প্রবেশগম্যতা সেটিংস

লেখাপত্র

বিষয়

রুয়ান্ডায় গণহত্যা, ফ্রান্সে আত্মগোপন ও পিছে লেগে থাকা এক সাংবাদিক

আর্টিকেলটি পড়ুন এই ভাষায়:

২০১২ সালে তোলা হয়েছে রুয়ান্ডার এই গণকবরের ছবি। ১৯৯৪ সালের এই গণহত্যায় প্রায় আট লাখ মানুষ মারা গিয়েছিল। ছবি: শাটারস্টক

প্রতি রবিবার, প্রার্থনার জন্য চার্চে যেতেন রুয়ান্ডার সাবেক সেনা কর্মকর্তা অ্যালোয়েস নিউইরাগাবো। অনেক বছর ধরে নিজেকে আড়ালে রেখেছিলেন তিনি। কিন্তু শেষপর্যন্ত এমনই এক রবিবারে, প্যারিস থেকে মাত্র এক ঘন্টা দূরে “ওরলিওঁ-র নির্জন শহরতলীতে” তিনি ধরা পড়ে যান এক সাংবাদিকের চোখে।

তার হাতগুলো ঢোকানো ছিল পকেটে। চোখে ছিল চশমা; চলাফেরাতেও ছিল বলিষ্ঠ ভাব। কিন্তু তার হাঁটাচলার মধ্যে এমন কিছু একটা ছিল, যা দেখে বোঝা যাচ্ছিল: তিনি সতর্ক।

প্রতিবেশীদের কোনো ধারণাই ছিল না যে, তাদের পাশের বাড়িতে থাকা মানুষটির নাম অ্যালোয়েস নিউইরাগাবো। একসময় তিনি ছিলেন রুয়ান্ডার উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তা। ১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডার গণহত্যায় যারা অভিযুক্ত হন, তাদের অন্যতম নিউইরাগাবো। এই গণহত্যায় ১০ লাখেরও বেশি মানুষ মারা গিয়েছিল বলে ধারণা করা হয়।

“বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর প্রতিবেশীরা অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। তারা কখনোই এমন কিছু সন্দেহ করেননি,” বলেছেন থিও এঙ্গেলবার্ট। ফরাসী এই সাংবাদিকই শেষপর্যন্ত সনাক্ত করেছিলেন নিউইরাগাবোকে। রুয়ান্ডার সাবেক এই গোয়েন্দাপ্রধান, ডেমোক্রেটিক ফোর্সেস ফর দ্য লিবারেশন অব রুয়ান্ডা (এফডিএলআর) গঠনের পেছনেও মূখ্য ভূমিকা রেখেছেন বলে ধারণা করা হয়। হুতু জনগোষ্ঠীর এই সশস্ত্র গ্রুপ, ১৯৯৪ সালের গণহত্যায় অংশ নিয়েছিল বলে অভিযোগ আছে।

“আমি এমন সময়ে তাকে খুঁজে পেয়েছি, যখন সাংবাদিকতা ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবছিলাম,” বলেছেন এঙ্গেলবার্ট। ২৯ বছর বয়সী এই সাংবাদিক আট মাস ধরে অনুসন্ধান চালিয়ে এই প্রতিবেদন তৈরি করেছেন। এবছরের জুলাইয়ে এটি প্রকাশিত হয়েছে ফরাসী অনুসন্ধানী সংবাদমাধ্যম, মিডিয়াপার্টে।

তাঁর এই অনুসন্ধান এতো প্রভাব ফেলেছে, যা খুব কম সাংবাদিকই কল্পনা করতে পারে। প্রতিবেদন প্রকাশের পর রুয়ান্ডার কর্তৃপক্ষ তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে; আর মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে তদন্ত শুরু করেন ফ্রান্সের কাউন্টার-টেরোরিজম প্রসিকিউটর। জিআইজেএন আয়োজিত “নিঁখোজের খোঁজে” ওয়েবিনার সিরিজে এই অনুসন্ধান নিয়ে কথা বলেন এঙ্গেলবার্ট। জানান, কিভাবে তিনি কাজটি করেছেন।

