প্রবেশগম্যতা সেটিংস

screenshot

লেখাপত্র

বিষয়

নাভালনির অনুসন্ধানী দল থেকে সাংবাদিকদের যা শেখার আছে

আর্টিকেলটি পড়ুন এই ভাষায়:

কৃষ্ণসাগরের উপকূলে “পুতিনের প্রাসাদের” এই ছবি তোলা হয়েছে ড্রোন ক্যামেরা দিয়ে। স্ক্রিনশট

গত বছরের অক্টোবরে, রাশিয়ার বিরোধীদলীয় নেতা অ্যালেক্সি নাভালনির এক আইনজীবী, তাঁর পকেটে অন্তত চারটি মোবাইল ফোন নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন পর্যটন শহর শোচিতে। 

একই সময়, সেই চারটি সেলফোনের মালিকেরা নৌকায় চেপে কৃষ্ণসাগরের তীর ধরে, আরো ২৫০ কিলোমিটার উত্তরে যাচ্ছিলেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, ড্রোন উড়িয়ে রাশিয়ার সবচেয়ে গোপন বাড়িটির ছবি তোলা। নৌকার আরোহীরা অলাভজনক প্রতিষ্ঠান, অ্যান্টি-করাপশন ফাউন্ডেশনের (এফবিকে) কর্মী। এটি গড়ে তুলেছেন নাভালনি। রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারি এড়াতে সাগর-তীরে ফোন রেখে আসা, দফায় দফায় ট্রেন বদল করা – এমন নানা কৌশল অবলম্বন করতে হয় তাদের। এতো লুকোছাপা – কারণ, আগেও গোপনীয়তায় ঢাকা অঞ্চলটির দুর্নীতি নিয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে তারা হামলার শিকার হয়েছেন। জিআইজেএনকে দেয়া সাক্ষাৎকারে ঘটনাটির বিশদ বিবরণ তুলে ধরেন এফবিকের অনুসন্ধানী দলের প্রধান মারিয়া পেভচিক।

গেলেনঝিক শহরের কাছেই জঙ্গল ঘেরা উপদ্বীপটির অবস্থান। এখানেই ড্রোন উড়ান এফবিকের অনুসন্ধানী দলের সদস্য, জর্জি আলবুরোভ। জায়গাটি সুরক্ষিত; রহস্য ঘেরা। সেখানে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তারক্ষীদের পাহারা চলে দিনরাত। ওপর দিয়ে বিমান ওড়ানো নিষেধ। সাগরপথেও এর দুই কিলোমিটারের মধ্যে আসা নিষিদ্ধ। 

জর্জির তোলা ড্রোন ছবির সূত্র ধরেই নির্মিত হয় এফবিকে’র  অনুসন্ধানী তথ্যচিত্র “আ প্যালেস ফর পুতিন,” যা মুক্তি পায় ২০২১ সালের জানুয়ারিতে। বেরিয়ে আসে, ১৩৫ কোটি ডলারের এই প্রাসাদ নির্মাণের নেপথ্যে যত দুর্নীতি, সরকারি টাকার অবিশ্বাস্য অপচয়, এবং প্রাসাদটির ওপর রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি। দুই ঘন্টার এই তথ্যচিত্র দেখে দ্য নিউ ইয়র্কার সাময়িকীর মাশা গেসেন বলেছিলেন, প্রাসাদটি আসলে “উন্মাদ ও বিকারগ্রস্ত মাথার এক বিশাল লেগো প্রকল্প।”

প্রকাশের মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে, ভিডিওটির ইউটিউব-ভিউ ১০ কোটি ছাড়িয়ে যায়। ঐ সপ্তাহেই দুই বছরের জন্য কারাবন্দী করা হয় নাভালনিকে। যদিও, তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলোকে অনেকেই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনের চেষ্টা হিসেবে দেখছেন। তিনি ২০১৮ সালে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন এবং গত আগস্টে তাকে বিষপ্রয়োগে হত্যার চেষ্টা করা হয়। পেভচিক বলেছেন, এখন এফবিকের পাঁচজন কর্মী কারাগারে আছেন। মামলা দায়ের করা হয়েছে, আলবুরোভের বিরুদ্ধেও ।

