নজরদারির ক্রমবর্ধমান হুমকির সাথে যেভাবে মানিয়ে নিচ্ছেন সাংবাদিকরা
স্ক্রিনশট: ইন্টারন্যাশনাল প্রেস ইন্সটিটিউট ট্র্যাকার
বিশ্বের অনুসন্ধানী সাংবাদিকরা এখন তাদের ডিজিটাল নিরাপত্তা আরো জোরদার করার দিকে মনোযোগ দিয়েছেন। কারণ নজরদারির নতুন নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার, জরুরি মহামারি আইন, এবং লকডাউন মিলিয়ে সাংবাদিকরা নজরদারি ও হয়রানির বাড়তি ঝুঁকিতে পড়েছেন।
যেমন, বিশ্ব যখন মহামারি নিয়ে ব্যস্ত, তখন হংকংয়ের ওপর নতুন একটি জাতীয় নিরাপত্তা আইন চাপিয়ে দিয়েছে চীন। এই আইনের ফলে বেইজিংয়ের সমালোচনাকারীদের অপরাধী সাব্যস্ত করা যাবে এবং “সাংবাদিকতার সরঞ্জাম” জব্দ করা যাবে। সম্প্রতি হংকংয়ে এই আইনের অধীনে গ্রেপ্তার করা হয় অ্যাপল ডেইলির প্রতিষ্ঠাতা জিমি লাই-কে।
থাইল্যান্ড, ব্রাজিল ও হাঙ্গেরির মতো দেশগুলোর সরকারও তথ্য-প্রবাহ সীমাবদ্ধ করার জন্য মহামারিকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করেছে। এমনকি, দক্ষিণ আফ্রিকার মতো গণতান্ত্রিক দেশেও, মিথ্যা মনে হতে পারে এমন তথ্য প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।
বৈশ্বিক মনোযোগের বাইরে থাকার সুযোগ নিয়ে, ছোট কয়েকটি দেশও কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। যেমন, কম্বোডিয়া। সেখানে, সাংবাদিকদের নিপীড়ন ও গ্রেপ্তারের ঘটনা যেমন বেড়েছে, তেমনি “জনমনে ভীতি ছড়াতে পারে,” এমন তথ্য প্রকাশেও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। ইন্টার আমেরিকান প্রেস অ্যাসোসিয়েশন, গত আগস্ট মাসে দেয়া এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, মহামারির সময় নিকারাগুয়ায় গণমাধ্যমের ওপর রাষ্ট্রীয় হুমকি ও নিপীড়ন আরো বেড়েছে। সেখানে অনলাইন হয়রানি, হামলা ও সেন্সরশিপের মত অন্তত ৩৫১টি ঘটনা ঘটেছে শুধু লকডাউনের সময়ে।
ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের হিউম্যান রাইটস সেন্টার ইনভেস্টিগেশন ল্যাবের সাইবার সিকিউরিটি বিশেষজ্ঞ ও সাংবাদিক জিসেলা পেরেজ দে আচা বলেছেন, “হ্যাকিংয়ের শিকার হবেন না, এমনটি নিশ্চিত করতে গেলেও আপনাকে নিরাপত্তার কিছু প্রাথমিক টুল ব্যবহার করতে হবে। আর নিজেকে ডিজিটালি পরিস্কার রাখা – সাংবাদিক হিসেবে আপনার দায়িত্বও বটে। মহামারির আগেও নজরদারি ছিল। কিন্তু মহামারি আসার পর নজরদারির কিছু ধরনকে বৈধ করে ফেলা হয়েছে।”
“আমরা এখন অনলাইনে আরো অনেক বেশি সময় কাটাচ্ছি। আগে রিপোর্টিং সংক্রান্ত যেসব কাজ সামনাসামনি করা হতো, এখন সেগুলো ডিজিটাল পদ্ধতিতে সেরে ফেলা হচ্ছে। আমরা কখনো জুম ব্যবহার করছি, কখনো ফোন – যার কোনোটিই এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপ্টেড নয়,” বলেছেন আচা।
“মহামারির আগেও নজরদারি ছিল। কিন্তু মহামারি আসার পর নজরদারির কিছু ধরনকে বৈধ করে ফেলা হয়েছে।” — সাংবাদিক জিসেলা পেরেজ দে আচা
অনলাইনে কাজ ঝুঁকি বাড়ায়
সম্প্রতি নজরদারি ও ডক্সিংয়ের (সোশ্যাল মিডিয়ায় হয়রানি, যেখানে নাম-পরিচয়-ঠিকানাসহ নানান ব্যক্তিগত তথ্য অবৈধভাবে ফাঁস করে দেওয়া হয়) বেশ কয়েকটি অভিযোগ সামনে এনেছেন সাংবাদিকরা। আগস্টে, ইউক্রেনের স্কিমস টিভি প্রোগ্রামের অনুসন্ধানী সাংবাদিক মিকাইলো তাচ খেয়াল করেন, তার বাড়িতে অডিও নজরদারি চালানো হচ্ছে। এর আগে এক সোর্স তাকে সতর্ক করে বলেছিলেন, তাঁর রিপোর্টিংয়ের কারণে সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা “বিরক্ত” বোধ করছেন। (একদিন পরে, স্কিমসের একটি গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়।) গত জুলাইয়ে, ইউক্রেনের অনুসন্ধানী সাংবাদিক লিউবভ ভেলিচকো-কে হত্যার হুমকিও দেওয়া হয়। তিনি টেলিগ্রামের কিছু প্রোপাগান্ডা চ্যানেলের পেছনে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের চিত্র উন্মোচন করেছিলেন।
