আল জাজিরার ডেটা সাংবাদিক মোহাম্মদ হাদ্দাদের প্রিয় অনুসন্ধানী টুল
আর্টিকেলটি পড়ুন এই ভাষায়:
সাংবাদিকদের প্রিয় টুল সিরিজের এবারের পর্বে আমরা কথা বলেছি আল জাজিরার ইন্টারঅ্যাকটিভ দল, এজে ল্যাবের প্রধান, মোহাম্মদ হাদ্দাদের সঙ্গে।
ফিলিস্তিনি-দক্ষিণ আফ্রিকান এই ডেটা সাংবাদিক আল জাজিরার সঙ্গে কাজ করছেন প্রায় এক দশক ধরে। ২০১১ সালে মিশরীয় গণঅভ্যুত্থানের সময় তিনি যোগ দিয়েছিলেন কাতার-ভিত্তিক এই সংবাদমাধ্যমে। হাদ্দাদের পুরস্কার-বিজয়ী দলটি খুব ছোট। এখানে সার্বক্ষণিক কাজ করেন মাত্র দুজন ভিজ্যুয়াল স্টোরিটেলার ও ডেটা সাংবাদিক। অবশ্য প্রায়ই বিভিন্ন কাজের জন্য তাঁরা সঙ্গে নেন ফ্রিল্যান্সারদের। এবছর দলের সদস্য সংখ্যা বাড়ানোরও পরিকল্পনা করছেন হাদ্দাদ। ডেটা সাংবাদিকতা নিয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষণ কর্মশালাতেও তিনি অংশ নেন নিয়মিত।
অনলাইনে এখন এমন পাঠক-দর্শকের সংখ্যা বেশি যারা বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে সংবাদ পান ও তা শেয়ার করেন। এমন পাঠকদের আকৃষ্ট করার জন্য ডিজিটাল টুল দিয়ে বানানো কন্টেন্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে বলে মনে করেন হাদ্দাদ।
তিনি বলেছেন, “আমরা এখন এমন এক পরিস্থিতিতে আছি, যেখানে আমাদের ইন-ডেপথ কন্টেন্টও বানাতে হয়, আবার খেয়াল রাখতে হয় যেন সেগুলো সহজে সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ারও দেওয়া যায়। এই টুলগুলো সাংবাদিকদের জন্য এতো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে যে, এগুলো ছাড়া অনেক কাজই সম্ভব হয় না।”
আরস্টুডিও, টাইডিভার্স
আর প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজের জন্য একটি বিনা পয়সার উন্মুক্ত টুল বানিয়েছে আরস্টুডিও। সাধারণত এটি ব্যবহৃত হয় পরিসংখ্যানগত বিশ্লেষণ ও ভিজ্যুয়ালাইজেশনের জন্য। হাদ্দাদ এটিকে আরো কার্যকরী করে তুলেছেন টাইডিভার্স-এর ব্যবহার করে। এর টেমপ্লেটগুলো কাজকে সহজ করে দেয়।
হাদ্দাদ, চার বছর ধরে ব্যবহার করছেন “আর” প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ। এটি হয়ে উঠেছে তার যাবতীয় ডেটা সাংবাদিকতা সংশ্লিষ্ট কাজের প্রধান অংশ। তিনি বলেছেন, “যদি প্রতিবেদনটিতে বিশ্লেষণ করার মতো ডেটার ব্যবহার থাকে, তাহলে আমি চলে যাই আর প্রোগ্রামিংয়ে। নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে, আরস্টুডিওতে।”
