Image: Shutterstock
ডেটা ও ভিজ্যুয়াল দিয়ে পরিবেশ বিষয়ক অনুসন্ধানী স্টোরিকে সমৃদ্ধ করুন
যখন হিমবাহ গলছে, বনে দাবানল বাড়ছে, আর সর্বকালের উষ্ণতম তাপমাত্রা প্রবণ অঞ্চলের তালিকায় ঢুকে পড়ছে ইউরোপও – তখন জলবায়ু পরিবর্তনের গভীরে সন্ধান করা পরিবেশগত স্টোরির প্রয়োজনীয়তাও অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে জরুরি হয়ে উঠছে৷
সম্প্রতি পুলিৎজার সেন্টারের পরিবেশগত অনুসন্ধানী সম্মেলনের ইন্টারকানেক্টেড: রিপোর্টিং দ্য ক্লাইমেট ক্রাইসিস শীর্ষক প্যানেলে পরিবেশ সাংবাদিক ও ডিজাইনারেরা বলেছেন, পরিবেশ বিষয়ক এই স্টোরিগুলোকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলার একটি উপায় হল ডেটা ও ডেটা ভিজ্যুয়ালাইজেশনের ব্যবহার।
থাইল্যান্ডের গণমাধ্যম পাঞ্চ আপ স্টোরিটেলার, ডিজাইনার, ডেটা বিশেষজ্ঞ এবং ডেভেলপারদের নিয়ে কাজ করে। এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা প্যাচার ডুয়াংক্ল্যাড বলেছেন, দর্শকদের আকৃষ্ট করা ও ধরে রাখার মূল চাবিকাঠি হল ডেটার্নিভর স্টোরি।
তিনি উপস্থিত শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে বলেন, “ডেটা নিজ থেকে কিছু বলতে পারে না, তবে রেখাচিত্র ও গল্পের কাঁধে চেপে হাজার শব্দ বলতে পারে।”
সম্প্রতি “এনক্রোচিং ফরেস্ট অ্যান্ড এনক্রোচিং পিপল (বন দখল ও মানুষ দখল),” নামে একটি অনুসন্ধান করেছে পাঞ্চ আপ, যার মূল বিষয়বস্তু থাই সরকারের বন উজাড় নীতি। বনাঞ্চলের ডেটা, সরকারি প্রতিবেদন ও বন পুনরুদ্ধারের মামলার তথ্য ব্যবহার করে, প্রকল্পটি তুলে এনেছে যে, মাত্র দুই বছরে (২০১৪ ও ২০১৫) সরকারী নীতির ফলে দেশটিতে বনবিধি লঙ্ঘনের ৩০ হাজারেরও বেশি মামলা জমেছে ৷
ডুয়াংক্ল্যাড বলেছেন, প্রকল্পটি শুরুই হয়েছে দেশটির ৪০% বনাঞ্চল পুনরুদ্ধারের সরকার ঘোষিত লক্ষ্যের প্রতি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে। এই লক্ষ্যই ছিল বন পুনরুদ্ধার নীতির মূল বিষয়। তিনি বলেন, “ডেটা খুঁজতে গিয়ে আরেকটি প্রশ্ন আমাদের সামনে আসে: ‘এমন একটি জোরালো পুনরুদ্ধার নীতির পরও থাইল্যান্ডে বনাঞ্চলের পরিমাণ কেন ততটা বদলায়নি?’ তাই আমাদের প্রশ্ন ছিল বন পুনরুদ্ধার নীতি আদৌ কাজ করেছে কি না।”
তিনি ব্যাখ্যা করে বলেছেন, এই অনুসন্ধান তাঁর দলকে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শিখিয়েছে; প্রথমটি হল “আরও ভালো প্রশ্ন না পাওয়া পর্যন্ত” ডেটায় চোখ রাখা। কিন্তু পাঠককে ধরে রাখার জন্য শুধু ডেটাই যথেষ্ট নয় বলে তিনি মনে করেন।