এই ঘটনাগুলোকে এখন পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন হিসেবেই দেখা হচ্ছে। মহামারির মধ্যে কাজ করা বেশ কয়েকজন সাংবাদিকের সাক্ষাৎকার, এবং বিভিন্ন গণমাধ্যম ও বেসরকারি সংগঠনের প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এমনটা নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না যে, মহামারির সময়ে ডিজিটাল তথ্য চুরি বা হয়রানির প্রবণতা বেড়েছে।
কিন্তু সাক্ষাৎকার থেকে এটি স্পষ্ট, রিপোর্টারা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি নাজুক অবস্থায় আছেন; এবং বড় বড় বেশ কয়েকজন সাংবাদিক তাদের কর্মপদ্ধতিতে ডিজিটাল নিরাপত্তার নতুন ব্যবস্থা যোগ করেছেন অথবা পুরোপুরি অফলাইনে রিপোর্টিং করছেন, অথবা দুই কৌশলই অবলম্বন করছেন।
সাংবাদিকদের বড় উদ্বেগ ছিল: লকডাউনের সময় রিপোর্টারদের কাজের ধরনে পরিবর্তন, কারণ এই সময়ে তারা সশরীরে কোথাও না গিয়ে বরং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে কাজ করতে বাধ্য হয়েছেন। ডিজিটাল মাধ্যমে যোগাযোগের মাত্রা যত বাড়ছে, সেখানে আড়ি পাতার আশংকাও ততটাই তীব্র হচ্ছে। নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনেক ক্ষেত্রে বোঝার-ই উপায় থাকে না যে, আড়ি পাতা হয়েছে।
মহামারিতে তৈরি হওয়া বাড়তি ঝুঁকির কারণে প্রাথমিক কিছু পদক্ষেপ এখন বাধ্যতামূলক হয়ে গেছে। যেমন: পাসওয়ার্ড ম্যানেজার ব্যবহার, সবসময় অ্যাপগুলো আপডেট রাখা, টু-ফ্যাক্টর অথেনটিকেশন ইত্যাদি।
তবে অনলাইন হুমকি বা হয়রানির কারণে যে একেবারে ভয় পেয়ে যেতে হবে, এমনটাও মনে করেন না বিশেষজ্ঞরা । তাঁদের মতে, এখন বরং সাংবাদিকদের উচিত হবে, ঝুঁকি মোকাবিলার জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তার প্রাথমিক কিছু পদক্ষেপ নেওয়া, বা নিরাপত্তা আরো বাড়িয়ে নেওয়া। যেমন, বেশি ঝুঁকিপূর্ণ অনুসন্ধানের সময় কম দামী, পুরোনো প্রযুক্তির ফোন ব্যবহার করা। সব ধরনের রিপোর্টের বেলায় আপনার যে বার্নার ফোন বা এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপশন দরকার হবে, তা নয়। কিন্তু মহামারিতে তৈরি হওয়া বাড়তি ঝুঁকির কারণে প্রাথমিক কিছু পদক্ষেপ সবাইকেই নিতে হবে। বিষয়টি এখন আর ইচ্ছে-অনিচ্ছের পর্যায়ে নেই, বরং কিছু ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক হয়ে গেছে। যেমন: পাসওয়ার্ড ম্যানেজার ব্যবহার, সবসময় অ্যাপগুলো আপডেট রাখা, টু-ফ্যাক্টর অথেনটিকেশন ইত্যাদি।
“জিরো ক্লিক” স্পাইওয়্যার
নতুন প্রযুক্তির মাধ্যমে কিভাবে সাংবাদিকদের হ্যাক করা যায়, তার একটি ভয়ানক উদাহরণ মরোক্কোর অনুসন্ধানী সাংবাদিক ওমর রাদির ওপর চালানো সাম্প্রতিক সাইবার হামলা। আশংকা হলো, কোভিড-১৯ রোগী সনাক্ত করার প্রযুক্তি কেনার নাম করে, সরকারগুলো এখন হয়তো নজরদারির এমন প্রযুক্তি কেনাকেই বৈধ করে নিচ্ছে।
এই গ্রাফিক্সের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে কিভাবে “জিরো ক্লিক” স্পাইওয়্যারের মতো প্রযুক্তি সাংবাদিকদের যোগাযোগকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে। ছবি: আমনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল
গণতন্ত্রপন্থী রাজনৈতিক কর্মীদের সাজা বহাল রাখায় এক বিচারকের সমালোচনা করেছিলেন রাদি। এর জের ধরে আদালত অবমাননার অভিযোগে গেল মার্চে তাকে চার মাসের কারাদন্ড দেওয়া হয়। আদালত, জামিনে থেকে রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন জানানোর সুযোগ দিলেও, এই সময়ের মধ্যে পুলিশ তাকে কয়েকবার আটক করেছে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রযুক্তি বিভাগ, একটি ফরেনসিক অনুসন্ধান চালিয়ে উন্মোচন করেছে: রাদির ফোনে সাইবার হামলা চালানো হয়েছে খুবই চতুরতার সাথে। একে বলে “নেটওয়ার্ক ইনজেকশন” হামলা। এই পদ্ধতিতে, একটি ডিভাইসের ব্রাউজার রি-ডিরেক্ট করে একটি সাইটে নিয়ে যাওয়া যায়, এবং সেখান থেকে গোপনে পেগাসাস স্পাইওয়্যার আপলোড করা হয়। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের রিপোর্টে বলা হয়েছে, “এনএসও গ্রুপ নামে ইসরায়েলি যে কোম্পানি কোভিড-১৯ মোকাবিলায় প্রযুক্তি সহায়তা নিয়ে কাজ করছে, তারাই মরক্কোর সরকারকে আধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে সাহায্য করছে সাংবাদিক ওমর রাদির বিরুদ্ধে নজরদারি করার জন্য। একটি ডিভাইসে যখন পেগাসাস ইন্সটল করা হয়, তখন সেই ফোনের মেসেজ, ইমেইল, ছবি-ভিডিও, মাইক্রোফোন; সব কিছুই হামলাকারীর হাতে চলে যায়। আর এই নেটওয়ার্ক ইনজেকশন হামলা আরো বেশি ক্ষতিকর। কারণ এখানে হামলাকারীকে সনাক্ত করা আরো কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।” এনএসও এবং মরোক্কোর সরকার; দুই পক্ষই অ্যামনেস্টির এই অনুসন্ধানের বক্তব্য অস্বীকার করেছে।
নতুন এই নেটওয়ার্ক ইনজেকশনের মাধ্যমে, আপনাকে কোনো কিছু ক্লিক করতে হবে না। আপনি হয়তো শুধু একটি মিস কল পেতে পারেন। এবং তাতেই হয়তো আপনি নিজের অজান্তে আক্রান্ত হয়ে যাবেন। — অ্যামনেস্টির ডানা ইঙ্গলটন
এই নতুন হুমকির সবচে যন্ত্রণাদায়ক ব্যাপারটি হলো: কেউ কোনো কিছু ক্লিক না করেও আক্রান্ত হতে পারেন, বলেছেন অ্যামনেস্টি টেক-এর ডেপুটি ডিরেক্টর ডানা ইঙ্গলটন। “এর আগে, এনএসও প্রযুক্তিগুলোর ক্ষেত্রে — বিশেষভাবে পেগাসাসের ক্ষেত্রে — দেখা গেছে: এই স্পাইওয়্যার ইন্সটলের জন্য কোনো না কোনোভাবে একটি লিংকে ক্লিক করার আহ্বান জানানো হতো। সেই লিংকে ক্লিক করলে একটি ওয়েবসাইট ওপেন হতো, এবং সেখান থেকে স্পাইওয়্যারটি হামলা চালাতো। কিন্তু নতুন এই নেটওয়ার্ক ইনজেকশনের মাধ্যমে, আপনাকে কোনো কিছু ক্লিক করতে হবে না। আপনি হয়তো শুধু একটি মিস কল পেতে পারেন। এবং তাতেই হয়তো আপনি নিজের অজান্তে আক্রান্ত হয়ে যাবেন। আপনি হয়তো নিজেকে নিরাপদ রাখার জন্য সব কিছু করছেন, তারপরও ঝুঁকি এড়াতে পারবেন না।”
ইঙ্গলটন বলেছেন, এধরনের সাইবার হামলা রোধে যতদিন না কার্যকরী নীতিমালা প্রণয়ন করা যাচ্ছে, ততদিন এসব নজরদারির প্রযুক্তি কেনাবেচার বিরুদ্ধে একটি বৈশ্বিক জনমত গড়ে তুলতে হবে।
“আমরা চাই: সাংবাদিকরা যেন তাদের প্রাইভেসির বিষয়টি মাথায় রাখেন, এবং প্রাইভেসি লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো উন্মোচন করেন। তাঁরা অ্যামনেস্টির মতো সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ করে সেগুলো সবার সামনে নিয়ে আসতে পারেন এবং জবাবদিহিতা দাবি করতে পারেন।”
প্রতিটি স্টোরি ও বিটের ঝুঁকি যাচাই
ক্যালিফোর্নিয়া-ভিত্তিক অনুসন্ধানী সাংবাদিক পেরেজ দে আচা অনুসন্ধান করছেন সন্ত্রাসবাদ নিয়ে। তিনি সন্দেহ করছেন: তাঁর সোর্সরা হয়তো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের নজরদারিতে আছেন, এবং তাই তাঁর ব্যক্তিগত যোগাযোগেও হয়তো নজর রাখা হচ্ছে।
একারণে এখন তিনি অস্থায়ী সিম কার্ডযুক্ত ফোন ব্যবহার করছেন, যেগুলোর সঙ্গে কোনোভাবেই তাঁর পরিচয় সংযুক্ত নেই। এর আগে মেক্সিকোতে কাজ করার সময় তিনি “বার্নার ফোন” ব্যবহার করেছেন। “কিন্তু আমাকে এটি করতে হয়েছে প্রতিবেদনের বিষয়বস্তুর কারণে। সেটি বুঝে আমি আমার আচরণ নির্ধারণ করেছি। এখন মহামারি সংক্রান্ত পরিস্থিতির কারণেও আমি এটি করছি। কারণ এখন আমি সোর্সদের সামনাসামনি দেখতে পাচ্ছি না। সব কিছুই হয় ডিজিটাল উপায়ে অথবা ফোনের মাধ্যমে। আমি অবশ্য আমার সোর্সদের বারবার সিগন্যাল ব্যবহারের কথা বলছি। কিন্তু এটি সব সময় সম্ভব হয় না।”
