে দ্রুত কী ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে সে সম্পর্কে সহায়তা দেয়। হেল্পলাইনটি সব অনুরোধের জবাব দুই ঘণ্টার মধ্যে দেয়। বর্তমানে নয়টি ভাষায় সহায়তা করছে—ইংরেজি, স্প্যানিশ, ফরাসি, জার্মান, পর্তুগিজ, রাশিয়ান, ট্যাগালগ, আরবি এবং ইতালীয়।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সিকিউরিটি ল্যাব স্পাইওয়্যার, নজরদারি প্রযুক্তি, এবং সিভিল সোসাইটির জন্য অন্যান্য ডিজিটাল হুমকির সাথে সম্পর্কিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের তদন্ত করে। যদি আপনি মনে করেন যে আপনাকে ডিজিটাল নজরদারির লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হয়েছে, তবে অ্যামনেস্টি সিকিউরিটি ল্যাব (Amnesty Security Lab)-এর সাথে যোগাযোগ করুন। এছাড়া কানাডাতে টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের মাংক স্কুল অব গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্সের সিটিজেন ল্যাবের সাথেও যোগাযোগ করতে পারেন।
ফোর্ড ফাউন্ডেশন-এর সাইবারসিকিউরিটি অ্যাসেসমেন্ট টুল-এর ওপর ভিত্তি করে জিআইজেএন সাংবাদিক এবং ছোট নিউজরুমগুলোর জন্য জার্নালিস্ট সিকিউরিটি অ্যাসেসমেন্ট টুল তৈরি করেছে। এটি ব্যবহার করে তাঁরা তাদের ডিজিটাল ও শারীরিক নিরাপত্তা বৃদ্ধির উপায় খুঁজে পেতে পারেন। এরইমধ্যে টুলটি আরবি, ফরাসি, জার্মান, হিন্দি, ইন্দোনেশিয়ান ভাষা, পর্তুগিজ, রাশিয়ান, স্প্যানিশ এবং তুর্কি ভাষায় প্রকাশ করাও হয়েছে।
এছাড়া উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছেন এমন সম্প্রদায়ের লোকেরা তাদের নিরাপত্তা চাহিদা সম্পর্কে আরও গভীর ধারণা নিতে যুক্তরাষ্ট্রের সাইবারসিকিউরিটি অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার সিকিউরিটি এজেন্সি (সিআইএসএ)-এর এই গাইডটি দেখতে পারেন।
রুনা স্যান্ডভিক গ্রানিট-এর প্রতিষ্ঠাতা। এটি একটি পরামর্শক সংস্থা, যেটি সারা বিশ্বের সাংবাদিক এবং উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছেন এমন ব্যক্তিদের নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করে। দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস, ফ্রিডম অব দ্য প্রেস ফাউন্ডেশন, এবং দ্য টর প্রজেক্ট-এর অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে তাঁর কাজের ভিত্তি গড়ে উঠেছে। তিনি সিআইএসএর টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজরি কাউন্সিল, ফোর্ড ফাউন্ডেশনের বিল্ড (BUILD) প্রোগ্রাম, এবং অ্যাস্পেন ইনস্টিটিউটের বৈশ্বিক সাইবারসিকিউরিটি দলের একজন উপদেষ্টা। টুইটারে তিনি (এক্স) @runasand নামে রয়েছেন।