এনক্রোচিং প্রকল্পে ডেটার পাশাপাশি একটি তথ্যবহুল ইন্টারেক্টিভ মানচিত্র আছে, যেখানে পাঠক চাইলে দেখতে পারেন – বন উজাড় নীতিমালার কারণে বিভিন্ন অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রা কীভাবে প্রভাবিত হয়েছে।
ডুয়াংক্ল্যাড জানান, এই প্রকল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল মানুষের গল্প ও ডেটাকে এক সুতোয় গাঁথা। দলটি ৩৬০ ডিগ্রী ক্যামেরা ফুটেজের সাহায্যে তুলে ধরেছে যে স্থানীয়দের জীবনাচারের কারণে বনের ক্ষতি হয় সামান্যই। তিনি বলেন, “বন ও মানুষ পাশাপাশি মিলেমিশে থাকতে পারে কিনা, তা নিয়ে গ্রামবাসী, আদিবাসী জনগোষ্ঠী ও জাতীয় উদ্যানের কর্মকর্তাদের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরতে তাঁদের সাক্ষাৎকার নিয়েছি আমরা।”
আমাজন থেকে যা শেখার আছে
আমাজোনিয়া মিনাদা আদিবাসীদের ভূমি ও সুরক্ষিত এলাকায় অবৈধ খননকাজের জন্য আবেদন রিয়েল টাইমে চিহ্নিত করে। এর প্রতিষ্ঠাতা, দুর্নীতি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ব্রাজিলীয় সাংবাদিক হিউরি পটার বলেছেন, প্রকল্পের শুরুতে তিনি সবসময় নিজেকে একই প্রশ্ন করেন: “এই মানচিত্রে বা এই সংখ্যাগুলোতে আমি কী দেখতে পাচ্ছি?”
তিনি উপস্থিত শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে বলেন, “মানচিত্রে কোনো বিন্দু থাকলে আপনাকে খুঁজে বের করতে হবে এই বিন্দুর সঙ্গে, এই অবৈধ খনি প্রকল্পের সঙ্গে, কার নাম জড়িত: কোনো ব্যক্তি, ব্যবসায়ী, কোম্পানি, নাকি খোদ সরকার?”
পটার সাংবাদিকদের সতর্ক হতে বলেছেন, কারণ আমাজোনিয়া মিনাদার কেন্দ্রীয় মানচিত্রটি সরকারি ডেটা ব্যবহার করে তৈরি, যদিও তথ্যগুলো উন্মুক্ত ও আনুষ্ঠানিক।
তিনি বলেন, “এ ধরণের ডেটা উন্মুক্ত হলেও খুব বিশ্বাসযোগ্য নয়। আপনাকে খুব সাবধানে থাকতে হবে। দু’বার যাচাই করতে হবে।”
পটারের মতে, এমনকি সমস্ত ডেটা থাকার পরও পরিবেশ বিষয়ক স্টোরিতে “প্রথাগত সাংবাদিকতা” এখানো গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে আক্রান্ত জনগোষ্ঠী ও তাদের নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থারও সাক্ষাৎকার থাকবে। একটি অনুসন্ধানের জন্য, তিনি অনেক বৈমানিকের সঙ্গে কথা বলেছেন, কারণ যেসব অবৈধ খনি নিয়ে অনুসন্ধান চলছিল, সেগুলোতে অবৈধ পণ্য পরিবহনের জন্য বিমান ব্যবহার করা হয়েছে।
