At the panel on
চেহারা শনাক্তকরণ ও গবেষণার অত্যাধুনিক যত কৌশল
প্রচলিত গবেষণা পদ্ধতির পাশাপাশি উচ্চ-প্রযুক্তির টুল ব্যবহার অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাকে সমৃদ্ধ করে। দ্রুত বদলে যাওয়া বৈশ্বিক পটভূমিতে প্রযুক্তিসমৃদ্ধ নিউজরুম আর সেরা কৌশল জানা রিপোর্টারেরাই নেতৃত্ব দেন এবং প্রভাবশালী গল্পগুলো তুলে ধরতে সক্ষম হন।
১৩তম গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম কনফারেন্সে (#জিআইজেসি২৩) অত্যাধুনিক গবেষণা কৌশল নিয়ে অনুষ্ঠিত একটি প্যানেলে ডাটালিডসের প্রধান নির্বাহী সৈয়দ নাজাকাতের সঞ্চালনায় অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন রিপোর্টিং প্রজেক্টের (ওসিসিআরপি) গবেষণা প্রধান কারিনা শেড্রোফস্কি এবং ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টসের (আইসিআইজে) প্রশিক্ষণ ব্যবস্থাপক জেলেনা কসিক তাদের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনগুলো নিয়ে আলোচনা করেন। সেখানে তারা ফেসিয়াল রিকগনিশন (চেহারা শনাক্তকরণ) সার্ভিস থেকে শুরু করে ডকুমেন্ট শ্রেণীবিন্যাস পর্যন্ত তাদের পছন্দের বিভিন্ন পদ্ধতি এবং টুল তুলে ধরেন।
চেহারা শনাক্তকরণ ও অন্যান্য
এ সময় শেড্রোফস্কি তার সর্বশেষ প্রকল্পগুলোর মধ্যে একটির কথা উল্লেখ করেন, যেখানে তিনি তার প্রিয় একটি টুল ব্যবহার করে রাশিয়ার শিক্ষকদের মধ্যে কথিত ক্রিপ্টোকারেন্সি কেলেঙ্কারি অনুসন্ধান করেছিলেন। সূত্র বলতে তার কাছে ছিল মাত্র একটি আলোকচিত্র। আর কিছু নয়। অনুসন্ধানের শুরুটা তিনি করেন পিমআইস ব্যবহারের মাধ্যমে। এটি চেহারা শনাক্তকরণে সক্ষম একটি রিভার্স ইমেজ (টেক্সের পরিবর্তে, যা প্রাথমিক ইনপুট হিসাবে ভিজ্যুয়াল ডেটা ব্যবহার করে) অনুসন্ধান পরিষেবা।
পিমআইস তাকে লিংকসহ অনেকগুলো ফলাফল দিয়েছিল, এবং তাতে একজন ব্যক্তির নামও ছিল। সেখানে তিনি একই ব্যক্তির আরেকটি সম্ভাব্য আলোকচিত্র খুঁজে পান। এরপর তিনি অ্যামাজনের রিকগনিশন-এর শরণাপন্ন হন যা চেহারা তুলনা করে ছবিগুলো একই ব্যক্তির কিনা তা চিহ্নিত করতে পারে। দুটি ছবির মধ্যে ৯৮ শতাংশ মিল খুঁজে পাওয়া যায়। শেড্রোফস্কি অবশ্য চেহারা শনাক্তকরণ পরিষেবা থেকে প্রাপ্ত ফলাফল যাচাইয়ের ওপর জোর দেন— এমনকি উচ্চমাত্রায় নির্ভুল ফলাফলের আশ্বাস থাকলেও— কেননা মাঝে মাঝে এ পরিষেবাগুলো সঠিক ফলাফল দিতে ব্যর্থ হতে পারে।
আরেকটি ঘটনায় পিমআইস থেকে ফলাফল না পাওয়ায়, তিনি সার্চফরফেসেজ এর শরনাপন্ন হন। এটি এমন একটি পরিষেবা যা রাশিয়ার জনপ্রিয় সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ভিকে (ভিকোনট্যাকটে)-এর কন্টেন্ট ইনডেক্স করে। তার মূলত যা যা প্রয়োজন ছিল, এখানে তিনি তা পেয়ে যান।
তৃতীয় উদাহরণ হিসাবে তিনি একজন ব্যবসায়ীর গল্প তুলে ধরেন, যিনি নিষেধাজ্ঞা আরোপিত এক রাশিয়ান অলিগার্কের প্রক্সি হিসাবে কাজ করতেন। একজন রিপোর্টার ওই ব্যবসায়ীর ছেলের পরিচয় প্রমাণের জন্য শেড্রোফস্কির সহযোগিতা চান। কারণ, প্রতিবেদক যখন ছেলেটির সঙ্গে কথা বলেছিলেন তখন সে দাবি করেছিল যে, লোকটি তার বাবা নয়।
