প্রবেশগম্যতা সেটিংস

Photo: Shutterstock

লেখাপত্র

বিশ্বজুড়ে যেভাবে ছড়িয়ে পড়ছে চীন ও রাশিয়ার তথ্য-নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তি

English

ছবি: শাটারস্টক

চীন ও রাশিয়া তাদের নিজেদের দেশে কতটা ব্যাপকভাবে তথ্যপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে, তা কমবেশি সবারই জানা। নাগরিকদের ব্যক্তিগত যোগাযোগের ওপর নজরদারি সেখানে খুব সাধারণ ব্যাপার। রাষ্ট্র আরোপিত সেন্সরশিপের ব্যাপ্তিও বেশ গভীর। কিন্তু নাগরিকদের মৌলিক মানবাধিকার খর্ব করার জন্য নজরদারি প্রযুক্তির ব্যবহার এখন নিছক দমনমূলক সরকার বা কোনো নির্দিষ্ট দেশের গন্ডিতে সীমাবদ্ধ নেই। কর্তৃত্বপরায়ন রাষ্ট্রগুলো এসব প্রযুক্তি ও তা ব্যবহারের জ্ঞান নতুন নতুন দেশে রপ্তানি করছে, যা তাদের নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতাকে আরো জোরালো করে তুলছে।

দ্য ওপেন টেকনোলজি ফান্ডের ইনফরমেশন কন্ট্রোলস ফেলোশিপের অংশ হিসেবে, এই প্রযুক্তির বিস্তার নিয়ে গবেষণা করেছেন ভ্যালেন্টিন ওয়েবার। এর প্রভাব নিয়ে করেছেন পদ্ধতিগত বিশ্লেষণ। তিনি দেখেছেন, এখন পর্যন্ত ১০০টিরও বেশি দেশ চীন ও রাশিয়া থেকে নজরদারির প্রযুক্তি কিনেছে, তাদের কাছ থেকে এগুলো ব্যবহারের প্রশিক্ষণ নিয়েছে অথবা অনুকরণ করে নিজেরাই বানিয়েছে।

বিশ্বজুড়ে চীন ও রাশিয়ার তথ্য নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তির বিস্তার নিয়ে পড়ুন এখানে, ইংরেজিতে

স্ক্রিনশট: ওপেন টেকনোলজি ফান্ড

কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা দেশগুলো চীন ও রাশিয়ার সমমনা। তাদের মধ্যে তথ্যপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণের ধরণেও বেশ মিল আছে। যেমন, ভেনেজুয়েলা, মিশর ও মিয়ানমার। কিন্তু এই তালিকায় এখন বিশ্বের অর্ধেকের বেশি দেশই ঢুকে গেছে। আরো অনেক দেশ তথ্য নিয়ন্ত্রণের পেছনে বিনিয়োগ শুরু করেছে। এদের মধ্যে আছে: আফ্রিকার সুদান ও উগান্ডা, যেখানে তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশ ঘটছে দ্রুত; আছে জার্মানি, ফ্রান্স ও নেদারল্যান্ডসের মত পশ্চিমা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র; আর ত্রিনিদাদ ও টোবাগোর মতো ছোট ক্যারিবিয়ান দ্বীপও। সবমিলে, ১১০টি দেশ চীন বা রাশিয়ার কাছ থেকে নজরদারি বা সেন্সরশিপের প্রযুক্তি আমদানি করেছে।

রাশিয়া ও চীন কেন কিছু নির্দিষ্ট দেশেই নিয়ন্ত্রণ-প্রযুক্তি ছড়াচ্ছে? অন্য দেশে কেন নয়? এখান থেকে বেইজিং ও মস্কোর সরকার কীভাবে লাভবান হচ্ছে?

১০০টিরও বেশি দেশ চীন ও রাশিয়া থেকে নজরদারির প্রযুক্তি কিনেছে, তাদের কাছ থেকে এগুলো ব্যবহারের প্রশিক্ষণ নিয়েছে অথবা অনুকরণ করে নিজেরাই বানিয়েছে।

এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে, রাশিয়া ও চীনের তথ্য নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তির বিস্তার নিয়ে দীর্ঘ অনুসন্ধান করেছেন ভ্যালেন্টিন। ঘাঁটাঘাঁটি করেছেন বিভিন্ন ওপেন সোর্স গবেষণা, কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন, টেকনিক্যাল নেটওয়ার্ক মেজারমেন্ট, সংবাদপত্র, জার্নালের প্রবন্ধ ও বিভিন্ন সরকারের আইনকানুন ও নীতিমালা। নিয়ন্ত্রণ-প্রযুক্তি বিস্তারের আকার ও গভীরতা পরিমাপ করার জন্য তিনি তিনটি ভিন্ন ভিন্ন নির্দেশক (প্রযুক্তি, অনুকরণ ও প্রশিক্ষণ) তৈরি করেছেন। যে দেশে নির্দেশকের উপস্থিতি যত বেশি, সেখানে তথ্য-নিয়ন্ত্রণের ব্যাপকতাও ততটাই বেশি দেখা গেছে।

