বিশ্বজুড়ে অনুকরণীয় অনুসন্ধানী প্রতিবেদন
আর্টিকেলটি পড়ুন এই ভাষায়:
বিষয় নির্ধারণ কখনো কখনো অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ বলে বিবেচিত হয়। তবে অসাধারণ অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের বিষয় যে সবসময় মৌলিক হতে হবে, এমন কোন বাধ্যবাধকতা নেই। কারণ দুর্নীতি, অবৈধ কার্যকলাপ ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মত বিষয়গুলোর বৈশিষ্ট্য বিশ্বের প্রায় সবখানেই একরকম।
দ্বাদশ গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম কনফারেন্সে বিশ্বের সাতজন সাংবাদিক তাদের প্রতিবেদনের ধারণা নিয়ে কথা বলেন। নিজ নিজ দেশে অন্য সাংবাদিকরা কীভাবে একই ধরনের অনুসন্ধান করতে পারেন, সে বিষয়েও পরামর্শ দেন।
প্যানেল সদস্যদের উপস্থাপিত প্রতিবেদনের পাঁচটি বিষয় ও পদ্ধতি নিচে উল্লেখ করা হল। অথবা চাইলে প্যানেলের পূর্ণাঙ্গ ভিডিও দেখে নিতে পারেন।
১. নারীহত্যা
জিআইজেএনের রিসোর্স সেন্টার পরিচালক নিকোলিয়া আপোস্টোলু বলেছেন, ভালোভাবে প্রতিবেদন করতে স্ব স্ব দেশে নারীহত্যার মানদণ্ড ও পূর্বশর্ত নিয়ে পরিষ্কার ধারণা থাকা জরুরী। তিনি বলেন, “অপরাধ হিসেবে বিবেচিত না হওয়ায় কিছু দেশে নারীহত্যা অভিযোগ হিসেবে নথিবদ্ধ হয় না। তাই আপনার দেশের আইনী ব্যবস্থায় নারীহত্যা কীভাবে নথিবদ্ধ হয়, তা যাচাই করে দেখুন।”
আপোস্টোলুর মতে, ডেটা খোঁজার পাশাপাশি আপনাকে নিজ দেশের তথ্য সংগ্রহ ব্যবস্থার ভালো বা মন্দ দিক সম্পর্কেও জানতে হবে। নির্ভরযোগ্য তথ্য সংগ্রহের উপায় নিয়ে পুলিশ কর্মকর্তা ও চিকিৎসা পেশাজীবীদের প্রশিক্ষণ আছে কি না এবং হত্যাকাণ্ডের ধরন, নির্যাতনকারী ও নির্যাতিতের লিঙ্গ পরিচয়, এবং হত্যাকাণ্ডের কারণ ও নির্যাতনকারী-নির্যাতিতের সম্পর্ক তারা নির্ণয় ও লিপিবদ্ধ করতে পারে কি না, সে বিষয়ে জানতে হবে। তিনি বলেন, “অনেক গ্রামীণ জনপদে অপরাধের অভিযোগ নথিবদ্ধ হয় না বা হাতে লেখা হয়ে থাকে – এই রেকর্ড পুলিশ সদর দপ্তরে পৌঁছাতে দেরি হওয়ায়, তা হারিয়ে যেতে অথবা বেহাত হতে পারে।”