তবে বিষয়টি নিয়ে আতঙ্কিত হতে বারণ করেছেন পেরেজ দে আচা। কারণ, তাঁর মতে, বেশিরভাগ অনুসন্ধানী প্রতিবেদনই গুরুতর সাইবার হামলার ঝুঁকিতে থাকে না। রিপোর্টাররা সাধারণ একটি ঝুঁকি যাচাইয়ের মাধ্যমেও বুঝে নিতে পারবেন, তাদের কী ধরনের ডিজিটাল নিরাপত্তা দরকার।
“খুবই ভালো হয় যদি, বিট বা কাজের ক্ষেত্র ধরে এই নজরদারি সংক্রান্ত উদ্বেগকে চিহ্নিত করা হয়। গৃহহীনদের নিয়ে রিপোর্টিং আর সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড নিয়ে রিপোর্টিং; এই দুইয়ের ঝুঁকি কখনো এক রকম নয়। আপনি যদি স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে রিপোর্টিং করেন, তাহলে আপনার হয়তো তেমন ঝুঁকি নেই। আপনাকে শুধু শক্তিশালী পাসওয়ার্ড ব্যবহার করতে হবে এবং একটু বুঝেশুনে চলতে হবে। আমি থাকি বার্কলিতে। ধরুন, আমি বার্কলির পুলিশ নিয়ে অনুসন্ধান করছি। এক্ষেত্রে আমার ফোনে আড়ি পাতার আশঙ্কা কতখানি? এটি করতে গেলে তাদেরকে বিচারকের কাছ থেকে একটি ওয়ারেন্ট নিতে হবে, অথবা ফোন অপারেটর কোম্পানির কাউকে দিয়ে তথ্য ফাঁস করাতে হবে, অথবা আমাকে হ্যাক করার জন্য আধুনিক সব যন্ত্রপাতির সাহায্য নিতে হবে। সত্যি বলতে, স্থানীয় একটি পুলিশ নিয়ে কাজে, এতো বেশি মাত্রার ঝুঁকি থাকে না,” বলেছেন আচা।
পেরেজ দে আচা আরো বলেছেন, মহামারির এই সময় আমাদের দেখিয়েছে: পেশাগত ও ব্যক্তিগত; দুটি জায়গা অনলাইনে এক করে ফেলা কতটা ক্ষতিকর।
যেমন, উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেছেন: ক্যালিফোর্নিয়ার এক রিপোর্টার সম্প্রতি বন্দুকের মালিকানা সংক্রান্ত তথ্য চেয়ে একটি আবেদন করেছিলেন। সেখানে তিনি, তাঁর সাথে যোগাযোগের ঠিকানা ও নম্বর উল্লেখ করেছিলেন। এরপর থেকে তিনি ও তাঁর পরিবার বেশ কয়েকবার হুমকি পেয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের “উগ্র ডানপন্থী” গ্রুপের সদস্যরা তাঁর এই তথ্য সংগ্রহ করেছিল সেই আবেদনপত্র থেকে। বিষয়টি এতোটাই গুরুতর হয়ে ওঠে যে, শেষপর্যন্ত তিনি অনুসন্ধানটি বাদ দিতে বাধ্য হন।
নিরাপত্তা সংক্রান্ত নিউজ সাইট ডিসাইফার-এর সিনিয়র রিপোর্টার ফাহমিদা রশিদ জানিয়েছেন, যে সোর্সরা ফোটনমেইলের মতো এনক্রিপ্টেড ইমেইলে অভ্যস্ত নয়, তাদের কাছ থেকে তথ্য পাওয়ার সময় অনেক রিপোর্টারই এখন সেই পুরোনো আমলের পোস্ট বক্স ব্যবহার করছেন।
“আমরা নিশ্চিতভাবেই দেখতে পাব, সরকার এই মহামারির সময় নজরদারির পরিধি বাড়াবে। এবং আগামীতে, পরিস্থিতি এমনটাই থেকে যাবে বলে আশঙ্কা আছে। যুক্তরাষ্ট্রে, ৯/১১-এর পরে জারি করা প্যাট্রিয়ট অ্যাক্টের মাধ্যমে, সূত্রদের পরিচয় প্রকাশে বাধ্য করা হয়েছিল সাংবাদিকদের। এসব-ই করা হয়েছিল সন্ত্রাসবাদ নিয়ে তদন্তের নাম দিয়ে।”
ফাহমিদা রশিদ বলেছেন, যে সোর্সরা ফোটনমেইলের মতো এনক্রিপ্টেড ইমেইলে অভ্যস্ত নয়, তাদের কাছ থেকে তথ্য পাওয়ার সময় অনেক রিপোর্টারই এখন সেই পুরোনো আমলের পোস্ট বক্স ব্যবহার করছেন।
রশিদ বলেছেন, হংকং ও তাইওয়ানে, তাঁর বেশিরভাগ রিপোর্টার সহকর্মীই এখন বার্তা আদান-প্রদানের জন্য উইচ্যাটের বদলে, টেলিগ্রাম বা সিগন্যাল ব্যবহার করেন। চীন-ভিত্তিক উইচ্যাট-ই এই অঞ্চলে বেশি জনপ্রিয়। কিন্তু এটি চীনা সরকারের নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণে থাকে। অন্যদিকে টেলিগ্রাম ও সিগন্যালের মেসেজগুলো এনক্রিপ্টেড থাকে এবং নিজের ইচ্ছেমতো সেগুলোর রেকর্ড রাখা যায়।
ফ্রিল্যান্সারদের ঝুঁকি বাড়ছে
সাংবাদিকতাদের একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য হলো, কৌতুহল। বাজে ব্যাপার হলো, ডিজিটাল ফাঁদ পাতার জন্য, এই বিষয়টিকেই কাজে লাগাচ্ছে অসাধু গোষ্ঠীরা।
