A gamekeeper surveys a fire on the North York Moors in October 2021. Image: Steve Morgan, courtesy of Greenpeace
স্যাটেলাইট ব্যবহার করে মুরল্যান্ডের আগুন উন্মোচন
ইয়র্কশায়ার ডেলস-এ গ্রিমউইথ নামে একটি জলাধার আছে। আর তার ঝকঝকে নীল পানির ওপর রয়েছে প্রাণ-প্রকৃতির এক সুবিশাল আবাস, যা দেশটির সরকারের ভাষায় ইংল্যান্ডের অন্যতম “জাতীয় চিরহরিৎ বন।” পাঁকে ভরা একটি জলা, ভূমির ওপরটাতে আধাপঁচা ঘাসের স্তর (পিট), আর তার মাটি এতই ভেজা ও নানা রকম উদ্ভিদে সমৃদ্ধ যে এটি ক্রান্তীয় চিরহরিৎ বনের চেয়ে বেশি কার্বন ধরে রাখতে পারে, এবং একরের পর একর এলাকাজুড়ে।
অথচ আজ এখানকার মাটি পুড়ে শুকনো, পায়ের নিচে পড়লেই মুড়মুড়িয়ে গুড়ো হয়ে যাচ্ছে। কচিপাতা পুড়ে কালচে হয়ে কাঁটার মত বেরিয়ে আছে – সবই সাম্প্রতিক এক আগুনের ফল। এখানে আগুন ধরানো হয়েছিল যেন লতায় দ্রুত অঙ্কুর গজায়, কারণ সেই লতা খেয়ে গ্রাউস পাখি বড় হবে, আর পরে শিকারীর দল গুলি করে সেই পাখি শিকার করবে।
গত বছর, গ্লাসগো জলবায়ু সম্মেলনের আগে পিটল্যান্ডে অগ্নিসংযোগের ওপর যুক্তরাজ্য সরকার আংশিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার পরও – এবং সেটি স্পষ্টত লঙ্ঘন করে – এখানে আগুন ধরানো হয়।
আমরা এখানে এসেছিলাম এই নতুন নিষেধাজ্ঞার প্রভাব নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে পিটের গভীরতা পরীক্ষার জন্য। সরকারের ভাষ্যমতে, নতুন এই নীতিমালার উদ্দেশ্য হল, আর্ন্তজাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ইংল্যান্ডের ব্লাঙ্কেট বগ নামের প্রাকৃতিক বনাঞ্চল রক্ষা করা এবং ২০৫০ সালের মধ্যে যুক্তরাজ্যের কার্বন নির্গমন শূন্যে নামিয়ে আনা।
যুক্তরাজ্যের মাটিতে প্রাকৃতিক কার্বনের সবচেয়ে বড় সংরক্ষণাগার এই পিটল্যান্ডগুলো। পর্যায়ক্রমিক অগ্নিসংযোগের ফলে পিট শুকিয়ে যায়। এতে পিটগুলোর বায়ূমণ্ডলের কার্বন মাটিতে ধরে রাখা এবং বন্যা প্রতিরোধের সক্ষমতা হ্রাস পায়। তবে বিজ্ঞানী ও প্রচারকর্মীরা বলছেন, নীতিমালাটিতে ইচ্ছে করেই ফাঁক রাখা হয়েছে বলে এই নিষেধাজ্ঞা বেশি দূর যেতে পারে না এবং এর ফলে নিয়ন্ত্রণের কাজটিও কঠিন হয়ে পড়বে।
তাই, গত অক্টোবরে অগ্নিসংযোগের মৌসুম শুরুর পর গ্রিনপিস যুক্তরাজ্যের সাংবাদিকতা প্রকল্প আনআর্থড, ইংল্যান্ডের গ্রাউস পাখির চারণভূমিতে নতুন এই নীতিমালার প্রভাব নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করে।
স্যাটেলাইট ডেটা
গ্রাউস পাখির কর্দমাক্ত চারণভূমিতে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ট্র্যাক করা বেশ কঠিন; কারণ, এই ঘটনাগুলো হয়ে থাকে প্রত্যন্ত অঞ্চলে, সরকারি ডেটাও খুব একটা পাওয়া যায় না, এবং আইনের প্রয়োগ অনেকটা জমির মালিকের সদিচ্ছা ও জনসাধারণের নজরদারির ওপর নির্ভর করে বলে প্রতীয়মান হয়।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, আগুনের ঘটনাগুলোকে নথিবদ্ধ করতে কাজ করছে স্বেচ্ছাসেবীদের একটি ক্রমবর্ধমান আন্দোলন। এসব পর্বতারোহী, ফেল (হিল) রানার্স ও অ্যাক্টিভিস্টেরা অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাগুলোকে সনাক্ত করে এবং সেগুলো নর্দার্ন ইংল্যান্ডের ওয়াইল্ড মুর বা রয়েল সোসাইটি ফর দ্য প্রোটেকশন অব বার্ডসের মত প্রচারণা সংগঠনের কাছে বিশদভাবে রিপোর্ট করে। তবে এই প্রতিবেদনগুলো সবসময় সুনির্দিষ্ট চিত্র তুলে ধরে না। ফলে নির্দিষ্ট জমির মালিককে দায়ী করা আরও কঠিন হয়ে পড়ে।
