যদি হতে চান সাংবাদিকতার “সোনার হরিণ!”
সাংবাদিকতার জগতে এখন তারাই সোনার হরিণ (লেখকের ভাষায় ইউনিকর্ন), যারা কোডিং জানেন। তাদের বলা হয় জার্নোকোডার। ছবি: আনস্প্ল্যাশ
সম্পাদকের নোট: পর্তুগালের সবচেয়ে পুরোনো রেডিও স্টেশন, রেডিও রেনেসাঁয় তিন বছর ধরে একটি ডেটা জার্নালিজম ইউনিট তৈরির কাজে জড়িত ছিলেন রুই বারোস। সেই সময়টাতে যা শিখেছেন, তুলে ধরেছেন এই লেখায়।
২০১৬ সালে আমি যখন রেডিও রেনেসাঁর নিউজরুমে ঢুকি, তখন আমার লক্ষ্য ছিল পরিস্কার: দেশের প্রথম ডেটা জার্নালিজম ইউনিট তৈরি, এবং ডেটা ও প্রোগ্রামিং দিয়ে গল্প বলার নতুন পদ্ধতি খুঁজে বের করা।
এরপর গত তিন বছর ধরে, আমি বার বার ব্যর্থতার মুখোমুখি হয়েছি, আর সেসব ভুল থেকে নিয়েছি অমূল্য শিক্ষা। এই যাত্রায় আমি অনেকবার হতাশ হয়েছি। কিন্তু বিভিন্ন ব্লগ, টুইটার ও প্রশ্নোত্তরের সাইট ঘেঁটে নতুন কিছু্ করারও চেষ্টা করেছি।
আপনার কাছে যে রিসোর্স আছে তা দিয়ে কী কী করা সম্ভব- সেটি আগে বুঝতে হবে। হয়তো তা দিয়ে অনেক কিছুই করা যায়। কিন্তু এক সাথে সব কিছু করতে গেলে, সময় বেশি লাগতে পারে।
এই তিন বছরে অবশ্য পর্তুগালের সাংবাদিকতা খুব একটা বদলায়নি। এখনো দেশটিতে ডেটা সাংবাদিকের সংখ্যা হাতে গোনা। অনেকেই বলেন, এধরণের কাজে ডেটা বিশ্লেষণ ও কোডিং জানা খুব জরুরি। কিন্তু কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সাংবাদিকতার সিলেবাসে এই বিষয়গুলো পড়ানো হয় না বললেই চলে। এখন কিছু হ্যাকাথন হচ্ছে, কিন্তু তা-ও তথ্যপ্রযুক্তিখাত এবং সরকারি পরিসরেই সীমাবদ্ধ। ওপেন বা উন্মুক্ত ডেটাও একরকমের মরীচিকা। মাঝে মধ্যে কিছু ডেটাভিত্তিক রিপোর্টিং হয়। কিন্তু এইসব প্রকল্পে কাজের সুযোগ পান, অল্প কিছু ডেটা সাংবাদিক (যার মধ্যে আমিও আছি)।
তার মানে এই নয়, পর্তুগালে ডেটা জার্নালিজম নিয়ে নতুন কিছুই হচ্ছে না। পরিবর্তন হচ্ছে, কিন্তু খুবই ধীরগতিতে। অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনায় একটু বেশিই ধীর বলতে হবে।
তিন বছর ধরে ডেটা ইউনিট গঠন করে, তাকে ৮৩ বছর পুরনো একটি গণমাধ্যমের প্রচলিত কর্মপদ্ধতিতে যুক্ত করতে গিয়ে, আমি নতুন কিছু জিনিস শিখেছি। আপনি যদি আপনার নিউজরুমে একটি ডেটা ইউনিট গঠন করতে চান, তাহলে এই শিক্ষাগুলো বিবেচনায় নিতে পারেন।
১. হয়ে যান সোনার হরিণ (জার্নোকোডার)
সাংবাদিকতার জগতে এখন তারাই সোনার হরিণ, যারা কোডিং জানেন। এদের বলা হয় জার্নোকোডার। এরা সেই বিরল প্রজাতির সাংবাদিক যাদের রিপোর্টিং দক্ষতা আছে, আবার প্রোগ্রামিং এবং ডেটা বিশ্লেষণেও পটু। এই বিশেষ দক্ষতাগুলোর মিশেলে, তারা হয়ে ওঠেন যে কোনো নিউজরুমের জন্যেই আরাধ্য। আপনি কি একটি ডেটা ইউনিট গঠন করতে চাইছেন? আপনার জন্য দুঃসংবাদ হলো, এই “সোনার হরিণ” আপনি যতটা ভাবছেন তার চেয়ে বিরল ও দুষ্প্রাপ্য।
