

Photo: Heino Ollin for GIJN
গণতন্ত্রের জন্য ৫টি আসন্ন হুমকি এবং তা উন্মোচনের কৌশল
আর্টিকেলটি পড়ুন এই ভাষায়:
ক্যারোল ক্যাডওয়ালাডার, অবজারভার ও গার্ডিয়ানের অনুসন্ধানী সাংবাদিক। তিনি ফেসবুকের ক্যামব্রিজ অ্যানালিটিকা ডেটা কেলেঙ্কারি উন্মোচন করে পুলিৎজার পুরস্কারের চূড়ান্ত তালিকায় নাম লিখিয়েছেন। ১৩তম গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম কনফারেন্সে (#GIJC23) ইনভেস্টিগেটিং ইলেকশনের (নির্বাচনবিষয়ক অনুসন্ধান) ওপর প্যানেল আলোচনায় তিনি একটি উদ্বেগজনক পর্যবেক্ষণের কথা উল্লেখ করেন: “আমরা সম্পূর্ণ অজানা এক রাজ্যে প্রবেশ করছি। স্রোত ধেয়ে আসছে। আগামী ১৮ মাসের মধ্যে, বিশ্বের অর্ধেক দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে… এর মধ্যে আমাদের সামনে অবিশ্বাস্যরকমের শক্তিশালী নতুন সব টুল উন্মোচিত হচ্ছে।”
প্যানেলটি সঞ্চালনা করেন কেনিয়ার অনুসন্ধানী সাংবাদিক ও আফ্রিকা আনসেন্সর্ডের প্রধান জন-অ্যালান নামু। আলোচনায় অংশ নেন কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির টো সেন্টার ফর ডিজিটাল জার্নালিজমের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো প্রিয়াঞ্জনা বেঙ্গানি এবং ক্লিপের (ল্যাটিন আমেরিকান সেন্টার ফর ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম) ব্রাজিলভিত্তিক অনুসন্ধানী সাংবাদিক জুলিয়ানা ডাল পিভা। তারা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকিগুলো তুলে ধরেন এবং সাংবাদিকরা কীভাবে এর বিরুদ্ধে লড়তে পারে সে বিষয়ে আলোচনা করেন।
গণতন্ত্রের জন্য পাঁচটি বড় হুমকি
অধিবেশনে বক্তারা গোটা বিশ্বে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য, তাদের ভাষায় “বড় পাঁচটি” হুমকি নিয়ে আলোচনা করেন।
১. কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) এবং প্রযুক্তি কোম্পানি। এআইয়ের প্রথম শিকার হবে প্রমাণ-ভিত্তিক প্রতিবেদন (এভিডেন্স-বেজড রিপোর্টিং)। ক্যাডওয়ালাডার বলেন. “নির্বাচন প্রযুক্তির ডিজরাপশন বা ব্যাঘাতকে তরান্বিত করে, কেননা এদের প্রতিটিই একক ঘটনা। এই খেলার চূড়ান্ত ফলাফল, শূণ্য। আপনার অনেক অনুগত অনুসারী আছে, আপনার প্রচুর টাকা এবং বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে কোনটি কাজ করে সেটি দেখারও সক্ষমতা আছে।” সোশ্যাল মিডিয়া প্রতিষ্ঠান যেমন এক্স (সাবেক টুইটার) এবং ফেসবুক অতীতের নির্বাচনের সময় যে ফিল্টারগুলো প্রয়োগ করেছিল, তা বাদ দিয়েছে এবং এর ফলে কর্তৃত্ববাদী অপপ্রচার ও ভুল তথ্যকে ছড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
২. নির্বাচনী যোগাযোগ সংস্থা বা কমিউনিকেশন কোম্পানি। এ ধরনের প্রতিষ্ঠান ও পরামর্শকেরা অপতথ্য প্রচারের নতুন হাতিয়ার নিয়ে আসবে। এরাই গত কয়েক বছর ধরে, দেশে দেশে নির্বাচনকে ব্যাহত করে চলেছে। তাদের প্লেবুক (নাটকের ছক) সবসময় এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ঘুরে বেড়ায়। অর্থাৎ তারা তাদের লক্ষ্য অর্জনের জন্য বিভিন্ন দেশ বা অঞ্চলে একই ধরনের কৌশল ব্যবহার করে। “এখানে অনেক টাকার ছড়াছড়ি, প্ল্যাটফর্মগুলোর মধ্যে কোন স্বচ্ছতা নেই, এবং তারা মিথ্যা ও ঘৃণার সঙ্গে মানুষের সম্পৃক্তি ঘটায়,” ব্যাখ্যা করে বলেন ডাল পিভা, যিনি স্প্যানিশভাষী সাংবাদিকদের সঙ্গে মিলে উগ্রপন্থী প্রার্থী ও প্রচার পরামর্শক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সংযোগ উন্মোচন করেন।