করোনাভাইরাস মহামারি নিয়ে আল জাজিরার চলমান কাভারেজের ক্ষেত্রে তিনি এই দুটি টুলই ব্যবহার করেছেন। “নিউজ ডেস্কের যে কোনো প্রতিবেদনে তাৎক্ষণিকভাবে কাজে লাগানোর জন্য আমরা ব্যবহার করেছি জন হপকিন্স ইউনিভার্সিটির ডেটা। তারা সংখ্যাগুলো প্রতিদিন হালনাগাদ করে। আমরা শুধু সেই ডেটা সংগ্রহ করে, সেটি ভিজ্যুয়ালাইজ করেছি,” বলেন হাদ্দাদ। বিশ্বজুড়ে কোভিড-১৯ পরিসংখ্যানের জন্য বিশ্বস্ত সূত্র হয়ে উঠেছে হপকিন্স ইউনিভার্সিটির করোনাভাইরাস রিসোর্স সেন্টার। একটি স্ক্রিপ্ট ব্যবহার করে সেখান থেকে ডেটা সংগ্রহ করেন হাদ্দাদ। এরপর আর ব্যবহার করে ডেটাগুলোকে তিনি রূপ দেন বিভিন্ন ম্যাপে। হাদ্দাদ বলেছেন, “আপনি এটি নতুন করে সাজাতে পারেন, বিভিন্ন সময়ের প্রেক্ষিতে পরিসংখ্যান দেখতে পারেন। সব কিছু এটি দিয়ে করা যায়। এধরনের ডেটা কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে এটি খুবই কার্যকরী একটি উপায়।
ম্যাপবক্স
এখন ম্যাপ বা মানচিত্র হয়ে উঠেছে ডেটা সাংবাদিকতার অন্যতম প্রধান উপাদান। আল জাজিরাও তাদের ভিজুয়্যাল কাজে অন্তর্ভূক্ত করেছে ম্যাপকে। “অন্যান্য অনেক সংবাদমাধ্যমের মতো, আমরাও ম্যাপের ব্যবহার করি অনেক বেশি। এবং এই কাজের জন্য গত ১৮ মাস ধরে আমরা ম্যাপবক্স ব্যবহার করছি,” বলেছেন হাদ্দাদ।
সাংবাদিকতা ছাড়াও অন্যান্য আরো অনেক কাজে ম্যাপবক্স ব্যবহার করা হয়। হাদ্দাদ এটি ব্যবহার করেন ভিজ্যুয়াল স্টোরিটেলিংয়ে বাড়তি মাত্রা যোগ করার জন্য। ম্যাপবক্স একটি ওপেন সোর্স, “ফ্রিমিয়াম” সেবা। কোনো প্রতিষ্ঠানের ব্যবহকারকারী ২৫ হাজার ছাড়িয়ে গেলে, তারপর মাসিক ব্যবহার অনুযায়ী টাকা পরিশোধ করতে হয়।
চীন ও ভারতের মধ্যকার সীমান্ত দ্বন্দ্ব নিয়ে আল জাজিরার করা একটি প্রতিবেদনের প্রসঙ্গ টেনে হাদ্দাদ বলেন, “আপনি যখন কোনো এলাকার ভৌগলিক বিষয়গুলো বুঝতে শুরু করবেন, তখন দেখবেন সেখানকার কিছু অংশ কত গুরুত্বপূর্ণ।” প্রতিবেদনটি তৈরি হয়েছে, ম্যাপবক্স এবং তার স্টোরিটেলিং টেমপ্লেট ব্যবহার করে। তার সাথে ছিল – থ্রিডি মডেলিং, ভিজুয়্যালাইজড ডেটা, ছবি ও ভিডিও। সব কিছুর সমন্বয়ে বলা হয়েছে: এই অঞ্চলের সীমানা নিয়ে ভারত ও চীন কিভাবে লড়ে যাচ্ছে।
“আমরা ভৌগলিক বিষয়গুলোকে ব্যবহার করছি একটি যাত্রাপথের মত করে। এবং প্রয়োজন অনুযায়ী বিষয় সংশ্লিষ্ট ইনফোগ্রাফিক্সও তৈরি করেছি, যেন সোশ্যাল মিডিয়ার দর্শক এই ঘটনাপ্রবাহ ভালোমতো বুঝতে পারে।”
এএমপি ওয়েব স্টোরিজ
মোবাইল ডিভাইসে বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া চ্যানেলের মাধ্যমে সংবাদ পাওয়ার হার ক্রমেই বাড়ছে। এই দিকটি মাথায় রেখে এএমপি (এক্সেলেরেটেড মোবাইল পিকচার) এবং এর ওয়েব স্টোরিজ হয়ে উঠেছে সংবাদ উপস্থাপনার অন্যতম প্রধান টুল। “ডেটা প্রতিবেদনের ক্ষেত্রে আমরা সবসময়ই এর মানবিক দিকটি মাথায় রাখি। কিভাবে মানুষ প্রভাবিত হচ্ছে? তাদের গল্পটা কী? ওয়েব স্টোরিজ তৈরি করা হয় মোবাইলের কথা মাথায় রেখে। এটি পড়া বা দেখা খুব সহজ এবং এটি ডেটা-নির্ভর,” বলেছেন হাদ্দাদি।