নব্বইয়ের দশকে যিনি ছিলেন রুয়ান্ডার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের (আইসিটিআর) চোখে মোস্ট-ওয়ান্টেড ব্যক্তি, তাকে একক চেষ্টায় কিভাবে খুঁজে বের করলেন এঙ্গেলবার্ট? ওপেন-সোর্স ইন্টেলিজেন্স, তথ্য অধিকার আইনে আবেদন এবং প্রথাগত পদ্ধতির খোঁজাখুঁজি। এই লেখায় আমরা তার সেই অনুসন্ধান পদ্ধতিকে তুলে ধরব। ইচ্ছা করে লুকিয়ে থাকতে চায়, এমন মানুষদের খুঁজে বের করার ক্ষেত্রে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শও থাকছে এখানে।

ডেটাবেজ তৈরি করুন 

রুয়ান্ডা থেকে আসা শরণার্থীদের নিয়ে আগে থেকেই কাজ করছিলেন এঙ্গেলবার্ট। মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে যাদের আশ্রয়ের আবেদন নাকচ করে দেওয়া হয়েছে, তাদের আইনি নথিপত্র সংগ্রহ করা শুরু করেছিলেন তিনি। এধরনের মানুষদের আশ্রয়ের জন্য ফ্রান্স বেশ লোভনীয় গন্তব্য। রুয়ান্ডা থেকে পালিয়ে আসা এমন বেশ কয়েকজন অভিযুক্ত ব্যক্তি এখন ফ্রান্সে আছেন বলে মনে করা হয়। কাজটি আরো গুছিয়ে করার জন্য, এঙ্গেলবার্ট একটি ডেটাবেজ তৈরি করেন। এতে করে তিনি নিজের সংগ্রহে থাকা নথিগুলোও বুঝতে পেরেছেন আরো ভালোভাবে। “এই ধরনের কাজে অনেক সময় লাগে,” বলেছেন এঙ্গেলবার্ট, “কিন্তু আমি লম্বা সময় ধরে লক্ষ্য করেছি অ্যালোয়েস নিউইরাগাবোকে। কারণ একটা সময় আমি বুঝতে পেরেছিলাম: কঙ্গোতে সক্রিয় একটি সশস্ত্র গ্রুপ (এফডিএলআর), তাদের নির্দেশনা পাচ্ছিল ফ্রান্সে থাকা কারো কাছ থেকে। এসময়েই আমি সিদ্ধান্ত নেই বিষয়টি ভালোমতো খতিয়ে দেখার। জানতে চেষ্টা করি নিউইরাগাবো সেই ফ্রান্সে থাকা সেই সক্রিয় ব্যক্তিটি কিনা।”

আইনি নথি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখুন 

তদন্ত বা মামলা চলার সময় পালিয়ে গেছে, এমন মানুষদের খোঁজার ক্ষেত্রে বা অপরাধী সংগঠন সম্পর্কে জানার ক্ষেত্রে আদালতের রায়গুলো অনেক সাহায্য করতে পারে সাংবাদিকদের। ফ্রান্সে, আমরা এগুলো অনলাইনেই দেখতে পারি। এজন্য আপনাকে legifrance.gouv.fr-এর মতো সাইটে সার্চ করতে হবে। আপনি যে বিষয় সংক্রান্ত রায়গুলো দেখতে চান, তা লিখে সার্চ করার মাধ্যমে অনেক তথ্য পেতে পারেন। সেজন্য সার্চ করতে হবে এভাবে: “site:legifrance.gouv.fr.” + আপনার কিওয়ার্ড।

নিউইরাগাবোর ক্ষেত্রে, এমন একটি আদালতের রায় পেয়েছিলেন এঙ্গেলবার্ট। ২০০১ সালে একটি ভিসা আবেদনের প্রেক্ষিতে সেই রায়টি দিয়েছিল নঁতের আদালত। এই বিষয়টি এঙ্গেলবার্টকে কৌতুহলী করে তোলে। সেই রায়ের নথিতে অবশ্য সাবেক এই কর্নেলের নাম উল্লেখ করা হয়নি। কিন্তু সেখানে এমন কিছু তথ্য ছিল, যাতে এঙ্গেলবার্ট সংশয়ী হয়ে ওঠেন। প্রথম দেখায় নথিটি হয়তো খুবই মামুলি মনে হবে, কিন্তু দীর্ঘ গল্পের শুরুটা হয়েছিল এখান থেকেই।

