প্রবেশগম্যতা সেটিংস

লেখাপত্র

অভিবাসীদের না-বলা গল্প যেভাবে উঠে এলো মহাদেশজোড়া অনুসন্ধানে

English

ছবি: মাইগ্র্যান্টস ফ্রম অ্যানাদার ওয়ার্ল্ড

যুক্তরাজ্য থেকে ভারত, বা যুক্তরাষ্ট্র থেকে ব্রাজিল; এখন অভিবাসন নিয়ে সবখানেই চলছে তীব্র তর্কবিতর্ক।

অভিবাসন বিষয়টি একই সাথে জটিল ও পরিবর্তনশীল; এর উৎস যেমন অনেক, গন্তব্যও তেমনটাই। এখন অভিবাসীদের নিয়ে আলোচনাটাও প্রায়ই উগ্র জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিকোন থেকে করা। তাই স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন ওঠে, এমন একটি পরিবেশে সাংবাদিকরা কিভাবে অভিবাসনকে ব্যাখ্যা করবেন।

কঠিন এই প্রশ্নের উত্তর যোগাতে পারে মাইগ্র্যান্টস ফ্রম অ্যানাদার ওয়ার্ল্ড প্রকল্পটি; যেখানে কয়েকটি দেশের ৪০ জনেরও বেশি সাংবাদিক একজোট হয়ে তুলে এনেছেন এশিয়া ও আফ্রিকার সেসব অভিবাসীর কথা, যারা প্রতি বছর লাতিন আমেরিকার ওপর দিয়ে যাত্রা করেন উন্নত কোনো দেশে পৌঁছানোর আশায়।

প্রকল্পটির উদ্যোক্তারা একে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, “বিষয়বস্তুর চলমানতা ও গতিশীলতার কারণেই, অভিবাসন সংক্রান্ত কোনো গল্প সহযোগিতামূলক প্রকল্প ছাড়া ঠিকমতো বলা সম্ভব নয়।”

কয়েক মাস ধরে চলা এই আন্তসীমান্ত অনুসন্ধানে অভিবাসীদের যাতায়াতের এমন একটি গোপন পথ উন্মোচিত হয়েছে, যা ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশনের প্রতিবেদনেও উল্লেখ করা হয়নি।

এই সহযোগিতামূলক অনুসন্ধানী প্রকল্পের প্রতিবেদনগুলো ২০২০ সালের বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত হয়েছে। এখান থেকে জানা গেছে সেসব অভিবাসীদের দুর্দান্ত কাহিনী, যারা ১০-১৫ হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে লাতিন আমেরিকায় পৌঁছান। তারপর, সেখান থেকে বেশ কয়েকটি সীমান্ত পাড়ি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বা কানাডায় যান। এই কাজের পেছনে মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে সহযোগিতা, আঞ্চলিক সাংবাদিকতা এবং বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের মধ্যে জোটবদ্ধতা।

“বিষয়বস্তুর চলমানতা ও গতিশীলতার কারণেই, অভিবাসন সংক্রান্ত কোনো গল্প সহযোগিতামূলক প্রকল্প ছাড়া ঠিকমতো বলা সম্ভব নয়।”

সব মিলিয়ে, ১৪টি দেশের ২৪টি সংবাদমাধ্যম অংশ নিয়েছে এই প্রকল্পে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে আসা ৪০ জনেরও বেশি প্রতিবেদক, সম্পাদক, ভিডিওগ্রাফার, ফটোগ্রাফার, প্রোগ্রামার, ডিজাইনার ও শিল্পী একজোট হয়ে কাজ করেছেন। চূড়ান্ত প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়েছে এই মহাদেশের দুটি প্রধান ভাষা, স্প্যানিশ ও পর্তুগিজে। একই সঙ্গে প্রকাশিত হয়েছে ইংরেজি ও ফরাসিতে।

