প্রবেশগম্যতা সেটিংস

লেখাপত্র

বিষয়

সহিংস অভ্যুত্থান পরবর্তী মিয়ানমারের ভেতর-বাইরে স্বাধীন গণমাধ্যমের পুর্নগঠন

আর্টিকেলটি পড়ুন এই ভাষায়:

English

independent media press freedom Myanmar

২০২১ সালের অভ্যুত্থানের পর স্বাধীনতা ও মিয়ানমারের ক্ষমতাচ্যুত বেসামরিক নেতা অং সান সুচির মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভকারীরা রাস্তায় মিছিল করেছিল। ছবি: শাটারস্টক

মিয়ানমারে রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থান তৃতীয় বছরে গড়াল। স্থানীয় সাংবাদিকেরা এখনো দেশটির অভ্যন্তরে ও ক্রমবর্ধমান অভিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে গণতন্ত্রের পক্ষে স্বাধীন গণমাধ্যমের কণ্ঠস্বর টিকিয়ে রাখা ও গড়ে তোলার সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন।

এটি নাগরিক সাংবাদিক, জনহিতৈষী সহায়তা প্রতিষ্ঠার, প্রচারণা ও প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা একটি আন্ডারগ্রাউন্ড নেটওয়ার্ক নির্ভর ইকোসিস্টেম, যা ক্রমেই বিকাশিত হচ্ছে। এটি তাতমাডাও সামরিক জান্তাদের সহিংস নিপীড়নের মুখে একধরনের দুরন্ত সাহসিকতাও বটে।

সামরিক বাহিনী পুরোনো ব্যবস্থা ভেঙে দিয়েছে।

বর্তমানে থাইল্যান্ডে পত্রিকা ও টিভি রিপোর্টার হিসেবে কর্মরত এক তরুণী বলেন, “আমি এই চাকরি ছাড়তে চাইনি। কিন্তু অভ্যুত্থানের পর থেকে সাংবাদিকেরা স্বাধীনভাবে প্রতিবেদন করতে পারেন না এবং নিজেদের ও আত্মীয়দের নিরাপত্তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকতে হয়। তাই আমাকে দেশ ছাড়তে হয়েছিল।”

২০২১ সালের পহেলা ফেব্রুয়ারি জেনারেল মিন অং হ্লাইং-এর নেতৃত্বে সংঘটিত সামরিক অভ্যুত্থানের শিকার হওয়া বিরোধী রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, সমাজকর্মী ও উন্নয়ন কর্মীদের সঙ্গে অন্যান্যদের মধ্যে প্রথম সারিতে ছিল সাংবাদিক সমাজ। তখন থেকে দু’বছরে স্থানীয় গণমাধ্যমে বা ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কর্মরত চারজন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন এবং ১৪৫ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন। প্রায় ৬০ জনকে গৃহবন্দী করা হয়েছে।

গত দশকে দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়া গণতান্ত্রিক গণমাধ্যমের নেটওয়ার্ক কার্যকরভাবে ভেঙে দিয়েছে এই অভ্যুত্থান। সেই সঙ্গে জনসংখ্যার হিসেবে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সাংবাদিকদের জন্য বিশ্বের বৃহত্তম কারাগারে পরিণত হয়েছে, আর কমিটি ফর দ্য প্রোটেকশন অব জার্নালিস্টস সাংবাদিকদের কারাবন্দীর জন্য মিয়ানমারকে বিশ্বের তৃতীয়-নিকৃষ্ট দেশ হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে।

গণমাধ্যমের কর্মপরিধি নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনীর প্রচেষ্টাও বাড়তে থাকা স্বাধীন গণমাধ্যম সংস্থা ও কন্টেন্ট নির্মাণের পথে বাধা হতে পারেনি। এ সময় রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমের জনপ্রিয়তায়ও ভাটা পড়েছে।