প্রয়োজনে ধোঁকা দিন

এরপর এঙ্গেলবার্টকে নিশ্চিত হতে হতো, আদালতের রায়ে যার কথা বলা হচ্ছে, সেই ব্যক্তিটি নিউইরাগাবো। এজন্য এখানে তিনি কিছুটা মিথ্যার আশ্রয় নেন। ২০০১ সালের এই রায়ের বিস্তারিত জানতে চেয়ে তিনি আবেদন জানিয়েছিলেন নতেঁর আদালতে। সেখানে তিনি সেই রায়, তারিখ ও অ্যালোয়েস নিউইরাগাবোর নাম উল্লেখ করেছিলেন। যদিও তাঁর কাছে থাকা আগের নথিটিতে নামগুলো কালো কালি দিয়ে মুছে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ভাগ্যদেবী প্রসন্ন ছিলেন। সেই আবেদনের জবাবে তার কাছে পূর্ণাঙ্গ রায়টি পাঠানো হয়। সেখানে নিউইরাগাবোর নাম ছিল। এভাবেই এঙ্গেলবার্ট প্রথম লিখিত প্রমাণ পেলেন, রুয়ান্ডার সাবেক এই কর্নেল ফ্রান্সে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয়ের আবেদন জানিয়েছিলেন।

যেখানে খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি সেখান থেকেই শুরু

এঙ্গেলবার্ট এই অনুসন্ধান শুরু করেছিলেন আদালতের সেই রায় ঘোষণার প্রায় দুই দশক পরে। তাই ভুল পথে চলে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। তাই তিনি আগে অন্য কয়েকটি দেশে খোঁজ করার সিদ্ধান্ত নেন। এঙ্গেলবার্ট  ভেবেছিলেন: সাবেক গোয়েন্দা প্রধান সেসব দেশে ঘাঁটি গাড়তে পারেন, যেখানে তার প্রকাশ্যে চলাফেরার সুযোগ আছে। এজন্য তিনি যোগাযোগ করেন সুদান, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক ও ডিআরসি-র সূত্রদের সঙ্গে। এই খোঁজাখুঁজির মাধ্যমে নিশ্চিত হন, নিউইরাগাবো সেসব দেশে নেই। এটি নিশ্চিত না করতে পারলে, বিষয়টা খড়ের গাদায় সূঁচ খোঁজার মতোই হয়ে দাঁড়াতো! এই খোঁজাখুঁজি ও গবেষণার মাধ্যমে এঙ্গেলবার্ট বুঝতে পারেন, ৯৪-এর গণহত্যার আগে নিউইরাগাবো কোথায় কোথায় ছিলেন।

একটি ফুল টেক্সট সার্চ টুল 

এভাবে অনুসন্ধানের এক পর্যায়ে, গোপন এক সূত্রের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ নথিপত্র (কয়েক গিগাবাইট পরিমাণ তথ্য) পেয়ে যান এঙ্গেলবার্ট। এই বিশাল আর্কাইভের ভেতরে কোথায় কোথায় নিউইরাগাবোর নাম আছে, তা খুঁজে দেখার জন্য ডেস্কটপ সার্চ ইঞ্জিন, জাপিয়ান ব্যবহার করেছেন তিনি। এটি কম্পিউটারে থাকা সব কনটেন্টকে তালিকার মতো করে সাজায়। এর সঙ্গে তিনি যুক্ত করেছেন ফুল টেক্সট সার্চ টুল, রিকোল। জাপিয়ান ও রিকোল-কে সংযুক্ত করতে হয় কমান্ড লাইনের মাধ্যমে। এরপর আপনি “নিউইরাগাবো” লিখে সার্চ দিলে কম্পিউটারের সব ফাইলে খোঁজ শুরু হবে। তা পিডিএফই হোক, বা ইমেইল। সার্চ শেষে আপনার কিওয়ার্ড সম্বলিত ফাইলগুলো সামনে চলে আসবে।

