Image: Screenshot (GIJC17)
সম্পাদকের নোট: জিআইজেএন, তার কর্মকাণ্ড বৈশ্বিক পর্যায়ে ছড়িয়ে দেয় দুর্দান্ত সব শিক্ষক ও প্রশিক্ষকের একটি নেটওয়ার্কের মাধ্যমে। এদের অনেকেই আমাদের সঙ্গে কয়েক বছর ধরে কাজ করছেন। এমনই একজন প্রিয় শিক্ষক অ্যান্ড্রু লেহরেন। তিনি শিক্ষকতা করেন দ্য সিটি ইউনিভার্সিটি অব নিউ ইয়র্কে। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়টির ওয়েবসাইটে তাঁর একটি প্রোফাইল প্রকাশিত হয়। সেটি দেখার পর, আমরা আমাদের বৈশ্বিক কমিউনিটির জন্য এখানে আর পোস্ট না করে পারিনি।
ক্রেইগ নিউমার্ক গ্র্যাজুয়েট স্কুল অব জার্নালিজমের শেষ সেমিস্টারে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার একটি বিশদ কোর্স পড়ান অ্যান্ড্রু লেহরেন। ক্লাসরুমে প্রবেশ করতে গিয়ে প্রতিবারই তাঁর মনে হয়, শিক্ষার্থীদের মধ্যে সেই দক্ষতাগুলো ছড়িয়ে দেবেন, যা তিনি তরুন সাংবাদিক থাকা অবস্থায় পেতে চাইতেন।
একটি না-বলা গল্প উন্মোচন, বিষয়টি আদৌ অনুসন্ধান করার যোগ্য কিনা সেটি মূল্যায়ন, ডেটা ও নথি ব্যবহার করে তাকে আরও অর্থবহ করে তোলা, এবং মানুষ ও তাঁদের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা গল্পগুলো খুঁজে বের করাসহ অনেক কিছুই শিক্ষার্থীরা তাঁর কাছ থেকে শেখেন।
তারা মাঠে গিয়েই সব কাজ করেন, বাস্তব জগতের ক্ষমতাধরদের সামনে দাঁড়িয়ে সত্যিকারের গল্প তুলে আনেন। লেহরেনের মতে, এ ধরনের সাংবাদিকতাই সবচেয়ে জরুরি। তিনি বলেন, “আমাদের আরও অনেক সত্যানুসন্ধানী দরকার। আমাদের আরও লোক চাই, যারা এমন সব বিষয় নিয়ে কাজ করার স্পর্ধা দেখাবেন যা হয়ত চোখের সামনে পড়ে থাকে, তবু সমাজ দেখতে পায় না”।
এই কোর্স শেষ করে বেরুনো শিক্ষার্থীরা যখন চাকরি জীবন শুরু করেন, তখন তারা নিজেরাই নিজেদের কাজের জায়গা নির্ধারণ করে নিতে পারেন এবং সেই কাজের পক্ষে যুক্তিও তুলে ধরতে পারেন। ক্যারিয়ার শুরুতে ব্যস্ত বার্তাকক্ষে নিজের সুযোগ তৈরি করে নেওয়ার জন্য এই দক্ষতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। লেহরেন বলেছেন, “যারা অনুসন্ধান করেন, তারা সাধারণত নিজেরাই নিজেদের স্টোরি প্রস্তাব করেন এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেটি তুলেও আনতে পারেন। আমি আদতেই শিক্ষার্থীদের জোর দিই নিজস্ব স্টোরি খুঁজে আনতে, এবং চ্যালেঞ্জ জানাই সেরা স্টোরি খুঁজে বের করতে।”
