বৈরুত কাঁপানো বিস্ফোরণের গভীরে গিয়েছে যে তিনটি অনুসন্ধান
আর্টিকেলটি পড়ুন এই ভাষায়:
২০২০ সালের ৪ আগস্ট, নৌবন্দরে শক্তিশালী এক বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে লেবাননের রাজধানী বৈরুত। মারা যান ২০০ মানুষ। আহত হন ৬৫০০ জন। গৃহহীন হয়ে পড়েন প্রায় তিন লাখ। যুক্তরাজ্যের শেফিল্ড ইউনিভার্সিটির বিশ্লেষণে: এটি ছিল ইতিহাসের অন্যতম বড় নন-নিউক্লিয়ার (অপারমানবিক) বিস্ফোরণ।
গণঅভ্যুত্থান ও চলমান অর্থনৈতিক সংকটের কারণে আগে থেকেই অনেকের দৃষ্টি ছিল লেবাননের দিকে। কিন্তু এই বিস্ফোরণের ব্যাপকতার জন্য আরেকদফা বৈশ্বিক সংবাদমাধ্যমগুলোর শিরোনামে পরিণত হয় দেশটি। এবং পরবর্তী অনুসন্ধানগুলো থেকে বেরিয়ে আসে: কিভাবে বছরের পর বছর ধরে দুর্নীতি হয়েছে তাদের সমুদ্রবন্দরে।
বৈরুতের এই বিস্ফোরণ নিয়ে বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য অনুসন্ধান হয়েছে। তার মধ্যে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমেরও কিছু অনুসন্ধান ছিল। জিআইজেএন এখানে এমনই তিনটি সংবাদমাধ্যমের অনুসন্ধানের কথা তুলে ধরছে। এখান থেকে উন্মোচিত হয়েছে: কিভাবে এই বিস্ফোরণটি ঘটেছে, এবং এই ঘটনার কেন্দ্রবিন্দু “রোসাস” নামের জাহাজে থাকা প্রাণঘাতী সামগ্রী, কেন এতো লম্বা সময় ধরে বন্দরে আটকে ছিল।
বেলিংক্যাটের অনুসন্ধানটির কথা বলতে হয় সবার আগে। বৈরুতের নৌবন্দরে সেদিন কী ঘটেছিল, তা তারা দ্রুত যাচাই করেছিল ওপেন সোর্স টুল ব্যবহার করে। আর অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন রিপোর্টিং প্রজেক্ট (ওসিসিআরপি)-এর আন্তসীমান্ত অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে: কিভাবে অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের মতো বিস্ফোরক দ্রব্য সেই নৌবন্দরে এসে আটকে ছিল। এবং সর্বশেষ অনুসন্ধানটি লেবাননের স্থানীয় আল জাদিদ টেলিভিশনের। তারা দেশটির বন্দর, সীমান্ত ও বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ নিয়ে এক দশক ধরে কাজ করে আসছে। ফলে এই বিস্ফোরণ নিয়ে অনুসন্ধানে তারা সহজেই অন্যদের পেছনে ফেলেছে।
বেলিংক্যাট: ওপেন সোর্স ভিডিও ও যাচাই
“সোশ্যাল মিডিয়ায় বিশাল এই বিস্ফোরণের ছবি, ভিডিও, ও রিপোর্ট আসছিল একের পর এক। শুরুতে শহরের বেশ কয়েক জায়গায় কয়েকটি বিস্ফোরণ ও বিমান হামলার খবরও পাওয়া যাচ্ছিল,” বৈরুত বিস্ফোরণের পর ব্যাপক তথ্যের জোয়ার নিয়ে জিআইজেএন-কে এমনটিই বলেছেন বেলিংক্যাটের সিনিয়র ইনভেস্টিগেটর নিক ওয়াটার্স।
ঘটনার ব্যাপকতা দেখে, এর উৎস ও স্থান খুজে বের করার সিদ্ধান্ত নেন ওয়াটার্স। বিমান হামলার অভিযোগের যথার্থতা আছে কিনা, তাও খতিয়ে দেখতে শুরু করেন।