অভ্যুত্থানের দু’বছর পর পাঠকশ্রোতাদের আস্থার শীর্ষে চারটি গণমাধ্যম হলো: বিবিসি বার্মিজ, মিজিমা, ডেমোক্র্যাটিক ভয়েস অব বার্মা (ডিভিবি), এবং ভয়েস অব আমেরিকা (ভিওএ)।

বিশেষ করে মিয়ানমারে ডিজিটাল বিজ্ঞাপনের মূল্য ধ্বস নিয়েই যত বিপত্তি। এতে পাঠক-নির্ভর আয় কমে গেছে। অনলাইনে দশ লক্ষ অ্যাড ভিউয়ে এখানে গণমাধ্যম সংস্থাগুলোর আয় যেখানে ১০ মার্কিন ডলার, সেখানে ইউরোপে ৫৭০ মার্কিন ডলার ও থাইল্যান্ডে ১৩০ মার্কিন ডলার।

মিয়ানমারে মেটার প্ল্যাটফর্মগুলো নিষিদ্ধ হওয়ায় সামাজিক মাধ্যমে গণমাধ্যমের সম্প্রসারণ এখানে সীমিত। এখন দেশটিতে কেবলমাত্র ভিপিএন সুবিধাসম্পন্ন অর্ধেক ইন্টারনেট ব্যবহারকারী মেটা ব্যবহার করতে পারেন। নিউজ কনসাল্টিং গ্রুপের একটি জরিপ অনুসারে, মিয়ানমারে মেটা ব্যবহারকারীদের মাত্র এক তৃতীয়াংশ সংবাদের প্রধান উৎস হিসেবে সক্রিয়ভাবে ফেসবুক ব্যবহার করেন।

কেন্দ্রীয়ভাবে মিয়ানমার নিয়ে সংবাদ তৈরিতে নিয়োজিত একটি স্থানীয় গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠাতার অভিযোগ, “আমরা যে একটি যুদ্ধ নিয়ে কাজ করছি, তা ফেসবুক বুঝে না, তাই তারা সব সময় আমাদের অ্যাকাউন্টগুলোকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ পেজ’ হিসেবে শ্রেণীভুক্ত করে, এখানেই ফেসবুকের সঙ্গে আমাদের ঝামেলা।” “তবে সহিংস কর্মকাণ্ডের ভিডিও প্রকাশ পেলে বড় গণমাধ্যমগুলো নয়, কেবল স্থানীয় গণমাধ্যমগুলোই স্থানীয় আইন লঙ্ঘনের শাস্তি পেয়ে থাকে। তারা আমাদের পাঠক-শ্রোতাদের ব্লক করে রাখে, তাই আমাদের দশ লক্ষ ফলোয়ার থাকলেও একেকটি পোস্ট মাত্র ১,০০০ জনের নাগাল পায়।”

স্বাধীন গণমাধ্যমগুলোর জন্য সাবস্ক্রিপশন, বিজ্ঞাপন ও অনুষ্ঠান আয়োজনের স্বাভাবিক আয়ের কাঠামো ব্যবহারের উপায় না থাকায় বেশিরভাগই টিকে থাকতে জনহিতৈষী অনুদানের দিকে ঝুঁকেছে।

এটি প্রধানত ইংরেজি-ভাষার জাতীয় গণমাধ্যম এবং মিয়ানমারের স্থানীয় ভাষার দুর্বল গণমাধ্যমগুলোর মধ্যে একটি ভারসাম্যহীন পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। এসব স্থানীয় গণমাধ্যমে  সম্পদ, হিসাবরক্ষণ বা মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা কর্মীরও সংকট রয়েছে। স্থানীয়ভাবে তহবিল স্থানান্তরে বিলম্বের কারণে অনুদান নির্ভর প্রতিবেদকদেরও আয়ের জন্য অসুবিধায় পড়তে হচ্ছে।