কোন ধরনের অগ্নিসংযোগে নতুন নিয়মের লঙ্ঘন হতে পারে, তা এখনো বের করা কঠিন – কারণ আগুন ধরানো নিষিদ্ধ করতে গেলে যায় শুধু তখন, যখন এটি অনিবন্ধিত ও ৪০ সেন্টিমিটারের (১৫ ইঞ্চি) বেশি গভীরতাসম্পন্ন হয়, সাইট অব স্পেশাল সাইন্টিফিক ইন্টারেস্টের (এসএসএসআই) মধ্যে অবস্থিত ও অন্য দুই বিধিবদ্ধ সংরক্ষণ ব্যবস্থার একটি দ্বারা সুরক্ষিত থাকে, এবং যন্ত্র দিয়ে কাটার মত ঢালু ও পাথুরে না হয়।
তাই অতীতের অগ্নিসংযোগ-মৌসুম অনুসন্ধানে একটি পদ্ধতি দাঁড় করিয়েছে আনআর্থড, যা কিনা গ্রাউস পাখির চারণভূমিতে আগুনের প্রমাণ খুঁজে বের করতে নাসা ও ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সিসহ তিনটি স্যাটেলাইট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান থেকে ডেটা ব্যবহার করে। গ্রিনপিসের গ্লোবাল ম্যাপিং হাবের সঙ্গে মিলে একটি প্লাটফর্ম তৈরি করেছি। ইংল্যান্ডের পিটের গভীরতা, সংরক্ষিত অঞ্চল, বনাঞ্চল ও জমির মালিকানা নিয়ে সরকারি যেসব মানচিত্র আছে, তার ওপর প্রমাণগুলোকে ওভার-লে করে এই প্লাটফর্ম। এরপর ওয়াইল্ড মুর থেকে শত শত প্রত্যক্ষদর্শীর পাঠানো রিপোর্টের সঙ্গে এটিকে যাচাই করা হয়।
এই অনুসন্ধানে উঠে এসেছে যে নতুন নীতি কার্যকর হওয়ার পর থেকে পরিবেশগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্রিটিশ পিটল্যাণ্ডে প্রচুর অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে, এবং সেটি আইনসম্মতভাবে। অগ্নিকাণ্ডের শিকার বেশিরভাগ অঞ্চল এসএসএসআই বা অন্যান্য সংরক্ষিত এলাকার মধ্যে পড়ে।
এই অনুসন্ধান ২৫১টি পিটল্যান্ডে আগুন ধরানোর ঘটনা সনাক্ত করেছে, যার শতকরা ২০ভাগই ঘটেছে বিভিন্ন ধরণের সংরক্ষিত এলাকায়। সরকারি সংস্থা ন্যাচারাল ইংল্যান্ডের ডেটা অনুযায়ী, এক ব্লাঙ্কেট বগেই ৪০টির বেশি ঘটনা চিহ্নিত হয়েছে। এই সংস্থা ইংল্যান্ডের প্রাকৃতিক পরিবেশ নিয়ে সরকারকে পরামর্শ দেয়। অথচ সরকার বলে আসছে, মূলত ব্লাঙ্কেট বগ রক্ষার জন্যই নীতিমালাটি করা হয়েছিল।
আমরা যেভাবে কাজ করেছি
এই নিষেধাজ্ঞা জারির পর থেকে, গত আট মাসে অগ্নিসংযোগ মৌসুমে প্রতিটি আগুনের গতিবিধি ট্র্যাক করছে আনআর্থড। এজন্য, গ্রিনপিসের গ্লোবাল ম্যাপিং হাবের সঙ্গে মিলে আমরা একটি ম্যাপিং প্লাটফর্ম তৈরি করেছি। এই ম্যাপ তিনটি স্যাটেলাইট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান থেকে পাওয়া প্রতিদিনের ডেটা ও ছবি আপলোড করে। ভূপৃষ্ঠে “তাপমাত্রার অস্বাভাবিকতা” সনাক্তের জন্য নাসার স্যাটেলাইটগুলো তাপ চিহ্নিতকরণ প্রযুক্তি ব্যবহার করে। এরপর আমরা স্যাটেলাইটের ছবি কাজে লাগিয়ে অগ্নিকাণ্ডের বাড়তি প্রমাণের খোঁজে এই উত্তপ্ত স্পটগুলো ব্যবহার করেছি। ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির সেন্টিনেল-২ স্যাটেলাইট ও বেসরকারি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান প্লানেট স্যাটেলাইট এই ছবিগুলো যোগান দেয়। এই ছবি দু ধরনের প্রমাণ সামনে এনেছে: অগ্নিশিখা ও ধোঁয়ার ছবি এবং মাটিতে পোড়া দাগের আগের ও পরের ছবি।