এফবিকে-র অনুসন্ধানী দল: জর্জি আলবুরোভ, আলেক্সি নাভালনি ও মারিয়া পেভচিক। ছবি কৃতজ্ঞতা: এফবিকে

নাভালনির অলাভজনক এই প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা, বেশিরভাগই আইনজীবী। তাদের একটি সুস্পষ্ট রাজনৈতিক লক্ষ্য আছে: দুর্নীতি বন্ধ করা এবং পুতিনকে ক্ষমতা থেকে সরানো। এটি সংবাদমাধ্যম নয়। তাদের অনুসন্ধানগুলোকে দেখা যেতে পারে বিরোধীদলের গবেষণা হিসেবে। তাদের ভাইরাল কনটেন্টগুলোতে প্রায়ই এমন বিদ্রুপপূর্ণ ধারাভাষ্য থাকে, যা কোনো পেশাদার নিউজরুম চিন্তা-ই করতে পারে না। এই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালানোর জন্য আর্থিক অনুদান দেওয়া ব্যক্তিদের একটি তালিকাও আছে এফবিকের ওয়েবসাইটে।

রাশিয়ার অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের মধ্যে অনেক বিতর্ক আছে নাভালনির প্রতিষ্ঠানটিকে নিয়ে। গত বছর অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন রিপোর্টিং প্রজেক্টের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে রাশিয়ার অনুসন্ধানী প্লাটফর্ম আইস্টোরিজের সম্পাদক রোমান আনিন সবাইকে সাবধান করে দিয়ে বলেছিলেন, এফবিকের অনুসন্ধানকারীরা “সাংবাদিকতার মানদণ্ড অনুসরণ করে না। এবং তারা কখনো আরেক পক্ষের কথা শোনারও চেষ্টা করে না।”

তবে আনিন স্বীকার করে নেন, এফবিকে “সম্ভবত রাশিয়ার সবচে কার্যকরী অনুসন্ধানী সংবাদমাধ্যম,” এবং তাদের কৌশলগুলো থেকে অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের অনেক কিছু শেখার আছে। 

গত এক দশক ধরে বেশ কয়েকটি ঘটনায় তারা যে সৃজনশীল ও সাহসী অনুসন্ধান পদ্ধতি ব্যবহার করেছে, তাতে কর্তৃত্বপরায়ন ও সীমিত গণমাধ্যম-স্বাধীনতার দেশে থাকা পেশাদার সাংবাদিকদের জন্য অনেক তাৎপর্যপূর্ণ উপাদান আছে। 

পেভচিক বলেছেন, “আমাদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির কথা অস্বীকার করাটা বোকামি হবে। আমরা এই রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাকে ব্যবহার করছি টুল হিসেবে।”

গত ১৭ জানুয়ারি জার্মানি থেকে রাশিয়ায় ফিরে আসেন নাভালনি। প্যারোল নীতিমালা ভঙ্গের দায়ে তাকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং দুই বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এ প্রসঙ্গে পেভচিক বলেছেন, “অ্যালেক্সি আমাদের দেখিয়েছেন সত্যিই দেশের প্রতিনিধিত্ব করার ধরনটা কেমন হতে পারে। অবশ্যই তিনি শতভাগ নিশ্চিত ছিলেন যে, রাশিয়ায় ফেরামাত্রই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হবে। এখন আমরা তাকে কারামুক্ত করার জন্য সম্ভাব্য সবকিছুই করব।”

আলেক্সি নাভালনি

অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন রিপোর্টিং প্রজেক্টের রাশিয়া অঞ্চল সম্পাদক ও অভিজ্ঞ অনুসন্ধানী সাংবাদিক রোমান শ্লেনোভও একমত, এফবিকে অনেক উঁচুদরের অনুসন্ধান পরিচালনা করেছে এবং তারপর সেগুলো উপস্থাপন করেছে রাজনৈতিক সব বার্তা দিয়ে। 