একজন স্থানীয় সম্পাদক বলেছেন, “আমরা স্টোরি লিখতে জানি, তবে প্রস্তাব বা অনুদান ফর্ম লেখার কায়দা কানুন জানি না। আমাদের ইংরেজি দক্ষতা আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর চাহিদা পূরণে যথেষ্ট নয়, তাই আমরা বড় বড় জাতীয় গণমাধ্যমগুলোর তুলনায় কম আর্থিক সহায়তা পেয়ে থাকি।”

বেশিরভাগ স্বাধীন গণমাধ্যম গোপনে বা বিদেশ থেকে, প্রধানত থাইল্যান্ড, বাংলাদেশ ও ভারত থেকে কাজ করতে বাধ্য হয়েছে। অভ্যুত্থানের পর থেকে দেশটির অন্তত এক হাজার সাংবাদিক নির্বাসিত জীবনযাপন করছেন বলে ধারণা করা হয়, যাঁদের এক তৃতীয়াংশ থাইল্যান্ডে। সেখানে বেশিরভাগ সময় তাঁদেরকে পেশাগত বা শিক্ষার সুবিধা নিশ্চিত করার মত শরণার্থী সুরক্ষা বা আইনি মর্যাদা ছাড়াই থাকতে হয়। মিয়ানমারে তাঁদের সম্পদের ওপর এখনও বাজেয়াপ্ত ও উচ্ছেদের হুমকি আছে এবং তাঁদের আত্মীয় স্বজন জিম্মি হওয়ার ঝুঁকিতে আছেন, ফলে বাধ্য হয়ে তাঁরা মুখ বন্ধ রাখেন।

এই “এক পা ভেতরে, আরেক পা বাইরে” মডেল একটি বড় ঝুঁকি। তা সত্ত্বেও মিয়ানমারের সাংবাদিকেরা তাঁদের জনগোষ্ঠীর জন্য তথ্যপ্রবাহের দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। আর দেশ থেকে স্থানীয় গণমাধ্যমগুলো গুরুত্বপূর্ণ যোগসূত্রের যোগান দিয়ে যাচ্ছে।

“স্থানীয় গণমাধ্যমগুলো বছরের পর বছর ধরে সোর্সের খুব নির্ভরযোগ্য একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে: তারা আমাদের বন্ধু, আত্মীয়, প্রতিবেশী,” একজন স্থানীয় সম্পাদক ব্যাখ্যা করেছেন। “এমনকি প্রবাসভিত্তিক গণমাধ্যমগুলো এখনও দেশের ভেতরে সোর্সের নাগাল পেতে এই নেটওয়ার্ক ব্যবহার করতে পারেন।”

তবে তাঁরা আরও বেশি ঝুঁকির মুখে থাকেন, আর জাতীয় বা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের অনাকাঙ্খিত উন্মোচন থেকে সেই সোর্সদের রক্ষার দায়িত্বও আছে।

শত শত প্রশিক্ষক মোবাইল রিপোর্টিং, অনুসন্ধান, ডিজিটাল সুরক্ষা ও ফিচার লেখায় অনলাইনে ও সশরীরে সক্ষমতা-তৈরির প্রশিক্ষণ সেশন পরিচালনা করেন। মিয়ানমার উইটনেস বা দ্য সেন্টার ফর ল অ্যান্ড ডেমোক্রেসির মতো সংস্থাগুলো নাগরিক সাংবাদিক ও পেশাদার সাংবাদিকদের আন্তর্জাতিক আদালতের মামলায় ব্যবহারোপযোগী যুদ্ধাপরাধের প্রমাণ সংগ্রহের প্রশিক্ষণ দেয়।

বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন হলেও নতুন বিতরণ ব্যবস্থা ব্যবহৃত হচ্ছে এবং বিকশিত হচ্ছে, যেমন এসএমএস, নিউজলেটার ও পডকাস্ট৷ 