অনুসন্ধানটিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন লাতিন আমেরিকান সেন্টার ফর ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম (ক্লিপ) এর প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক মারিয়া তেরেসা রন্দেরোস।

প্রকল্পের ওয়েবসাইটে পাঁচটি অধ্যায়ে তুলে ধরা হয়েছে, লাতিন আমেরিকা ধরে অভিবাসী ও শরনার্থীদের এই সমস্যা সংকুল যাত্রা। যাত্রাপথে তাদের যে যত রকমের বিড়ম্বনা পোহাতে হয়, তার বিশদ বিবরণ পাওয়া যাবে শুরুতেই। পদে পদে সরকার ও অপরাধী চক্রগুলোর তৈরি করা বাধা পেরিয়ে তারা কিভাবে এগিয়ে  যান – আছে তারও বর্ণনা। চলতে চলতে কোথায় অভিবাসীদের মৃত্যু হচ্ছে অথবা তাঁরা নিখোঁজ হচ্ছেন, তা দেখানো হয়েছে মানচিত্রে। উঠে এসেছে – সরকারের ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার কারণে কিভাবে দুর্নীতি, হিংস্রতা ও মানবপাচারের বড় একটি বাজার গড়ে উঠেছে গোটা অঞ্চলজুড়ে, যার দায় মেটাতে অভিবাসীদের হাজার হাজার গুনতে হচ্ছে যাত্রাপথের প্রতিটি ধাপে।

ছবি: মাইগ্র্যান্টস ফ্রম অ্যানাদার ওয়ার্ল্ড

এই অনুসন্ধানের সময়, সরকারি তথ্য বিশ্লেষণ ও তথ্যের জন্য আবেদন করার মাধ্যমে নতুন কিছু বিষয়ও উন্মোচিত হয়েছে। যেমন: প্রতি বছর ১৩-২৪ হাজার এশীয় ও আফ্রিকান অভিবাসী-শরণার্থী এই পথ পাড়ি দেন। কত দূরদূরান্ত ও বৈচিত্র্যপূর্ণ এলাকা (ক্যামেরুন, ভারত, কঙ্গো, বাংলাদেশ, অ্যাঙ্গোলা ও শ্রীলঙ্কা) থেকে এই যাত্রা শুরু হয়, তাও বেরিয়ে এসেছে এই অনুসন্ধানের মাধ্যমে।

বৈশ্বিক এক ধাঁধার টুকরো ধরে বিশ্লেষণ 

“অন্য বিশ্বের অভিবাসী” (মাইগ্র্যান্টস ফ্রম অ্যানাদার ওয়ার্ল্ড)  প্রকল্পটির পেছনেও একটি গল্প আছে, যার শুরু ২০১৯ সালে, মেক্সিকোতে; অভিবাসী বিষয়ক এক কর্মশালা থেকে। সেখানে প্রশিক্ষক হিসেবে ছিলেন কলম্বিয় সাংবাদিক রন্দেরোস।

বিষয়টি নিয়ে তখন পর্যন্ত যেসব প্রতিবেদন বেরিয়েছে, তাতে পুরো গল্পের খন্ড খন্ড চিত্রই কেবল উঠে এসেছে। তার মধ্যে কয়েকটি প্রতিবেদনের বিষয় ছিল, অভিবাসীরা কোন এলাকায় এসে মৃত্যুর কবলে পড়ছেন বেশি। কিন্তু রন্দেরোসের চোখে গোটা আখ্যানে বড় কিছু ফাঁক ধরা পড়ে। সেখান থেকে তৈরি হয় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন: যেমন, মানুষগুলো কারা, তারা কোথা থেকে এসেছেন, তারা লাতিন আমেরিকায় কিভাবে এলেন, কেন তারা এই যাত্রা শুরু করেছেন, এবং তাদের গন্তব্য কোথায়।