ওয়েব স্টোরিজ একটি ওপেন সোর্স ও ফ্রি সেবা। যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গদের পুলিশি সহিংসতার শিকার হওয়া নিয়ে আল জাজিরা একটি প্রতিবেদন (“নো দেয়ার নেমস”) তৈরি করেছিল ওয়েব স্টোরিজ ব্যবহার করে।
“এই কাজের জন্য আমরা ম্যাপিং পুলিশ ভায়োলেন্স ওয়েবসাইটের ডেটা ব্যবহার করেছি। যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশের হাতে খুন হওয়া প্রতিটি মানুষের তথ্য আছে এই ডেটাবেজে। আমরা তাদের পুরো ডেটাবেজটি প্রথমে ডাউনলোড করেছি একটি এক্সেল ফাইল আকারে। এরপর সেটিকে নিয়ে গেছি আর প্রোগ্রামের মধ্যে। সেখানে আমাদের চাহিদামতো নানাবিধ ফিল্টার ব্যবহার করে ছেঁকে নেওয়া হয়েছে প্রাসঙ্গিক তথ্যগুলো,” বলেছেন হাদ্দাদ। এরপর একজন ইলাস্ট্রেটর ও যুক্তরাষ্ট্র সম্পাদকের সঙ্গে পরামর্শ করে তারা তৈরি করেছেন একটি গ্রাফিক স্টোরি, যেখানে উঠে এসেছে জর্জ ফ্লয়েড ও ব্রিওনা টেইলরের মতো পুলিশি নির্যাতনের শিকার কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তিদের গল্প।
নিভো
ডেটা ভিজ্যুয়ালাইজেশনের জন্য হাদ্দাদ বেশ কিছু টুল ব্যবহার করেন। তার মধ্যে অন্যতম হলো নিভো। এটি ওপেনসোর্স এবং বিনামূল্যে ব্যবহার করা যায়। “জটিল ডেটা সেট পেলে, সেটি ভিজ্যুয়ালাইজেশনের জন্যে আমরা নিভোর টেমপ্লেট ব্যবহার করি,” বলেছেন হাদ্দাদ। জাতিসঙ্ঘে আমার দেশ কিভাবে ভোট দিয়েছে? – এই প্রতিবেদনটি তৈরির কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল নিভোর। এখানে আল জাজিরা বিশ্লেষণ করেছিল, ১৯৪৬ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত জাতিসঙ্ঘের সাধারণ সভায় কোন দেশ কিভাবে ভোট দিয়েছে।
হাদ্দাদ বলেছেন, “ আমরা বুঝতে চেয়েছিলাম, জাতিসঙ্ঘে কোন দেশ কিভাবে ভোট দেয়, এবং কিভাবে এর বিবর্তন ঘটেছে। যেমন, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্ব, পারমাণবিক অস্ত্র, মানবাধিকার, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ইত্যাদি বিষয়ে কাদের ভোট কোন দিকে গেছে।”
নিভো দিয়ে তৈরি করা এই প্রতিবেদন ছিল একটি বড় আকারের ইন্টারঅ্যাকটিভ কন্টেন্ট। এখানে অঞ্চল বা দশক ধরে ধরে বিভিন্ন বিষয় তুলে আনা হয়েছে। যার মাধ্যমে দেখা যায় জাতিসঙ্ঘের সদস্য দেশগুলো বিভিন্ন ইস্যুতে কিভাবে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান নিয়েছে। যে ইস্যুগুলো জাতিসঙ্ঘে সবচে বেশি আলোচিত হয়েছে (যেমন মানবাধিকার), সেগুলো নিয়েও করা হয়েছে বিশেষ শ্রেণিবিভাগ।
চার্টবিট
চার্টবিট একটি অ্যানালিটিকস টুল, যা হাদ্দাদের মতে, নিউজরুম ও সাংবাদিকদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। এর মাধ্যমে পাঠকদের ওয়েবসাইট ব্যবহারের নানা খুঁটিনাটি বিষয় জানা যায়। যেমন, পাঠক একটি পেজের কতদূর পর্যন্ত পড়েছেন। এটি রিয়েল টাইম অ্যানালিটিকসও দেয়।