কাজেই, আমার পরামর্শ হচ্ছে, আপনি নিজেই তেমনটা হয়ে উঠুন। যদি ডেটা জার্নালিজমে আগ্রহী হন, তাহলে কোনো সন্দেহ নেই, এরিমধ্যে দারুণ কিছু আইডিয়া আপনার মাথায় এসেছে। আর আপনি শুরুতেই হোঁচট খেয়েছেন। হয়তো বসে বসে ভেবেছেন, “ইশ! কোনো প্রোগ্রামার যদি আমাকে একটু সাহায্য করতো…।”
আপনার প্রতিষ্ঠান আপনাকে সাহায্য করার জন্য কোনো ডেভেলপার নিয়ে আসবে, এমনটা ভেবে অপেক্ষা করারও কোনো মানে হয়না। কারণ তেমনটা হবে না।
কিন্তু ভালো খবর হচ্ছে, অনেক রকমের পথ আছে যেগুলো ধরে আপনি নিজে নিজেই শুরু করতে পারেন। অনলাইনে বেশ কিছু বিনামূল্যের কোর্স আছে। গিটহাবে দারুন দারুন সব জিনিসপত্র আছে। আর প্রোগ্রামিং কমিউনিটি রীতিমত হাত বাড়িয়ে আছে, যে কোনো সময় আপনাকে সাহায্য করার জন্য। কিছু জানার থাকলে নির্ভয়ে তাদের প্রশ্ন করুন।
২. আকাঙ্ক্ষায় লাগাম টানুন
ডেটা জার্নালিজম পুরস্কারের সংক্ষিপ্ত তালিকাটা হয়তো আপনার মন কেড়েছে, ডেটা জার্নালিজম হ্যান্ডবুক পড়েছেন। গার্ডিয়ান, নিউ ইয়র্ক টাইমস, ফাইভথার্টিএইট, লা ন্যাসিওন বা বার্লিনার মর্গেনপোস্টে দুর্দান্ত কিছু কাজও দেখেছেন। এই প্রকল্পগুলো একেকটা মাস্টারপিস। আপনিও হয়তো এমন কিছু করতে চাইছেন।
দারুন কিছু করার আকাঙ্ক্ষা থাকা ভালো। কিন্তু আপনাকে জানতে হবে, সেই আকাঙ্ক্ষা কীভাবে সামলে রাখতে হয়। আরেকভাবে বললে, আপনার কাছে যে রিসোর্স আছে তা দিয়ে কী কী করা সম্ভব- সেটি আগে বুঝতে হবে। হয়তো তা দিয়ে অনেক কিছুই করা যায়। কিন্তু এক সাথে সব কিছু করতে গেলে, সময় বেশি লাগতে পারে; কাজটি গুছিয়ে আনতে দরকার হতে পারে অন্যদের সহযোগিতা; যা হয়তো এই মুহূর্তে আপনার হাতে নেই।
তার মানে এই না যে, আপনি বড় কোনো লক্ষ্য স্থির করবেন না। শুধু ফলাফল মনের মতো না হলে হতাশ হওয়া যাবে না।
এই পদ্ধতির সঙ্গে কাজ করতে হবে ভালোবাসা নিয়ে। শুধু শেষ ফলাফলটার দিকে তাকিয়ে থাকলে হবে না।
৩. কীভাবে সময় নিতে হয়, শিখুন
আমার সম্পাদক সবসময়ই আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করেন। কারণ, যখনই তিনি কোনো অদ্ভুত নতুন আইডিয়া নিয়ে আমার কাছে আসেন; আমি বলি: “হ্যাঁ, এটা করা যাবে। কিন্তু কীভাবে করব, তা শিখতে কিছুটা সময় দরকার।”