যুক্তরাজ্যের সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা এর আগেও মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা ইস্যু নিয়ে বেশ কয়েকটি ওপেন সোর্স অনুসন্ধান পরিচালনা করেছেন। তার মধ্যে ছিল সিরিয়ান রেড ক্রিসেন্টের গাড়িবহরে হামলা, সিরিয়ার শহর হামাতে রাসায়নিক হামলার অভিযোগ, এবং ইরান মার্কিনী ড্রোন হ্যাক করছে কিনা, তা নিয়ে বিশ্লেষণ।
বৈরুত বিস্ফোরণের পর সোশ্যাল মিডিয়ায় একের পর এক ভিডিও আসতে দেখে মোটেও অবাক হননি ওয়াটার্স। তার অনুসন্ধানও শুরু হয় এসব ফুটেজ সংগ্রহের মাধ্যমে। “এই ধরনের ঘটনার ক্ষেত্রে অনেক মানুষ তাদের ফোন বের করে ছবি তোলেন বা ভিডিও করেন,” বলেছেন ওয়াটার্স। শুধু টুইটারেই তিনি “বিপুল পরিমাণ” ভিডিও পেয়েছেন। এগুলো সংগ্রহের পাশাপাশি বৈরুতে চেনাজানা মানুষদের সঙ্গেও যোগাযোগ করে তথ্য নিতে শুরু করেন ওয়াটার্স।
সংগ্রহের পর ওয়াটার্স সেসব ফুটেজ একজায়গায় এনে মিলিয়ে দেখতে শুরু করেন। সত্যিই সেখানে কী ঘটেছিল, তা বোঝার জন্য তথ্য যাচাইয়ের কাজ শুরু করেন। তিনি বলেছেন, “অন্য কোনো জায়গাতেও বিস্ফোরণ হয়েছিল কিনা, তা বোঝার জন্য আমি ভিডিওগুলো জিওলোকেট করার চেষ্টা করেছিলাম। এজন্য আমি ভিডিওগুলো আস্তে আস্তে, ফ্রেম বাই ফ্রেম দেখেছি। ভিডিওগুলো একটি আরেকটির সঙ্গে মিলিয়ে দেখেছি। মূলত আমি এর মাধ্যমে একটি টাইমলাইন তৈরি করেছি।”
বিস্ফোরণের কয়েক ঘন্টা পর তিনি প্রকাশ করেন এই প্রতিবেদন: হোয়াট জাস্ট ব্লিউ আপ ইন বৈরুত?
প্রতিবেদনটির উপসংহারে বলা হয়েছে: “বিস্ফোরণের মূল জায়গাটি ছিল একটি গুদাম। এটির অবস্থান: 33.901353, 35.518835। কয়েক জায়গার সূত্রের তথ্য থেকে এমন ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে, বিস্ফোরণের উৎস ছিল একটি জাহাজে থাকা ২,৭০০ টন অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট, যেটি বৈরুতের বন্দরে পড়ে ছিল ২০১৩ সাল থেকে। অবশ্য এ ব্যাপারে এখনো কর্তৃপক্ষের আনুষ্ঠানিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি।”
এর পরের কিছু দিন, ওয়াটার্স নিজের সংগ্রহ করা ভিডিও ফুটেজগুলো আবার দেখেছেন। এধরনের বিধ্বংসী একটি ঘটনার পর সাধারণত অনেক ভুয়া তথ্য ছড়াতে থাকে। লেবাননে, কর্তৃপক্ষ যখন কী ঘটেছে বোঝার চেষ্টা করছিল, তখন ভুয়া তথ্যের কারখানাগুলো চলছিল পুরোদমে। একটি ভিডিওতে, আকাশ থেকে একটি মিসাইল এসে পড়ার মিথ্যা দাবিও করা হয়েছিল। আবার অনেকেই ভুয়া থার্মালচিত্র শেয়ার করছিলেন, যেখানে দাবি করা হচ্ছিল: পারমানবিক কোনো যন্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে।