ছবির ব্যবহার পাঠকের কাছে প্রতিবেদন সহজবোধ্য করার একটি সৃজনশীল উপায়, যা কখনো কখনো বিপদগ্রস্ত সূত্রের পরিচয়কে সুরক্ষিত করে। স্কুল অব ডেটা কিরগিজস্তানের ডেটা সাংবাদিক সাভিয়া হাসানোভা বলেন, গল্প বলার ক্ষেত্রে ভুক্তভোগী বা অপরাধের প্রকৃত দৃশ্য ব্যবহারের বদলে আপনি চার্ট ও মানচিত্রের মত ডেটা ভিজ্যুয়ালােইজেশন টুল ব্যবহারের কথা বিবেচনা করতে পারেন। তিনি আরো বলেন, “মৃতদেহের বিশদ বিবরণ ভুলে যান।” আর প্রতিবেদন প্রকাশের আগে ও পরে সতর্কীকরণ ও ডিসক্লেইমার লিখুন।
নারীহত্যা অনুসন্ধানের জন্য আরো একটি পরামর্শ হল: একা কাজ না করা, কারণ প্রতিবেদনের জন্য প্রয়োজনীয় সব তথ্য আপনার একার পক্ষে সামাল দেওয়া সম্ভন না-ও হতে পারে। অন্য সাংবাদিকদের সঙ্গে দলবদ্ধ হয়ে কাজ করুন, যারা আপনার বোঝা ভাগ করে নিতে পারে এবং এবং অনুপ্রেরণাও যোগাতে পারে।
আপোস্টোলু মনে করেন, “নারীহত্যার স্টোরি কাভার করা বেশ কঠিন এবং এটি অতীতে মানসিক চাপে পড়ার অভিজ্ঞতা হয়েছে এমন রিপোর্টারদের মধ্যে সেই অনুভূতি ফিরিয়ে আনতে পারে।” তাই বেঁচে ফিরে আসা ব্যক্তি ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের সাক্ষাৎকার নেয়া বেশ কষ্টসাধ্য। একারণে রিপোর্টারের পূর্ব প্রস্তুতি থাকতে হবে এবং অনুসন্ধানের সময় নিজের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকেও নজর রাখতে হবে, কারণ দিনশেষে এই বিষয়গুলোর ওপর কাজের ফলাফল নির্ভর করে।
আপোস্টোলু ও হাসানোভার মতে, নারীহত্যা সংশ্লিষ্ট ঘটনার অনুসন্ধানে কয়েক ধরনের সূত্রের ওপর আস্থা রাখা যায়। তার মধ্যে রয়েছে:
- আইন প্রয়োগকারী সংস্থা
- আদলতের রায়
- অপরাধ সংক্রান্ত সংবাদ বিজ্ঞপ্তি
- নারীহত্যা বিষয়ক জাতীয় পর্যবেক্ষণ সংস্থা
- পুলিশ
- অধিকার-কর্মী
- জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধবিষয়ক দপ্তর (ইউএনওডিসি)
- ফেমিসাইড ওয়াচ
২. ভূমি দখল
ভূমি দখল সংক্রান্ত অনুসন্ধান বেশ কঠিন এবং শারীরিকভাবে বিপদজনক হতে পারে। কারণ এই ধরনের ঘটনায় অনেক সময় অপরাধী গোষ্ঠী ও ক্ষমতাধর সরকারি সংস্থাগুলো জড়িত থাকে। এছাড়া প্রতিশোধের আশঙ্কায় আক্রান্ত জনগোষ্ঠী সাধারণত মুখ খুলতে চায় না। কেউ যখন কথা বলতে চায় না, তখন ভূমিদখল নিয়ে সাংবাদিকরা অনুসন্ধান করবেন কী করে?