এর একটি অন্যতম দৃষ্টান্ত হলো, ২০০১ সাল থেকে চলে আসা বাংলাদেশভিত্তিক প্রথম রোহিঙ্গা সংবাদ সংস্থা কালাদান মিডিয়া। বার্মা নিউজ ইন্টারন্যাশনাল (বিএনআই) এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এই সংবাদ সংস্থা। ভারত, বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডে নির্বাসিত বার্মিজ সাংবাদিকদের নেতৃত্বে ১৫টি স্বাধীন গণমাধ্যম গোষ্ঠীর এই নেটওয়ার্কের যাত্রা শুরু হয় ২০০৩ সালে।

“বার্মার আর্মির ইসলাম বিষয়ক ভীতিকর ব্যাখ্যাকে আমরা নিয়মিত চ্যালেঞ্জ জানিয়ে আসছি, পর্যবেক্ষণ ও অনুসন্ধান করছি। মিয়ানমারে মুসলিম বিরোধী সহিংসতা চলাকালে আমাদের ওয়েবসাইট ছয় মাসের জন্য হ্যাক হয়েছিল এবং কিছু ব্যবহারকারীর অযাচিত রিপোর্টের কারণে আমাদের ফেসবুকে অসংখ্যবার ব্লক হতে হয়েছিল। আমাদের সমর্থকেরা সহজে ইন্টারনেট সুবিধা পান না, তাই আমরা একটি ৩০ মিনিটের দৈনিক সংবাদ বুলেটিন চালু করেছি, যা লাউডস্পিকারের মাধ্যমে শরণার্থী শিবিরের কমিউনাল সভাস্থলে সম্প্রচার করা হয়,” কালাদান প্রেস নেটওয়ার্কের প্রধান সম্পাদক টিন সোয়ে ব্যাখ্যা করেন।

ফ্রন্টিয়ার মায়ানমার দো আথান (“আমাদের কণ্ঠস্বর”) অনুষ্ঠানটি চালিয়ে যাচ্ছে এবং ইরাবদি অঞ্চলের জন্য ডেল্টা নিউজ এজেন্সির মত স্থানীয় গণমাধ্যম এবং সাগাইং ও ম্যাগওয়ে অঞ্চলের জন্য মিয়ালাট আথান পডকাস্ট ও সাপ্তাহিক টিভি শো চালু করেছে।

মিয়ালাট আথানের প্রতিনিধি বলেছেন, “আমাদের তিনটি পডকাস্ট রয়েছে, একটি সংবাদ বিষয়ক, একটি স্বাস্থ্যসেবা, আর একটিকে বলা হয় ‘লেটার ফ্রম পিপল ডিফেন্স ফোর্সেস।’ আমরা গণতন্ত্রপন্থী যোদ্ধাদের আত্মীয় বা বান্ধবীদেরকে লেখা তাঁদের চিঠি অন-এয়ারে পড়ছি। এই চমৎকার কাঠামো ব্যবহার করে আমরা লোকচক্ষুর আড়ালে সবার থেকে বিচ্ছিন্ন মানুষগুলোর সঙ্গে তাঁদের কাছের মানুষদের যোগাযোগের পথ করে দেই।”

ইস্ট-ওয়েস্ট সেন্টারের খণ্ডকালীন ফেলো ডঃ মিমি উইন বায়ার্ড জোর দিয়ে বলেন: “একটি সফল বিপ্লবের অন্তত ৭৫%-ই হলো যোগাযোগ। সৈন্যদের দলত্যাগকে পদ্ধতিগতভাবে দেখা, জনগণের সমর্থনের দিকে মনোনিবেশ এবং আন্তর্জাতিক স্বার্থ বজায় রাখার বিষয়গুলোকে আমি মিয়ানমারের প্রেক্ষাপটে সাফল্যের পথ হিসেবে দেখছি।”

