ভূগোলের ডিপফেইক: যেভাবে ভুয়া স্যাটেলাইট ছবি ধরে ফেলছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা
আর্টিকেলটি পড়ুন এই ভাষায়:
নিউ ইয়র্কের সেন্ট্রাল পার্কে, একটি আগুনের ঘটনার স্যাটেলাইট ছবিতে দেখা যাচ্ছে ধোঁয়ার কুণ্ডলী। ভারতে দীপাবলির রাতে বর্ণিল স্যাটেলাইট ছবি দেখে মনে হয়, সেখানে অনেক বড় জায়গাজুড়ে আতশবাজি ফোটানো হচ্ছে।
কিন্তু দুটি ছবিই ভুয়া। ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি পরিচালিত নতুন একটি গবেষণায় যেটিকে উল্লেখ করা হয়েছে “লোকেশন স্পুফিং” বলে। ভুয়া এই ছবিগুলো ভিন্ন ভিন্ন মানুষ তৈরি করেছে, ভিন্ন ভিন্ন উদ্দেশ্যে। কিন্তু এগুলো একটি সত্যিকারের জায়গার একদম আসল ছবি বলে মনে হবে। এবং বর্তমানে যে ধরনের উন্নত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রযুক্তি আছে, তাতে এই ধরনের “ডিপফেইক জিওগ্রাফি” ভবিষ্যতে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে সতর্ক করেছেন গবেষকেরা।
অন্যান্য অডিও ও ভিডিও ফাইলে কারসাজি শনাক্ত করার যে পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করা হয়, সেগুলো কাজে লাগিয়ে গবেষকেরা এসব ভুয়া স্যাটেলাইট ছবি শনাক্ত করার নতুন পদ্ধতি বের করেছেন। তাঁরা তিনটি শহরের স্যাটেলাইট ছবির ওপর গবেষণা চালিয়ে দেখেছেন, কীভাবে এসব ভুয়া ছবি তৈরি করা হয়; এবং সবাইকে সতর্ক করেছেন এমন ভুয়া জিওস্পেশাল ডেটা সম্পর্কে। আহ্বান জানিয়েছেন এ ধরনের ভূতাত্ত্বিক তথ্য যাচাই ব্যবস্থা গড়ে তোলার।
“এটি শুধু ফটোশপ করার ব্যাপার নয়, এখানে ডেটাগুলোকে আশ্চর্যজনকভাবে বাস্তব করে তোলা হয়। এই পদ্ধতিগুলো এখনই আছে। আমরা শুধু এই পদ্ধতিগুলো কীভাবে ব্যবহার হতে পারে, তা তুলে ধরছি। এবং এটিকে মোকাবিলা করার কৌশল খুঁজে বের করার প্রয়োজনীয়তার কথা বলছি,” বলেছেন বো জাও। ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির ভূতত্ত্ব বিভাগের এই সহযোগী অধ্যাপক গবেষণাটির প্রধান লেখক ছিলেন। কার্টোগ্রাফি অ্যান্ড ইনফরমেশন সায়েন্স জার্নালে এটি প্রকাশিত হয়েছে গত ২১ এপ্রিল।
এখানে জাও এবং তাঁর অন্য সহ-লেখকেরা উল্লেখ করেছেন যে, মানচিত্র তৈরির সময় নানান ভুলত্রুটি এবং ভুয়া অবস্থান বসানোর প্রবণতা দেখা যায় প্রাচীনকাল থেকে। কারণ, তখন কোনো জায়গাকে মানচিত্রে তুলে আনার সময় অনেক ভুলভ্রান্তি ঘটত। কোনো মানচিত্রেই হুবহু সেই জায়গার চিত্র তুলে আনা যেত না।
তবে ম্যাপমেকার, অর্থাৎ মানচিত্র-নির্মাতারা ইচ্ছে করেও কিছু ভুলত্রুটি ঢুকিয়ে দিয়েছেন মানচিত্রগুলোতে। “পেপার টাউন” বা “কাগজের শহর” প্রত্যয়টি দিয়ে এ ধরনের ভুয়া শহর, পাহাড়, নদী ইত্যাদি বোঝানো হয়। ম্যাপমেকাররা এটি করতেন যেন কেউ তাঁদের কাজটি কপি করে নিজের বলে চালিয়ে দিতে না পারে। [অন্য কারও মানচিত্রে সেই ভুয়া ল্যান্ডমার্ক দেখলেই তাঁরা বুঝে যেতেন যে, কেউ তাঁদের কাজ নকল করেছে।] এ ধরনের ঘটনার একটি মজার উদাহরণ দেওয়া যাক। ১৯৭০-এর দশকে মিশিগান ডিপার্টমেন্ট অব ট্রান্সপোর্টের হাইওয়ে মানচিত্রে যোগ করা হয়েছিল দুটি কল্পিত শহর: “বিটওসু” ও “গোবলু”। [বিটওসু দিয়ে বোঝানো হয়: বিট ওএসইউ (ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটি) এবং গোবলু দিয়ে বোঝানো হয়: গো ব্লু (যেটি কিনা মিশিগান ইউনিভার্সিটির স্লোগান)।] ট্রান্সপোর্ট ডিপার্টমেন্টের তৎকালীন প্রধান এই কল্পিত শহর দুটি যোগ করেছিলেন; কারণ, এর মধ্য দিয়ে একই সঙ্গে তিনি নিজের সাবেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতি সমর্থন জুগিয়েছেন এবং মানচিত্রটির কপিরাইট রক্ষা করেছেন।