“আ প্যালেস ফর পুতিন” নামের তথ্যচিত্রটিকে তিনি এককথায় “অসাধারণ” বলে বর্ণনা করেছেন।

শ্লেনোভ বলেছেন, “এফবিকে ও নাভালনির কাজ দারুন হয়েছে। তারা এই ভবন সংক্রান্ত নতুন নথিপত্র সংগ্রহ করেছেন, প্রাসাদ নির্মানের সঙ্গে জড়িত কোম্পানিগুলোর সাথে পুতিনের বন্ধুদের আর্থিক লেনদেনের বিস্তারিত তথ্য খুঁজে বের করেছেন। পুতিনের এই বন্ধুরা মূলত বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করেই বিপুল অর্থ উপার্জন করেছে। ভিডিওটিতে খুব বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে, কেন এসব বড় বড় অর্থ লেনদেন এবং এমন চোখধাঁধানো প্রাসাদ গড়ে তোলার জন্য সরাসরি পুতিনকে কোনো কাগজপত্রে স্বাক্ষর করতে হয়নি।”

প্রাসাদে কাজ করা শ্রমিকদের সোশ্যাল মিডিয়া ছবি সংগ্রহ করেছে এফবিকে। সেখানে পাওয়া গেছে ঘরের ছাদের এই জাঁকজমকপূর্ণ সব কারুকাজ। স্ক্রিনশট

এফবিকের মাত্র দুজন পূর্ণকালীন অনুসন্ধানী গবেষক ও দুজন ক্যামেরাম্যান আছে। তাদের মধ্যে একজনকে সম্প্রতি কারাবন্দী করা হয়েছে। নাভালনি নিজেই বিভিন্ন ভিডিও তথ্যচিত্র পরিচালনা করেন এবং ধারাভাষ্যকার হিসেবে কাজ করেন। 

রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পড়াশোনা করা ও সাবেক ফিন্যান্স প্রফেশনাল পেভচিক বলেছেন, তাদের দলে কারোরই অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার আনুষ্ঠানিক কোনো প্রশিক্ষণ নেই। প্রতিটি প্রকল্পের জন্য এফবিকের অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের নতুন নতুন টুল ও দক্ষতার প্রয়োজন পড়ে। এবং সেগুলো তারা কাজ করতে করতে শিখে নেন। শখের বশে কোডিং শেখা আলবুরোভ, নাভালনিকে পাইথন কোড লেখার প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। 

গত বছর, রাশিয়ার এক রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের চেয়ারম্যান কিভাবে তার বান্ধবীকে লাখ লাখ ডলারের রোমান্টিক উপহার দিয়েছিলেন, তা উন্মোচন করতে গিয়ে পাইথন কোডিং ব্যবহার করেছে এফবিকে। এর মাধ্যমে তারা মেরিনট্রাফিকফ্লাইটরাডারের মতো টুলকে যুক্ত করেছিল ইনস্টাগ্রামের ডেটার সঙ্গে। রুশ এই ব্যাংকার, জনগণের টাকায় তার গোপন প্রেমিকাকে যে ইয়টটি উপহার দিয়েছিলেন, তার নাম ও দাম জানতে চাইছিল এফবিকে দল। পেভচিক বলেছেন, বন্দর থেকে ছেড়ে যাওয়া নৌযানের সাথে বিমান বন্দরে একটি প্রাইভেট জেটের (এটিও উপহার পেয়েছিলেন সেই প্রেমিকা) অবতরণের তারিখের সম্পর্ক খুঁজতে তারা প্রোগ্রামটি ব্যবহার করেন। শেষপর্যন্ত দেখা যায়, ৬২ মিলিয়ন ডলারের সেই “সুপার-ইয়ট” যে চারটি বন্দরে নোঙর করেছে, সেখানে বিমানটিও নেমেছে, এবং একই তারিখে। ইনস্টাগ্রামে সেই নারীর ভ্রমনকালীন ছবির সঙ্গে, ইয়টটির ছবিও মিলে গিয়েছিল দারুনভাবে। 