কিন্তু এসব ভুয়া তথ্য ছড়ানোর আগেই “একশরও বেশি ভিডিও” দেখে ফেলেছিলেন ওয়াটার্স। এবং কোনো ভিডিওতেই তিনি বিমান হামলা থেকে বিস্ফোরণের চিত্র পাননি।
ওয়াটার্স জিআইজেএন-কে বলেছেন, “ভুয়া যে ভিডিওগুলো পরবর্তীতে ছড়িয়েছে, সেগুলো কিছুটা অস্বাভাবিক ছিল। এমন ভুয়া ভিডিও তৈরির চেষ্টা, সচরাচর দেখা যায় না। সাধারণত আমরা দেখি মানুষ অন্য জায়গার পুরোনো ভিডিও নতুনভাবে ছড়ানোর মাধ্যমে দাবি করে সেটি এই ঘটনার ভিডিও।”
ভুয়া ভিডিওগুলো যাচাই করে দেখার জন্য প্রকৃত ভিডিওগুলোও ওয়াটার্সের কাছে ছিল। সম্পাদনা করা ভিডিওতে দেখানো হচ্ছিল: একটি “মিসাইল” নৌবন্দরে আঘাত হানছে। কিন্তু ভিডিওটি ধীরগতিতে দেখার পর তিনি বুঝতে পারেন: সেই বস্তুটি ছিল আসলে একটি পাখি। আর সেই থারমাল ফুটেজ? “এগুলোতে নেগেটিভ ফিল্টার ব্যবহার করা হয়েছিল, যেন যাচাই করা কঠিন হয়ে পড়ে।”
বিস্ফোরণটি বিমান হামলার কারণেই হয়েছিল, এমন ধারণা এখনো কারো কারো মধ্যে আছে। বৈরুতের অনেক বাসিন্দাই বলেছিলেন, তারা এমন শব্দ শুনেছেন যার সাথে জেট বিমানের শব্দের মিল আছে। তবে ওয়াটার্স বলেছেন, তিনি যেসব ছবি-ভিডিও সংগ্রহ করেছেন, তা কয়েকশ অ্যাঙ্গেল থেকে দেখেও “জেট বিমানের কোনো ফুটেজ বা প্রমাণ” পাওয়া যায়নি।
তারপরও, ওয়াটার্স শব্দযুক্ত ভিডিওগুলো ভালোমতো বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁর সিদ্ধান্ত ছিল: সেখানে [জেট বিমানের] গর্জনের মতো যে শব্দ শোনা গেছে, তা হতে পারে একই ওয়্যারহাউজে থাকা আতশবাজির বিস্ফোরণ থেকে।
আগস্টের ৭ তারিখে, বেলিংক্যাট এসব অনুসন্ধানের ফলাফল প্রকাশ করে। যেখানে ভুয়া ও অসত্য নানা দাবি খণ্ডন করা হয় যুক্তিপ্রমাণ দিয়ে।
একটা সময় এই ধরনের ফরেনসিক বিশ্লেষণ নিয়ে কাজ হতো সীমিত আকারে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতো বড় সংগঠন এবং নিউ ইয়র্ক টাইমসের মতো বড় সংবাদমাধ্যম তাদের অনুসন্ধানী কাজগুলোতে এগুলো ব্যবহার করতো। ভিডিও ফুটেজ যাচাই করার জন্য বিভিন্ন টুলের ব্যবহার শেখা জরুরি বলে স্বীকার করেছেন ওয়াটার্স। তবে তাঁর কাছে, একজন রিপোর্টারের সবচে গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র হলো: ঘটনার প্রেক্ষিত ও প্রাসঙ্গিকতা সম্পর্কে বোঝাপড়া।
“একটি ভিডিও সম্পাদনা করে অন্য কিছু বানানোর আগেই যদি আপনি সেটি দেখে থাকেন, তাহলে আপনার মনে হবে: আপনি যা দেখছেন, তা ভুয়া। আপনার যদি ঘটনার প্রেক্ষিত সম্পর্কে প্রয়োজনীয় ধারণা না থাকে, তাহলে কোনো ভালো টুল দিয়েই আপনি ভুয়া ভিডিও শনাক্ত করতে পারবেন না,” বলেছেন ওয়াটার্স।
আল জাদিদ টেলিভিশন: পেপার ট্রেইল