পাকিস্তানের ডন পত্রিকার সহকারী সম্পাদক নাজিহা সৈয়দ আলী মনে করেন, রিপোর্টিংয়ের সেরা কৌশলের মধ্যে রয়েছে স্থানীয়দের আস্থা অর্জন, জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত নথিপত্র এবং ডিজিটাল মানচিত্র সংক্রান্ত টুল ব্যবহার।
তিনি বলেন, “বিরোধপূর্ণ ভূমি নিয়ে দাবির সমর্থনে প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য এবং দালিলিক প্রমাণ সংগ্রহ করুন। আইনী বিবরণী ও জমির দলিলের মারপ্যাঁচে বিভ্রান্ত হয়ে সাংবাদিকদের কাছে জনদুর্ভোগ গৌণ হয়ে যায় এবং এর চূড়ান্ত ফলাফল হিসেবে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণে ব্যর্থ হয়।”
অবৈধ ভূমিদখল মামলায় অভিজ্ঞ মানবাধিকার সংশ্লিষ্ট আইনজীবী, স্থানীয়দের নিয়ে কাজ করা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসহ বাইরের পক্ষগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার পরামর্শ দেন নাজিহা। ভূমিদখলের ঘটনার আইনী বিষয়ে আরো গভীর অনুসন্ধানের স্বার্থে এবং অনিয়ম কোথায় হয়েছে বুঝতে, আদালতের নথিপত্র মনোযোগ দিয়ে পড়ার চেষ্টা করুন।
৩. পেনশন ব্যবস্থার দুর্নীতি
অনেক দেশে শ্রমিকদের পেনশন পরিশোধ একটি বড় সমস্যা বিবেচিত হয় যা সাংবাদিকদের জন্যেও অনুসন্ধান করার মতো একটি বিষয়। কিন্তু এই বিষয়টি খবরে ততটা গুরুত্ব পায় না। গত জুলাই মাসে, অর্থনীতি বিষয়ক স্বাধীন প্রতিবেদক লুইসা গার্সিয়া তেইয়েজ একটি আন্তঃসীমান্ত অনুসন্ধানে যৌথভাবে নেতৃত্ব দেন। এই অনুসন্ধানে উঠে আসে, লাতিন আমেরিকার নয় দেশের শ্রমিকরা পেনশন ব্যবস্থায় প্রায় ৫০,০০০ কোটি ডলার দিলেও, বছরের পর বছর ধরে এই অর্থ কীভাবে ব্যয় হচ্ছে, সে ব্যাপারে তাদের জানার পরিধি নেহাতই সামান্য।
তিনি এই ধরনের প্রতিবেদন তৈরিতে দলগত কাজে উৎসাহ দেন এবং অন্যান্য সূত্রের বদলে সাংবাদিক ও বিশেষজ্ঞদের দলে রাখার পরামর্শ দেন। প্রতিবেদনের পরিসর বড় করার জন্য তিনি তথ্য অধিকার আইন ব্যবহারের তাগিদ দেন। তিনি আরো বলেন, “তথ্য অধিকার আইন বা কর্মকর্তাদের অস্বীকৃতি চুক্তি কাজে লাগিয়ে যেসব নথিপত্র পেয়েছেন, সেগুলো নিয়ে সম্ভাব্য সহযোগীদের কাছে যান। ব্যাখ্যা করে বলুন, তাদের জন্য তৈরি করা অভ্যন্তরীণ টুলকেই, তারা কতটা বেশি কাজে লাগাতে পারেন।”
৪. কোভিড-১৯
কোভিড-১৯ মহামারী শুধু বিশ্বের লক্ষ লক্ষ মানুষের স্বাস্থ্যের ওপরই প্রভাব ফেলেনি, বিশ্জুড়ে দুর্নীতি ও অসাধু কর্মকাণ্ডের উৎস হিসেবেও আবির্ভূত হয়েছে। জিআইজেএনের প্রতিবেদক রোয়ান ফিলিপ, সাংবাদিকদের উন্মোচন করা একটি কৌশলের দিকে ইঙ্গিত করেন। সেখানে উঠে আসে, চীনা কোম্পানির পরিচালিত পরীক্ষামূলক টিকাদান অভিযানে সাধারণ মানুষের আগেই “সৌজন্য” টিকা গ্রহণ করেছেন লাতিন আমেরিকান দেশগুলোর উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তারা।