গবেষণা থেকে পাওয়া এসব ডেটার ওপর ভিত্তি করে ভ্যালেন্টিন দেখেছেন, রাশিয়া ও চীনের তথ্য নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তির বিস্তার বেশি ঘটেছে হাইব্রিড বা কর্তৃত্বপরায়ন শাসনব্যবস্থায়, বিশেষভাবে যাদের সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ট সম্পর্ক আছে। কোনো দেশে বিস্তার কতটা, তা নির্ধারণের ক্ষেত্রে ভৌগলিক নৈকট্য প্রধান ব্যাপার হিসেবে কাজ করেনি। বরং শাসনব্যবস্থা এবং রাশিয়া বা চীনের সঙ্গে সম্পর্কের মাত্রা –  এই দুটো ব্যাপার দিয়েই তাকে ব্যাখ্যা করা গেছে। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ধরণ খতিয়ে দেখার মাধ্যমেই ব্যাখ্যা করা গেছে, কেন কিছু দেশে নিয়ন্ত্রণ-প্রযুক্তির বিস্তার ঘটেছে, আর কিছু দেশে ঘটেনি। যেমন, চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের সঙ্গে যুক্ত দেশে দেখা গেছে চীনা প্রযুক্তি। অন্যদিকে রাশিয়া থেকে আমদানি করেছে সাবেক কমনওয়েলথ অব ইনডিপেনডেন্ট স্টেটসভুক্ত দেশগুলো।

স্ক্রিনশট: ওপেন টেকনোলজি ফান্ড

ভ্যালেন্টিন বলছেন, এর প্রাথমিক ফলাফল রুশ ও চীনা “প্রযুক্তিবলয়” তৈরি। এই বলয়ের অন্তর্ভূক্ত ভৌগলিক অঞ্চলগুলো থেকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও গোয়েন্দা-তথ্য প্রাপ্তির সুবিধা আদায় করে নেয় রপ্তানিকারক দেশ দুটি। রাজনৈতিক সুবিধা হলো, ব্যবহারকারীরা যত নিয়ন্ত্রণমূলক হবে, সেখানে চীন ও রাশিয়ার কর্তৃত্ববাদী মতাদর্শও ততটাই বজায় থাকে। অর্থনৈতিকভাবে, তাদের প্রযুক্তি রপ্তানিপণ্যের নতুন বাজার তৈরি হয় (অবস্থা এমন, এখন রাশিয়া ও চীনে নিরাপত্তা-প্রযুক্তির ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স গড়ে উঠেছে)। এর গুপ্তচরবৃত্তিক সুবিধাও অনেক। এর ফলে নজরদারি প্রযুক্তি ব্যবহার করা দেশগুলো, তাদের প্রযুক্তি বলয়ে সীমাবদ্ধ থাকে।

রাশিয়া ও চীন থেকে চেহারা সনাক্ত করা যায় এমন সিসিটিভি ক্যামেরা, স্মার্ট কার্ড ও ইন্টেলিজেন্ট ডেটাবেজের মত অত্যাধুনিক টুল আমদানি করছে সরকারগুলো।

চীনা প্রযুক্তিবলয়ের কেন্দ্রে আছে মিশর, ইরান, মালয়েশিয়া, রাশিয়া, তানজানিয়া, থাইল্যান্ড, উগান্ডা, ভেনেজুয়েলা, জাম্বিয়া ও জিম্বাবুয়ে। রাশিয়ার প্রযুক্তিবলয় কিছুটা ছোট। এখানে আছে আজারবাইজান, বেলারুস, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, ইউক্রেন ও উজবেকিস্তান।

সংখ্যা ও বৈচিত্র্যের বিচারে দেশে দেশে যেভাবে তথ্য নিয়ন্ত্রণের এসব প্রযুক্তি আমদানি ও ব্যবহার করা হচ্ছে – তাতে বিশ্বজুড়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের ওপর গুরুতর প্রভাব পড়ছে। রাশিয়া ও চীন থেকে চেহারা সনাক্ত করা যায় এমন সিসিটিভি ক্যামেরা, স্মার্ট কার্ড ও ইন্টেলিজেন্ট ডেটাবেজের মত অত্যাধুনিক টুল আমদানি করছে সরকারগুলো। এসব প্রযুক্তি অপব্যবহারের আশঙ্কা বেশ বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। অনেক দেশে অপব্যবহারও হচ্ছে, যা ভয় ছড়াচ্ছে জনসাধারণের মনে।

ভ্যালেন্টিনের সুপারিশ, গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে এসব প্রযুক্তির ব্যবহার কমিয়ে আনা, এবং যেখানে এই প্রযুক্তি ছড়িয়েছে, সেখানে তার অপব্যবহার ঠেকানো। গত ১৩ বছরে চীন ও রাশিয়া থেকে নজরদারির অত্যাধুনিক প্রযুক্তি অনেক নতুন দেশে পৌঁছে গেছে। সেই তালিকা থেকেও অপব্যবহারের প্রবণতা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়, এবং দমনপীড়ন প্রযুক্তির বিস্তার রোধে পাল্টা কৌশল গ্রহণ করা যায়।