এমনকি খুব মেধাবী আর অভিজ্ঞ কোডার হলেও – শেখার জন্য, চিন্তা করার জন্য, কোডটা লেখা বা ডিবাগ করার জন্য আপনার সময় দরকার হবে। কাজেই, আপনি আর আপনার সম্পাদক মিলে সত্যিই যদি দারুন কোনো প্রজেক্ট শুরু করতে চান, তাহলে শিখতে হবে, কীভাবে দরকষাকষি করে একটু বেশি সময় আদায় করে নেওয়া যায়। কাজটা ভালোমতো করার জন্য এই সময় নেওয়াকে বিনিয়োগ হিসেবেও ধরতে পারেন, যা থেকে শেষপর্যন্ত আপনি লাভবানই হবেন।
(অতিরিক্ত পরামর্শ: যদি ভেবে থাকেন, একটি কাজ করে ফেলতে মাত্র কয়েক মিনিট সময় লাগবে, তাহলে আপনি ভুল ভাবছেন। এটি তার চেয়েও অনেক বেশি সময় নেবে।)
৪. যখন মনে হবে নিজ ঘরে পরবাসী
আমি প্রোগ্রামিং জানা সহকর্মীদের প্রতি প্রথাগত সাংবাদিকদের মনোভাবের ব্যাপারে কথা বলছি না। আমি নিজেও প্রথাগত সাংবাদিকদের কাছ থেকে কিছু হতচকিত দৃষ্টি পেয়েছি। কিন্তু তারা দ্রুতই আপনাকে বুঝতে পারবে, যখন তারা আপনার কাজের শেষ ফলাফলটা দেখবে।
কিন্তু বেশিরভাগ সংবাদমাধ্যমই এখনো জার্নোকোডারদের জন্য প্রস্তুত হয়নি। সার্ভার, অভ্যন্তরীন এপিআই বা WYSIWYG ইন্টারফেসের ভেতরে আইটির লোকজন যা আড়াল করে রাখে, তাতে সচরাচর সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকার থাকে না।
জার্নোকোডার একটা “নতুন জিনিস।” তারা নিউজরুম থেকে যেসব অনুরোধ পাঠায়, সেগুলো সামলাতে আইটির লোকজন অভ্যস্ত না। কোনো নতুন পরামর্শ পেলে আইটির লোকেরা সবার আগে যে কথা বলে অভ্যস্ত, সেটি হলো, “নিরাপত্তা সংক্রান্ত কারণে এটি করা সম্ভব নয়।”
মনে রাখবেন, বাধা আসবে। কিন্তু নতুন নতুন জিনিস চেষ্টা করে দেখা থেকে বিরত হবেন না। এমন অনেক সার্ভিস আছে যেগুলোর সাহায্য নিয়ে আপনি অনেক দরকারি বিষয় বিনা পয়সাতেই ঘাঁটাঘাটি করে দেখতে পারবেন।
অনেক জার্নোকোডারেরই কম্পিউটার সায়েন্সে কোনো আনুষ্ঠানিক পড়াশোনা নেই। এটি দেখেও আইটি বিভাগের কর্মীরা কিছুটা নার্ভাস বোধ করেন। অনেক সময় জার্নোকোডাররা নিজেদের কাজ হাসিলের জন্য “বেস্ট প্র্যাকটিস” বাদ দিয়ে একটা অপ্রথাগত পথ বেছে নেন। হ্যাঁ, আমরা সাংবাদিকরা কৌতুহল-তাড়িত প্রাণী, আমাদের প্রবণতাই হলো জিনিসপত্র ভেঙেচুরে দেখার।
নিজের কম্পিউটারের অ্যাডমিন অ্যাকসেস থেকে শুরু করে সার্ভারের নিরাপদ অ্যাকসেস পয়েন্ট; কোনোটাই হয়তো আপনার নেই। ধরেই নিতে হবে যে এরকম অনেক বাধাই আপনাকে পেরোতে হবে। বিশেষভাবে যদি আপনি অনেক বেশি প্রথাগত কোনো নিউজরুমে কাজ করেন। ভালো খবর হচ্ছে, আপনি যদি কোডিং পারেন, তাহলে আপনি আইটি দলের সঙ্গেও তাদের ভাষায় কথা বলতে পারবেন। হয়তো বুঝিয়ে বলতে পারবেন কোন সমস্যাটি আপনার কাজে বাধা হয়ে দাড়াচ্ছে। কে জানে, আপনি হয়তো নতুন কিছু বন্ধুও তৈরি করে ফেলতে পারেন।
