Image: Pexels
সাংবাদিকতায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা: যতটা ক্ষমতা ততটাই দায়িত্বশীলতা
আর্টিকেলটি পড়ুন এই ভাষায়:
২০১৯ সালের ডিসেম্বর সংখ্যায়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এক রোবটের সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছিল দ্য ইকোনমিস্ট। জিপিটি-২ নামের এই রোবট স্বয়ংক্রিয়ভাবে শব্দ-বাক্য তৈরি করতে পারে। সাক্ষাৎকারের সময়, ২০২০ সালের বৈশ্বিক পরিস্থিতি নিয়ে এটিকে প্রশ্ন করা হয়। “কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ভবিষ্যৎ কী?”- এমন প্রশ্নের জবাবে রোবটটি উত্তর দিয়েছিল: “এর পরিণতি ভালো হতে পারে যদি আমরা এই প্রযুক্তি আরো দায়িত্বশীলতার সাথে ব্যবহার করতে পারি। অন্যভাবে বললে, আমাদের একে ব্যবহার করা উচিৎ উপযোগিতার বিচারে। একটি টুলের মতো। প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী এই প্রযুক্তির বিকাশ ঘটানোর জন্য আমাদের কাজ করা উচিৎ। এটি আমাদের ক্ষতি করবে এবং জীবনযাত্রা ব্যাহত করবে – শুধু এমন দুশ্চিন্তা করলে হবে না।”
জিপিটি-২ আসলে কী বলছে, সে সম্পর্কে তার নিজের খুব বেশি ধারণা নেই। সাক্ষাৎকারের সময় এটি সাধারণভাবে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে, এবং তা-ও ছিল কিছুটা অস্পষ্ট। তারপরও এর পারফরম্যান্স আকর্ষণীয়। এবছরের শুরুতে জিপিটি-২-এর নির্মাতা, ওপেনএআই তৈরি করেছে জিপিটি-৩। যেটি আরো অনেক বেশি শক্তিশালী। সংবাদমাধ্যম কত শক্তিশালীভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করতে পারে, তার অনেকগুলো উদাহরণের একটি হচ্ছে এই স্বয়ংক্রিয় বার্তা তৈরি।
২০১৯ সালের জুনে, সাংবাদিকতায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার নিয়ে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেছিল ইউরোপিয়ান সায়েন্স-মিডিয়া হাব (ইএসএমএইচ)। এর পরপরই একই বিষয়ে তরুন সাংবাদিক ও শিক্ষার্থীদের নিয়ে তিন দিনের একটি কর্মশালা আয়োজিত হয়েছিল ফ্রান্সের স্ট্রাসবার্গ শহরে। তারপর থেকে এ বিষয়ে কী কী গুরুত্বপূর্ণ তৎপরতা ও আলোচনা দেখা গেছে?
অগ্রগতির হালচিত্র
যুক্তরাষ্ট্রের নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির কমিউনিকেশন স্টাডিজ অ্যান্ড কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক নিকোলাস ডিয়াকোপুলোস বলেছেন, “গত বছর সবচে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি দেখা গেছে, তা হলো: বিশ্বজুড়ে নিউজরুমগুলোতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার ও এ সম্পর্কে সচেতনতা বেড়েছে। সামনে সাংবাদিকতার কাজের ধরনে পরিবর্তন আসবে। এমন ধরনের কাজ দেখা যাবে যেখানে প্রথাগত রিপোর্টিংয়ের পরিমাণ কমে আসবে এবং প্রযুক্তিগত দক্ষতা প্রয়োজন বেশি হবে।”
সাম্প্রতিক সময়ে, সাংবাদিকতায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার সংক্রান্ত কিছু অগ্রগতিরও খবর দিয়েছেন ডিয়াকোপুলোস। যেমন, সাংবাদিকতায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য একটি গবেষণা ইউনিট তৈরি করেছে নিউ ইয়র্ক টাইমস। সংবাদ খুঁজে বের করার একটি টুল নিয়ে পরীক্ষা চালাচ্ছে ওয়াশিংটন পোস্ট। এই কাজটির সঙ্গে আংশিকভাবে যুক্ত আছেন ডিয়াকোপুলোস। একাডেমিক আলাপ-আলোচনার জন্য গড়ে উঠেছে মেশিন + মিডিয়া এবং কম্পিউটেশন + জার্নালিজম-এর মতো সিম্পোজিয়াম।