রন্দেরোস জিআইজেএন-কে বলেছেন, “আমি দেখতে পাচ্ছিলাম, এখানে একটা বড় ফাঁক আছে। ক্রমেই চোখের আড়ালে থাকা দারুন একটি গল্পও আমার চোখের সামনে ভেসে উঠতে থাকে। সংবাদমাধ্যম এখন পর্যন্ত শুধু এই ধাঁধার অল্প কিছু অংশ দেখিয়েছে। কিন্তু সার্বিক চিত্রটি আমাদের সামনে নেই।”

এরপরই কাজে নেমে পড়েন রন্দেরোস। প্রথমেই, গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের জোট গড়ে তোলার লক্ষ্যে, লাতিন আমেরিকার ভেতরে ও বাইরে সহযোগী প্রতিষ্ঠানের সন্ধান শুরু করেন তিনি।

মেক্সিকোতে, দলটি যখন প্রথমবারের মতো মিলিত হয়, ততদিনে ঠিকঠাক হয়ে গিয়েছিল কারা কাজ করবেন। ইউরোপ-ভিত্তিক অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন রিপোর্টিং প্রজেক্ট, ফাউন্ডেশন আভিনা এবং সিয়াটল ইন্টারন্যাশন্যাল ফাউন্ডেশনের মতো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকেও সহায়তা নিয়েছেন তারা।

“আমি দেখতে পাচ্ছিলাম, এখানে একটা বড় ফাঁক আছে। সংবাদমাধ্যম এখন পর্যন্ত শুধু এই ধাঁধার অল্প কিছু অংশ দেখিয়েছে। কিন্তু সার্বিক চিত্রটি আমাদের সামনে নেই।” —মারিয়া তেরেসা রন্দেরোস

রন্দেরোস বলেছেন, “সেখান থেকেই আমরা একটা পরিকল্পনা করি। কোন এলাকাগুলো নিয়ে কাজ করব, এবং কী ধরনের তথ্যের খোঁজ করব, তা নির্ধারণ করি। আমরা শুরুতেই একটি ডিজিটাল নিরাপত্তা প্রশিক্ষণ কর্মশালা আয়োজন করেছিলাম এবং কিছু শর্তে একমত হয়েছিলাম।” শর্তগুলোর মধ্যে ছিল: সবাই প্রতিবেদন প্রকাশের দিনক্ষণ সম্পর্কে একমত হবে এবং তথ্য যাচাই ও সম্পাদকীয় পরিমার্জনার এক্তিয়ার থাকবে ক্লিপ-এর কাছে।

রন্দেরোস বলেছেন, ডেটা সংগ্রহের কাজটি এই প্রকল্পে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কারণ, অভিবাসীদের সম্পর্কে পর্যাপ্ত নথিপত্র ছিল না, হিসাবগুলো কোথা থেকে আসছে তাতেও স্বচ্ছতা ছিল না, সরকারী কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন ডেটা বদলে দিয়েছে, এবং বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করেছে।

 

শেষপর্যন্ত, কাজটির জন্য নিজস্ব ডেটাবেজ তৈরি করে নিতে হয়েছে ক্লিপ-কে। নিজ নিজ দেশে উন্মুক্ত তথ্যের ডেটাবেজ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে এই নতুন ডেটাবেজ তৈরিতে সহায়তা করেছেন রিপোর্টাররা। এটি আরো সমৃদ্ধ করা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে তথ্য অধিকার আইনের অধীনে তথ্যের জন্য আবেদন করার মাধ্যমে। বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকেও পাওয়া গেছে অনেক প্রাসঙ্গিক উপাত্ত। বিভিন্ন জায়গা থেকে পাওয়া এই ডেটা নিয়মতান্ত্রিকভাবে সাজানোর জন্য তাঁরা ব্যবহার করেছেন এক্সেল। আর সেটি বিশ্লেষণ করেছেন ট্যাবলু প্ল্যাটফর্মের সাহায্যে। সূত্রগুলো যাচাই করার জন্য ডেটাগুলো পর্যালোচনা করেছে ক্লিপ।