যেমন, গত বছর, নির্বাসিত সৌদি সাংবাদিক সাফা আল-আহমাদ, তাঁর টুইটার অ্যাকাউন্টে একটি অদ্ভুত বার্তা পান। তিনি দ্য গ্রেট সৌদি পডকাস্ট নামে একটি অনুসন্ধানী সিরিজ উপস্থাপনা করেন।
এই পডকাস্টের প্রথম সিজনটি ছিল সৌদি ভিন্নমতাবলম্বী ও ওয়াশিংটন পোস্টের কলাম-লেখক জামাল খাসোজির হত্যাকাণ্ড নিয়ে। সাফার টুইটার অ্যাকাউন্টে আসা বার্তায় বলা হয়েছিল: একটি নিরাপদ ইমেইল অ্যাড্রেস দেওয়া হলে, এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি ভিডিও পাঠানো হবে।
২০১৫ সালে সৌদি আরবের পূর্বাঞ্চলে একটি অভ্যুত্থানের ঘটনা উন্মোচন করেছিলেন পুরস্কারজয়ী স্বাধীন চলচ্চিত্র-নির্মাতা, সাফা আল-আহমাদ। এবং তিনি ছিলেন খাসোজির দীর্ঘদীনের বন্ধু।
সেই সময়ের স্মৃতি স্মরণ করে আল-আহমাদ বলেছেন, “তো, আমার মনে হয়েছিল, ‘ঠিক আছে…’ কিন্তু এরপর তারা বলা শুরু করে, ‘আমরা এই ভিডিওটি দূতাবাস থেকে গোপনে বের করেছি, আমাদের কাছে পুরো হত্যাকাণ্ডের ভিডিও আছে, আমরা অনেক ঝুঁকি নিয়েছি…’ ইত্যাদি। এরপর তারা সেই ভিডিওর কিছু স্ক্রিনশট পাঠায়। ছবিগুলোকে শুরুতে সাংবাদিকতার দৃষ্টিকোন থেকে খুবই অদ্ভুত ও আকর্ষণীয় মনে হচ্ছিল। সেখানে দেখা যাচ্ছিল: মেঝেতে একটি মৃতদেহ পড়ে আছে। এসময় প্রথমেই আমার মাথায় এসেছে ডিজিটাল নিরাপত্তার কথা। এবং আমার মনে হচ্ছিল: ‘আমরা তথ্যচুরির কবলে পড়ছি … এক্ষুনি আমাদের ফোনগুলো ছুঁড়ে ফেলা দরকার।’”
আল-আহমাদ এখনো জানেন না, এই বার্তার পেছনে সত্যিকারের উদ্দেশ্য কী ছিল। যদিও তিনি শেষপর্যন্ত সত্যিকারের ভিডিওটি খুঁজে বের করেছিলেন, এবং নিশ্চিত হয়েছিলেন – এটি তাঁর বন্ধু, খাসোজি হত্যাকাণ্ডের ভিডিও নয়।
ডিজিটাল মাধ্যমে যোগাযোগের ক্ষেত্রে, সবসময় একটা আতঙ্ক কাজ করছে পড়তে হচ্ছে নির্বাসনে থাকা সৌদি সাংবাদিকদের। এবং কোভিডের কারণে এই নজরদারির ঝুঁকি আরো বেড়ে গেছে। — সাংবাদিক সাফা আল-আহমাদ
তবে, আল-আহমাদ সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, পেশাগত কৌতুহল বা ব্যক্তিগত তথ্য-সম্পর্ক সংশ্লিষ্ট বার্তা দিয়ে সাংবাদিকদের টার্গেট করা হচ্ছে হ্যাকিংয়ের জন্য।
“এভাবেই অন্য রিপোর্টাররা হ্যাকিংয়ের শিকার হয়েছেন পেগাসাস স্পাইওয়্যার দিয়ে। আমার মনে আছে, এক রিপোর্টারের কাছে “মিনিস্ট্রি অব জাস্টিস অ্যালার্ট” নামে একটি বার্তা পাঠানো হয়েছিল। তিনি যে মামলাটি কাভার করছেন, সে সংক্রান্ত তথ্য ছিল সেখানে। সাংবাদিকদের জন্য ডিজিটাল যোগাযোগ কতটা মারাত্মক হতে পারে, তার একটি উদাহরণ এই ঘটনা। আমি এখন আগের চেয়ে আরো বেশি সতর্ক, কিন্তু তারপরও যে কোনো সময় হ্যাকিংয়ের শিকার হতে পারি। সাংবাদিক হিসেবে, আমি তো সেই লিংকে ক্লিক করে ছবিটি দেখতেই চাইব। আমি জামালকে ২০ বছর ধরে চিনতাম। এটি শুধুই একটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা নয়, আমাদের জন্য এটি অনেক বেশি ব্যক্তিগত ব্যাপার ছিল।”
আল-আহমাদ একজন ফ্রিল্যান্সার। টরোন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের সিটিজেন ল্যাব-এর সঙ্গে যোগাযোগ থাকার কারণে তিনি সম্ভাব্য ডিজিটাল ঝুঁকির বিষয়টি মূল্যায়ন করতে পেরেছেন।
সাধারণভাবে, মহামারির সময়ে নানা রকম নীতিমালা ও কর্মকাণ্ড দিয়ে যে বাড়তি নজরদারিমূলক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তাতে বিশেষভাবে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছেন ফ্রিল্যান্স সাংবাদিকরা। কারণ ডিজিটাল নিরাপত্তার জন্য তাদের কোনো প্রতিষ্ঠানিক সহযোগিতার ব্যবস্থা থাকে না।