বার্মিজ গণমাধ্যমের শিক্ষার্থী ও আন্তর্জাতিক সৃজনশীল ব্যক্তিদের অভ্যুত্থানের পর দক্ষতা ও জাতীয়তার মধ্যে সেতু বন্ধন তৈরির উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে ভিজ্যুয়াল রেবেলিয়ন মিয়ানমারের নামের সংঘবদ্ধ দলটি যৌথভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল [সম্পাদকের নোট: এই অংশের লেখক সহ।] মায়ানমারের ভেতরে ও বিশ্বজুড়ে সাংবাদিক ও শিল্পীদের একটি সংবাদমাধ্যম যৌথভাবে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে অভ্যুত্থানের প্রভাব নিয়ে ইন-ডেপথ ফিচার, গবেষণা প্রতিবেদন, ছবির গল্প ও তথ্যচিত্র নির্মাণ করে। তাদের সেরা কিছু কন্টেন্টকে অন্যান্য ভাষায় রূপান্তরিত ও অনুবাদ করা হয়েছে, যেমন ফরাসি অনুসন্ধানী সংবাদমাধ্যম মিডিয়াপার্টের জন্য বানানো একটি ধারাবাহিক।

ভিজ্যুয়াল রেবেলিয়ন, স্টোরির বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ সামনে আনতে বদ্ধ পরিকর যেখানে মানুষ কেবল ভাগ্যের শিকার নন, বরং ভাগ্য পরিবর্তনকারী। এগুলোর মধ্যে রয়েছে থাইল্যান্ডে মিয়ানমারের অভিবাসী শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ করা, কক্সবাজার শরণার্থী শিবিরে রোহিঙ্গাদের নিয়ে একটি ফটো ম্যাগাজিন বানানো, সম্মুখ সারির সংগ্রামরত নারী এবং অভ্যুত্থানের ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সঙ্কটে টিকে থাকতে তৃণমূলের মানুষদের মানিয়ে নেয়ার প্রক্রিয়া

সমতট এলাকার কেন্দ্রস্থলে এক বছর ধরে সামরিক বাহিনীর পোড়া-মাটি অভিযানের পর স্থানীয় দলটির এক সদস্য বলেছেন: “আমি আর মৃতদেহ ও পোড়া গ্রাম নিয়ে লিখতে পারি না, কারণ এটি বারবার ভয়াবহতা ফিরিয়ে আনে, জান্তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড তুলে ধরে যা মানুষের মনোবলে জোরেশোরে ধাক্কা দেয়, সেই সঙ্গে আমার মানসিক স্বাস্থ্যে বড় ধরনের প্রভাব ফেলে; কারণ আমি শৈশব থেকেই খুব ভালভাবে ভুক্তভোগী এলাকা ও এলাকাবাসীদের সম্পর্কে জানি। গল্প বলার অন্য উপায় আমাদের খুঁজে বের করতে হবে।”

বার্মিজ গণমাধ্যমের প্রকাশিত ৭৫% স্টোরি অভ্যুত্থান বা যুদ্ধ বিষয়ক বলে মনে হওয়ায় বেশ কয়েকটি দর্শক জরিপে “অভ্যুত্থানের একঘেয়েমি” এর বাস্তবতা উঠে আসে। মানুষ বরং দ্রব্যমূল্য, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও কৃষি নিয়ে পড়তে চায়, সেই সঙ্গে জানতে চায় আবহাওয়া, উদ্বাস্তু এবং ব্যবসায়িক ও আন্তর্জাতিক বিষয়ক স্টোরি।

সম্মুখ সারিতে স্থানীয় সাংবাদিক

বেশিরভাগ আন্তর্জাতিক ও জাতীয় গণমাধ্যম তাদের কর্মীদের মিয়ানমার থেকে সরিয়ে আনায় তারা তৃণমূলের তথ্যের জন্য নাগরিক প্রতিবেদকদের ওপর নির্ভর করে। তাঁরা বিনামূল্যে বা সামান্য অর্থের বিনিময়ে ফোন থেকে তথ্য, ছবি এবং ভিডিও পাঠান।