এই আর্কাইভটিই হয়ে দাঁড়ায় এই অনুসন্ধানের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এক নথিতে দেখা যায়: ফরাসী গোয়েন্দা সংস্থা, নিউইরাগাবো-র স্ত্রীর কথা উল্লেখ করছে তার বিবাহপূর্ব নাম দিয়ে। নামটি ছিল: ক্যাথেরিন নিকুজে। তিনি প্যারিসের ৬০ মাইল দক্ষিণপশ্চিমের শহর, ওরলিওঁ-তে থাকেন বলেও জানানো হয় সেই নথিতে।

মুক্ত তথ্য ধরে সূত্র মেলানো

পরবর্তী ধাপটি ছিল: ক্যাথেরিন নিকুজে বা ক্যাথেরিন নিউইরাগাবোকে নিয়ে গবেষণা করা। এটি নিশ্চিত করতে হতো যে, তিনি এখনো ফ্রান্সেই আছেন। এজন্য এঙ্গেলবার্ট ফ্রেঞ্চ-রুয়ান্ডান কমিউনিটির সমিতিগুলো খুঁজে বের করেন। তিনি বোঝার চেষ্টা করেন: ওরলিওঁ-তে রুয়ান্ডান অভিবাসীরা কিভাবে আছেন। এই কাজের জন্য তিনি যোগাযোগ করেছেন ফরাসী সরকারের গেজেট জার্নাল অফিসিয়ালের সঙ্গে। জানার চেষ্টা করেছেন, একেবারে স্থানীয় পর্যায়ে কী ধরনের অ্যাসোসিয়েশন আছে।

ফ্রান্সে একটি আইনের কারণে সব ধরণের অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য উন্মুক্ত রাখতে হয়। এই আইন কাজে লাগিয়ে আরো তথ্যের জন্য আবেদন করেন এঙ্গেলবার্ট।

এসব নথিপত্র থেকে দেখা যায়: ক্যাথেরিন নিকুজে অভিবাসী কমিউনিটির সঙ্গে খুব গভীরভাবে সম্পৃক্ত এবং রুয়ান্ডার কিছু উগ্রপন্থী গ্রুপের সঙ্গেও তার সংযোগ আছে। নথিতে তাকে উল্লেখ করা হয়েছে ক্যাথেরিন নিকুজে হিসেবে, কিন্তু ডিরেকটরিতে তার নাম লেখা ক্যাথেরিন নিউইরাগাবো। এই দুই ক্যাথেরিনের মধ্যে সংযোগের বিষয়টিও নিশ্চিত করে এখান থেকে পাওয়া একটি নথি।

এবার এঙ্গেলবার্ট খোঁজ শুরু করেন ফ্রেঞ্চ অনলাইন ডিরেকটরিতে (১১৮৭১২)। এখানে কারো নাম, ফোন নম্বর বা ঠিকানা দিয়ে সার্চ করা যায়। এ জাতীয় কাজের জন্য তিনি adresse-française.com সাইটটি ব্যবহারেরও পরামর্শ দিয়েছেন। এখানে কোনো অঞ্চল, শহর বা কোনো নির্দিষ্ট জায়গা ধরে সার্চ করা যায় এবং সেখানে থাকা মানুষদের ফোন নম্বর খুঁজে পাওয়া যায়।

তারপর ভিজ্যুয়াল তথ্য সংগ্রহ

অ্যালোয়েস নিউইরাগাবোকে খুঁজে পাওয়ার জন্য অবশ্যই জানতে হতো:  তিনি দেখতে কেমন। সামনাসামনি দেখে চিনতে পারাটাও ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাই, তার ছবির জন্য রুয়ান্ডার তথ্যদপ্তরের আর্কাইভে তল্লাশি চালান এঙ্গেলবার্ট। রুয়ান্ডার বড় বড় অনুষ্ঠানগুলোর ছবিতে খুঁজতে থাকেন নিউইরাগাবোকে। কিন্তু সেখানে কিছুই পাওয়া যায়নি। একটি ছবিও না। “তিনি রুয়ান্ডাতে খুবই সুপরিচিত ছিলেন। পুরো কিগালি অঞ্চলে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন; মানুষ তার সম্পর্কে জানত। কিন্তু আমার মনে হয়, তিনি বরাবরই কিছুটা আলাদা ছিলেন,” বলেন এঙ্গেলবার্ট।