সব মিলিয়ে, রিপোর্টিং, তথ্য সংগ্রহ, ডেটাবেজ তৈরি, মাল্টিমিডিয়া কনটেন্ট তৈরি; ইত্যাদির জন্য নয় মাস ধরে কাজ করেছেন প্রকল্পের অংশগ্রহণকারীরা।

এই প্রক্রিয়ায় যোগাযোগটাই ছিল মূখ্য। সাধারণ আলোচনা তো হতোই; কিন্তু তার বাইরে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে তারা আলাদা সভা করতেন। কোনো দলের কাজ ছিল নির্দিষ্ট প্রতিবেদন ধরে এগুনো, কারো দায়িত্ব ছিল কাজের অগ্রগতি পর্যালোচনা, অন্যরা করতেন ফলোআপ –  এমন নানা বিষয়ে আলাপ হয়েছে গোটা সময় জুড়ে। এসময় ওয়ার্ক প্ল্যাটফর্ম ও চ্যাটের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ চালিয়ে গেছেন  প্রকল্পের কর্মীরা।

প্রকল্পটির চূড়ান্ত পর্যায়ের সম্পাদনার কাজ শুরু হয় মার্চ মাসে। কিছু প্রতিবেদন শুরুতেই বাদ দেওয়া হয়। বাছাই করা লেখাগুলোর জন্য পাঁচটি ধাপে সম্পাদনা, তথ্য যাচাই ও পরিমার্জনের কাজ করা হয়েছে। প্রতিটি সংবাদমাধ্যম তাদের প্রতিবেদনগুলো আলাদাভাবে সম্পাদনা করেছে। তবে যে প্রতিবেদনগুলো প্রকল্পের মূল পেইজে জায়গা পেয়েছে, সেগুলো সম্পাদনা করেছে ক্লিপ।

ছিল অজানা, হলো বৈশ্বিক

মেক্সিকোর নিউজরুম, এনিম্যাল পলিটিকোর সাংবাদিক আলবার্তো প্রাডিলা বলেছেন, “এই প্রকল্পটি খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারণ এর মাধ্যমে পাঠক-দর্শকদের বলা হয়েছে: কিভাবে সবার অলক্ষ্যে দীর্ঘদিন ধরে এই পথ ব্যবহার করছেন অভিবাসী, শরণার্থীরা। কিন্তু এখন এই ব্যাপারটি আর আড়ালে থাকবে না।”

প্রাডিলার কাছে, বিশ্বের প্রতিটি অভিবাসীর গল্পই এক সূতোয় গাঁথা। যেমন, মেক্সিকোর চিয়াপাসে একটি জাহাজডুবি কাভার করতে গিয়ে তিনি চিন্তা করতে বাধ্য হয়েছেন আফ্রিকান অভিবাসী ও শরণার্থীদের কথা, যারা প্রতি বছর ভূমধ্যসাগরে মারা যায়। তিনি দেখেছিলেন, লাতিন আমেরিকাতে সেই একই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে: অন্যায্য শাসন, সহিংসতাপ্রবণ বা দরিদ্র এলাকা থেকে পালিয়ে বাঁচার জন্য অনেক অভিবাসী একইভাবে ঝুঁকিপূর্ণ পথে যাত্রা করছেন এবং ট্রাজেডির শিকার হচ্ছেন।

প্রাডিলা বলেছেন, বিষয়টি বৈশ্বিক হলেও, অভিবাসনকে ঘিরে যে ধরনের ভাষ্য গড়ে ওঠে, তা হয় পক্ষপাতদুষ্ট ও অসম্পূর্ণ। এটি কাভার করার সময় যে ধরনের ভাষা ব্যবহার করা হয়, তা থেকেই এটি স্পষ্ট বোঝা যায়। কিছু রিপোর্টে এই মানবীয় বিষয়কে বর্ণনা করা হয় অপরাধ জগতের ভাষা ব্যবহার করে। কিছু রিপোর্টে শুধুই মানবিক সহায়তা বা কোনো হামলা ও সংকটের জায়গা থেকে বিষয়টি তুলে আনা হয়।