প্রতিবেদনের বিষয় খুঁজে বের করা, প্রস্তাব করা এবং চিন্তাভাবনা গুছিয়ে আনার মতো বিষয় শেখানোর ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয় এখানে। তাই শিক্ষার্থীরাও তাদের অনুসন্ধানের মাধ্যমে কাঠামোগত সমস্যা, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং অন্যায়-অবিচারের বিভিন্ন ঘটনা উন্মোচন করতে পেরেছেন।
নিউ ইয়র্কের চাকরি হারানো পুলিশ কর্মকর্তারা কীভাবে অন্য পেশার আরও ক্ষমতাধর পদে যোগ দিচ্ছে, অবসরে যাওয়া সেনাদের ওপিঅয়েড নেশা থেকে রক্ষার জন্য নীতিমালা তৈরি করা প্রতিষ্ঠান নিজেই কিভাবে সেই আইন ভাঙছে – এমন অনেক অনুসন্ধানী প্রকল্প বড় বড় সংবাদ প্রতিষ্ঠানে ছাপা বা প্রচার হয়েছে। শিক্ষার্থীদের বেশ কয়েকটি প্রতিবেদন আইআরই পুরস্কার জিতেছে। রিপোর্টের প্রতিক্রিয়ায় কর্তৃপক্ষ বক্তব্য দিতে বা পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছে।
সাংবাদিকতা বিভাগটি চালু হয় ১৫ বছর আগে। লেহরেন, তখন থেকেই কোর্সটি পড়াচ্ছেন এবং দিনে দিনে উন্নত করে তুলেছেন। কোর্সটি সাজানোই হয়েছে হাতেকলমে কাজ শেখার বিষয়টিকে মাথায় রেখে। তাই এটি হয়ে উঠেছে সাংবাদিকতা বিভাগের সবচেয়ে আকর্ষণীয় কোর্স। তিন সেমিস্টারের মাস্টার্স প্রোগ্রামে, নিউ ইয়র্ক সিটি জুড়ে নানা অ্যাসাইনমেন্টের মাধ্যমে ক্লাসরুমে পড়া বিষয়গুলো বাস্তবে চর্চা করে দেখার সুযোগ পান শিক্ষার্থীরা। গ্র্যাজুয়েশনের আগেই সবাই একটি পেইড নিউজরুম ইন্টার্নশিপ সম্পন্ন করে ফেলেন।
কন্যকৃত ভোঙ্কিয়াকাজর্ন অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার এই কোর্স নেন ২০১৫ সালে। তখনও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় ক্যারিয়ার গড়ার কোনও পরিকল্পনাই তার ছিল না। কিন্তু সেমিস্টার শেষ হতে হতে সেটি পুরোপুরি বদলে যায়। ভোঙ্কিয়াকাজর্ন বলেন, “অ্যান্ডি এভাবেই মানুষকে অনুপ্রাণিত করতে পারেন। তিনি আপনাকে এমন অনুভূতি দেবেন যে, আপনার মনে হবে কাজটি আপনি করতে পারবেন, বিষয়টি শেষ করতে পারবেন। এবং এজন্য তিনি সব ধরনের টুল ও সহায়তা দিয়ে আপনার পাশে থাকবেন।”
নিউ ইয়র্ক টাইমস ও এনবিসি নিউজ-এর অনুসন্ধানী সাংবাদিক হিসেবে সুনামের সঙ্গে কাজ করেছেন লেহরেন। পুলিৎজার-জয়ী এবং সেখানে সেরা হিসেবে মনোনয়ন পাওয়া অনুসন্ধানেও অবদান আছে তার। নিজের সাবেক সহকর্মী ও শিক্ষার্থীদের প্রায়ই ক্লাসরুমে ডেমে আনেন তিনি। তাঁরা তাদের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান, শিক্ষার্থীদের মাঝে ছড়িয়ে দেন। ভোঙ্কিয়াকাজর্ন, এখন নিউমার্ক জে-স্কুলের যে কোনো শিক্ষার্থীকে এই কোর্সে অংশ নিতে উৎসাহিত করেন, তার আগ্রহ বা কাজের ক্ষেত্র যা-ই হোক না কেন।