ডেটা সাংবাদিকরা পাঠকদের গতিবিধি বোঝার চেষ্টা করেন না ততটা। তবে হাদ্দাদ বলেছেন, এ ধরনের তথ্য গুরুত্বপূর্ণ এবং এখান থেকে অনেক কিছু বোঝা যায়। যেমন, জাতিসঙ্ঘে ভোট নিয়ে তৈরি প্রতিবেদনটির ক্ষেত্রে, “সাংবাদিকরা আমাকে বলেছিলেন, এখানে তথ্যের পরিমাণ অনেক বেশি। কিন্তু আমি অ্যানালিটিকসে দেখেছি: অনেক মানুষ প্রতিবেদনটি দেখেছেন ছয় মিনিট বা তারও বেশি সময় ধরে,” বলেছেন হাদ্দাদ। তাদের বেশিরভাগ প্রতিবেদনই মানুষ গড়ে দেখেছে তিন মিনিট সময় ধরে।
প্রতিবেদনের প্রভাব ও তাদের সময়োপযোগিতা বোঝার জন্য হাদ্দাদ ও তার দলের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে এই অ্যানালিটিকস।
হাদ্দাদ বলেছেন, “আমাদের কোনো প্রতিবেদন প্রকাশের পরপরই, আমি প্রথমে চার্টবিট খুলি। এবং খেয়াল করি, অন্য কোনো সংবাদমাধ্যম প্রতিবেদনটি নিয়ে কাজ করেছে কিনা, বা সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিবেদনটি নিয়ে কেমন প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। আগেকার দিনে, সংবাদপত্রের প্রকাশকরা তাদের ইচ্ছামতো প্রতিবেদন প্রকাশ করতেন, এবং সংবাদপত্র বিক্রির হিসেবে তাদের সাফল্য নির্ধারিত হতো। কিন্তু এখনকার সময়ে, আমরা প্রতি মুহূর্তে দেখতে পাই, পাঠক-দর্শক কোন প্রতিবেদনের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হচ্ছেন এবং কোনগুলো বেশি সময় নিয়ে পড়ছেন।”
চার্টবিট অবশ্য ফ্রি নয়, আপনাকে টাকা দিয়ে কিনতে হবে।
এরপর কী?
২০১০ সালের ডিসেম্বরে মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ আফ্রিকার বেশ কয়েকটি দেশে যে জনপ্রিয় অভ্যুত্থানগুলো হয়েছিল, তা পরিচিতি পেয়েছে আরব বসন্ত নামে। সেটি নিয়েই বিশেষ একটি স্মরণিকা তৈরি করেছেন হাদ্দাদ ও তাঁর দল। কাজটির জন্য তারা ব্যবহার করেছেন টুইটারের বিভিন্ন পোস্ট। শুধু স্মৃতিশক্তির উপর নির্ভর না করে তারা কাজ করেছেন টুইটার ডেটা নিয়ে।
হাদ্দাদ ব্যাখ্যা করে বলেছেন, “সাংবাদিক হিসেবে আমাদের কাজ মানুষকে তথ্য জানানো। যদি কোনো গল্পের পুরো একটি অধ্যায়ই আমাদের অজানা থেকে যায়, তাহলে আমরা আমাদের পাঠকের সঙ্গে সুবিচার করছি না।”
আরো পড়ুন
প্রিয় টুল ২০২০: সেরা সাংবাদিকরা যেসব টুল নিয়মিত ব্যবহার করেন
আল জাজিরা অ্যানালাইজড ৬,৫০০ হোমপেজ ইমেজ। হিয়ার ইজ হোয়াট দে লার্নড
সম্পাদকের বাছাই: ২০২০ সালে আরব বিশ্বের সেরা অনুসন্ধান
করিম শিহায়েব লেবাননের বৈরুত-ভিত্তিক একজন সাংবাদিক ও গবেষক। তিনি লেখালেখি করেন স্বাধীন সংবাদমাধ্যম, দ্য পাবলিক সোর্সের জন্য। তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছে নিউ ইয়র্ক টাইমস, মিডল ইস্ট আই ও বিজনেস ইনসাইডারে।