রাশিয়ার এক রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের চেয়ারম্যান কিভাবে জনগনের টাকায় তার বান্ধবীকে ৬২ মিলিয়ন ডলারের এই সুপার ইয়ট উপহার দিয়েছেন, তা জানার জন্য বিভিন্ন ওপেন সোর্স টুলকে ইনস্টাগ্রামের ডেটার সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন এফবিকের কর্মীরা। স্ক্রিনশট

এই ভিডিওটি পেয়েছিল প্রায় সোয়া এক কোটি ভিউ। এতে একটি স্মরণীয় দৃশ্য ছিল, যেখানে দেখা যায় নিউ ইয়র্কের সেন্ট্রাল পার্কের একটি বেঞ্চে বসে আছেন নাভালনি, একটু পাশে সরে গিয়ে তিনি বের বের করে আনছেন পিতলের ফলকে খোদাই করা একটি প্রেমপত্র, যার নিচে সেই ব্যাংকারের নাম মুদ্রিত। 

এই প্রতিবেদনটির কথা মনে করে পেভচিক বলেছেন, “এটা বেশ মজার স্টোরি। সত্যি বলতে, প্রাসাদ নিয়ে অনুসন্ধানটি ছিল বেশ একঘেঁয়ে। অন্য অনুসন্ধানে আমরা আরো অনেক বেশি প্রযুক্তি ব্যবহার করেছি। পুতিনের প্রাসাদ সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদনটিই ছিল পুরোনো ধাঁচের কাজ। এখানে বেশিরভাগ সময়ই কাটাতে হয়েছে জমি নিবন্ধনের রেকর্ড ঘেঁটে। অবশ্য, শেষমেষ কাজটি ভালোই হয়েছে।”

সর্বোপরি, এফবিকের কাজের যে ধরণ, তার কেন্দ্রে আছে মূলত অধ্যবসায় এবং মৌলিক কাণ্ডজ্ঞান-নির্ভর চিন্তাভাবনা। তাদের এই বিপুল প্রভাবের পেছনে আছে ভিডিও ফরম্যাট। পেভচিক বলেছেন, “অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় লিখিত ফরম্যাটে। এমনকি বেলিংক্যাটের মতো আধুনিক সংবাদমাধ্যমের ক্ষেত্রেও। কিন্তু জিআইজেএন-এর পাঠকদের আমি অনুপ্রাণিত করব ভিডিও ফরম্যাটে স্টোরি বানানোর জন্য।”

তিনি আরো বলেন, “পৃথিবী অনেক বদলে গেছে। মানুষ এখন ভিন্নভাবে তথ্য গ্রহণ করে। আপনি যদি আপনার কাজ দিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চান তাহলে আইফোন বের করুন এবং ভিডিও ধারণ করুন। ইউটিউবে আপনার ভিডিও প্রকাশ করুন। ছাপা মাধ্যমে আপনি যে পরিমাণ ভিউ পাবেন, ইউটিউবে পাবেন তার চেয়ে ২০, ৩০ বা ১০০ গুন বেশি। একই কথা প্রযোজ্য বোৎসোয়ানা বা উগান্ডার সাংবাদিকদের জন্যও। আপনি যদি একটি প্রতিবেদন লিখতে পারেন, তাহলে সেটির একটি স্ক্রিপ্ট এবং ভিডিও-ও বানাতে পারবেন।”

প্রাসাদের দুর্নীতি ও অপচয় উন্মোচিত হলো যেভাবে 

শুরুতে একটি শিশুদের ক্যাম্পগ্রাউন্ড হিসেবে বর্ণনা করা হলেও, পুতিনের এই প্যালেস কমপ্লেক্সের মোট আয়তন এখন ১৭,৭০০ বর্গমিটার। এখানে আছে পালাজো স্টাইলের একটি প্রধান ভবন, তার চারপাশে কয়েকটি বিলাস ভবন, একটি বিশাল গ্রীনহাউজ, একটি ভাস্কর্যে পূর্ণ উদ্যান, এবং ১৬৮ একরের গোটা কমপ্লেক্সেজুড়ে ছড়ানো ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গ নেটওয়ার্ক। 