ভোঙ্কিয়াকাজর্ন বলেন, “অ্যান্ডি একজন অসাধারণ শিক্ষক। তাঁর অনেক অভিজ্ঞতা আছে, এবং একইসঙ্গে তিনি ভীষণ উদ্যমী। তিনি সত্যিই আপনার ওপর বিশ্বাস রাখবেন এবং চাইবেন যেন আপনি সফল হন। প্রতিবেদনের বিষয় সন্ধান, আরও তীক্ষ্ণ দৃষ্টিকোণ গঠন বা প্রস্তাব তৈরিতে তিনি ক্রমাগত উৎসাহ দিয়ে যাবেন।”
অন্যান্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মিলে ভোঙ্কিয়াকাজর্ন যে ক্লাস প্রজেক্টটি করেছিলেন, সেটি আইআরই পুরস্কারের (শিক্ষার্থী ক্যাটাগরি) জন্য ফাইনালিস্ট হিসেবে মনোনীত হয়েছিল। অনুসন্ধানটির বিষয় ছিল কেন্দ্রীয় শরণার্থী সহায়তা প্রকল্পের তহবিল নিয়ে নয়ছয়। কাজটি শেষ করার জন্য সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে রিপোর্টিং অনুদান নিয়ে মিশিগানে একটি সিরিয় শরণার্থী কমিউনিটি পরিদর্শন করেছিলেন শিক্ষার্থীরা। এই কোর্সে, কাজের মধ্য দিয়ে শেখা দক্ষতার জোরেই পরবর্তীতে মাদার জোনস-এ একটি ফেলোশিপ পেয়েছিলেন ভোঙ্কিয়াকাজর্ন। পরে তিনি সেখানে নিয়োগও পেয়েছিলেন। এখন তিনি ওয়াশিংটন পোস্টে কাজ করছেন সিনিয়র সাবস্ক্রাইবার এনগেজমেন্ট এডিটর হিসেবে।
আনুষ্ঠানিকভাবে ক্লাস শুরু হওয়ার কয়েক মাস আগে থেকেই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কাজ শুরু করেন লেহরেন। কোর্স শেষ হওয়ার লম্বা সময় পরও সেই সম্পর্ক বজায় থাকে। তিনিই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আগ-বাড়িয়ে যোগাযোগ করেন। জানতে চান যে, তাদের কোনো বিশেষ জায়গা নিয়ে কাজের আগ্রহ আছে কিনা। যদি থাকে, তাহলে তিনি সেই সংক্রান্ত সরকারি নথিপত্রের জন্য আগেভাগেই আবেদন করে রাখতে সাহায্য করেন। কোর্স শেষ হয়ে যাওয়ার পরও তিনি শিক্ষার্থীদের নানা বিষয়ে পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা দেন। তাদের প্রতিবেদনগুলো বড় সংবাদমাধ্যমে প্রকাশের ক্ষেত্রে সাহায্য করেন।
কোর্সটিতে প্রবেশের আগেই শিক্ষার্থীদের বিস্তৃত পরিসরের গবেষণা ও অনুসন্ধানী কৌশল শেখা হয়ে যায়। প্রথম বছরে, সব শিক্ষার্থীকে অ্যাডভান্সড অনুসন্ধানী গবেষণা কৌশলের ক্লাস করতে হয়। সেখানে তারা শেখেন: শহরের নানা সরকারী সংস্থা ও বেসরকারী কোম্পানি সম্পর্কে সত্য উদঘাটন করতে গেলে কী ধরনের রেকর্ড প্রয়োজন, সেগুলো কোথায় পাওয়া যাবে এবং সোশ্যাল মিডিয়া ও ওপেন সোর্স অনুসন্ধান পদ্ধতি ব্যবহার করে কিভাবে ব্যক্তি নিয়ে অনুসন্ধান করতে হবে।