বামের ছবিটি এঙ্গেলবার্ট খুঁজে পেয়েছেন একটি পুরোনো মানবাধিকার রিপোর্টে। আর ডানের ছবিতে তিনি নিউইরাগাবোকে ক্যামেরাবন্দী করেছেন ওরলিওঁ-তে। ছবি কৃতজ্ঞতা: এঙ্গেলবার্ট

শেষপর্যন্ত, বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া একটি মানবাধিকার সংগঠনের কাছ থেকে একটি পুরোনো রিপোর্ট পাওয়া যায়, যেখানে নিউইরাগাবোর ছবি ছিল। গণহত্যার আগে ছবিটি তোলা হয়েছিল।

মূলনায়ককে অনুসরণ ও ভিজ্যুয়াল প্রমাণ জোগাড়

এঙ্গেলবার্ট এই অনুসন্ধানের কাজে প্রথমবার ওরলিওঁ-তে গিয়েছিলেন গত জানুয়ারিতে। তার আগে তিনি খুবই ভালোভাবে সেই ঠিকানা খুঁজে বের করেছিলেন গুগল আর্থ ও স্ট্রিটভিউর সাহায্য নিয়ে। সাদামাটা সেই শহরতলীতে পৌঁছানোর পর, তিনি সেই ঠিকানায় থাকা বাড়িটি খুঁজে বের করেন। বাড়ির সামনে ও চিঠির বাক্সে লেখা ছিল ক্যাথেরিন নিউইরাগাবোর নাম। এরপর তিনি খোঁজ করে দেখেন, কাছাকাছি কোনো চার্চ আছে কিনা। “কারণ আমি জানতাম, এফডিএলআর-এর সদস্যরা ধর্মীয়ভাবে মৌলবাদী। চার্চে যাওয়াটা তাদের কাছে একটি ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা। ফলে আমি জানতাম, তাদেরকে যদি কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়, সেটি হবে তাদের প্রার্থনার জায়গা,” বলেন এঙ্গেলবার্ট।

এই দম্পত্তির বাড়ির কাছাকাছিই একটি চার্চ খুঁজে পান তিনি। কিন্তু রবিবারের প্রার্থনায় এখানে আরো অনেক রুয়ান্ডান আসেন। ফলে কাজটি জটিল হয়ে উঠেছিল। এঙ্গেলবার্ট ব্যাখ্যা করে বলেছেন, “কাজটি আসলেই কঠিন ছিল। আপনার মাথায় রাখতে হবে যে তিনি গোয়েন্দাবাহিনীর প্রধান ছিলেন। এবং গত ২০ বছর ধরে তিনি এরকম গোপনীয় জীবনযাপন করছেন।”

বাড়ি থেকে চার্চে যাওয়ার সময়টুকুতে সাবেক এই কর্নেলকে দেখার জন্য এঙ্গেলবার্ট সাত-আটবার ওরলিওঁ-তে গেছেন। “আমি তার খুব কাছাকাছি যেতে পারতাম না। কারণ পিছনে কী ঘটছে দেখার জন্য তিনি ঘনঘন শপ উইন্ডোতে নজর ফেরাতেন। ঘাড় ঘুরিয়ে কিছু একটা দেখলেই তিনি অবস্থান পরিবর্তন করে ফেলেন। ফলে তাকে অনুসরণ করার কাজটি কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। সমাধান ছিল: একটি নির্দিষ্ট জায়গায় থেকে তাকে পর্যবেক্ষণ করা। সেই জায়গার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় তাকে ক্যামেরাবন্দী করা। এভাবে সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে আমাকে বিভিন্ন জায়গায় বসে পর্যবেক্ষণ করতে হয়েছে।” এঙ্গেলবার্ট এই কাজে খুব সতর্ক ছিলেন। তিনি একই জামাকাপড় দ্বিতীয়বার পরতেন না এবং একই জায়গায় দ্বিতীয়বার থাকতেন না। এভাবে শেষপর্যন্ত তার এই পরিশ্রমের ফল পাওয়া যায় এবং তিনি নিউইরাগাবোকে ক্যামেরাবন্দী করতে সক্ষম হন। অবশ্য সেটি ছিল খুবই কম সময়ের জন্য।

