প্রবেশগম্যতা সেটিংস

লেখাপত্র

বিষয়

অনুসন্ধানই বাঁচিয়ে রাখে থামিয়ে দেওয়া সাংবাদিকদের অসমাপ্ত কাজ

আর্টিকেলটি পড়ুন এই ভাষায়:

English

“বালু মাফিয়াদের” নিয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া সাংবাদিক জগেন্দ্র সিংয়ের মেয়ে দিক্সা সিং। ছবি: ফরবিডেন স্টোরিজ

ভারতের “বালু মাফিয়া” থেকে শুরু করে গুয়াতেমালার ফেরোনিকেল শিল্প অথবা তানজানিয়ার স্বর্ণ – খনিশিল্পের কারবার নিয়ে যেখানেই সাংবাদিকরা পর্দা ধরে টান দিচ্ছেন, সেখানেই তাদের চুপ করিয়ে দেয়া হচ্ছে।

ভারতে বালু উত্তোলন ব্যবসার সাথে স্থানীয় এক মন্ত্রীর সম্পৃক্ততা নিয়ে রিপোর্ট করেছিলেন সাংবাদিক জগেন্দ্র সিং। ২০১৫ সালে তিনি আগুনে পুড়ে মারা যান। চিকিৎসাধীন অবস্থাতেই তিনি অভিযোগ করেন, ইচ্ছাকৃতভাবে তাঁর বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। গুয়েতেমালায়, ২০১৭ সালে পানি দূষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা এক জেলেকে খুন করা হয়। সেই ঘটনা তুলে ধরেছিলেন সাংবাদিক কার্লোস চোক। এর জের ধরে তিনি এখনো ফৌজদারী মামলার ঘানি টানছেন। তানজানিয়ার গ্রেট লেক অঞ্চলে, সোনার খনিতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা নিয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে রীতিমত বাঁচামরার হুমকিতে মুখে পড়ে গেছেন বেশ কয়েকজন রিপোর্টার।

তাঁদের মত যেসব স্থানীয় সাংবাদিক অনুসন্ধান শেষ করার সুযোগ পাননি, তাদের কাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে জোট বেঁধেছেন ১৫টি দেশের ৪০ জন সাংবাদিক। গ্রীন ব্লাড নামের এই অনুসন্ধানী প্রকল্পটিতে নেতৃত্ব দিচ্ছে জিআইজেএন-এর সদস্য সংগঠন, ফরবিডেন স্টোরিজ। প্যারিস ভিত্তিক এই অলাভজনক প্রতিষ্ঠান, হুমকির কারণে শেষ হয়নি এমন অসমাপ্ত অনুসন্ধান নিয়ে রিপোর্ট করে এবং তা প্রকাশ  করে।

দুর্নীতি, পরিবেশগত অপরাধ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো বিপজ্জনক বিষয় নিয়ে কাজে শক্তি যোগায় একতা – এমন বিশ্বাস থেকে ২০১৭ সালে ফরবিডেন স্টোরিজ প্রতিষ্ঠা করেন অনুসন্ধানী সাংবাদিকরা। এর প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী সম্পাদক লরেন্ত রিচার্ড বলেছেন, “একটি দল হিসেবে, আমরা গণমাধ্যমের শত্রুদের এই সংকেত দিতে চাই: আপনি বার্তাবাহককে থামাতে পারবেন, কিন্তু বার্তাটি প্রচারিত হবেই।”

আট মাস ধরে অনুসন্ধানের পর, ২০১৯ সালের জুলাইয়ে এই গ্রীন ব্লাড প্রজেক্ট থেকে ৩০টির বেশি সংবাদমাধ্যমে সমন্বিতভাবে প্রকাশিত হয়েছে অনেকগুলো ধারাবাহিক প্রতিবেদন, এবং সম্প্রতি ফ্রান্স টিভিতে প্রচারিত হয়েছে একটি ডকুমেন্টারি সিরিজ। এই অনুসন্ধানগুলোর বড় ধরনের প্রভাবও দেখা যেতে শুরু করেছে এরই মধ্যে। যেমন: ক্যানন, অ্যাপল ও নোকিয়ার মতো বড় কিছু প্রযুক্তি কোম্পানি তানজানিয়ার সোনার খনির সঙ্গে তাদের ব্যবসায়িক চুক্তি পুনর্বিবেচনা করছে; গুয়েতেমালার বিচারবিভাগ কিছু ফেরোনিকেল উত্তোলক কোম্পানির সাথে খনিজ আহরণ চুক্তি বাতিল করেছে।

ফরবিডেন স্টোরিজের প্রকল্প ব্যবস্থাপক জুল জিওদা বলেছেন, এতো বড় আকারের একটি আন্তঃসীমান্ত অনুসন্ধান পরিচালনার জন্য সবচে বেশি জরুরি ছিল সব কিছুর মধ্যে সমন্বয় করা।