করোনাভাইরাসের কারণে ২০২০ অলিম্পিক গেমস বাতিল হওয়ার আগে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রযুক্তি, কম্পিউটার ভিশন নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছিল নিউ ইয়র্ক টাইমস। তারা এর মাধ্যমে একটি ক্রীড়ানুষ্ঠানের ত্রিমাত্রিক দৃশ্য নির্মানের চেষ্টা করেছে। তাদের পরিকল্পনা ছিল: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে একটি দৃশ্য এমনভাবে নির্মান করা, যা বাস্তবে টেলিভিশনে দেখার অভিজ্ঞতা দেবে। যেমন, এর মাধ্যমে কোনো অ্যাথলিটের পারফরম্যান্স সম্পর্কে নানা তথ্য পাওয়া যাবে।
২০২০ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের খবর খুঁজে বের করার জন্য, ওয়াশিংটন পোস্টের একটি দলকে নিয়ে একটি টুল তৈরি করেছিলেন ডিয়াকোপুলোস। তাদের লক্ষ্য ছিল: কয়েক লাখ নিবন্ধিত ভোটারের ডেটাসেট ব্যবহার করে বিশেষ বিশেষ জায়গা খুঁজে বের করা, যেখানে সাংবাদিকরা রিপোর্টিংয়ের জন্য যেতে পারেন। যেমন, টেক্সাসে নতুন অনেক হিসপ্যানিক ভোটারের নিবন্ধন লক্ষ্য করা গেছে। এতে সেখানকার ভোট পরিস্থিতি কিভাবে বদলে যেতে পারে, তা জানতে সেখানে যেতে পারেন কোনো সাংবাদিক।
ডিয়াকোপুলোস ও তাঁর গবেষনা প্রতিষ্ঠান আরো একটি টুল তৈরি করছেন, যা দিয়ে অনুসন্ধানী সাংবাদিকরা খুঁজে দেখতে পারবেন যুক্তরাষ্ট্র সরকার কিভাবে বিভিন্ন অ্যালগোরিদম ব্যবহার করছে। টুলটি প্রতি সপ্তাহে স্বয়ংক্রিয়ভাবে একটি বার্তা দেয়। যেমন: “গত সপ্তাহে আমি তোমার আগ্রহের বিষয়ে আটটি নতুন অ্যালগোরিদম খুঁজে পেয়েছি।” বর্তমানে, নয় জন সাংবাদিক এই টুলটি পরীক্ষা করে দেখছেন।
সমাজের ওপর প্রভাব
২০১৯ সালে, সাংবাদিকতা ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে একটি বৈশ্বিক জরিপের ফলাফল প্রকাশ করে লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস। ৩২টি দেশের ৭১টি নিউজরুমের ওপর জরিপ চালিয়ে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। এই গবেষণার একটি সিদ্ধান্ত ছিল: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, সাংবাদিকতার পরিবর্তনে অল্প ভূমিকা রাখবে কিন্তু এর কাঠামোগত প্রভাব হবে দীর্ঘস্থায়ী। প্রতিবেদনে এমনও বলা হয়েছিল যে, সাংবাদিকতার জন্য তৈরি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার টুল, সমাজে এর প্রভাব নিয়ে কিছু প্রশ্ন তৈরি করে। যেমন: গণতন্ত্র, বৈচিত্র্যপূর্ণ রিপোর্টিংয়ের ওপর এটি কেমন প্রভাব ফেলবে? রিপোর্টিংয়ে জনগণের মতামত, মূল্যবোধের ওপর কেমন প্রভাব পড়বে?
আমস্টার্ডাম ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক নাটালি হেলবার্জার ঠিক এই প্রশ্নগুলো নিয়েই গবেষণা করছেন। তিনি গুরুত্ব দিয়ে বলেছেন, ঐতিহাসিকভাবে সাংবাদিকতা ও প্রযুক্তি সবসময়ই হাতে হাত ধরে চলেছে। ফটোগ্রাফি, টেলিফোন, রেডিও, টিভি, কম্পিউটার, ইন্টারনেট, স্মার্টফোন; সব কিছুই সাংবাদিকতায় বদল এনেছে। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, “প্রতিটি প্রযুক্তি নিয়েই শুরুতে অনেক হইচই হয়েছে, এরপর এসেছে সেটি নিয়ে উদ্বেগ ও এমনকি অশুভ কল্পনা। কিন্তু শেষপর্যন্ত দেখা গেছে একটি গঠনমূলক পর্ব, যেখানে প্রযুক্তিটি ব্যবহার করা হয়েছে সাংবাদিকতার সুবিধার্থে।”
হেলবার্জারের মতে, কোনো নির্দিষ্ট প্রযুক্তিকেই অবজ্ঞা করা ঠিক নয়। বরং, কিভাবে সেই প্রযুক্তি একটি গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করতে পারে, তা আমাদের খতিয়ে দেখা উচিৎ। তিনি বলেছেন, “সাংবাদিকতাকে আমূল বদলে দেওয়ার মতো ক্ষমতা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আছে। এর মাধ্যমে আপনি পাঠক-দর্শকের সাথে সংযুক্ত হওয়ার নতুন নতুন উপায় খুঁজে পেতে পারেন। এমন সম্ভাবনা তৈরি করতে পারেন, যেখানে মানুষ আরো কার্যকরভাবে, তাদের চাহিদামতো তথ্য খুঁজে নিতে পারবে। কিন্তু এই ক্ষমতার সাথে সাথে দায়িত্বের বিষয়টিও চলে আসে। যেমন, মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতা রক্ষার দায়িত্ব।”