একবার ক্যামেরাবন্দী করে ফেলার পর, এঙ্গেলবার্ট এবার রুয়ান্ডার গোয়েন্দা বিভাগের সূত্রদের দিয়ে সেটি যাচাই করার কাজ শুরু করেন। তিনি তাদেরকে সেই ছবি দেখিয়ে জানতে চেয়েছিলেন যে, ইনিই তাদের সাবেক পরিচালক কিনা। “বেশিরভাগই নিশ্চিত করেছিল যে, এটি তিনিই। কিন্তু এফডিএলআর-এর কিছু সদস্য বিষয়টি লুকাতে চেয়েছিল। নিউইরাগাবো কিছু সময়ের জন্য নিজেকে মৃত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। সেই নির্দেশনা মেনে, কেউ কেউ বলেছিলেন তিনি মারা গেছেন,” বলেন এঙ্গেলবার্ট।

প্রতিবেদনটি প্রকাশের জন্য এঙ্গেলবার্টের আর একটি শেষ প্রমাণ প্রয়োজন ছিল। রেজিস্টার্ড ডাকে পাঠানো একটি চিঠির রসিদ, যেই চিঠি রুয়ান্ডার সাবেক কর্নেল পোস্ট অফিসে গিয়ে বুঝে নিয়েছিলেন। আর সেই খামের ওপর নাম লেখা ছিল: অ্যালোয়েস নিউইরাগাবো।

যে অনুসন্ধান এখনো চলমান

এঙ্গেলবার্ট যে সময় নিউইরাগাবোকে খুঁজে বের করেছেন, তখন আইসিটিআর [রুয়ান্ডার ট্রাইব্যুনাল], ইন্টারপোল, ফ্রান্স বা রুয়ান্ডা; কেউই তাকে সেভাবে খুঁজছিল না। গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছিল।

এঙ্গেলবার্ট বলেছেন, “তারা কখনোই তাকে খুঁজে পেত না। তারা জানতই না যে, ব্যক্তিটি জীবিত না মরে গেছে। তিনি অনেকটা আফ্রিকান কেজার সোজের (“দ্য ইউজুয়াল সাসপেক্টস” চলচ্চিত্রের একটি চরিত্রের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে) মতো।”

“আইসিটিআর বন্ধ করে দিতে চেয়েছিল জাতিসংঘ। কারণ এটি ছিল খুব ব্যয়বহুল। ফলে তাদের বিচারাধীন ব্যক্তির সংখ্যা কমিয়ে আনতে হয়েছিল। নিউইরাগাবোকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না মনে করে, ২০০৪ সালে প্রত্যাহার করা হয় তার ওয়ারেন্ট।”

বর্তমানে, ইউরোপের অল্প কিছু দেশের মধ্যে ফ্রান্স একটি, যারা রুয়ান্ডার অভিযুক্ত কোনো ব্যক্তিকে সেদেশে ফিরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ গ্রহণ করে না। এফডিএলআর-ও ফ্রান্সে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে বিবেচিত হয় না। বৃহৎ পরিসরের দৃষ্টিভঙ্গি অবশ্য মোটেও এমন না। যুক্তরাষ্ট্রে এই গ্রুপকে সন্ত্রাসী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এফডিএলআর প্রসঙ্গে জাতিসংঘ বলেছে, “তারা এমন গুরুতর অপরাধ করেছে, যা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। তারা সশস্ত্র সংঘাতের সময় নারী ও শিশুকে শিকার বানিয়েছে, যার মধ্যে হত্যা, যৌন সহিংসতা ও বলপূর্বক উচ্ছেদের অভিযোগ ছিল।”