বিস্ফোরণের পর, স্থানীয় টেলিভিশন, আল জাদিদ দ্রুত কাজ শুরু করেছিল। প্রায় এক দশক ধরে দেশটির সীমান্ত ও শুল্ক কর্মকর্তাদের নিয়ে কাজ করেছে সংবাদমাধ্যমটি। ফলে কী হয়েছিল, খুঁজে দেখার ক্ষেত্রে বেশ ভালো অবস্থানে ছিল তাদের অনুসন্ধানী দল।
“নৌ ও বিমানবন্দর দিয়ে আসা সব ধরনের চোরাচালান সম্পর্কে আমাদের ভালো ধারণা ছিল,” বলেছেন আল জাদিদ টেলিভিশনের রিপোর্টার লায়াল বুউ মুসা। বিগত বছরগুলোতে রিপোর্ট করার সময় নৌবন্দর ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে কাজ করা মানুষেরাই তাদের তথ্য দিয়েছে। তারা চাইতেন দুর্নীতি ও অনিয়মের ঘটনাগুলো উন্মোচিত হোক।
আগের অভিজ্ঞতা থেকে মুসা ও তাঁর সহকর্মীরা জানতেন – কোথায় যেতে হবে, কাকে ফোন করতে হবে, এবং কার সঙ্গে কথা বলতে হবে। তাদের এই কাজে, সবাই ভিন্ন ভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছেন। মুসা নিজে মনোযোগ দিয়েছিলেন আইনি ও অন্যান্য সরকারি কাগজপত্র জোগাড়ের দিকে। জিআইজেএনকে তিনি বলেছেন, “ঘটনার পরপরই আমরা তথ্য সংগ্রহ শুরু করি নিরাপত্তা বাহিনী, বিচারক, বিশেষজ্ঞ, আইনজীবী – সবার কাছ থেকে। আমরা এসব কিছুই করেছি অন্য কেউ বিষয়টি ভালোমতো বুঝে ওঠার আগেই।”
বিস্ফোরণের পরপরই কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করায় তাদের সঙ্গে সহজে কথা বলা গেছে। দ্রুত তাদের সঙ্গে কাজ শুরু করতে না পারলে হয়তো এই কথা বলা যেত না। কারণ এই কর্মকর্তাদের অনেকের বিরুদ্ধেই পরবর্তীতে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়। এছাড়াও, যে কর্মকর্তারা মনে করেছিলেন যে তারা বিপদের মধ্যে আছেন; তারা অন্য কর্মকর্তাদের দিকে আঙুল তুলেছিলেন। দোষারোপের খেলা বেশ জমে উঠেছিল।
মুসা বলেছেন, “আমরাই একমাত্র নিউজরুম যারা বিস্ফোরণের পর সাবেক পরিবহন মন্ত্রী ও অন্যান্য কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলতে পেরেছি… কারণ আমরা ঘটনার পরপরই এটি করতে পেরেছিলাম।” নিরাপত্তা বাহিনীর কাছ থেকেও তারা সহজেই সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন বিভিন্ন নথি ও চিঠিপত্র।
আল জাদিদ লেবাননের একটি প্রধান টেলিভিশন চ্যানেল। বেশ কয়েক বছর ধরে তারা গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎকার প্রচার করেছে। ফলে এই বিষয়গুলো তাদের তথ্য সংগ্রহে সাহায্য করেছিল। কিন্তু লেবাননের অন্য বড় বড় সংবাদমাধ্যমগুলো বিস্ফোরণ পরবর্তী দিনগুলোতে সেই একই তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে ঘাম ঝরিয়েছে। [সম্পাদকের নোট: সব কিছু “উন্মুক্ত” রাখার ভাবনা থেকে এই অনুসন্ধান সংক্রান্ত সব নথিপত্র একটি গুগল ড্রাইভ ফোল্ডারে আপলোড করেছে চ্যানেলটির অনুসন্ধানী দল। অন্য যে কোনো সংবাদমাধ্যম অনুরোধ জানালে তারা এগুলো সরবরাহ করবে।]
