Image: Rocky Kistner for GIJN
হুমকির মুখে, তবু ঐক্যবদ্ধ: জিআইজেসি২৩ হাইলাইটস
আর্টিকেলটি পড়ুন এই ভাষায়:
বৈশ্বিক মহামারি বলুন, ইউক্রেনে রাশিয়ার পূর্ণ মাত্রার আগ্রাসন বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় আকস্মিক ও বড় ধরনের অগ্রগতি। ২০১৯ সালে সবাই যেবার সশরীরে গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম কনফারেন্সে অংশ নিলেন. তারপর থেকে এমন অনেক ঘটনা বিশ্বকে আলোড়িত করেছে, যার প্রভাব সাংবাদিকতায়ও পড়েছে।
এই চার বছরে, সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য হুমকির তীব্রতা বেড়েছে এবং আরও জটিল আকার নিয়েছে। আমরা অবশ্য এর বিপরীত স্রোতও দেখতে পেয়েছি। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা এখন অনেক বেশি শক্তিশালী ও কৌশলী হয়েছে। সাংবাদিকদের মধ্যে জোটবদ্ধতা ও একতা আরও বেড়েছে।
এর বাস্তব প্রমাণ ১৩তম গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম কনফারেন্স (#GIJC23)। সুইডেনের গোথেনবার্গের সভেনস্কা ম্যাসান সম্মেলন কেন্দ্রে ১৩০টিরও বেশি দেশ থেকে ২ হাজার ১০০ জনেরও বেশি সাংবাদিকের অংশগ্রহণের মাধ্যমে, এটি রীতিমতো সাংবাদিকতার সর্ববৃহৎ সম্মেলনে পরিণত হয়েছে।
চারদিনব্যাপী #জিআইজেসি২৩ সম্মেলনের অংশগ্রহণকারীরা তাদের সতীর্থ বিশেষজ্ঞ সাংবাদিকদের কাছ থেকে বিভিন্ন কৌশল ও পরামর্শ জেনে সমৃদ্ধ হয়েছেন এবং আন্তঃসীমান্ত অংশীদারিত্বের জন্য নতুন সংযোগ গড়েছেন। স্ল্যাপ (হয়রানিমূলক মামলা) থেকে সাইবার গুপ্তচরবৃত্তি, সংগঠিত অপপ্রচার থেকে মৃত্যুর সত্যিকারের হুমকিসহ গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর নানা ধরনের আক্রমণের বিপরীতে, রুখে দাঁড়ানোর নতুন সাহস ও জ্ঞান সঞ্চয় করেছেন।
এবারের সম্মেলনের মূল বক্তা ও সিটিজেন ল্যাবের পরিচালক রন ডেইবার্ট ডিজিটাল হ্যাকিংয়ের ব্যাপক ও অপ্রতিরোধ্য-প্রায় হুমকির প্রকৃত চিত্র তুলে ধরেন। তিনি উপস্থিত সবাইকে হাল ছেড়ে না দিয়ে বা হার না মেনে, বরং যুথবদ্ধ হয়ে পাশার দান পাল্টে দিতে এবং সাংবাদিকের লক্ষ্যবস্তু বানানো এই নজরদারি শিল্প নিয়ে অনুসন্ধানে নামতে উৎসাহিত করেন। তিনি বলেন, “আমাদের জোটবদ্ধতা অবশ্যই উদযাপন করার মতো বিষয়।”
এখানে সম্মেলনের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি বিষয় তুলে ধরা হলো :
গোটা বিশ্ব থেকে রেকর্ডসংখ্যক সাংবাদিকদের অংশগ্রহণ
এই সম্মেলনে ১৩২টি দেশ থেকে ২ হাজার ১৩৮ জন নিবন্ধিত অংশগ্রহণকারী যোগ দেন, যা একে ইতিহাসের বৃহত্তম অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা সম্মেলনে পরিণত করেছে। নিছক সংখ্যা নয়, সম্মেলনের বক্তা ও সাংবাদিকদের বৈচিত্র্যপূর্ণ উপস্থিতির কথাও বলতেই হয়। যেমন, গ্লোবাল সাউথের (অনগ্রসর দক্ষিণ) অঞ্চলের শত শত ফেলো এবং অসংখ্য আদিবাসী অনুসন্ধানী আউটলেটের অংশগ্রহণ।
হুমকি, হুমকি, এবং আরও হুমকি
মূল প্রবন্ধ ও পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনের থিম ছাড়াও সম্মেলন জুড়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল সাংবাদিকতার জন্য ডিজিটাল হুমকির বিষয়গুলো। প্রথমত, আইস্টোরিস_মিডিয়ার দুইজন অংশগ্রহণকারীকে কনফারেন্সে যোগ না দিতে হুমকি দেওয়া হয়, এবং তাদের বিস্তারিত তথ্য ও ভ্রমন বিবরণ প্রকাশ করে ভয় ছড়ানো হয়।
এরপরে, খবর ছড়িয়েছিল যে ফরাসি প্রতিবেদক আরিয়ান লাভিয়েকে ফ্রান্সে আটক করা হয়েছে এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা সংস্থার লোকেরা তার বাড়িতে অভিযান চালিয়েছে। এ ঘটনা সম্মেলনে উপস্থিত সাংবাদিক সম্প্রদায়ের মধ্যে বড় ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।