শেড্রোফস্কির কাছে শুধু এ তথ্যটুকুই ছিল— তাদের পুরো নাম, ছেলেটির জন্ম তারিখ এবং ছেলেটি রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোন ব্যাংকে কাজ করত। এ পর্যায়ে তিনি পিপল ব্যবহার করেন। এটি ব্যক্তির অনলাইন ও অফলাইন উপস্থিতি তুলে ধরতে সক্ষম। কোনো ব্যক্তির ইমেইল বা ফোন নম্বর দিলে এই টুলটি তার বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম একাউন্ট এবং (বাসা বা অফিসের) ঠিকানার সন্ধান দিতে পারে।
ছেলেটির নাম ছিল একেবারেই সাধারণ বা প্রচলিত। অর্থাৎ, এই নামে আরো অনেক ব্যক্তি আছেন। তাই সেই নাম দিয়ে সার্চ দেওয়ার পর অনেক ফলাফল আসে। একটি ফলাফলে একটি ব্যাংকের ডোমেইনসহ ইমেইল ঠিকানা ছিল। সেই সূত্র ধরে তিনি একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্টের হদিস পান এবং ধরে নেন যে, এটি সম্ভবত ওই ব্যক্তির ছেলের। তবে সেটি ছিল একটি ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট এবং সেখানে কোনো তথ্য ছিল না। ঠিক এ পর্যায়ে এসে মনে হতে পারে, আর বুঝি কূলকিনারা নেই। তবে শেড্রোফস্কি একটি দারুণ কৌশল জানতেন: ব্যক্তিগত ফেসবুক অ্যাকাউন্ট হলেও, প্রোফাইল পেজের ডান কোণে তিনটি অনুভূমিক বিন্দু “(…)” ক্লিক করে টাইমলাইনের পাবলিক পোস্টগুলো খুঁজে বের করা যায়।
জন্মদিন, প্রাসঙ্গিক নাম থেকে শুরু করে যা যা মনে আসে তা দিয়ে শেড্রোফস্কি সার্চ দিতে থাকেন। একপর্যায়ে তিনি দেখেন যে, এই প্রোফাইলে জন্মদিন উপলক্ষে বার্তা প্রেরণ করা হয়েছে, আর সেই তারিখও ছেলেটির জন্মদিনের সঙ্গে মিলে যায়।
এই পর্যায়ে এসে, তিনি বেশ আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন যে, এটিই সঠিক প্রোফাইল। “ভালোবাসা” শব্দটি সার্চ দিয়ে তিনি তার স্ত্রীর নাম খুঁজে পান। এরপর তিনি নামের প্রথম ও শেষ অংশ দিয়ে কাস্টম গুগল সার্চ দেন। তিনি একটি ফটোগ্রাফি প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট খুঁজে পান, যারা তাদের বিয়ের শুটিং করেছিল। এরপর তিনি ভীষণ অবাক হয়ে দেখেন যে, প্রতিষ্ঠানটি তাদের বিয়ের গোটা অ্যালবামটি পোস্ট করেছে৷ ওই অ্যালবামে তিনি এমন এক ব্যক্তির ছবি খুঁজে পান, যাকে দেখে তার সন্দেহ হয় যে, এই লোকটিই ছেলেটির বাবা। এরপর ছবিটি তিনি পিমআইস দিয়ে যাচাই করেন এবং মিল খুঁজে পান।
শেড্রোফস্কি বলেন, ওসিসিআরপির আলেফ ডাটাবেস ছাড়াও ইদানিং তার প্রিয় টুলগুলোর মধ্যে রয়েছে ওপেনকরপোরেটস, ট্রু কলার এবং রকেটরিচের মতো যোগাযোগ অ্যাপ।
সনাতন পদ্ধতি, অত্যাধুনিক টুল
ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অফ ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টের সাংবাদিক কসিক, অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরির সময় আধুনিক টুলের সঙ্গে সনাতন পদ্ধতির সংমিশ্রণ ঘটানোর কথা বলেন। তিনি আইসিআইজের হয়ে করা তার সর্বশেষ প্রকল্পগুলোর মধ্যে থেকে একটি প্রতিবেদন নিয়ে কথা বলেন। পরিবেশগত প্রত্যয়নপত্র দেখিয়ে “টেকসই” তকমাযুক্ত ব্র্যান্ডগুলো কীভাবে বন ধ্বংস ও মানবাধিকার লঙ্ঘন করে চলেছে তা উন্মোচন করেছে ডিফরেস্টেশন ইনক. শিরোনামের এই আন্তঃসীমান্ত অনুসন্ধান। কাজটি মোটেও সহজ ছিল না, তাছাড়া বিভিন্ন সোর্স ব্যবহার করতে গিয়ে তাদের নিজস্ব ডেটাবেজও তৈরি করতে হয়েছে।