আল-আহমাদ বলেছেন, “ এখন প্রায়-ই এমন অবস্থাতে পড়তে হচ্ছে নির্বাসনে থাকা সৌদি সাংবাদিকদের। ডিজিটাল মাধ্যমে যোগাযোগের ক্ষেত্রে, সবসময় আমাদের মধ্যে একটা আতঙ্ক কাজ করছে, এবং কোভিডের কারণে এই নজরদারির ঝুঁকি আরো বেড়ে গেছে। আমি এখন সহজেই কোনো সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করে ফেলতে পারি না। কাউকে সহজেই বলে দিতে পারি না যে, ‘আমরা যখন দেখা করব, তখন আমি সব কিছু জেনে নেব।’ সব কিছুই হচ্ছে ডিজিটাল কোনো উপায়ে, বা ফোনের মাধ্যমে। এক্ষেত্রে, মহামারির এই সময়, সিগন্যাল হয়ে উঠেছে আমার সবচে ভালো বন্ধু। ডিজিটাল নিরাপত্তার উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে এখন ফ্রিল্যান্সাররা খুবই ঝুঁকির মুখে আছেন।”
“প্রাতিষ্ঠানিক কর্মীদের তুলনায় আমরা পিছিয়ে আছি। তাদের কাছে প্রায়ই অ্যাসাইনমেন্টে যাওয়ার সময় পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন ল্যাপটপ ও সেল ফোন থাকে। কিন্তু, ফ্রিল্যান্সার হিসেবে, আমি ক্রমাগত বার্নার ফোন কিনতে পারি না। যে নম্বরটি দিয়ে সবাই আমাকে চেনে, সেটি হারিয়ে ফেলার সুযোগ নিতে পারি না। সত্যিকারের ডিজিটাল হাইজিন মেনে চলতে গেলে যে পরিমাণ অর্থ খরচ করতে হবে, তা আমার জন্য অসম্ভব। ফলে, প্রশ্ন হচ্ছে: কিভাবে আমি সাধ্যমতো আরো দায়িত্বশীল হয়ে উঠতে পারি?
সম্প্রতি জানা গেছে, মাইক্রোসফট উইন্ডোজের পুরোনো ভার্সনগুলোতে ভিডিও চ্যাটের প্ল্যাটফর্ম, জুম হ্যাক হতে পারে। এ খবরে হতাশা প্রকাশ করেছেন আল-আহমাদ।
তিনি বলেছেন, “আমি সাধারণত জুমে মিটিং করি এবং পরে সেটির রেকর্ড ডিলিট করে দেই। কিন্তু উইন্ডোজে হ্যাক হবার ঝুঁকি আছে- এই খবরটি শোনার পর, আমি এটি আর আমার কম্পিউটারে ইন্সটল করতে চাই না। আবার, আমি যার সঙ্গে জুমে কথা বলছি, সেই ব্যক্তি কী ধরনের কম্পিউটার ব্যবহার করছে, তাও আমি জানি না। আমি তো আর তাকে জিজ্ঞাসা করতে পারি না যে, আপনার কম্পিউটারের অপারেটিং সিস্টেম কী? বা এটি সম্প্রতি আপডেট করা হয়েছে কিনা?”
“আমি এখন আগের চেয়ে আরো বেশি সতর্ক, কিন্তু তারপরও যে কোনো সময় হ্যাকিংয়ের শিকার হতে পারি। সাংবাদিক হিসেবে, আমি তো সেই লিংকে ক্লিক করে ছবিটি দেখতেই চাইব। আমি জামালকে ২০ বছর ধরে চিনতাম। এটি শুধুই একটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা নয়, আমাদের জন্য এটি অনেক বেশি ব্যক্তিগত ব্যাপার ছিল।” — সাফা আল-আহমাদ
গুপ্তচরদের প্রধান টার্গেট আপনার ফোন
কোভিড মোকাবিলায় বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় লকডাউনের সময় আরেকটি যে সাধারণ ঝুঁকি তৈরি হয়েছে, তা হলো: কর্তৃপক্ষ, সাংবাদিকদের ফোন কল ডেটা দেখে খোদ সাংবাদিক ও তাদের সোর্সদের হেনস্তা করছে।
নাইজেরিয়ায়, রিপোর্টারদের ফোন থেকে কল রেকর্ড ঘেঁটে সোর্সদের খুঁজে করতে দেখা গেছে পুলিশকে। এমনটা তারা করত মহামারির আগে থেকেই।
কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে)-র আফ্রিকা প্রোগ্রামের সমন্বয়ক জোনাথন রোজেন বলেছেন, “নাইজেরিয়াতে, যে সাংবাদিকদের সঙ্গে এমনটা করা হয়েছিল, তারা খুবই অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁরা কখনো এ ধরনের নজরদারি আশা করেননি। পুলিশ এক্ষেত্রে ব্যবহার করেছে খুবই মৌলিক কিছু ফোনকল ডেটা। খুবই সাদামাটা ধরনের এসব তথ্য তারা ব্যবহার করেছে সাংবাদিকদের হেনস্তা করার জন্য। এ কাজের জন্য পুলিশ প্রথমে রিপোর্টারদের কল ডেটা সংগ্রহ করে। যেখান থেকে দেখা যায়, কাদেরকে বেশি বেশি ফোন করা হয়েছে। এই তথ্য সংগ্রহের পর, তারা সেই মানুষদের সঙ্গে যোগাযোগ করা শুরু করে। কিছু ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে থেকে কাউকে গ্রেপ্তারও করা হয় এবং টার্গেট করা সাংবাদিকের বিরুদ্ধে কথা বলতে বাধ্য করা হয়।”
এই অবস্থার মধ্যে, মহামারিকে কেন্দ্র করে আরো কিছু বাড়তি নজরদারির ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। এর অর্থ: আফ্রিকাসহ পুরো বিশ্বের সাংবাদিকদের আরো বেশি সতর্ক হতে হবে, বলেছেন রোজেন। গত জুলাইয়ে, তিনি সিপিজে-র হয়ে একটি রিপোর্ট লিখেছিলেন, যেখানে উন্মোচিত হয়েছিল: ঘানার আইনশৃঙ্খলাবাহিনী কোন আধুনিক ফোন হ্যাকিং প্রযুক্তি কিনেছে, এবং এটি দিয়ে কিভাবে সাংবাদিকদের সেলফোন যোগাযোগে নজরদারি করা হচ্ছে।