হুমকি থাকলে যত্নেরও দরকার হয়
নিউজরুমের নেতারা কীভাবে ক্রমবর্ধমান ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশের চাপ সামলাবেন এবং রাগে ফেটে না পড়ে পরিস্থিতিকে আরো ভালভাবে মোকাবিলা করতে পারেন সে সম্পর্কিত বোঝাপড়া তৈরির জন্য সম্মেলনের একটি জনপ্রিয় অধিবেশন ছিল ডার্ট সেন্টারের এলেনা নিউম্যানের “কোপিং উইথ স্ট্রেস, ট্রমা অ্যান্ড বার্নআউট ( ফর ম্যানেজার্স” বিষয়ক কর্মশালা। এছাড়াও রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স এবং সিটিজেন ল্যাব ডিজিটাল নিরাপত্তার ওপর একাধিক কর্মশালা পরিচালনা করে। যেমন সম্মেলনে উপস্থিত সাংবাদিকদের ফোনগুলো স্পাইওয়্যার হামলার শিকার হয়েছে কিনা তা পরীক্ষা করা হয়, এবং যদি আক্রান্ত হয়ে থাকে তাহলে কীভাবে তা থেকে সুরক্ষিত থাকা যায় সে বিষয়ক কৌশল ও পরামর্শ প্রদান করা হয়।
…কিছু হাস্যরস ও সুরের মূর্ছনা
দুর্নীতি, অর্থ-পাচার, জলবায়ু পরিবর্তন, অলিগার্ক, যুদ্ধাপরাধ ইত্যাদি নিয়ে কয়েকদিনের গুরুগম্ভীর সেশনের পর কিছু উচ্ছাস ও উদযাপনের প্রয়োজন ছিল বৈকি। জিআইজেএনের নিজস্ব গানের দল, দ্য মাকরেকার্সের গানের তালে সবার স্বত:স্ফূর্ত নৃত্য পরবর্তীতে ইন্সটাগ্রামে দারুণ সব আমুদে ‘স্টোরি’তে পরিণত হয়।
প্রযুক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ
প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে সাংবাদিকদের সৃজনশীলতা, কর্মপদ্ধতি ও কৌশলগুলো উন্নত করারও তাগিদ ছিল। তাই আমাদের সেশনগুলোতে এমন সব বিশেষজ্ঞ উপস্থিত ছিলেন যারা প্রযুক্তির দৌড়ে এগিয়ে আছেন। পাশাপাশি যাদের ওপেন সোর্স অনুসন্ধান থেকে শুরু করে হ্যাকারদের সঙ্গে কাজ করা, ডিজিটাল বিজ্ঞাপন, ক্রিপ্টোকারেন্সি, ওয়েব আর্কাইভিং, ডেটা স্ক্র্যাপিং কিংবা সামাজিক মাধ্যমে অনুসন্ধানের মতো বিষয়গুলোতে দখল রয়েছে।
(সতর্কতার সঙ্গে) এআই যুগের সূচনা
হুমকি হোক কিংবা সম্ভাবনাময় টুল— কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) যে সাংবাদিকতার ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে এটা স্পষ্ট ছিল। লিন্ডহোলমেন সায়েন্স পার্কে অনুষ্ঠিত সম্মেলনের প্রথম দিন এআই, এর ঝুঁকি ও সম্ভাবনা কীভাবে ছোট নিউজরুমকে সাহায্য করতে পারে এমন নানা আলোচনায় মুখর ছিল!
গ্লোবাল শাইনিং লাইট অ্যাওয়ার্ডস
সম্মেলনের অন্যতম আকর্ষণ ছিল গ্লোবাল শাইনিং লাইট অ্যাওয়ার্ডের বিজয়ীদের নাম ঘোষণার ক্ষণটি। ২০১৯ সালের পর প্রথমবারের আবার এর ঘোষণা দেওয়া হয়। বরাবরের মতো এবারও ব্যতিক্রমী অনুসন্ধানী প্রতিবেদনগুলোকে পুরস্কৃত করা হয়। যেমন, ভেনেজুয়েলায় অবৈধ খনন, উত্তর-পশ্চিম নাইজেরিয়ায় পদ্ধতিগত দস্যুতা, বাংলাদেশে গোপন বন্দীশালা উন্মোচন, দক্ষিণ আফ্রিকায় পুলিশের বর্বরতা, ইউক্রেনের ইজিয়ামে গণকবর এবং উত্তর মেসিডোনিয়ায় কভিড-১৯ মহামারির সময় মুনাফা লুটে নেয়া। সব বিজয়ীদের অভিনন্দন!
https://twitter.com/ZulkarnainSaer/status/1705205729878020429
অতঃপর, দায়িত্ব হস্তান্তর
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় জিআইজেএন কমিউনিটি বিদায় জানিয়েছে ২০১৩ সাল থেকে সংগঠনটিকে নেতৃত্ব দেওয়া এবং প্রথম নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করা ডেভিড কাপলানকে। এসময় অনেকেরই চোখ আদ্র হয়ে ওঠে। ২০০১ সাল থেকে ডেভিড জিআইজেএনের প্রতিটি সম্মেলনে উপস্থিত থেকেছেন। শেষ দিন গালা ডিনার ইভেন্টে তিনি জিআইজেএনের নতুন নির্বাহী পরিচালক, এমিলিয়া ডিয়াজ-স্ট্রাকের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করেন।