- প্রত্যয়ন ও নিরীক্ষণ সংস্থা।
- দেশ অনুযায়ী ইইউটিআর’স (ইইউ টিম্বার রেগুলেশনস) লঙ্ঘনের তালিকা।
- এনজিও ও বিভিন্ন দেশের প্রতিবেদন থেকে পরিবেশগত বিধিনিষেধ লঙ্ঘনের প্রতিবেদন সংগ্রহ।
- ইমপোর্টজিনিয়াস থেকে ট্রেড ডেটা সংগ্রহ।
- এফওআই, কর্পোরেট নথি, বিপণন উপকরণ এবং আদালতের নথি সংগ্রহ।
- অরবিস এবং ফ্যাক্টিভার মাধ্যমে মূল কোম্পানির তথ্য সংগ্রহ।
এ সব ডেটাসেটকে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে হয়েছিল যেন সব তথ্য একটি একক মাস্টার ডেটাবেসে পাওয়া যায়। তবে এ ধরনের অনুসন্ধান শুরুর আগে গবেষণা পদ্ধতি ঠিক করে নেওয়ার ওপর গুরুত্ব দেন কসিক।
কসিক বলেন তার সর্বকালের সবচেয়ে প্রিয় টুল হচ্ছে আইসিআইজের ডেটাশেয়ার — যেটি আপলোড করা নথিগুলোকে ওসিআর (অপটিকাল ক্যারেকটার রিকগনিশন) প্রযুক্তির মাধ্যমে খুঁজে বের করে। এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে ব্যক্তি, সংস্থা এবং অবস্থানের ভিত্তিতে নথিগুলো শনাক্ত ও ফিল্টার করে, এবং সার্চগুলোকে আরো কার্যকর করতে সহায়তা করে।
‘যতটা বিজ্ঞান, তার অধিক কলা’
শেড্রোফস্কি ও কসিক উভয়ই অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার অনেক চ্যালেঞ্জ স্বীকার করে নেন। তাদের পর্যবেক্ষণ হলো, এটি “যতটা না বিজ্ঞান, তার অধিক কলা (আর্ট)”, যা প্রতিনিয়তই পরিবর্তনশীল। শেড্রোফস্কি সতর্ক করে দিয়ে বলেন, “বিবর্তনশীল অপরাধ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকা একটি নিরন্তর চ্যালেঞ্জ।”
কসিক তার বক্তব্যে চীন থেকে তথ্য প্রাপ্তির অসুবিধা, ইউরোপীয় ইউনিয়নের ডেটা সুরক্ষা প্রবিধান জিডিপিআর আরোপিত সীমাবদ্ধতা এবং অফশোর ডেটা ও ডোমেইন নিবন্ধনের জটিল জগতে বিচরণের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কথা বলেন।
তবে, এই জুটি মনে করেন, চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও এগিয়ে থাকার উপায় রয়েছে। অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের জন্য তাদের দেওয়া কিছু পরামর্শ তুলে ধরা হলো।
- স্প্রেডশীট আপনার সবচেয়ে কার্যকর বন্ধু — তথ্য গুছিয়ে রাখতে এটি ব্যবহার করুন।
- কার্যকর ডেটা ব্যবস্থাপনার জন্য ডেটা বিশেষজ্ঞদের নির্দেশনা নিন।
- ডাউনলোড করা নথিগুলোকে নির্দিষ্ট লেবেল দিয়ে ফোল্ডারে গুছিয়ে রাখুন।
- গোটা ওয়েবপেজ ক্যাপচারের জন্য ক্রোম অ্যাড-অন এবং অনুসন্ধান ইতিহাস সংরক্ষণের জন্য ওয়েব্যাক মেশিন অ্যাড-অন ব্যবহার করুন।
- কার্যকরভাবে শ্রেণীবিন্যাসের জন্য নথিগুলোকে সাজান ও ট্যাগ করুন।
- ডবল-এনক্রিপ্ট করা ওপেন সোর্স প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করুন এবং নিরাপদে জোটবেঁধে কাজ করুন।
- অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় বৈচিত্র্যময় দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার মূল্য স্বীকার করুন।