সাংবাদিকতায় আসার আগে আইন নিয়ে পড়ালেখা করেছেন মুসা। সেই জ্ঞান তাঁর অনেক কাজে লেগেছে। তিনি বলেছেন, “কী ঘটেছিল তা খুঁজে বের করার জন্য সবচে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা হলো অপরাধের স্থান। এটিই হলো ‘ব্ল্যাক বক্স।’”
কিন্তু কেন এই কর্মকর্তারা সুপরিচিত একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিককে সহায়তা করেছেন? বিষয়টি পুরোপুরি সাদা মনে করা হয়েছে বলে মনে করেন না মুসা। তিনি বলেছেন, “আমার মনে হয়, তারা অন্যদের ঘাড়ে দায় চাপানোর জন্য আমাদেরকে তথ্য দিতে রাজি হয়েছিল।”
এভাবে বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে এবং সম্ভাব্য যাবতীয় আইনি ও আনুষ্ঠানিক নথিপত্র সংগ্রহের পর, তিনি পুরো বিষয়টি এক জায়গায় এনে বুঝতে চেষ্টা করেন: কিভাবে প্রায় পাঁচ বছর আগে এই অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট বন্দরের গুদামে এসে জমা হয়? কে এটির সঙ্গে জড়িত ছিল? এবং সবচে গুরুত্বপূর্ণ – কে এই বিষয়টি জানত।
তিনি বলেছেন, “আমি সব নথি ভালোভাবে দেখেছি। এমনকি যেগুলো মিথ্যা বলে মনে হয়েছে, সেগুলোও। কিন্তু প্রতিটি নথিই যেন যাচাই করে নেওয়া যায়, তা আমাকে নিশ্চিত করতে হয়েছে।”
আল জাদিদের সহকর্মীদের নিয়ে করা তাঁর এই অনুসন্ধানটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে আসলেই কী ঘটেছিল তা বোঝার জন্য। এবং তাদের এই রিপোর্টিং, বিশ্বজুড়ে সংবাদমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। অ্যাসোসিয়েট প্রেসসহ অনেক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম বিস্ফোরণটির ব্যাপারে জানার জন্য মুসার সহকর্মী, রিয়াদ কোবাইসির সাক্ষাৎকার নিয়েছিল।
মুসা বলেছেন, “এই দ্রব্য [অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট] থেকে যে এরকম বিধ্বংসী ঘটনা ঘটতে পারে, তা অনেকেই জানত, ২০১৪ সাল থেকে। আমরা দেখাতে পেরেছি, কিভাবে কর্মকর্তারা এই অপরাধের দায় এড়ানোর চেষ্টা করেছে। আবার, বিভিন্ন নথি সংগ্রহের মাধ্যমে আমরা দেখিয়েছি, কিভাবে তারা এই ঘটনার জন্য দায়ী।”
“আমরা দেখিয়েছি: সবাই ব্যাপারটি জানত। কিন্তু কেউই দায়িত্ব নেয়নি।”
ঘটনা ঘটার সাথে সাথে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারাটাই অনেক পার্থক্য গড়ে দিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। “মিথ্যা ভাষ্যগুলো বড় হয়ে সামনে আসার আগেই” তারা কাজটি সেরে ফেলেন। মুসার ভাষায়: আপনি যদি দ্রুত তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন, তাহলে “বেশি সত্য” জানতে পারবেন।