কোনো অগ্নিসংযোগ নিষেধাজ্ঞার লঙ্ঘন কি না তা ভালোভাবে জানতে ন্যাচারাল ইংল্যান্ডের বিভিন্ন স্পেশিয়াল ডেটাসেটের সঙ্গে স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া প্রমাণ মেলানো হয়েছে: পিটের গভীরতা জানতে আমরা যুক্তরাজ্যের পিটের মাটি সংক্রান্ত ডেটাবেস ব্যবহার করেছি, ব্লাঙ্কেট বগ এলাকা সম্পর্কে জানতে আমরা সরকারের অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বনাঞ্চলের তালিকা, এবং সংরক্ষিত এলাকা সম্পর্কে জানতে আমরা ইংল্যান্ডের সাইটস অব স্পেশাল সাইন্টিফিক ইন্টারেস্ট, স্পেশাল এরিয়াস অব কনজারভেশন, এবং স্পেশাল প্রোটেকশন এরিয়াস এর ডেটাবেস ব্যবহার করেছি। ভূপৃষ্ঠের ঢালের উচ্চতা যাচাইয়ে আমরা এসরির ওয়ার্ল্ড স্লোপ জিএমটিইডি ম্যাপও যুক্ত করেছি।
পরিশেষে জমির মালিকানা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে আমরা ল্যান্ড রেজিস্ট্রির ইন্সপায়ার ইনডেক্সের পলিগন ডেটাসেটের সঙ্গে প্রচারকর্মী গাই শ্রাবসোলের তৈরি করা গ্রাউস চারণভূমির মালিকানার ম্যাপ মিলিয়ে দেখেছি। এছাড়া ড্রোন থেকে তোলা অগ্নিকাণ্ড ও পোড়াদাগের ছবি এবং কয়েকটি এলাকার পিটের গভীরতা পরীক্ষার ফলাফল আমাদের হাতে এসেছে। এছাড়া আমরা প্রচারণা সংগঠন ওয়াইল্ড মুরের সঙ্গে কাজ করেছি। স্বেচ্ছাসেবীদের রিপোর্টের ডেটাবেস থেকে ৫১টি সাইটের কথা উল্লেখ করেছে দলটি।
নটিংহাম ট্রেন্ট ইউনিভার্সিটির জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সিস্টেম অ্যান্ড রিমোট সেন্সিংয়ের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক ও পিট বিশেষজ্ঞ ড. বেন ক্লাটারবাক আনআর্থডকে বলেছেন, “আপনাদের তৈরি করা পদ্ধতি যে বিষয়টি তুলে ধরে তা হলো, রিমোট সেন্সিং কৌশলের কল্যাণে একটি নির্দিষ্ট পরিসরে ঘটা নিয়ন্ত্রিত অগ্নিসংযোগের ঘটনাগুলো দূর থেকে সনাক্ত করা যায়। কেবল অগ্নিকাণ্ড নয়, ভূমি ব্যবস্থাপনাও মহাকাশ থেকে স্পষ্টভাবে ম্যাপ করা যায় এবং তার দিন-তারিখও নির্ধারণ করা যায়।”
এই পোস্ট মূলত যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান গ্রিনপিসের পুরস্কার জয়ী সাংবাদিকতা প্রকল্প আনআর্থেডের প্রকাশিত মূল স্টোরি থেকে নেয়া হয়েছে। এই প্রকল্প বিশেষত পরিবেশগত অনুসন্ধান নিয়ে কাজ করে। এই প্রবন্ধ এখানে ক্রিয়েটিভ কমনস লাইসেন্সের অধীনে পুনঃপ্রকাশিত হল। এডিকান উমোহ ও ওলুফাডেকে ব্যাঞ্জো এই স্টোরির জন্য বাড়তি রিপোর্টিং করেছেন।
আরও পড়ুন
পরিবেশগত অনুসন্ধানের জন্য রিমোট সেন্সিং ও ডেটা টুল
ড্রোন ও স্যাটেলাইট ছবি ব্যবহার করে আকাশ থেকে মিথ্যা উন্মোচন
পরিবেশ সাংবাদিকেরা নাসার নতুন ল্যান্ডস্যাট ৯ স্যাটেলাইট ব্যবহার করবেন যেভাবে
এমা হাওয়ার্ড, গ্রিনপিসের পরিবেশভিত্তিক সাংবাদিকতা প্রকল্প আনআর্থড-এর অনুসন্ধানী সাংবাদিক। আগে তিনি গার্ডিয়ানের রিপোর্টার হিসেবে কাজ করেছেন।
ক্রিসপিন ডাউলার গ্রিনপিসের আনআর্থড সাইটের জ্যেষ্ঠ অনুসন্ধানী রিপোর্টার। আগে তিনি হেলথ সার্ভিস জার্নালে কাজ করেছেন।