ফাঁস হয়ে যাওয়া ছবি ও ভবনটির নকশা থেকে দেখা গেছে, কী বিপুল টাকা অপচয় করা হয়েছে প্রকল্পটিতে। ছাদের দেয়ালে বর্ণিল সব চিত্রকর্ম; দুই স্তর বিশিষ্ট সিনেমা হল, একটি ক্যাসিনো, ড্যান্স পোলের সঙ্গে হুক্কা বার, মডেল ট্রেন রুম, ওয়াইন টেস্টিং চেম্বার, ভিডিও ড্যান্স রুম, মার্বেল স্তম্ভ দিয়ে ঘিরে থাকা বিশাল জাকুজি (বাথটাব) – কী নেই সেখানে।

তথ্যচিত্রে দাবি করা হয়েছে: এই প্রাসাদ তৈরির টাকা সরানো হয়েছে হাসপাতাল ও অন্যান্য চিকিৎসা সামগ্রী কেনার জন্য বরাদ্দ করা অর্থ থেকে। 

পেভচিক বলেছেন, তথ্য-প্রমাণ থেকে “সন্দেহাতীতভাবে” স্পষ্ট হয়েছে, কাগজেকলমে গোটা জায়গার মালিক বলে যে “মিখাইল ইভানোভিচ” নামটি ব্যবহার করা হয়েছে, তা ভ্লাদিমির পুতিন ছদ্মনাম হিসেবে ব্যবহার করেছেন। 

এই অনুসন্ধানে কী ধরনের কৌশল ব্যবহার করা হয়েছে, তা জানিয়েছেন পেভচিক: 

  • এফবিকের এই দল সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করেছেন এক দশকেরও বেশি সময়ের জমি নিবন্ধন দলিল। তারা বিশেষভাবে খেয়াল করেছেন: সময়ের সাথে সাথে কখন কোথায় কী পরিবর্তন হয়েছে। এবং তাঁরা আরো বেশ কিছু জমির দলিল দেখতে চেয়ে আবেদনও করেছিলেন। “আমরা এগুলো একটি আরেকটির সাথে তুলনা করে দেখছিলাম আর নিজেদেরই জিজ্ঞাসা করছিলাম: তারা বাড়ির বিবরণে কী ধরনের পরিবর্তন করেছে? বর্গমিটারের হিসেবে? আইনজীবীর নামে? আবেদনপত্রের পেছনে থাকা কোম্পানিতে?
  • প্রাসাদটির ভার্চুয়াল ট্যুর তৈরির জন্য তারা একটি থ্রিডি মডেলিং কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করেছেন। এর মাধ্যমে তারা প্রাসাদটির নকশা এবং চোখধাঁধানো জাঁকজমকের চিত্র তুলে ধরতে চেয়েছেন। একই সঙ্গে এফবিকের অনুসন্ধানকারীদের মনোবলও বাড়াতে চেয়েছেন। পেভচিক বলেছেন, ডেটাকে থ্রিডি মডেলের সঙ্গে মেলানোর বিষয়টি এবারই প্রথম। দলটি প্রতিটি অনুসন্ধানের জন্য নতুন নতুন কৌশল নিয়ে কাজের চেষ্টা করে, তাদের ভাষায়, “মজা ধরে রাখার জন্যে”।
  • প্রাসাদের জায়গাটিতে যে কিছু একটা ঘটে চলেছে তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য ড্রোন ব্যবহার করেছিল এফবিকে দল। ২০২০ সালে ফাঁস হওয়া ছোটখাট কিছু তথ্যের ওপর ভিত্তি করে তাদের এমন অনুমান তৈরি হয়েছিল। পরবর্তীতে ড্রোন ফুটেজ থেকে দেখা যায়, সত্যিই সেখানে বিপুল অর্থব্যয়ে পুনঃসংস্কারের কাজ চলছে। অনুসন্ধানী দলটি উপলব্ধি করেছিল যে, এর মানে সেখানে হয়তো কয়েকশ শ্রমিক কাজ করছে, যারা এই জাঁকজমকের প্রত্যক্ষদর্শী। এবং তাদের মধ্যে কেউ কেউ সোর্স হিসেবে কাজ করতে পারে। এভাবে নতুন তথ্য পাওয়া এবং দর্শকদের মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্য ড্রোন ভিডিও ফুটেজ প্রথমবারের মতো ব্যবহার করেছে এফবিকে। আগে, দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদদের বাড়ির ভিডিও ধারণ করার জন্য তারা প্যারাগ্লাইডার পাইলট ভাড়া করতো। 