বিষয়টি মিয়ানমারের গণমাধ্যম সংশ্লিষ্টদের মধ্যে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে প্রায়ই নিরাপদে বিদেশে আশ্রয় নেয়া ব্যবস্থাপনা-স্তরের সম্পাদক এবং অনিশ্চিত বাস্তবতায় টিকে থাকতে মরিয়া তৃণমূলের তরুণ প্রতিবেদকদের মাঝে একটি বিভাজন রেখা টেনে দেয়। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম প্রায়ই বিনামূল্যে স্থানীয় গণমাধ্যমের সংগৃহীত কন্টেন্ট ব্যবহার করে থাকে।

সেন্টার ফর ল অ্যান্ড ডেমোক্রেসির নির্বাহী পরিচালক টবি মেন্ডেল বলেছেন, “অ-পেশাদার গণমাধ্যম কর্মীদের ওপর আস্থা রাখায় একটি বড় ঝুঁকি থাকে: তাঁরা আবেগ সামলাতে হিমশিম খান, নিম্নমানের ছবি তোলেন, সেগুলো সব গণমাধ্যমে পাঠান আর তারপর কপিরাইট সমস্যার মুখে পড়েন, অনেকে সোর্সের নাম অনলাইনে প্রকাশ করেন এবং বেশিরভাগই নির্ভুলতা যাচাই করার মতো যথেষ্ট প্রশিক্ষিত নন।” তিনি বলেন, “পেশাদার সাংবাদিকতা বজায় রাখতে ডিজিটাল, শারীরিক, মানসিক-সামাজিক ও আইনি নিরাপত্তা একটি পূর্বশর্ত এবং যথাযথ টুল ছাড়া স্থানীয় নাগরিকেরা এই ঘাটতি পূরণ করতে পারেন না।”

অভ্যুত্থান-পরবর্তী তথ্য ঘাটতির ফলে গণমাধ্যমের (বিজ্ঞাপন) হার হ্রাস পেয়েছে এবং এখনও দেশে অবস্থানরত পেশাদার প্রতিবেদকদেরকে এখন নাগরিক প্রতিবেদকদের সমপরিমাণ মজুরি দেওয়া হয়। ন্যায্য মজুরি ও সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা পেতে গণমাধ্যম কর্মীদের দেনদরবারের সামর্থ্য ও শিল্পখাতকেন্দ্রিক সংগঠনের ঘাটতি রয়েছে, যা নিয়ে আন্তর্জাতিক সাংবাদিক ফেডারেশনের অ্যান্টি-থেফ্ট ওয়েজ ক্যাম্পেইনে নিন্দা জানানো হয়েছে।

এই বিভাজন অভ্যন্তরীণ অবিশ্বাস উস্কে দেয়। থাই-মিয়ানমার সীমান্তবর্তী শহরে আত্মগোপনে থাকা এক স্থানীয় গণমাধ্যম সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা বলেন: “সামরিক জান্তাদের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত শব্দগুলো ব্যবহার করে আমরা সামরিক প্রচারণার সঙ্গে জড়িত অ্যাকাউন্টগুলো সনাক্তের চেষ্টা করি। আমরা আরও জানি, কিছু ‘সাংবাদিক’ নির্বাসিত প্রকৃত প্রতিবেদকদের ব্যাপারে গুপ্তচরবৃত্তি করতে এবং মিয়ানমারে ফিরে গিয়ে সামরিক বাহিনীকে জানানোর উদ্দেশ্য নিয়ে থাইল্যান্ডের সীমান্তবর্তী শহরে আসে। এমনকি সামরিক-পন্থী সংবাদপত্রের জন্য কর্মরত কিছু সাংবাদিককে আজকাল স্বাধীন গণমাধ্যম সংস্থাগুলো নিয়োগ দিয়ে থাকে, কারণ এসব ক্ষেত্রে অতীত যাচাই ও ছাড়পত্র দেয়ার কোনো প্রক্রিয়া নেই। যে কেউ এখন [ফেসবুক] মেসেঞ্জারে কিছু ছবি ও ফুটেজ পাঠিয়ে এবং দুই সপ্তাহের নাগরিক সাংবিাদিকতা প্রশিক্ষণে অংশ নেওয়ার অভিজ্ঞতা দেখিয়ে গণমাধ্যমে কাজের জন্য আবেদন করতে পারেন।”