ভ্যালেন্টিনের পুরো রিপোর্ট, দ্য ওয়ার্ল্ডওয়াইড ওয়েব অব চাইনিজ অ্যান্ড রাশিয়ান ইনফরমেশন কন্টোলস, পাওয়া যাচ্ছে ইংরেজি, চাইনিজরাশিয়ান ভাষায়।

লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ওপেন টেকনোলজি ফান্ডের ওয়েবসাইটে। অনুমতি নিয়ে এখানে পুনঃপ্রকাশ করা হলো।

এই রিপোর্টের লেখক, ভ্যালেন্টিন ওয়েবার অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করছেন সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর টেকনোলজি অ্যান্ড গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স বিভাগে কাজ করছেন রিসার্চ অ্যাফিলিয়েট হিসেবে। ওপেন টেকনোলজি ফান্ডের ছয় মাসের ফেলোশিপে অংশ নিয়ে তিনি এই রিপোর্ট তৈরি করেছেন।

ক্রিয়েটিভ কমন্স লাইসেন্সের অধীনে আমাদের লেখা বিনামূল্যে অনলাইন বা প্রিন্টে প্রকাশযোগ্য

লেখাটি পুনঃপ্রকাশ করুন


Material from GIJN’s website is generally available for republication under a Creative Commons Attribution-NonCommercial 4.0 International license. Images usually are published under a different license, so we advise you to use alternatives or contact us regarding permission. Here are our full terms for republication. You must credit the author, link to the original story, and name GIJN as the first publisher. For any queries or to send us a courtesy republication note, write to hello@gijn.org.

পরবর্তী

অনুসন্ধান পদ্ধতি শিক্ষাদান ও প্রশিক্ষণ

যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্তের অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ‘হাব’ যেভাবে একটি প্রজন্মের রিপোর্টারদের তৈরি করেছে

মেক্সিকো সীমান্তে কর্মরত সাংবাদিকদের জন্য তাঁদের পেশাটা ছিল যথেষ্ট চ্যালেঞ্জিং। কেন্দ্রে যাঁরা সাংবাদিকতা করেন, তাঁদের সঙ্গে দূরত্ব তো ছিলই, ছিল সার্বক্ষণিকি নিরাপত্তাহীনতাও। সাংবাদিকেরা একজোট হয়ে এই দূরত্ব ঘুঁচিয়ে আনতে গড়ে তোলেন একটি সংগঠন। প্রয়োজনীয়ল প্রশিক্ষণ শেষে হাজারো প্রতিকূলতার মধ্যেও তাঁরা অনুসন্ধান করে তুলে আনেন বেশ কিছু প্রতিবেদন।

অনুসন্ধান পদ্ধতি গবেষণা

ডেনমার্কের কল্যাণ সংস্থার অ্যালগরিদমপদ্ধতি নিয়ে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের অনুসন্ধান

কল্যাণ সহায়তা বণ্টন পদ্ধতিকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে অ্যালগরিদমভিত্তিক পদ্ধতি অনুসরণ করছিল ডেনমার্কের প্রতিষ্ঠান। অনুসন্ধানে দেখা গেল, বৈষম্য বিলোপে নেওয়া এই উদ্যোগে উল্টো বাড়ছে বৈষম্য।

সংবাদ ও বিশ্লেষণ

২০২৪ ডাবল এক্সপোজার ফেস্টিভ্যাল: সংবাদমাধ্যমে গুরুত্ব না পাওয়া কিংবা অন্যায্যতার মতো ইস্যু নিয়ে অনুসন্ধান

জিআইজেএন সদস্য ও অলাভজনক অনুসন্ধানী বার্তাসংস্থা 100Reporters আয়োজিত চার দিনের ২০২৪ ডাবল এক্সপোজার চলচ্চিত্র উৎসব ও সিম্পোজিয়ামে (৭-১০ নভেম্বর) ২৩টি পূর্ণ ও স্বল্পদৈর্ঘ্য তথ্যচিত্র প্রদর্শিত হয়ে গেল। দেখে নিন কী কী বিষয় নিয়ে তথ্যচিত্র তৈরি করেছেন নির্মাতারা।

পরামর্শ ও টুল

দেখুন, ওয়েবসাইট কনটেন্ট ও মেটাডেটা বিশ্লেষণে ওপেন সোর্স টুল ‘ইনফরমেশন লন্ড্রোম্যাট’ কীভাবে কাজ করে

বিভিন্ন ওয়েবসাইটের মধ্যকার যোগসূত্র, মালিকানা চিহ্নিত করা এবং কনটেন্টের ধরন ও বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণের জন্য সবচেয়ে নতুন ও মজার টুলগুলোর মধ্যে ইনফরমেশন লন্ড্রোম্যাট একটি। কোনো পয়সাকড়ি খরচা না করেই আপনি এটি ব্যবহার করতে পারেন। জর্জ মার্শালের অর্থায়নে টুলটি বানিয়েছে অ্যালায়েন্স ফর সিকিউরিং ডেমোক্রেসি (এএসডি)।