প্রাসাদের এই সম্পত্তিটি যে ভ্লাদিমির পুতিনেরই, তা ভালোভাবে প্রমাণ করার জন্য এটিকে ঘিরে কী পরিমাণ বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে, তার প্রমাণ সংগ্রহ করেছে এফবিকে। এই রেকর্ডটি থেকে দেখা যায়: এটিকে এমনভাবে নো ফ্লাই জোন ঘোষণা করা হয়েছে, যা সাধারণত করা হয় কোনো নিউক্লিয়ার স্থাপনার ক্ষেত্রে। স্ক্রিনশট

  • টেলিগ্রামে চ্যাট বট ব্যবহার করেছে এফবিকে দল। অনুসন্ধানটির অধিকাংশ সময়ে উঁচু-মানের কোনো প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়নি। তবে গাড়ি নিবন্ধন নম্বর ও ট্রাফিক জরিমানার রেকর্ড থেকে সোর্স ও টার্গেটের তথ্য বের করার জন্য গেটকন্ট্রাক্ট নামের টেলিগ্রাম বট মাঝেমধ্যে ব্যবহার করা হয়েছে। পেভচিক বলেছেন, “গুগলে সার্চ করে সহজে পাবেন না, এমন অনেক তথ্য খুঁজে বের করার জন্য বেশ কিছু টেলিগ্রাম বট পাওয়া যায়। বিশেষ করে রাশিয়াতে এটি দারুনভাবে প্রাসঙ্গিক।”
  • স্যাটেলাইট ছবি মাপজোক করে বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে একটি হেলিপ্যাড ঠিক কতটা জায়গা জুড়ে আছে; এবং কেন তৃতীয় হেলিপ্যাডটিকে তিনটি সুড়ঙ্গের প্রবেশমুখসহ একটি বিশাল ঢিবিতে বদলে ফেলা হয়েছে। মাপজোক করে দেখা যায়: ৫৬ মিটার দীর্ঘ ও ২৬ মিটার প্রশস্ত জায়গাটিকে রীতিমত একটি আইস হকি মাঠে বদলে ফেলা হয়েছে। পরবর্তীতে সেখানকার ঠিকাদাররাও তথ্যটি নিশ্চিত করেছেন। 

স্যাটেলাইট ছবি থেকে সরাসরি কোনো ভূগর্ভস্থ স্থাপনা দেখার সুযোগ নেই। তবে অনুসন্ধানকারীরা এই উঁচু ঢিবির দৈর্ঘ্য-প্রস্থ পরিমাপ করে নিশ্চিত হয়েছেন যে এটি বানানো হয়েছে আইস হকির মাঠ হিসেবে। স্ক্রিনশট