প্রতিবেদনটি প্রকাশের তিন মাস পেরিয়ে গেলেও, ফ্রান্স এখনো রুয়ান্ডার অপরাধী বিনিময়ের অনুরোধের জবাব দেয়নি। এঙ্গেলবার্টও নিশ্চিত নন, ফরাসী কর্তৃপক্ষ নিউইরাগাবোর সঙ্গে যোগাযোগ করেছে কিনা।

আরো পড়ুন


মার্থে হুবিও জিআইজেএনের ফরাসি ভাষা সম্পাদক। তিনি আর্জেন্টিনার লা নাসিওন পত্রিকায় ডেটা সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছেন। স্লেটএল মুন্দোলিবারেশনলা ফিগারো এবং মিডিয়াপার্টে লিখেছেন ফ্রিল্যান্সার হিসেবে। তিনি ডেটা সাংবাদিকতার প্রশিক্ষক হিসেবেও কাজ করে থাকেন।

লেখাটি পুনঃপ্রকাশ করুন


Material from GIJN’s website is generally available for republication under a Creative Commons Attribution-NonCommercial 4.0 International license. Images usually are published under a different license, so we advise you to use alternatives or contact us regarding permission. Here are our full terms for republication. You must credit the author, link to the original story, and name GIJN as the first publisher. For any queries or to send us a courtesy republication note, write to hello@gijn.org.

পরবর্তী

environmental spill ocean liquid natural gas terminal

পরামর্শ ও টুল সংবাদ ও বিশ্লেষণ

কীভাবে খুঁজবেন, পরিবেশের ক্ষতির পেছনে কে বা কারা জড়িত?

পরিবেশ সম্পর্কিত যে কোন অবৈধ কাজের সঙ্গে অনেক বেশি আর্থিক সংশ্লেষ থাকে। আর তা উন্মোচনের জন্য নিবিড়ভাবে জানতে হয় বিভিন্ন অঞ্চল, আর সেখানকার আইন কানুন, গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে হয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের। এ ধরনের প্রতিবেদন তৈরিতে কিছু কৌশল সাংবাদিকদের সাহায্য করতে পারে।

Studio, headphones, microphone, podcast

সংবাদ ও বিশ্লেষণ

ঘুরে আসুন ২০২৩ সালের বাছাই করা অনুসন্ধানী পডকাস্টের জগত থেকে

নানাবিধ সীমাবদ্ধতা ও প্রতিকূলতার মধ্যেও ২০২৩ সালে বিশ্বজুড়ে প্রকাশিত হয়েছে সাড়া জাগানো কিছু অনুসন্ধানী পডকাস্ট। এখানে তেমনই কিছু বাছাই করা পডকাস্ট তুলে এনেছে জিআইজেএনের বৈশ্বিক দল।

সংবাদ ও বিশ্লেষণ সম্পাদকের বাছাই

চিংড়ি চোরাচালান, হাসপাতালে অগ্নিকাণ্ড, তামাক শিল্পের ক্ষতিকর প্রভাব: চীন, হংকং ও তাইওয়ানের ২০২৩ সালের সেরা অনুসন্ধানী প্রতিবেদন

অনেক বাধাবিপত্তি ও চ্যালেঞ্জের মুখেও চীন, হংকং ও তাইওয়ান থেকে ২০২৩ সালে প্রকাশিত হয়েছে প্রভাব তৈরির মতো অনুসন্ধানী প্রতিবেদন। এমনই কিছু প্রতিবেদন জায়গা করে নিয়েছে জিআইজেএনের সম্পাদকের বাছাইয়ে।

InterNation international journalism network

সংবাদ ও বিশ্লেষণ

ইন্টারনেশন: (সম্ভবত) বিশ্বের প্রথম অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার নেটওয়ার্ক

প্রায় ৪০ বছর আগে, গড়ে উঠেছিল অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের (সম্ভবত) প্রথম আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক, ইন্টারনেশন। পড়ুন, এটির নেপথ্যের কাহিনী।