৩. ইকো চেম্বার। প্রবাদ আছে, সর্বোত্তম মিথ্যাও অর্ধ-সত্যে পরিণত হয়। বেঙ্গানির মতে, ভুয়া বা মিথ্যা খবরের চেয়ে সত্যের বিকৃতি অনেক বেশি ধারালো হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। ‘‘আমরা এই ধারণার মধ্যে এসে পড়েছি যে… একটি ইকো চেম্বার বা ইকোসিস্টেমের মাধ্যমে একাধিক পক্ষ বারবার একই বার্তা প্রচার করতে সহযোগিতা করে,’’ তিনি বলেন। এই গোষ্ঠীটি টিভি, ইন্টারনেট ও রেডিওতে বার্তাগুলো ছড়িয়ে দিয়ে লোকেদের একই জিনিস বারবার শুনতে বাধ্য করে, আর তখন তা বাস্তবের মতো মনে হয় – আর এটি অন্যতম কারণ যা প্রমাণ-ভিত্তিক রিপোর্টিংকে মানুষকে প্রভাবিত করার কার্যকর টুল হয়ে উঠতে বাধা দেয়।
৪. কর্তৃত্ববাদীরা হেরে গেলেও জিতে যায়। প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন এবং গণতন্ত্রের প্রতি জনগণের ক্ষয়িষ্ণু আস্থা কর্তৃত্ববাদীদের জেতার সুযোগ করে দেয়, এমনকি তারা হেরে গেলেও (জিতে যায়)। ক্যাডওয়ালাডর বলেন ‘‘এটি শুধু নির্বাচনে জয়ের বিষয় নয়। ট্রাম্পের পর, আমরা এখন বলসোনারোর ক্ষেত্রেও দেখছি যে নির্বাচনে জয়লাভ এখন মূল খেলা নয়। নির্বাচন সম্পর্কে আমাদের বোঝাপড়ার পুনর্বিন্যাস প্রয়োজন।”
৫. সাংবাদিকদের মুখ বন্ধ করতে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা ব্যবহার । কর্তৃত্ববাদী নেতৃত্বের বিরুদ্ধে যে সব সাংবাদিক শক্তিশালী অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেন তাদের মুখ বন্ধ রাখতে ও ভয় দেখাতে নীরব ও সংগোপনে তাদের বিরুদ্ধে লিঙ্গ-ভিত্তিক সহিংসতা ব্যবহার অন্যতম একটি উপায় হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। যৌন হয়রানি এবং ডক্সিং (ছবি বা ভিডিওতে ব্যক্তির চেহারা বিকৃতি) আক্রমণের উদ্ধৃতি দিয়ে ডাল পিভা বলেন, “আমি মনে করি বলসোনারোর আমলে নারী হিসেবে আমরা অন্যতম লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছিলাম। আমরা নারী সাংবাদিকেরা তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নেতৃত্ব দিয়েছি, এতে করে সেও আমাদের পিছনে লেগেছিল।”

ব্রজিলের অনুসন্ধানী প্রতিবেদক জুলিয়ানা ডাল পিভা গণতন্ত্রের জন্য হুমকির বিষয়ে সম্মেলনে কথা বলছেন। ছবি: জিআইজেএন-এর জন্য হেইনো ওলিন
নির্বাচনবিষয়ক অনুসন্ধানের দশ পরামর্শ ও কৌশল
রাজনীতিবিদ ও নির্বাচন ঘিরে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরির জন্য বেঙ্গানি, ক্যাডওয়ালাডর এবং ডাল পিভা নিম্নলিখিত কৌশল ও চর্চাগুলোর কথা উল্লেখ করেছেন—
১. শুরুটা ছোট পরিসরে হলেও ঘাবড়ে যাওয়ার কিছু নেই। নির্বাচনী প্রচারণা থেকে শুরু করে রাজনীতিবিদদের সরস আর্থিক তথ্য পেতে খানিকটা সময় লাগতে পারে। অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের মৌলিক ধাপগুলো অনুসরণ করতে থাকুন, আর এভাবেই আপনি আর্থিক নথিগুলো হাতে পাবেন। ডাল পিভা বলেন যে, তার কাছে কখনই সাড়া ফেলার মতো তথ্য ছিল না। ‘‘স্পাইডার মেথড’’ এর মাধ্যমে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা রাজনীতিবিদদের নিয়ে একটি চার্ট আঁকা এবং জালের আশেপাশের লোকেদের ওপর অনুসন্ধান চালানোর বিষয়টি বরং আরো বেশি কার্যকর হয়েছে।