ওসিসিআরপি: আন্তসীমান্ত অনুসন্ধান
বেলিংক্যাটের ওয়াটার্স কাজ করেছিলেন নিজে নিজে।মুসা অনুসন্ধান করেছিলেন চারজনের একটি দল নিয়ে। অন্যদিকে অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন রিপোর্টিং প্রজেক্ট (ওসিসিআরপি)-র অনুসন্ধানে যুক্ত হয়েছিলেন তিনটি মহাদেশের ১২টি সংবাদমাধ্যম থেকে ২০ জনেরও বেশি সাংবাদিক।
এই অনুসন্ধানটি ছিল সময়সাপেক্ষ। তবে, কিভাবে সেই অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট ২০১৩ সালে বৈরুতের নৌবন্দরে এসে পৌঁছেছিল; তা বোঝার ক্ষেত্রে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এমনটিই জানিয়েছেন ওসিসিআরপির মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা অঞ্চলের জ্যেষ্ঠ সম্পাদক রানা সাবাগ।
জিআইজেএনকে তিনি বলেছেন, “আমরা দেখতে চেয়েছিলাম: কিভাবে সেই জাহাজটি বৈরুতে এসেছিল। এটি কী ইচ্ছাকৃত ছিল নাকি তার দিক পরিবর্তন করা হয়েছিল।”
রোসাস নামের জাহাজটি সমুদ্রে চলাচলের উপযুক্ত কিনা, তা নিয়েও ছিল প্রশ্ন। মালদোভা থেকে এই বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ে এটি আদিতে যাত্রা শুরু করেছিল মোজাম্বিকের দিকে। কিন্তু শেষপর্যন্ত তার যাত্রা শেষ হয় বৈরুতে। কিভাবে, কোন পথে জাহাজটি সেখানে এসে থেমেছিল, তা অনুসন্ধান করার কাজটি ছিল খুব জটিল। কারণ এর মালিকানা ও মধ্যসত্বভোগী ছিল বেশ কয়েকটি দেশে।
এই কাজের জন্য সাবাগ পরামর্শ নিয়েছিলেন ওসিসিআরপি-র ইউক্রেন-ভিত্তিক সম্পাদক, অব্রে বেলফোর্ডের। তিনি জাহাজ চলাচল নিয়ে ভালো ধারণা রাখেন।
ধীরে ধীরে এই দলটিতে যুক্ত হন লেবানন, জর্জিয়া, মোজাম্বিক, মালদোভা ও রাশিয়ার সাংবাদিকরা। তাঁরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করতেন একটি সিগন্যাল গ্রুপ ও প্রতিদিনের জুম কলের মাধ্যমে। সংগ্রহ করা তথ্য সংরক্ষণ ও গুছিয়ে রাখার জন্য তাঁরা একটি ডেটাবেজ গড়ে তুলেছিলেন।
তারা কাজ করেছেন বেশ কয়েকটি ভাষায় লেখা নথিপত্র নিয়ে। এবং সেগুলোর পরিমাণও ছিল বড় আকারের। ফলে অনুসন্ধান পরিচালনার কাজটি অনেক ক্ষেত্রেই চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়িয়েছে। “অনেক লোক ছিল দলে,’” বলেছেন সাবাগ। তবে তিনি এও মনে করেন, এরকম একটি আন্তর্জাতিক দল গড়ে তোলায় অনেক ইতিবাচক বিষয় দেখা গেছে।
সাবাগ বলেছেন, “আমাদের দলে সাতটি ভাষা জানা মানুষ ছিল। এই সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য আমাদের প্রতিবেদন অনেক অর্থবহ করে তুলেছে… এখানে স্থানীয় নানা বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা ছিলেন।”