  • তারা সোশ্যাল মিডিয়া সম্পর্কের মানচিত্র তৈরি করেছেন প্রকল্পটির সঙ্গে জড়িত প্রতিটি ব্যক্তির। বিশেষ করে, পাওয়ার অব অ্যাটর্নি নথিতে যাদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তাদের প্রত্যেকের নাম ধরে বিভিন্ন পেশাগত ও সোশ্যাল মিডিয়া নেটওয়ার্কে গবেষণা করেছে এফবিকে দল। 
  • নিজেদের চিহ্ন লুকোনোর জন্য এফবিকের অনুসন্ধানী দল কিছু পাল্টা কৌশল ব্যবহার করেছেন। যেমন, সিম কার্ড বদলে ফেলা ও বার্নার ফোন ব্যবহার করা। কারণ তারা ভালো করেই জানতেন, দলটির প্রতিটি পদক্ষেপ নজরদারির মধ্যে রাখা হচ্ছে। 
  • গৃহসজ্জার জন্য ব্যবহৃত সামগ্রী ও আসবাবের দাম খুঁজে পাওয়ার জন্য তারা অফলাইনে চলে গেছেন। প্রাসাদের মেঝের নকশায় পাওয়া একটি লোগো থেকে তারা জানতে পারেন সেটির সঙ্গে একজন ইতালিয়ান ডিজাইনারের সংযোগ আছে। এরপর ক্রেতা সেজে তাদের কাছ থেকে একটি ক্যাটালগ সংগ্রহ করেন এফবিকের অনুসন্ধানকারীরা। এবং ক্যাটালগ ও প্রাসাদের ভেতরকার বিভিন্ন ছবির তুলনা করে তারা এসব আসবাবের দাম সনাক্ত করেছেন। যেমন, একটি সোফার দাম ২৭ হাজার ডলার এবং একটি ড্রিংকস টেবিলের দাম ৫৪ হাজার ডলার।  

এই সবকিছু এক জায়গায় আনতে বেশ কয়েক মাস লেগে গেছে এফবিকে দলের। থ্রিডি মডেলিংয়ের বাইরে এই ভিডিও সংক্রান্ত সব কাজই হয়েছে তাদের নিউজরুমে। তাদের কর্মীরাই ভিডিও সম্পাদনা ও গ্রাফিক্সের কাজ করেছেন। নেপথ্য সঙ্গীত বাছাইয়ের কাজ করেছেন পেভচিক। 

তবে শেষপর্যন্ত, পেভচিকের দলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল প্রাসাদটির সঙ্গে পুতিনের সংযোগ দেখানো। পুতিনের মুখপাত্র অবশ্য এটিকে উড়িয়ে দিয়েছে “পুরো আজগুবি” বলে। কিন্তু ভিডিওটি এখনই ১১ কোটি ভিউ কুড়িয়েছে, আর তাতে মনে হচ্ছে ক্রেমলিন দ্রুতই এই বিতর্কে হেরে যাচ্ছে।

পেভচিক ব্যাখ্যা করে বলেছেন, “আমরা একটি বোর্ডের সামনে কাগজপত্র নিয়ে দুই মাসের বেশি সময় ধরে কাজ করেছি। এবং বোর্ডে এমন ১০০টি পয়েন্ট লিখেছি যা থেকে দেখানো যায় প্রাসাদটি পুতিনের। সেই তালিকা থেকে আমরা প্রধান ২৫টি যুক্তি ও সম্পর্ক বেছে নিয়েছি, যেগুলো তথ্যচিত্রে জায়গা করে নিয়েছে। আমরা এটিকে যে কোনো যুক্তিযুক্ত সংশয়ের উর্ধ্বে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছি।

আরো পড়ুন

রাশিয়ার রোমান আনিন তার অনুসন্ধানে যেসব টুল ব্যবহার করেন

স্যাটেলাইট ছবি কোথায় পাবেন এবং কীভাবে ব্যবহার করবেন?

ভিজ্যুয়াল ফরেনসিক: ছবি ব্যবচ্ছেদ করে যেভাবে নিরাপত্তা বাহিনীর হামলা উদঘাটন করছেন রিপোর্টাররা

আগামী ২৫ মার্চ জিআইজেএন-এর একটি ওয়েবিনার আয়োজিত হতে যাচ্ছে আলেক্সি নাভালনিকে বিষপ্রয়োগের ওপর করা অনুসন্ধান নিয়ে। এখানে বক্তা হিসেবে থাকবেন বেলিংক্যাটের ক্রিস্টো গ্রোজেভ, এবং ইনসাইডার রাশিয়ার রোমান দোব্রোখোটভ। বিস্তারিত জানতে চোখ রাখুন আমাদের ওয়েবসাইটে।