২. এমন তিনটি বড় নামের ওপর চোখ রাখুন, যারা প্রচারণার কাজ শুরু করছে ও ইভেন্টগুলো সংগঠিত করছে। কারণ এরা সাধারণত বড় ভূমিকা পালন করে থাকে। এছাড়া প্রাথমিকভাবে সোর্সগুলো ঘিরে একটি মানচিত্র তৈরি করুন।
৩.বছরের পর বছর রিপোর্ট করেছেন বলে কখনই ধরে নেবেন না যে আপনি একজন রাজনীতিকের পেছনের সব তথ্য জানেন; সবসময় তাদের অতীতের দিকে তাকান, কারণ কিছু উপেক্ষিত উপাদান আগের তুলনায় এখন বেশি প্রাসঙ্গিক হতে পারে। মনে রাখবেন: সর্বোত্তম সোর্স সাধারণত এমন লোকেরা হয় যারা একসময় রাজনীতিবিদদের ঘনিষ্ঠ ছিলেন বা এখন তাদের প্রতিপক্ষ, বা মিত্ররা যারা হীনমন্যতা বা উপেক্ষিত বোধ করেন।
৪. আর্থিকভাবে হৃষ্টপুষ্ট কিংবা বাজারে এক ধরনের প্রভাব রয়েছে এমন সংস্থা ও সোস্যাল মিডিয়ায় প্রভাবকদের খুঁজুন। তাদের নেটওয়ার্ক অনুসরণ এবং তারা কারা তা জানতে চেষ্টা করুন। তারা যা বলছেন, সেগুলো কে বা কারা ছড়িয়ে দিচ্ছে? তারা কি একটি ইকো চেম্বার তৈরি করছেন? এর পেছনে কারা থাকতে পারে?
৫. যে সংস্থাগুলো ফেসবুকে প্রচার-প্রচারণা চালানোর মাধ্যমে নির্বাচনকে প্রভাবিত করে, ওই সংস্থাগুলোর বিজ্ঞাপনগুলোকে খুঁজে বের করুন এবং যখনই সম্ভব, ডিজিটাল প্রচারাভিযানের বিজ্ঞাপন উৎস ও পরিমাণের হিসাব রাখুন। সোস্যাল মিডিয়ায় ডিজিটাল প্রচারণা খরচ কখনও কখনও প্রচারাভিযানের জন্য বেধে নির্দিষ্ট ব্যয় সংক্রান্ত আইন লঙ্ঘন করে, কারণ এ ধরনের খরচ সনাক্ত করা কঠিন।
৬. পক্ষপাত এড়াতে, এমন ঘটনা প্রকাশ করুন যেখানে সব তথ্য প্রমাণ তুলে ধরা সম্ভব হয় এবং পাঠকের কাছে উপস্থাপন করা যায়।
৭. সম্ভব হলে অন্যান্য গণমাধ্যম এবং অন্যান্য দেশের সহকর্মীদের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করুন। নির্বাচন নিয়ে অনুসন্ধান ঘড়ির কাঁটার বিপরীতে চলা এক সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া, তাছাড়া দেশে দেশে কিছু রাজনৈতিক ম্যানিপুলেশন কৌশলও প্রয়োগ করা হয়।
৮. আপনি যে নির্বাচনী আচরণ নিয়ে অনুসন্ধান করছেন সেটি যে ভোটের ফলকে প্রভাবিত করতে পারে, এটি যারা বিশ্বাস করেন না, কখনই তাদের কথা শুনবেন না। বরং তাদের আচরণ গ্রহণযোগ্য কিনা তার ওপর নজর দিন।
৯. বৈচিত্র্যপূর্ণ নিউজরুম গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন ব্যাকগ্রাউন্ডের সাংবাদিকেরা প্রায়ই অভাবনীয় অন্তর্দৃষ্টি এবং ধারণা প্রদান করে।
১০. আসন্ন নির্বাচন কভার করার জন্য আপনি কীভাবে প্রস্তুতি নেবেন সে সম্পর্কে আপনার নিউজরুমে আলোচনা করুন। কীভাবে মাঠে নামবেন, সে পরিকল্পনা করুন।
গণতন্ত্র থেকে স্বৈরাচারী ব্যবস্থার বিস্তার বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। প্রতিরোধের প্রথম সারিতে সাংবাদিকদের অবস্থান। “এক বছর আগের তুলনায় বর্তমানে বিশ্বের বিশ শতাংশের বেশি রাষ্ট্র কর্তৃত্ববাদী সরকারের অধীনে রয়েছে”, বলেন ক্যাডওয়াল।