ছবি: মাইগ্র্যান্টস ফ্রম অ্যানাদার ওয়ার্ল্ড

এই প্রকল্পের মাধ্যমে পাঠক-দর্শককে বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে যে, অভিবাসনের বিষয়টি একটি বৈশ্বিক প্রক্রিয়া। এবং এর সঙ্গে অনেক মানবিক গল্প জুড়ে থাকে। তারা দেখাতে চেয়েছেন যে, এটি শুধুই কিছু সংখ্যা, বিচ্ছিন্ন ট্রাজেডি বা জাতীয়তাবাদী প্রতিক্রিয়ার বিষয় নয়।

রন্দেরোস ব্যাখ্যা করে বলেছেন, “আমরা দেখাতে চেয়েছি, যারা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পাড়ি জমায়, তারাও আমাদের মতোই মানুষ। তাদেরও আমাদের মতো স্বপ্ন আছে। তাহলে কেন তাদের জন্য এতো বাধাবিপত্তি তৈরি করা হচ্ছে? কেন এসব অভিবাসীদের মাপা হচ্ছে বর্ণবাদ ও জাতিবিদ্বেষ দিয়ে? তারা যদি আমাদের মতোই হয়, তাহলে তাদেরকে ঘিরে কেন কৃত্রিম ভয়ভীতির পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে?”

অভিবাসন বিষয়ে পুরস্কারজয়ী সাংবাদিক ইলেন ট্রুয়াক্স এই প্রকল্পের অংশ ছিলেন না। কিন্তু তিনি মনে করেন, অন্য অনেকে যেখানে ব্যর্থ, সেখানে এই প্রকল্প সফল হয়েছে। তারা সফল হয়েছে এই অভিবাসীদের মানবীয় দৃষ্টিকোন থেকে তুলে আনতে। এটি সম্ভব হয়েছে গল্পগুলো বিভিন্ন ফরম্যাটে একসঙ্গে প্রকাশিত হওয়ার কারণে।

ট্রুয়াক্স ব্যাখ্যা করে বলেছেন, “প্রকল্পটিতে ডেটা ও গল্পগুলো খুব দক্ষতার সাথে একসঙ্গে বোনা হয়েছে। এবং সবকিছু উপস্থাপন করা হয়েছে খুবই কার্যকরভাবে। অভিবাসীরা যে পথ ধরে যাত্রা করেন, সেটি কত দীর্ঘ, সেখানকার পরিবেশ-পরিস্থিতি কতটা রূক্ষ- এসব সম্পর্কে পাঠক খুব পরিস্কার ধারনা পান এখানে।”

মধ্য আমেরিকা হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমানোর গল্প দেখে দেখে আমরা অভ্যস্ত। কিন্তু যারা এশিয়া বা আফ্রিকা থেকে আসছেন, তাদের জন্য সেই ছোট পথটাই যে কত লম্বা, তা তুলনা করতে গিয়ে আমরা অবাক হয়েছি,” বলেন তিনি। এখান থেকে পাঠক ভাবতে বাধ্য হবেন: ‘কী ঘটেছে তাদের দেশে যে তারা এতটা পথ পাড়ি দিতে রাজি হয়েছে?’ অভিবাসন প্রক্রিয়া সম্পর্কে বুঝতে হলে এই প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ,” বলেছেন ট্রুয়াক্স।