নির্বাসিত একদল প্রতিবেদক স্বাধীন গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নতুন আচরণবিধি তৈরি, ব্যবসা বা বার্মিজ সামরিক বাহিনী বা বিরোধী শক্তির শৃঙ্খল থেকে মুক্ত থাকার লক্ষ্য নিয়ে একটি পরামর্শমূলক প্রক্রিয়া চালু করেছেন। তাঁরা ভবিষ্যতের সংবিধানে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সাংবাদিকতা সুরক্ষা সম্পর্কিত একটি ধারা যুক্ত করতে একটি ফেডারেল ডেমোক্রেসি চার্টার তৈরির দায়িত্বে থাকা সংস্থার কাছেও তদবির করেছে।

চলমান সংঘাত থেকে যে রাজনৈতিক পরিস্থিতিরই উদ্ভব হোক না কেন, সাংবাদিক সমাজ ইতিমধ্যেই স্ব-নিয়ন্ত্রণের নীতি বাস্তবায়ন, মালিকানা কাঠামো পুনর্বিবেচনা এবং লিঙ্গ ও জাতিগত বৈচিত্র্যের অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে জোর দিয়ে সুস্থ বিতর্কে অংশ নিয়েছে। মিয়ানমারের গণমাধ্যমের জন্য দেশজুড়ে চলমান তথ্য যুদ্ধ থেকে বাঁচার উপায় হলো বাহ্যিক সমর্থন ও অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির মধ্যে ভারসাম্য।

এই স্টোরি প্রথম প্রকাশিত হয় ইন্টারন্যাশনাল প্রেস ইন্সটিটিউটে (আইপিআই)। ক্রিয়েটিভ কমন্স লাইসেন্সের আওতায় এখানে পুনঃপ্রকাশ করা হলো। রচনাশৈলীর স্বার্থে সামান্য সম্পাদনা করা হয়েছে। মূল স্টোরি পড়তে পারেন এখানে

আরও পড়ুন

অ্যামিড আ প্রেস ক্র্যাকডাউন ইন মিয়ানমার, ওয়ান নিউজ সাইট সার্ভাইভস অন রিডার রেভিনিউ

উইল মিয়ানমার’স প্রেস ক্র্যাকডাউন মাজল রিপোর্টিং অন এনভায়রনমেন্টাল ক্রাইমস?

‘রিপোর্টিং ফ্রম দ্য আউটসাইড’: লেসনস ফ্রম ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস ইন এক্সাইল


IPI logoলরা সিগেল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ভিত্তিক একজন রিপোর্টার এবং বার্মিজ সাংবাদিক, আলোকচিত্রী, চলচ্চিত্র নির্মাতা ও শিল্পীদের কাজ প্রকাশের সাইট ভিজ্যুয়াল রেবেলিয়নের প্রতিষ্ঠাতা। ২০২১ সালের অভ্যুত্থানের প্রেক্ষিতে সাইটটি তৈরি করা হয়েছিল। সিগেল ফরাসি সংগঠন মিডিয়াপার্টের প্রতিবেদক এবং নিক্কেই এশিয়া ও ফরাসি-জার্মান পাবলিক টিভি চ্যানেল আর্তের হয়ে কাজ করেছেন।

ক্রিয়েটিভ কমন্স লাইসেন্সের অধীনে আমাদের লেখা বিনামূল্যে অনলাইন বা প্রিন্টে প্রকাশযোগ্য

লেখাটি পুনঃপ্রকাশ করুন


Material from GIJN’s website is generally available for republication under a Creative Commons Attribution-NonCommercial 4.0 International license. Images usually are published under a different license, so we advise you to use alternatives or contact us regarding permission. Here are our full terms for republication. You must credit the author, link to the original story, and name GIJN as the first publisher. For any queries or to send us a courtesy republication note, write to hello@gijn.org.