লেহরেনের অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা কোর্সের আরেকটি স্বাতন্ত্র্য হলো, এখানে জোট বেঁধে কাজ করাকে উৎসাহ দেওয়া হয়। এভাবে, আরও বিস্তৃত পরিসর নিয়ে রিপোর্টিং করতে শিক্ষার্থীদের সাহায্য করেন লেহরেন। সম্ভাব্য সব দরজায় তারা কড়া নাড়েন, এবং প্রতিটি ডেটা ফাইল বিশ্লেষণ করেন।
হান্না র্যাপলআই বলেন, “এই ক্লাসগুলোর পর আমার মধ্যে উপলব্ধি হয় যে, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা সত্যিই একটি দলগত বিষয়। বড় প্রতিবেদন শেষ করতে হলে, আপনাকে সত্যিই অন্যদের সঙ্গে মিলে কাজ করা শিখতে হবে।” লিসা রিওর্ডান সেভিলের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘমেয়াদী অনুসন্ধানী জুটিটি তৈরি হয়েছিল লেহরেনের ক্লাসে। ২০১৮ সালে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জন্য স্টিভেন বি. শেপার্ড পুরস্কার জিতেছেন এই দুই সাংবাদিক।
এখন, র্যাপলআই একজোট হয়ে কাজ করছেন লেহরেনের সঙ্গেও। তিনিই লেহরেনকে নিউ ইয়র্ক টাইমস থেকে এনবিসি নিউজে আনতে সাহায্য করেন। র্যাপলআই এনবিসি নিউজের অনুসন্ধানী ইউনিটে কাজ করেন, আর লেহরেন সেখানকার সিনিয়র এডিটর। লেহরেন সেখানে যে কাজ করছেন তার জন্য কঠোর পরিশ্রম, আবেগ এবং রসবোধ থাকা প্রয়োজন – যার সব কিছুই পর্যাপ্ত পরিমানে রয়েছে লোকটির মধ্যে, যিনি এক অন্ধ ম্যারাথনারকে পথ দেখাতে নিজের অবসর সময়টুকু ব্যয় করেন।
লেহরেন মনে করেন, অন্যায় উন্মোচনের পেছনে “লেগে থাকার ভয়াবহ রোমাঞ্চের” সঙ্গে কোনো কিছুরই তুলনা হয় না। “অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের মাধ্যমে সমাজে বিতর্ক তৈরি হয়, একটি সমস্যা তুলে ধরা হয় এবং পরিবর্তন আসে। এই ধরনের বিষয় ও তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নানা উপাদান খুঁজে বের করা এবং রিপোর্টিং দলের সঙ্গে মিলে সেটি নিয়ে কাজ করা … সাংবাদিকতায় এটিই অন্যতম আকর্ষণীয় পুরস্কার।”
প্রোফাইলটি প্রথম প্রকাশিত হয় নিউ ইয়র্ক সিটির সিইউএনওয়াই গ্র্যাজুয়েট স্কুল অব জার্নালিজম-এর ওয়েবসাইটে। অনুমতি নিয়ে এখানে পুনঃপ্রকাশ করা হলো।
আরো পড়ুন
মাত্র ১৫ সপ্তাহে একজন শিক্ষার্থীকে অনুসন্ধানী সাংবাদিক বানাবেন যেভাবে
বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা কেন্দ্রের বৈশ্বিক উত্থান
সামান্থা গ্রস, অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের প্রাক্তন সাংবাদিক এবং সিইউএনওয়াই গ্রাজুয়েট স্কুল অব জার্নালিজমের টাও নাইট সেন্টার ফর অন্ট্রপ্রনরিয়াল জার্নালিজমের একজন উদ্যোক্তা সাংবাদিকতা ফেলো। তিনি স্টোরি ট্যুরের প্রতিষ্ঠাতা, যা একটি “ইন-পারসন ম্যাগাজিন”এবং নিউ ইয়র্ক নগরীর বিভিন্ন স্পট থেকে সরাসরি গল্প তুলে ধরে।