ফিলিপ বলেন, “পেরুর সাংবাদিকতা প্রতিষ্ঠান সালুদ কন লুপার অনুসন্ধানে রাজনীতিক, শিক্ষক ও অন্যান্য প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের পরিবারসহ শতাধিক ব্যক্তির গোপনে টিকা নেওয়ার খবর উঠে আসে।” দেশটিতে টিকা গ্রহণে এই অনিয়ম “ভাকুনাগেট” কেলেংকারি নামে পরিচিতি পায়। চীনা টিকা বাজারজাতকরণে সহায়তার বিনিময়ে প্রভাবশালীদের টিকা গ্রহণে অনিয়ম নিয়ে পেরুর এই অনুসন্ধান লাতিন আমেরিকার অন্য দেশগুলোর সাংবাদিকরাও অনুকরণ করে।
তাঁর মতে, চীনা টিকার পরীক্ষা হয়েছে এমন দেশের সাংবাদিকদের ওষুধ আমদানির ডেটাবেজ ঘেঁটে বাড়তি ডোজের তথ্য যাচাই এবং চীনা দূতাবাসের কর্মীদের বিশেষ প্রবেশাধিকার নিয়ে গভীর অনুসন্ধান করা উচিত। এই নতুন ধরনের দুর্নীতিতে অনেক নীতিবান কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যেতে পারে।
৫. মার্কিনী “অবৈধ অর্থের” বিস্তার
যুক্তরাজ্য ভিত্তিক বৈশ্বিক গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান ওপেনডেমোক্রেসির সঙ্গে কাজ করা তুর্কী সাংবাদিক যেইনেপ সান্তেক বিশ্বজুড়ে মার্কিন ডানপন্থীদের “অবৈধ অর্থের” বিস্তার নিয়ে কাজ করেছেন। তাঁর ডেটা নির্ভর অনুসন্ধান বিশ্বব্যাপী চলমান রিপোর্টিং প্রক্রিয়ায় নতুন তথ্য ভাণ্ডার যুক্ত করেছে।
সান্তেকের অনুসন্ধানে যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে সমলিঙ্গ বিয়ে ও বৈধ গর্ভপাতের বিরুদ্ধে প্রচারাভিযানে সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ ডানপন্থী আইনজীবী ও রাজনীতিকদের অর্থায়নের বিষয়টি উঠে আসে।
সান্তেকের বিশ্লেষণে স্পষ্ট হয়, “তারা এলজিবিটি ও সমলিঙ্গ শিক্ষার বিরুদ্ধে প্রভাব খাটাতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে। লাতিন আমেরিকায় কোভিড-১৯ ও প্রজনন স্বাস্থ্যসহ অনেক বিষয়ে তারা অপপ্রচার চালায়। এছাড়াও অনুসন্ধানে দেখা যায়, পুতিন প্রশাসনের সাথে সংশ্লিষ্ট রাশিয়ার প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গকে তারা লক্ষ লক্ষ টাকা সরবরাহ করে।”
সান্তেক বলেন, অলাভজনক মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলো বিশ্বজুড়ে সক্রিয় এবং তাদের লক্ষ কোটি ডলারের সম্পদ রয়েছে। কিন্তু রিপোর্ট করা হয় না বলে এগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অজানাই রয়ে যায়। স্থানীয় পর্যায়ে এই অর্থের ব্যবহার ও দেশগুলোর আভ্যন্তরীণ নীতি নির্ধারণে প্রভাব নিয়ে অন্য দেশের সাংবাদিকরা অনুসন্ধান করতে পারেন।
মার্কিন অলাভজনক সংবাদ সংস্থা প্রোপাবলিকের ননপ্রফিট এক্সপ্লোরার কাজে লাগিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অলাভজনক প্রতিষ্ঠানগুলোর বার্ষিক আয়কর ফর্ম আইআরএস ৯৯০ অনুসন্ধান এবং ওপেনডেমোক্রেসির ট্র্যাকিং টুল ব্যবহার করে ডেটাসেট খুঁজে বের করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। আর কোনভাবেই তথ্য পাওয়া না গেলে, নিজস্ব ডেটাসেট গড়ে তোলা এবং সর্বোপরি সংখ্যার সীমা ছাড়িয়ে জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট স্টোরি উদঘাটনে মনোযোগী হতে বলেছেন সাংবাদিকদের।