আন্তসীমান্ত অনুসন্ধানের জন্য আঞ্চলিক সহযোগিতা

এধরনের সহযোগিতামূলক প্রকল্প তৈরির বেশ কিছু রাস্তা আছে বলে জানিয়েছেন রন্দেরোস। তিনি বলেছেন, “অনেক সহযোগিতামূলক প্রকল্পের ক্ষেত্রে দেখা যায়: একেকটি নিউজরুম শুধু তাদের নিজ নিজ দেশ ধরে কাজ করে। তারা ধরে নেয়, এই প্রতিবেদনগুলোই তাদের পাঠকদের আকৃষ্ট করবে। কিন্তু এই প্রকল্পের ক্ষেত্রে, আমরা বুঝেছিলাম: এখানে সহযোগিতার মাত্রা আরো বেশি হতে হবে। ‘শুধু আমি আমার স্টোরিটা করব’; এই মনোভাব দিয়ে কাজ হবে না। কারণ তাহলে শেষপর্যন্ত আপনি কাজ শেষে পাবেন কিছু আঞ্চলিক প্রতিবেদন। কিন্তু আমাদের আসলে বলা দরকার সত্যিকারের সীমানা পেরুনো সব গল্প।”

যদি আগ্রহী হন জোটবদ্ধ কাজে, তাহলে পড়ে নিন তাঁর কয়েকটি পরামর্শ:

১. বিষয়-জ্ঞান আছে এমন মানুষদের নিয়ে দল গঠন করুন। দলের সদস্যদের বিষয়টি সম্পর্কে ধারণা আছে কিনা এবং তারা সেটি নিয়ে কাজ করতে সমানভাবে উৎসাহী কিনা, তা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সহযোগিতামূলক প্রকল্পে সাধারণত লম্বা সময় লাগে এবং ক্রমাগত নানা কাজ চালিয়ে যেতে হয়। প্রথমবারের মতো কোনো তথ্য খুঁজে বের করার ক্ষেত্রে এটি বিশেষভাবে প্রযোজ্য।

২. তথ্য সংগ্রহ করুন। নির্দিষ্ট কিছু তথ্য একবার এক জায়গায় করে ফেলার পর প্রাসঙ্গিক অনেক ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায়। যেমন আইন, পরিসংখ্যান, আদালত বা পুলিশের সূত্র।

৩. তথ্য আদান প্রদানের জন্য অনলাইনে জায়গা তৈরি করুন। এটি হতে পারে গুগল ড্রাইভ বা অন্য আরো কোনো আধুনিক প্ল্যাটফর্ম। কিন্তু সবখানেই নিরাপত্তার চর্চাগুলো ভালোভাবে করা উচিৎ। যেমন: এমন পাসওয়ার্ড ব্যবহার করা উচিৎ যেটি নম্বর, সংকেত ও অন্যান্য ডিজিট মিলে তৈরি হয়েছে। বা কোনো এনক্রিপশন সিস্টেম ব্যবহার করা উচিৎ। যেমন মাইগ্রেন্টস ফ্রম অ্যানাদার ওয়ার্ল্ড- এই প্রকল্পের জন্য বানানো হয়েছিল লা ভেসিনদাদ — দ্য নেইবারহুড। এই এনক্রিপশন প্ল্যাটফর্মটি তৈরি করেছেন ক্লিপ-এর ডেটা বিজ্ঞানী রিগোবার্তো কারভাহাল। এখানে গুগল ড্রাইভ, ডক, ট্রেল্লো ও স্ল্যাকের মতো ফিচার আছে। এই জায়গায় রিপোর্টাররা ডকুমেন্ট আপলোড করতে পারেন; টেক্সট ও টেবল সম্পাদনা করতে পারেন; সম্পাদকীয় কর্মকাণ্ডের দিকে নজর রাখতে পারেন; এবং তথ্য নিরাপদে রেখে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করতে পারেন। শুধু ক্লিপের সংশ্লিষ্টতা আছে, এমন প্রকল্পগুলোতে লা ভেসিনদাদ ব্যবহার করা যায়। তবে আন্তসীমান্ত অনুসন্ধানের অন্যান্য প্রকল্পগুলোর জন্যও এটির ব্যবহার উন্মুক্ত করে দেওয়ার একটি সম্ভাবনা আছে।