রোয়ান ফিলিপ জিআইজেএন-এর রিপোর্টার। দক্ষিণ আফ্রিকার সানডে টাইমসে কাজ করেছেন প্রধান প্রতিবেদক হিসেবে। বিদেশ প্রতিনিধি হিসেবে রাজনীতি, দুর্নীতি ও সংঘাত নিয়ে রিপোর্ট করেছেন বিশ্বের দুই ডজনেরও বেশি দেশ থেকে।

ক্রিয়েটিভ কমন্স লাইসেন্সের অধীনে আমাদের লেখা বিনামূল্যে অনলাইন বা প্রিন্টে প্রকাশযোগ্য

লেখাটি পুনঃপ্রকাশ করুন


Material from GIJN’s website is generally available for republication under a Creative Commons Attribution-NonCommercial 4.0 International license. Images usually are published under a different license, so we advise you to use alternatives or contact us regarding permission. Here are our full terms for republication. You must credit the author, link to the original story, and name GIJN as the first publisher. For any queries or to send us a courtesy republication note, write to hello@gijn.org.

পরবর্তী

কেস স্টাডি

মোটরসাইকেলে চেপে দুর্গম এলাকা চষে নাইজেরিয়ার এক সাংবাদিক যেভাবে সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের চিহ্নিত করেছেন

নাইজেরিয়ান সাংবাদিক ইউসুফ আনকা, তিন বছর ধরে মোটরসাইকেলে করে উত্তর-পশ্চিম নাইজেরিয়ার বিপজ্জনক অঞ্চলগুলো চষে বেড়িয়েছেন এবং বিবিসি আফ্রিকা আইয়ের হয়ে নিজ অঞ্চলের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো নিয়ে অনুসন্ধান করেছেন।

কেস স্টাডি

অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় জরিপ: যে খবর এড়িয়ে যাওয়া কঠিন

কখনো কখনো ছোট ছোট স্থানীয় সংবাদপত্র এমন সব বড় খবরের জন্ম দেয়, যা হেভিওয়েট জাতীয় পত্রিকাগুলোতে খুঁজে পাওয়া যায় না। রাজধানী ঢাকা থেকে প্রায় দুইশ কিলোমিটার দূরে, যশোরের গ্রামের কাগজের ঘটনাও ঠিক একই রকম।

অনুসন্ধান পদ্ধতি শিক্ষাদান ও প্রশিক্ষণ

যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্তের অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ‘হাব’ যেভাবে একটি প্রজন্মের রিপোর্টারদের তৈরি করেছে

মেক্সিকো সীমান্তে কর্মরত সাংবাদিকদের জন্য তাঁদের পেশাটা ছিল যথেষ্ট চ্যালেঞ্জিং। কেন্দ্রে যাঁরা সাংবাদিকতা করেন, তাঁদের সঙ্গে দূরত্ব তো ছিলই, ছিল সার্বক্ষণিকি নিরাপত্তাহীনতাও। সাংবাদিকেরা একজোট হয়ে এই দূরত্ব ঘুঁচিয়ে আনতে গড়ে তোলেন একটি সংগঠন। প্রয়োজনীয়ল প্রশিক্ষণ শেষে হাজারো প্রতিকূলতার মধ্যেও তাঁরা অনুসন্ধান করে তুলে আনেন বেশ কিছু প্রতিবেদন।

অনুসন্ধান পদ্ধতি গবেষণা

ডেনমার্কের কল্যাণ সংস্থার অ্যালগরিদমপদ্ধতি নিয়ে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের অনুসন্ধান

কল্যাণ সহায়তা বণ্টন পদ্ধতিকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে অ্যালগরিদমভিত্তিক পদ্ধতি অনুসরণ করছিল ডেনমার্কের প্রতিষ্ঠান। অনুসন্ধানে দেখা গেল, বৈষম্য বিলোপে নেওয়া এই উদ্যোগে উল্টো বাড়ছে বৈষম্য।