কিন্তু জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সিস্টেম (ভূতাত্ত্বিক তথ্যব্যবস্থা), গুগল আর্থ ও অন্যান্য স্যাটেলাইট ইমেজিং ব্যবস্থা গড়ে ওঠার ফলে এখন মানচিত্রে কারসাজি করতে অনেক উন্নত মানের প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে, এবং এতে ঝুঁকিও থাকছে অনেক বেশি। ২০১৯ সালে, ন্যাশনাল জিওস্পেশাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির পরিচালক বলেছিলেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে কারসাজি করা স্যাটেলাইট ছবিগুলো ভবিষ্যতে জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে গুরুতর হুমকি হয়ে উঠতে পারে। এই এজেন্সিই যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়কে মানচিত্র ও স্যাটেলাইট ছবি সরবরাহ ও বিশ্লেষণের কাজে সাহায্য করে।
কীভাবে এই স্যাটেলাইট ছবিগুলোতে কারসাজি করে ভুয়া ছবি তৈরি করা হয়, তা বোঝার জন্য জাও এবং তাঁর দল একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ফ্রেমওয়ার্কের সাহায্য নিয়েছেন, যেটি অন্যান্য ডিজিটাল ফাইল (যেমন অডিও, ভিডিও) কারসাজিতেও ব্যবহার করা হয়। মানচিত্রের ক্ষেত্রে এটিকে প্রয়োগ করলে, অ্যালগরিদমটি একসময় শিখে যায়: একটি শহুরে অঞ্চলের স্যাটেলাইট ছবির বৈশিষ্ট্য কেমন হবে। এরপর সে এই বৈশিষ্ট্যগুলো অন্য একটি মানচিত্রের ওপর প্রয়োগ করে। জনপ্রিয় ইমেজ ফিল্টারগুলো যেভাবে মানুষের মুখের ওপর বিড়ালের মুখ যুক্ত করে দেয়; স্যাটেলাইট ছবি কারসাজির ক্ষেত্রেও ঠিক তেমন কাজই করা হয়।
অ্যালগরিদমটিকে স্যাটেলাইট ছবির বৈশিষ্ট্যগুলো চিনিয়ে দেওয়ার পর, গবেষকেরা তিনটি শহরের স্যাটেলাইট ছবি ও মানচিত্র এক জায়গায় করেছেন: ওয়াশিংটন স্টেটের টাকোমা ও সিয়াটল এবং চীনের রাজধানী বেইজিং। এখানে তাঁরা শহরগুলোর বৈশিষ্ট্য তুলনা করে দেখেছেন। এবং দুই শহরের মিলিত বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে তৃতীয় শহরটির নতুন ছবি তৈরি করেছেন। টাকোমাকে তাঁরা তাঁদের “বেজ ম্যাপ” হিসেবে ডিজাইন করেছিলেন এবং তার ওপরে সিয়াটল ও বেইজিংয়ের ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যগুলো জুড়ে দিয়ে তৈরি করেছিলেন টাকোমার ডিপফেইক স্যাটেলাইট ছবি।
নিচের এই উদাহরণে টাকোমা শহরের একটি অঞ্চল দেখা যাচ্ছে ম্যাপিং সফটওয়্যারে (ওপরে, বামে)। এবং সেই জায়গারই একটি স্যাটেলাইট ছবি দেখা যাচ্ছে (ওপরে, ডানে)। নিচের দুটি ছবিতে সেই একই স্যাটেলাইট ছবির ডিপফেইক তৈরি করা হয়েছে সিয়াটল ও বেইজিং শহরের বৈশিষ্ট্য অনুসরণ করে। নিচু নিচু ভবন ও সবুজে ঘেরা টাকোমা শহরের সিয়াটল সংস্করণ দেখা যাচ্ছে নিচে, বামে। এবং বেইজিংয়ের উঁচু উঁচু ভবনের আদলে তৈরি টাকোমা শহরের চিত্র দেখা যাচ্ছে নিচে, ডানে। উঁচু ভবনের কারণে ছায়া তৈরি হয় বলে সেই বৈশিষ্ট্যও এখানে তুলে এনেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সফটওয়্যার। ফলে নিচে, ডানের ছবিতে কিছুটা অন্ধকার ভাব আছে। তবে, এজাতীয় ভিন্নতা ছাড়া, সব ছবিরই রাস্তা ও দালানগুলোর অবস্থান হুবহু একই আছে।