৪. আপনার মূল ভাবনাকে প্রতিফলিত করে, এমন গল্প নিয়ে কাজ করুন। রিপোর্টিংয়ের কাজ ৯০ ভাগ শেষ হয়ে যাওয়ার পর, চূড়ান্ত প্রতিবেদনগুলো নিয়ে আলোচনা সেরে ফেলাটা জরুরি। প্রতিটি লেখা বা ভিডিও এমনভাবে তৈরি করতে হবে, যেন তা পুরো অনুসন্ধানটি ফুটিয়ে তুলতে সাহায্য করে। প্রথম খসড়া তৈরি থেকে শুরু করে শেষপর্যন্ত জিনিসটি প্রকাশিত হওয়ার মধ্যে দুই থেকে তিন মাস সময় লাগতে পারে।

৫. বাড়তি অর্থের খোঁজ করুন। এ ধরনের সাংবাদিকতার প্রকল্পে অর্থায়ন করে এমন সংগঠনের সঙ্গে জোট বাঁধাটা ‍গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই অর্থ দিয়েই হয়তো আপনাকে বিভিন্ন জায়গায় যাতায়াতের খরচ মেটাতে হবে। নিউজরুমগুলো হয়তো নিজেদের অর্থে সেগুলো করতে পারবে না। ফলে এ ধরনের সংগঠন থেকে অনুদান পাওয়ার মানে: আপনাকে অর্থনৈতিক কারণে কোনো নিউজরুমকে বাদ দিতে হবে না।

৬. গল্প বলা ও তথ্যের ভিজ্যুয়াল উপস্থাপন নিয়ে একটি কৌশল তৈরি করুন। সম্ভাব্য সবচে ভালো উপায়ে আপনার গল্পটি বলতে হবে। দর্শকদের আকৃষ্ট করার মতো বর্ণনা কিভাবে লেখা যায়, তা নিয়ে অনলাইনে খোঁজাখুঁজি করতে পারেন। আপনার গল্পে যে মানুষগুলোর কথা বলা হয়েছে, তাদের আবেগ-অনুভূতিগুলো সঠিকভাবে উঠে এসেছে কিনা, তা নিশ্চিত করুন। সেটি হতাশা-বেদনাই হোক বা ভালো ভবিষ্যতের আকাঙ্ক্ষাই হোক।

৭. সহনশীল হোন এবং ধৈর্য্য ধরুন। এই ধরনের প্রকল্পে কাজ করতে গেলে এটি মাথায় রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, অংশীদার দলগুলোর কাজ ও সময়ের ধরন একেক রকম হবে। আপনি যদি এরকম একটি প্রকল্প পরিচালনা করতে চান, তাহলে আপনাকে অবশ্যই সহনশীল হতে হবে এবং ধৈর্য্য ধরতে হবে। একই সঙ্গে, কাজের অগ্রগতি দিয়ে দলের সবাইকে অনুপ্রাণিত করাটাও গুরুত্বপূর্ণ।

আরো পড়ুন

অভিবাসন রিপোর্টিংঅভিবাসন রিপোর্টিংয়ের নৈতিকতা নিয়ে আরো বিস্তারিত দেখুন জিআইজেএন রিসোর্স সেন্টারে। দেখুন মানবপাচার, ও দাসত্ব নিয়ে রিপোর্টিংয়ের গাইড। আরো সহযোগিতামূলক প্রকল্প সম্পর্কে জানতে দেখুন আমাদের পুরোনো লেখাগুলো।