মনে রাখবেন, বাধা আসবে। কিন্তু নতুন নতুন জিনিস চেষ্টা করে দেখা থেকে বিরত হবেন না। এমন কিছু সার্ভিস আছে যেগুলোর সাহায্য নিয়ে আপনি অনেক দরকারি বিষয় বিনা পয়সাতেই ঘাঁটাঘাটি করে দেখতে পারবেন। আর এই নতুন কিছু চেষ্টা করতে গিয়ে সম্ভবত আপনি নতুন নতুন জিনিসও শিখে ফেলবেন। হয়তো একদিন, আপনার নিজের কোম্পানির ক্রেডিট কার্ড দিয়েই আপনি চুকাতে পারবেন প্রজেক্টের যাবতীয় খরচ।
(অনলাইনে কার্ড দিয়ে কিছু কেনাকাটার ভারটা সাধারণত আইটির হাতেই থাকে। এই টুইটার থ্রেডে ডেটা জার্নালিজম বিশেষজ্ঞ ম্যাট ওয়েইট বলছিলেন, নিউ ইয়র্ক টাইমসের জার্নোকোডাররাও একই সমস্যায় পড়েছিলেন। তিনি ঠিকই ধরেছেন, সাংবাদিকতায় উদ্ভাবনের ইতিহাস যখন লেখা হবে, তখন পি-কার্ডের (যে কার্ড দিয়ে অনলাইনে কেনাকাটা হয়) কথা, সেখানে বিশেষ জায়গা করে নেবে।)
.
৫. আপনার সুপারপাওয়ার আছে, এমন ভাবা বন্ধ করুন
আপনি কোডিং বা ডেটা বিশ্লেষণ করতে জানেন, এর মানে এই না আপনি রহস্যময় ক্ষমতা পেয়ে গেছেন। নিউজরুমের মধ্যে নিজেকে একজন নিঃসঙ্গ কোডার হিসেবে আবিস্কার করার পর আচমকা সেটা রূপ নিতে পারে পুরোদস্তুর “ডিভা সিনড্রোমে” (নিজেকে খুব বড় ভাবা)। আপনার মনে হতে পারে, কেউই আপনার কাজকর্ম বুঝতে পারে না। কিন্তু আপনি কি তাদের কাছে কখনো ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন?
“প্রথাগত” সাংবাদিকদের সঙ্গে আমি যখনই কোনো প্রজেক্টে একসঙ্গে কাজ করি, খুব বিস্তারিতভাবে তাদের ব্যাখ্যা করি, কীভাবে ডেটা বিশ্লেষণ করা হয়। যদি একটি স্ক্র্যাপার বানানো দরকার হয়, তখন আমি সবাইকে ব্যাখ্যা করি, সব ডেটা একসঙ্গে ডাউনলোড করে ফেলার সহজ কোনো রাস্তা নেই। কাজেই আপনাকে এমন একটা ছোট “রোবট” বানাতে হবে যা প্রতিটি পেজে গিয়ে গিয়ে ডেটা সংগ্রহ করবে।
হঠাৎ করেই দেখতে পাবেন, আপনার ডেটা দক্ষতা না থাকা সহকর্মীরা বুঝতে শুরু করবে, আপনি কী করছেন। শুধু তা-ই নয়, কীভাবে একটি নির্দিষ্ট সমস্যা সমাধান করা যায়, তা নিয়ে আপনাকে পরামর্শও দেয়া শুরু করবে সেই সহকর্মীরা। আর একজন জার্নোকোডারের জন্য এটাই সবচেয়ে বড় পাওয়া।
লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয় ইউরোপিয়ান জার্নালিজম অবজারভেটরি ওয়েবসাইটে। অনুমতি নিয়ে এখানে পুনঃপ্রকাশ করা হলো।
রুই বারোস ২০১৬ সাল থেকে ডেটা জার্নালিস্ট হিসেবে কাজ করেন রেডিও রেনেসাঁতে। এটা পর্তুগালের পুরোনো রেডিও স্টেশনগুলোর মধ্যে অন্যতম। সেখানে তিনি কোড ও ডেটাবেজ দিয়ে তৈরি করেন নানা ইন্টারঅ্যাকটিভ ফিচার ও ডেটাভিত্তিক প্রতিবেদন। নিউজরুমে উদ্ভাবনের নানা উপায় নিয়ে তিনি এখন করছেন মাস্টার্স থিসিস।