“মহামারির শুরু থেকেই সাংবাদিকদের মধ্যে এমন একটি আশঙ্কা ছিল যে, লকডাউনের প্রেক্ষিতে রাষ্ট্রগুলো হয়তো তাদের নজরদারি সক্ষমতা আরো বাড়াবে এবং তা অনেক ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের হেনস্তা করার কাজে ব্যবহার হবে,” বলেছেন রোজেন।
চরম ডিজিটাল হাইজিন রক্ষা করতে চাইলে কয়েকটি পদক্ষেপ নিতে পারেন। প্রথমত, আপনার ব্রাউজারের সার্চ প্রেফারেন্সে গিয়ে “চেক ইউর স্পেলিং অ্যাজ ইউ টাইপ,” এবং “প্রোভাইড সার্চ সাজেশনস,” এই দু’টি অপশন থেকে টিকচিহ্ন উঠিয়ে দিন; এবং “ব্লক অল কুকিজ” সিলেক্ট করুন, যাতে বাইরের সাথে আপনার ব্রাউজারের যোগাযোগ কমিয়ে দেয়া যায়। অথবা গুগল ক্রোম ও ইন্টারনেট এক্সপ্লোরারের মতো প্রচুর ডেটা সংগ্রহ করে, এমন ব্রাউজার ব্যবহার বাদ দিন। ডাকডাকগো-র মতো সার্চ ইঞ্জিন ব্যবহার করুন, যারা প্রাইভেসিকে বেশি গুরুত্ব দেয়। তাতেও যে আপনার ঝুঁকি একেবারে কমে যাবে, এমনটা মনে করেন না পেরেজ দে আচার মত বিশেষজ্ঞরা।
সিপিজে-সহ আরো বেশ কিছু সাংবাদিকতা-কেন্দ্রিক সংগঠন, সাংবাদিকদের জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা গাইড তৈরি করেছে। এই লেখার জন্য নেয়া সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে, জিআইজেএনও তার নিজস্ব গাইডটি আরো হালনাগাদ করছে। নিচে থাকছে ডিজিটাল নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট ১০টি টুল ও কৌশল, যেগুলো বিশেষভাবে এই মহামারির সময়ে কাজে আসবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
তৈরি করুন ভার্চুয়াল বার্নার ফোন: গুগল ভয়েস ব্যবহার করতে পারেন “ভার্চুয়াল বার্নার ফোন” হিসেবে। এই লেখা তৈরির জন্য সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় যখন জিআইজেএন-এর পক্ষ থেকে বিশেষজ্ঞদের ফোন দেওয়া হয়েছে, তখন দেখা গেছে: সেগুলোর বেশিরভাগই তাদের ব্যক্তিগত কোনো নম্বর ছিল না। এটি ছিল গুগল ভয়েসের নির্ধারণ করা একটি নাম্বার। পেরেজ দে আচা বলেছেন, “শুধু মা আর প্রেমিক ছাড়া আর কেউই বোধহয় আমার সত্যিকারের নম্বরটা জানে না,” কিন্তু গুগল নিজেও যে ডেটা সুরক্ষার ক্ষেত্রে দুর্বল অবস্থায় আছে, তাও তিনি সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। সুরক্ষিত ব্রাউজার ব্যবহার করুন: ফায়ারফক্সের মতো সুরক্ষিত কোনো ব্রাউজার ব্যবহার করুন। এবং ইন্টারনেট এক্সপ্লোরের মতো ব্রাউজারকে আপনার অপারেটিং সিস্টেম থেকে ফেলে দিন। এনক্রিপ্টেড যোগাযোগ-পদ্ধতি ব্যবহার করুন: সংবেদনশীল কোনো বিষয় নিয়ে কাজের সময়, আপনার সূত্রকে এনক্রিপ্টেড যোগাযোগ-পদ্ধতি ব্যবহার করতে বলুন। যেমন ইমেইলের জন্য ফোটনমেইল এবং মেসেঞ্জিংয়ের জন্য সিগন্যাল। হোয়াটসঅ্যাপের মতো অধিক পরিচিত এনক্রিপ্টেড পদ্ধতি দিয়েও কাজ চালানো যায়। কিন্তু হোয়াটসঅ্যাপেও মেটাডেটা আর্কাইভ করা থাকে। যদি কিছুতে কাজ না হয়, তাহলে সংবেদনশীল কাগজপত্র লেনদেনের জন্য পোস্ট অফিস ব্যবহার করুন। উইন্ডোজ হালনাগাদ করুন: আপনি যদি উইন্ডোজ ৭ বা তারও পুরোনো কোনো ভার্সনের অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহার করেন, তাহলে সেটি হালনাগাদ না করা পর্যন্ত জুম ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন। জুমের একটি নিরাপত্তা সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানের জন্য মাইক্রোপ্যাচ ইন্সটল করতে পারেন। এই সমস্যাটি ধরা পড়েছিল গত ৯ জুলাই। ভার্চুয়াল মিটিং প্ল্যাটফর্ম হিসেবে জুমের বিকল্প হতে পারে ওপেন সোর্স জিটসি। যদিও এখানে