মারিয়ানা লিমন একজন ফ্রিল্যান্স মেক্সিকান সাংবাদিক। তিনি লেখালেখি করেন জেন্ডার, গ্লোবালাইজেশন, মানবাধিকার ও পপ কালচার নিয়ে। ডিজিটাল কমিউনিটি ও নতুন ধরনের ন্যারেটিভ নিয়ে তাঁর বিশেষ আগ্রহ আছে। তিনি ভাইস, জিকিউ, ও চিলাঙ্গো ডট কমের জন্য লিখেছেন। 

ক্রিয়েটিভ কমন্স লাইসেন্সের অধীনে আমাদের লেখা বিনামূল্যে অনলাইন বা প্রিন্টে প্রকাশযোগ্য

লেখাটি পুনঃপ্রকাশ করুন


Material from GIJN’s website is generally available for republication under a Creative Commons Attribution-NonCommercial 4.0 International license. Images usually are published under a different license, so we advise you to use alternatives or contact us regarding permission. Here are our full terms for republication. You must credit the author, link to the original story, and name GIJN as the first publisher. For any queries or to send us a courtesy republication note, write to hello@gijn.org.

পরবর্তী

IDL-Reporteros founder Gustavo Gorriti

সদস্য প্রোফাইল

আইডিএল-রিপোর্টেরস: যে নিউজরুম পেরুর রাজনৈতিক অভিজাতদের চ্যালেঞ্জের সাহস দেখিয়েছে

পেরুর ক্ষমতাবানদের দুর্নীতি-অনিয়ম নিয়ে অনুসন্ধানের জন্য ক্রমাগত নানা ধরনের চাপ ও হুমকির মুখে পড়েছে অনুসন্ধানী সংবাদমাধ্যম, আইডিএল-রিপোর্টেরস এবং এর প্রতিষ্ঠাতা গুস্তাভো গোরিতি। পড়ুন, কীভাবে সেগুলো সামলে তারা সাহসিকতার সঙ্গে রিপোর্টিং চালিয়ে যাচ্ছে।

post office boxes, shell companies

পরামর্শ ও টুল

শেল কোম্পানির গোপন মালিকদের যেভাবে খুঁজে বের করবেন

অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের জন্য শেল কোম্পানি ও সেগুলোর প্রকৃত মালিকদের পরিচয় খুঁজে বের করা বেশ কঠিন হতে পারে। তবে শক্তিশালী কিছু টুল রয়েছে যার সাহায্যে জটিল এই ক্ষেত্রে নতুন আসা সাংবাদিকেরাও গোপনে অবৈধ সম্পদ লুকোনো ব্যক্তিদের পদচিহ্ন খুঁজে বের করতে পারেন।

টেকসইতা পদ্ধতি

সাংবাদিকতার প্রভাব পরিমাপ — আমরা নতুন যা জানি

সব সংবাদমাধ্যমই চেষ্টা করে তাদের রিপোর্টিংয়ের মাধ্যমে সমাজে প্রভাব তৈরির জন্য। কিন্তু এই প্রভাব পরিমাপ করার ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যমগুলো ব্যবহার করে একেক ধরনের সূচক। পড়ুন, এ নিয়ে সাম্প্রতিক গবেষণার মাধ্যমে নতুন কী জানা গেছে।

BBC Newsnight NHS investigations lessons learned

কেস স্টাডি

যেভাবে ব্রিটিশ স্বাস্থ্যসেবা কেলেঙ্কারির স্বরূপ উন্মোচন করেছে বিবিসি নিউজনাইট

যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা নিয়ে ছোট একটি অনুসন্ধানের পরিকল্পনা করেছিল বিবিসি নিউজনাইট। কিন্তু পরবর্তীতে এক বছরব্যাপী অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে নানাবিধ অনিয়ম-অব্যবস্থাপনার বিস্তারিত চিত্র। পড়ুন, পুরস্কারজয়ী অনুসন্ধানটির নেপথ্যের গল্প ও অভিজ্ঞতা-পরামর্শ।