তবে তিনি আরও বলেছেন, মানচিত্র ও ডেটায় এমন আরও তথ্য থাকে যা অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের দুর্দান্ত স্টোরির পথ দেখাতে পারে। একটি মানচিত্রে তিনি গানা গোল্ড মাইনিং কোম্পানির উপস্থিতি আবিষ্কার করেছিলেন। প্রতিষ্ঠানটি নিয়ে ব্রাজিলের পুলিশও তদন্ত করেছে। এক বছর পর তিনি দ্বিতীয় স্টোরি করতে গিয়ে দেখতে পান, কোম্পানিটি সোনা পরিশোধনের জন্য যে নতুন প্ল্যান্টের সঙ্গে চুক্তি করেছে সেটি অর্থ পাচার ও জালিয়াতির দায়ে দোষী সাব্যস্ত বেলজিয়ান ধনকুবের সিলভাইন গোয়েটজের টাকায় চলে।
পটার ব্যাখ্যা করে বলেন, “এই লোকগুলোর নাম দিয়ে আমরা তাদের সঙ্গে জড়িত কোম্পানিগুলোকে ট্র্যাক করতে সক্ষম হই।” মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সোনার ক্রেতাদের তথ্য উন্মুক্ত বলে তিনি জানতে পারেন যে এর ক্রেতা – বেশ, বড় বড় মার্কিন কর্পোরেশন। “আর এই নথিগুলো আমাদের তাই বলেছে।”
ডেটা সাংবাদিকতার নেটওয়ার্ক তৈরি
পূর্ব আফ্রিকায়, জিও-জার্নালিস্টদের একটি আন্তঃসীমান্ত জোট, ডেটা ব্যবহার করে খতিয়ে দেখছে- জলবায়ু পরিবর্তন, জলবিদ্যুৎ বাঁধ, জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং অন্যান্য চ্যালেঞ্জের কারণে নীল নদের তীরে কী প্রভাব পড়ছে৷
ইনফোনাইলের উগান্ডাভিত্তিক মার্কিন সাংবাদিক অ্যানিকা ম্যাকগিনিস বলেছেন, লাখ লাখ লোকের সহায় হলেও পানি-স্বল্পতার কারণে নীল নদ অববাহিকা এখন পরিবেশগত ঝুঁকির মুখে রয়েছে।
২০১৭ সাল থেকে, ইনফোনাইল দলটি এই অঞ্চলের বিভিন্ন হ্রদের জীববৈচিত্র্য, প্লাস্টিক দূষণ ও করোনা মহামারি চলাকালীন পানি সংকটের মতো বিষয় নিয়ে ২৫০ টিরও বেশি প্রকল্পে কাজ করেছে। সংস্থাটি অনুদানের মাধ্যমে সাংবাদিকদের খবর প্রকাশে সহায়তা করে, রিপোর্টারদের যৌথ উদ্যোগে উৎসাহ জোগায় এবং নির্ভরযোগ্য সোর্সের নাগাল পেতে সাহায্য করে। নীল নদ প্রবাহিত হয়, এমন ১১টি দেশে ডেটাভিত্তিক রিপোর্ট করার উপায় নিয়ে প্রায় ১৫০ জন সাংবাদিককে তারা প্রশিক্ষণ দিয়েছে৷
তাদের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি প্রকল্পের মধ্যে আছে পূর্ব আফ্রিকায় বন্যপ্রাণী পাচার ও সংরক্ষণ নিয়ে দ্য প্যানডেমিক পোচার্স; ভূ ও জলভাগে বিদেশি কোম্পানির দখলদারিত্ব নিয়ে সাক্ড ড্রাই; এবং লেক ভিক্টোরিয়ার চারপাশে প্লাস্টিক দূষণের স্টোরি নিয়ে প্লাস্টিক ভিক্টোরিয়া।