পরবর্তী

পরামর্শ ও টুল সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা

সেন্সরশিপ এড়াতে ইন্টারনেটে যেভাবে বেনামে বিচরণ করবেন

ইন্টারনেট সেন্সরশিপ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারগুলো যেমন প্রতিনিয়ত পদ্ধতি ও টুল বদলাচ্ছে, তেমনি একইভাবে বদলাচ্ছে সেন্সরশিপ ও ট্র্যাকিং এড়ানোর কৌশলও। অনলাইনে বেনামে বিচরণের জন্য এখন পাওয়া যায় ভিপিএন ও প্রাইভেসি-কেন্দ্রিক সার্চ ইঞ্জিনসহ কার্যকরী অনেক টুল ও সফটওয়্যার। জেনে রাখুন, কীভাবে নিরাপদে ও বেনামে ইন্টারনেটে বিচরণ করবেন এবং সেন্সরশিপ এড়িয়ে চলবেন।

সংবাদ ও বিশ্লেষণ সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সুরক্ষা ও নিরাপত্তা

ফোন ডেটা সংগ্রহের ফরেনসিক টুল যখন সাংবাদিক নিপীড়নের নতুন ক্ষেত্র  

কোনো সাংবাদিকের ব্যাপারে তদন্তে নেমে ফোন ও কম্পিউটার জব্দ করা সরকারী সংস্থাগুলোর জন্য মোটেও নতুন কিছু নয় – বরং, এটি একটি নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু ফোন ও ডিভাইস থেকে সংগ্রহ করা তথ্য অনেক ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে, যা সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্যেও ক্রমেই হুমকি হয়ে উঠছে। পড়ুন, বিষয়টি নিয়ে সিপিজের বিশ্লেষণ।

Laptop with bomb and bullseye target keys

সংবাদ ও বিশ্লেষণ সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা

স্বাধীন গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধের প্রধান অস্ত্র ডিজিটাল হামলা

ডিজিটালাইজেশনের ফলে স্বাধীন সংবাদমাধ্যমগুলো এখন আরও বেশি পাঠক-দর্শকের কাছে পৌঁছাতে পারে। কিন্তু একই সঙ্গে এটি অনেক চ্যালেঞ্জ ও দূর্বলতাও তৈরি করেছে এসব স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের জন্য। কারণ প্রায়ই তাদের কণ্ঠরোধের জন্য প্রয়োগ করা হয় নানাবিধ ডিজিটাল হামলার কৌশল। অনেক ক্ষেত্রেই যেসব হামলার নেতৃত্বে থাকে বিভিন্ন দেশের সরকার। সংবাদমাধ্যম সংশ্লিষ্ট ডিজিটাল পরিবেশ নিয়ে এমন কিছু উদ্বেগজনক প্রবণতার কথা উঠে এসেছে এই লেখায়।

World Press Freedom Day 2022, UNESCO

সংবাদ ও বিশ্লেষণ সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা

বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস: সাংবাদিকতা যখন ক্রমবর্ধমান ডিজিটাল ও শারীরিক হুমকির শিকার

গণতন্ত্রের মতো গণমাধ্যমের স্বাধীনতা পরিস্থিতিও পৌঁছেছে এই শতকের সবচেয়ে শোচনীয় অবস্থায়, আর সাংবাদিকদের ওপর হামলা এবং নজরদারিও ঠেকেছে সর্বোচ্চ পর্যায়ে। গত ৩রা মে মুক্ত গণমাধ্যম দিবস উপলক্ষ্যে আয়োজিত আলোচনায় এসব দমনমূলক পরিস্থিতির কথাই উঠে এসেছে বেশি করে। তবে এতো কিছুর মধ্যেও হাল না ছেড়ে সাহসীকতার সঙ্গে রিপোর্টিং চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকারও করেছেন সাংবাদিকরা।