এসব দায়দায়িত্বের কারণে, সাংবাদিকতার গবেষণা ও উন্নয়ন নিয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করা দরকার বলে মনে করেন হেলবার্জার। এ সংক্রান্ত স্বাধীন গবেষণার জন্য কাঠামো না থাকায় কিছুটা উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেছেন, “সাংবাদিকতায় প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন সংক্রান্ত কাজের জন্য অর্থায়ন করে গুগল নিউজ ইনিশিয়েটিভ। খুবই ভালো ব্যাপার যে, তারা এটি করছে। কিন্তু গুগল একটি কোম্পানি। তাই না? আমাদের গণতন্ত্র রক্ষায় সংবাদমাধ্যম একটি বড় ভূমিকা রাখে। ফলে তাদের সবসময় স্বাধীন থাকতে পারা উচিৎ।”
হেলবার্জার নিজে গবেষণা করছেন অটোমেটিক নিউজ রিকমেন্ডেশন-এর ব্যবহার এবং এটি বৈচিত্র্যপূর্ণ রিপোর্টিংয়ের ওপর কেমন প্রভাব ফেলবে; তা নিয়ে। তিনি বলেছেন, “চিন্তাভাবনা, মতামত, সংস্কৃতি, জাতি ও ধর্মের বৈচিত্র্য গণতন্ত্রের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এটি আমাদের সহনশীল হতে শেখায়। বিশেষভাবে আমাদের এই বর্তমান মেরুকরণের সময়ে, সংবাদমাধ্যমকে অবশ্যই সর্বব্যাপী হতে হবে। এটি যেন সবার স্বার্থে কাজ করে। কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর পক্ষে নয়।”
জার্মান পাবলিক ব্রডকাস্টার, জেডিএফ-এর সঙ্গে মিলে, তিনি ও তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকর্মীরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন একটি বৈচিত্র্যের টুলকিট নিয়ে। এটি তাঁরা তৈরি করেছেন নেদারল্যান্ডসের বাণিজ্যিক ব্রডকাস্টার আরটিএল-এর ডেটা বিজ্ঞানীদের সহযোগিতায়। এই টুল দিয়ে সাংবাদিকরা যাচাই করতে পারবেন: তাদের অ্যালগোরিদমিক রেকমেন্ডেশনে কতখানি বৈচিত্র্য আছে। এই টুল থেকে পাওয়া তথ্য ও নির্দিষ্ট সংবাদমাধ্যমের চাহিদা (বেশি পাঠক-ঘনিষ্ঠ কন্টেন্ট, বেশি রাজনৈতিক কন্টেন্ট, বা বেশি সংখ্যালঘুদের খবর ইত্যাদি) অনুযায়ী এই রেকমেন্ডেশনে পরিবর্তনও আনতে পারবেন।
“সংবাদমাধ্যমের জন্য তৈরি প্রতিটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার টুলকে সাজিয়ে নিতে হবে নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের চাহিদার ওপর ভিত্তি করে। কারণ আপনার প্রতিষ্ঠান সাংবাদিকতা সংক্রান্ত যেসব মূল্যবোধকে প্রাধান্য দেয়, তার সব কিছু হয়তো সেই টুলের মাধ্যমে পাওয়া যাবে না। কোন মূল্যবোধগুলো গুরুত্বপূর্ণ, সেই সিদ্ধান্ত মেশিন নিতে পারে না। এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায় একান্তই মানুষের,” বলেছেন হেলবার্জার।
লেখাটি ২০২০ সালের ৯ সেপ্টেম্বর প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ইউরোপিয়ান সায়েন্স-মিডিয়া হাব ওয়েবসাইটে। অনুমতি নিয়ে এখানে পুনঃপ্রকাশ করা হলো।
আরো পড়ুন
সাংবাদিকতায় যেভাবে ব্যবহার হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা
হাউ মেশিন লার্নিং ক্যান (অ্যান্ড ক্যাননট) হেল্প জার্নালিস্টস
বিয়ন্ড দ্য হাইপ: ইউজিং এআই ইফেক্টিভলি ইন ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম
বেনি মোলস আমস্টারডাম-ভিত্তিক বিজ্ঞান বিষয়ক ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক, লেখক ও বক্তা। তিনি বিশেষভাবে কাজ করেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবট ও মস্তিস্ক নিয়ে। তাঁর ব্লগ পড়তে পারেন (ইংরেজি ও ডাচ ভাষায়) এখানে। ওয়েবসাইট দেখুন (ডাচ ভাষায়) এখানে। মানুষ ও মেশিনের মিথস্ক্রিয়া নিয়ে তাঁর টেডএক্স বক্তৃতা দেখুন এখানে।