গবেষকেরা এটিও উল্লেখ করেছেন যে, এসব ক্ষেত্রে জানাশোনা বা প্রশিক্ষণ না থাকলে, অনেক সময়ই এই সত্য-মিথ্যার পার্থক্য শনাক্ত করা মুশকিল হয়ে যায়। সাধারণ কোনো দর্শক হয়তো এই রং ও ছায়ার ব্যাপারগুলোকে ছবির মান খারাপ বলে ধরে নেবে। “ভুয়া” জিনিসগুলো শনাক্ত করার জন্য এখন গবেষকেরা এই ছবি প্রক্রিয়াকরণের বিভিন্ন প্রযুক্তিগত দিকও তলিয়ে দেখার চেষ্টা করছেন। যেমন, কালার হিস্টোগ্রাম, ফ্রিকোয়েন্সি ও স্পেশাল ডোমেইনস।
এভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে ছবি তৈরির প্রযুক্তি কিছু ভালো কাজেও ব্যবহৃত হতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন জাও। বিশেষভাবে যখন লম্বা সময়ের জন্য কোনো ভূখণ্ডের ডেটা উপস্থাপন করার বিষয় আসবে। যেমন কীভাবে একটি শহরের কলেবর বেড়েছে, বা একটি অঞ্চল জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বদলে গেছে। কিছু নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কোনো অতীত ছবি পাওয়া যায় না—এমন জায়গার ক্ষেত্রে, সমগোত্রীয় কিছু জায়গার ছবির ওপর ভিত্তি করে সেই জায়গার নতুন ছবি তৈরি করা যায়। এবং স্পষ্টভাবে বলে দেওয়া যায় যে, এগুলো প্রযুক্তির সাহায্যে তৈরি করা হয়েছে। বিষয়টি একই সঙ্গে একটি তথ্য ঘাটতিও পূরণ করে এবং পুরো বিষয়টির প্রেক্ষাপট বুঝতেও সাহায্য করে।
জাও বলেন, জিওস্পেশাল ডেটার যে বিকৃতি ঘটানো সম্ভব, শুধু সেটি দেখানো এই গবেষণার উদ্দেশ্য ছিল না; বরং এই গবেষকেরা এসব ভুয়া স্যাটেলাইট ছবি শনাক্ত করার কৌশল শেখার আশা করছেন, যেন জিওগ্রাফাররা এ ধরনের ক্ষেত্রেও ডেটা সাক্ষরতার টুল তৈরি করতে পারেন। যেমনটি এখন জনস্বার্থে করে থাকে আজকের অনেক তথ্য যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান।
জাও বলেছেন, “এই ধরনের প্রযুক্তির বিকাশ ক্রমাগত ঘটে চলেছে। ফলে এই গবেষণার লক্ষ্য ছিল: জিওগ্রাফিক ডেটা ও তথ্য সম্পর্কে আরও বোঝাপড়ার উৎসাহ তৈরি করা। যেন আমরা স্যাটেলাইট ছবি বা অন্যান্য জিওস্পেশাল ডেটার ওপর যে প্রশ্নাতীত বিশ্বাসের জায়গাটি আছে, সেটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারি।”
“আমরা ভবিষ্যৎকেন্দ্রিক চিন্তাপদ্ধতিও গড়ে তুলতে চাই, যেন প্রয়োজন অনুযায়ী এই জাতীয় জিনিসের তথ্য যাচাই করে নেওয়া যায়।”
লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটন নিউজ-এ। অনুমতি নিয়ে এখানে পুনঃপ্রকাশ করা হলো। এখানে পড়ুন আসল লেখাটি। সেখানে সহ-লেখক ইফান সান, সাওজেং জাং, চুনেক্স জু ও চেংবিন ডেং-এর নামও উল্লেখ করা আছে।
আরো পড়ুন
আপনার পরবর্তী অনুসন্ধানে স্যাটেলাইট ছবি কিভাবে ব্যবহার করবেন
আসছে “ডিপ ফেইক” ভিডিওর জোয়ার, মোকাবেলা করবেন কীভাবে?
ম্যাপিং টুলবক্স: ১০+ টুলস ওর্থ চেকিং আউট
কিম একার্ট কাজ করেন ওয়াশিংটনের শিয়াটল-ভিত্তিক ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনের পাবলিক ইনফরমেশন অফিসে। যেটি কাজ করে সামাজিক বিজ্ঞান, আইন ও সামাজিক কর্মকাণ্ড নিয়ে।