ম্যাকগিনিস বলেছেন, “আমাদের কর্মসূচিতে থাকা সব সাংবাদিক একটি মেন্টরশিপ ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে যান। ডেটা সাংবাদিকতা ও বিজ্ঞান বিষয়ক রিপোর্টিং নিয়ে এই কার্যক্রমের সময়কাল তিন থেকে ছয় মাস। তাই এই কর্মসূচির শেষ দিকে, আমাদের লক্ষ্য থাকে যেন তাঁরা সবাই নিজেদের স্টোরির জন্য একটি ভিজ্যুয়ালাইজেশন তৈরি করতে পারেন, আর তা যেন স্থানীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়।”
ম্যাকগিনিস বলেছেন, কোন ডেটা ভিজ্যুয়ালাইজেশন কার্যকর হবে তা জানা অনেক সময় কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। “ডেটা দিয়ে শুরু করা অনেক সাংবাদিক বলেন, ‘ঠিক আছে, আমার স্টোরি এই বিষয় নিয়ে, আর আমি এই ডেটা খুঁজে পেয়েছি।’ অথচ ভিজ্যুয়ালাইজেশন তৈরি হওয়ার পর বোঝা যায় যে স্টোরিতে এই চার্ট তেমন কোনো মাত্রা যোগ করছে না।”
তবে ডুয়াংক্ল্যাড ও ম্যাকগিনিস দু’জনই এক সুরে বলেছেন, অনেক সময় একটি আকর্ষণীয় স্টোরি তুলে ধরতে বিনামূল্যে ব্যবহারযোগ্য টুলগুলোই যথেষ্ট; ভালো উদাহরণ হিসেবে তিনি ডেটার্যাপার, ফ্লোরিশ ও গুগল শিটের নাম উল্লেখ করেছেন। “বিনামূল্যে ব্যবহারযোগ্য টুল কাজে লাগিয়ে চেষ্টা করুন, সেগুলো নিয়ে জানুন, ডেটা নিয়ে খেলুন,” ডুয়াংক্ল্যাড বলেন৷ আর পটার বলেছেন, তিনি প্রায়ই ওপেন সোর্স ভৌগলিক তথ্য ব্যবস্থা কিউজিআইএস ব্যবহার করেন।
একটি জায়গায় প্যানেল সদস্যদের সবাই একমত: ডেটা সাংবাদিকতা ও ভিজ্যুয়ালাইজেশন টুল জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে প্রতিবেদন তৈরিতে বেশ সাহায্য করতে পারে। অনেকে এই জলবায়ু পরিবর্তনকে “আমাদের সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্টোরি” বলে থাকেন। চাইলে প্যানেলের মডারেটর মালয়েশিয়াভিত্তিক পুরস্কারজয়ী ফ্রিল্যান্স বিজ্ঞান সাংবাদিক ইয়াও-হুয়া ল-এর মতামত বিবেচনা করে দেখতে পারেন। “প্রতিটি স্টোরিই একটি পরিবেশগত স্টোরি,” হুয়া ল বলেন।
নিচে পুলিৎজার সেন্টার প্যানেলের পুরোটা দেখুন:
আরও পড়ুন
পরিবেশগত অনুসন্ধানের জন্য রিমোট সেন্সিং ও ডেটা টুল
পরিবেশ সাংবাদিকেরা নাসার নতুন ল্যান্ডস্যাট ৯ স্যাটেলাইট ব্যবহার করবেন যেভাবে
আফ্রিকা থেকে: পরিবেশ নিয়ে অনুসন্ধানে যেভাবে শক্তি যোগাচ্ছে জিও-জার্নালিজম
মারিয়েল লোজাদা জিআইজেএনের স্প্যানিশ ভাষার সহযোগী সম্পাদক এবং নিউ ইয়র্ক সিটি ভিত্তিক ভেনেজুয়েলান ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক। তিনি সিটি ইউনিভার্সিটি অব নিউ ইয়র্কের ক্রেইগ নিউমার্ক গ্রাজুয়েট স্কুল অব জার্নাালিজম থেকে এনগেজমেন্ট জার্নালিজমে স্নাতকোত্তর করেছেন, এবং তিনটি দেশে স্বাস্থ্য, জেন্ডার, অভিবাসন, ও মানবাধিকার নিয়ে রিপোর্ট করেছেন।