ফলে, এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে এই দল উন্মোচন করেছে: রোসাস কোন জায়গায় যাওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল এবং এই যাত্রাপথে কী কী হয়েছিল। একই সঙ্গে তাঁরা এই জাহাজের রহস্যময় সব মালিকদের নেটওয়ার্ক ও এটির পরিচালনায় জড়িত থাকা ভিন্ন ভিন্ন কোম্পানিদের তথ্যও সামনে এনেছে। সাবাগ বলেছেন, এই অনুসন্ধানটি একা একা করতে গেলে তাঁর অন্তত “দুই বছর” সময় লাগতো।
অনুসন্ধানটি বেশ কয়েকটি ভাষায়, বিভিন্ন আঙ্গিক থেকে প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মজুড়ে।
মধ্যপ্রাচ্যের অভিজ্ঞ সাংবাদিক, সাবাগ, এধরনের আন্তসীমান্ত অনুসন্ধানকেই দেখেন “ভবিষ্যৎ হিসেবে। যেখানে পুরো বিশ্বের মানুষ আরো বেশি করে সংযুক্ত হচ্ছে এবং সাংবাদিকতার জগত, নিজেদের টিকিয়ে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে।”
বড় অনুসন্ধান “বেশ ব্যয়সাধ্য, এবং কেউই তা একা একা করতে পারে না,” বলেন সাবাগ। “প্রত্যেকেরই দক্ষতা সমান নয়। কারও কারিগরি দক্ষতা থাকতে পারে, এবং অন্য একজন হয়তো সাগর পথ বিশেষজ্ঞ। যখন অনেকরকম দক্ষতা এক জায়গায় জড়ো হয়, এবং একে অপরের পরিপূরক হয়, তখন বড় প্রভাবও তৈরি করা যায়।”
গত ১৭ নভেম্বর, এ বিষয়ে আরেকটি যৌথ অনুসন্ধান প্রকাশ করে ফরেনসিক আর্কিটেকচার ও মিশরীয় সংবাদমাধ্যম মাদা মাসর। এখানে থ্রিডি মডেল ও জিওলোকেটেড ভিডিও দিয়ে বিস্ফোরণটি বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এবং তাদের সব নথিপত্র-উপকরণ সবার জন্য উন্মুক্ত আছে।
কিভাবে বিস্ফোরণটি ঘটল, এবং এজন্য কে দায়ী- সরকারের এই অনুসন্ধানে সাহায্য দিচ্ছে এফবিআই ও ফরাসী বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু বিস্ফোরণের চার মাস পরেও, দেশটির সরকারি অনুসন্ধান প্রক্রিয়া পিছিয়ে পড়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো ভাষ্য না থাকায় একটি তথ্যের ঘাটতি তৈরি হয়েছে। ভালো দিক হলো – এর একটা অংশ পূরণ হচ্ছে, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা দিয়ে। আর খারাপ দিক হলো, বাকিটা পূরণ হচ্ছে, ষড়যন্ত্র তত্ত্ব দিয়ে।
এখন সবার জন্য বড় প্রশ্ন: কিভাবে বিস্ফোরণের আশঙ্কায় থাকা এই দ্রব্য এতোগুলো বছর ধরে বসে থাকলো লেবাননের রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে?
আরো পড়ুন
ডাঙায় বসে সাগরে থাকা জাহাজ অনুসরণ করবেন যেভাবে
ইউজিং টুইটার টু ফাইন্ড পিপল অ্যাট দ্য সিন অব এ ব্রেকিং স্টোরি
করিম শেহায়েব একজন বৈরুত-ভিত্তিক সাংবাদিক ও গবেষক। তিনি স্বাধীন সংবাদমাধ্যম, দ্য পাবলিক সোর্স-এ লেখালেখি করেন। তাঁর লেখা প্রকাশ হয়েছে নিউ ইয়র্ক টাইমস, মিডল ইস্ট আই ও বিজনেস ইনসাইডারে।