অংশগ্রহণকারীর সীমাবদ্ধতা আছে। ব্যক্তিগত ও পেশাগত তথ্য আলাদা করুন: সম্ভব হলে, ডিজিটাল দুনিয়ায় আপনার ব্যক্তিগত ও পেশাগত ব্যাপারগুলো আলাদা রাখুন। এজন্য ব্যবহার করতে পারেন বার্নার সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট। এবং যোগাযোগ করতে পারেন এনক্রিপ্টেড পদ্ধতিতে। তথ্য চেয়ে করা আবেদনে কখনো নিজের ব্যক্তিগত ঠিকানা লিখবেন না। হামলাগুলো রিপোর্ট করুন: “জিরো-ক্লিক” স্পাইওয়্যার থেকে সুরক্ষা পাওয়ার মতো কোনো ব্যবস্থা এখনো পাওয়া যায়নি। তবে এধরনের হামলার শিকার হয়েছেন মনে হলে, অ্যামনেস্টি টেক-এর মতো কোনো ফরেনসিক ইউনিটের কাছে রিপোর্ট করুন। পারলে আপনার পাঠক-দর্শকদেরও বিষয়টি বুঝিয়ে বলুন। বার্নার অ্যাকাউন্ট তৈরি করুন: সোশ্যাল মিডিয়ায় নিস্ক্রিয়ভাবে কোনো চরমপন্থী চ্যাটগ্রুপ পর্যবেক্ষণের সময়, “বার্নার” সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করুন। যার সঙ্গে আপনার ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টের কোনো সম্পর্ক নেই। তবে যখন আপনি সেই চ্যাট গ্রুপের কোনো সদস্যের সাক্ষাৎকার নিতে যাবেন, তখন অবশ্যই আপনার পেশাগত অ্যাকাউন্ট (যেখানে আপনার সাংবাদিক পরিচয় লেখা আছে) ব্যবহার করবেন। পাসওয়ার্ড ম্যানেজার ব্যবহার করুন: সাংবাদিকরা আস্থা রাখেন, এমন কোনো ফ্রি পাসওয়ার্ড ম্যানেজার ব্যবহার করুন। যেমন: লাস্টপাস। এখানে আপনাকে শুধু একটি মাস্টার পাসওয়ার্ড নির্ধারণ করে দিতে হবে। তারপর থেকে এটি-ই অন্যান্য সাইটগুলোর জন্য শক্তিশালী সব পাসওয়ার্ড তৈরি করবে। ভিপিএন ব্যবহার করুন: একটি ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক (ভিপিএন) তৈরি করুন, যেটি আপনার ইন্টারনেট সংযোগকে এনক্রিপ্ট করবে। আপনার ডিজিটাল প্রাইভেসি রক্ষার জন্য টানেল বিয়ার-এর মতো বিশ্বস্ত ভিপিএন সেবা ব্যবহার করতে পারেন। টু-ফ্যাক্টর অথেনটিকেশন ব্যবহার করুন: এখনকার এই সময়ে কোনো অ্যাকাউন্টের জন্য শুধুই ইউজারনেম ও পাসওয়ার্ড ব্যবহার করার অর্থ: খুবই অপরাধপূর্ণ শহরের কোনো বাড়ির দরজায় সাদামাটা একটি তালা ঝুলিয়ে রাখা, যেটি সহজেই ভেঙে ফেলা যাবে। ফলে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ: টু-ফ্যাক্টর অথেনটিকেশন ব্যবহার করুন। এটি চালু করার প্রক্রিয়া একটু বিরক্তিকর হতে পারে। কিন্তু ভালো একটি স্টেপ বাই স্টেপ গাইড দেখে আপনি এটি সহজেই করে ফেলতে পারবেন। এমন একটি গাইড তৈরি করেছে দ্য ভার্জ।
মহামারির সময় বিশ্বজুড়ে সংবাদমাধ্যমগুলো বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। এই অবস্থার মধ্যেও যদি ভালো কিছু ঘটে থাকে, তা হলো: সাংবাদিকরা ডিজিটাল নিরাপত্তার চর্চাকে তাদের রুটিন বানিয়ে ফেলেছেন। পেরেজ দে আচা বলেছেন, “ডিজিটাল নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য অনেক প্রযুক্তিগত রিসোর্স বা অর্থ প্রয়োজন; এই কথাটিকে আমি আসলে মিথ মনে করি। এটি সত্যিই খুব সহজ বিষয়। এবং আপনি যদি সেভাবে দেখতে পারেন, তাহলে এটি মজারও হয়ে উঠতে পারে।”
আরো পড়ুন
ডিজিটাল নিরাপত্তা নিয়ে আরো তথ্যের জন্য জিআইজেএন-এর রিসোর্স সেন্টারে দেখুন: ডিজিটাল নিরাপত্তা; অনুসন্ধানী সাংবাদিক হিসেবে কিভাবে নিজের ডিজিটাল সুরক্ষার ব্যবস্থা করবেন, তা নিয়ে প্রাথমিক কিছু আলোচনা; এবং ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলের সাংবাদিকদের ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে ডিজিটাল নিরাপত্তার বিষয়টি মূল্যায়নের উপায়।
রোয়ান ফিলিপ জিআইজেএন-এর রিপোর্টার। দক্ষিণ আফ্রিকার সানডে টাইমসে কাজ করেছেন প্রধান প্রতিবেদন হিসেবে। বিদেশী প্রতিনিধি হিসেবে রাজনীতি, দুর্নীতি ও সংঘাত নিয়ে রিপোর্ট করেছেন বিশ্বের দুই ডজনেরও বেশি দেশ থেকে।