প্যারিসে, নিজেদের প্রথম বৈঠকে, রিপোর্টাররা শুরুতেই শিখে নিয়েছেন কিভাবে নিরাপদে তথ্য আদানপ্রদানের জন্য একটি ইন্ট্রানেট ব্যবস্থা ব্যবহার করতে হবে। এটি তৈরি করা হয়েছিল কনফ্লুয়েন্স নামের একটি সফটওয়্যার দিয়ে। এর সাহায্যে সবাই পেজ, ব্লগ পোস্ট, মিটিং নোট, ফাইল ইত্যাদি নিরাপদে আদানপ্রদান করতে পারতেন। এখানে সবার একটি ব্যক্তিগত ওয়ার্ক স্পেস তৈরি করা হয়েছিল, যেখানে পাসওয়ার্ড দিয়ে প্রবেশ করা যেত।

এই কাজের জন্য রিপোর্টাররা তিনটি দলে নিজেদের ভাগ করে নেন। ঠিক হয়: প্রতিটি দল একটি করে দেশের দিকে মনোযোগ দেবে। এই পর্যায়ে, তাঁরা চূড়ান্ত করে ফেলেন, কোন প্রতিবেদনগুলো নিয়ে কাজ করবেন। নতুন কী তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যেতে পারে, মাঠপর্যায়ের ব্যক্তিদের সঙ্গে কিভাবে একসাথে কাজ করা যেতে পারে – এমন বিষয় নিয়ে তখন চিন্তাভাবনা চলছিল।

গোপন একটি বৈঠকের মাধ্যমে একজোট হয়েছিলেন গ্রীন ব্লাড অনুসন্ধানের সাংবাদিকরা। ছবি: ফরবিডেন স্টোরিজ

“আমরা তিনটি ভিন্ন মহাদেশের ঘটনা নিয়ে কাজ করেছি এটি দেখানোর জন্য যে: [পরিবেশগত অপরাধের ঘটনাগুলি] সত্যিই একটি বৈশ্বিক ইস্যু,” জিআইজেএনকে বলেছেন জিওদা।

প্রতিটি দলে, কেউ মনোযোগ দিয়েছেন গবেষণায়, আবার কেউ পরিকল্পনা করেছেন মাঠপর্যায়ের রিপোর্টিং নিয়ে। গবেষকরা অনেক ধরনের টুল ব্যবহার করেছেন, যার মধ্যে ছিল: সোশ্যাল মিডিয়া বিশ্লেষণ, বিমান সনাক্তের টুল, ভিডিও ফরেনসিক ও অ্যাডভান্সড ইন্টারনেট সার্চ। মাঠপর্যায়ে কাজ করা সাংবাদিকরা তৈরি করেছেন গুরুত্বপূর্ণ ও গোপনীয় সব সূত্রের নেটওয়ার্ক। ব্যবহার করেছেন এনভায়রনমেন্ট সেন্সর এবং সন্ধান করেছেন নানা উন্মুক্ত নথিপত্র ও কোম্পানি রেজিস্ট্রি।

তানজানিয়ার সোনার খনির উৎস থেকে খোঁজ

কোনো খনিজদ্রব্য, খনি থেকে শুরু করে শেষপর্যন্ত কার কাছে যাচ্ছে; এই সরবরাহ চেইনের সন্ধান করা অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার সবচেয়ে কঠিন কাজ। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো স্বচ্ছতার খাতিরে হয়তো খনিজ পরিশোধনকারী প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করে। কিন্তু কোন খনি থেকে এগুলো উত্তোলন করা হয়, সেই তথ্য সেখানে থাকে না। আর এই অন্ধকার জায়গাটিতেই অনেক গল্প লুকিয়ে থাকে।

তানজানিয়ার একটি সোনার খনি। ছবি: ফরবিডেন স্টোরিজ

গ্রীন ব্লাড প্রজেক্টের সাংবাদিকরা যে খনিটির গোপন খবর উন্মোচন করতে চাইছিলেন, তার অবস্থান ছিল তানজানিয়ার উত্তরের মারা অঞ্চলে। সেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা নিয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে বাধার মুখে পড়েছিলেন বেশ কয়েকজন দেশী-বিদেশী সাংবাদিক। তাদেরকে গ্রেপ্তার, হুমকি বা তথ্য গোপন করতে বাধ্য করেছিল তানজানিয়ার কর্তৃপক্ষ। গার্ডিয়ানসহ গ্রীন ব্লাড প্রকল্পের কয়েকটি সংবাদমাধ্যম, হেনস্তার শিকার হওয়া সেই মানুষদের জবানবন্দি সংগ্রহ করেন। বছরের পর বছর ধরে যারা চুপ ছিলেন, তাদের কথাই উঠে আসে সেখানে।

এই অবৈধ স্বর্ণগুলো শেষপর্যন্ত কোন কোন কোম্পানির কাছে পৌঁছায়, তা অনুসন্ধান করে দেখার সিদ্ধান্ত নেন গ্রীন ব্লাডের সাংবাদিকরা। সেই কাজ শুরুর জন্য প্রাথমিকভাবে তাঁরা অনেক ওপেন সোর্স টুল ব্যবহার করেছেন। অ্যাডভান্সড গুগল সার্চের মাধ্যমে তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রাথমিক দলিল পেয়েছেন। যার মধ্যে ছিল আদালতের নথি ও সরবরাহ চেইন নিয়ে কোম্পানির অভ্যন্তরীণ কিছু পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন। এগুলোর সাহায্যে সাংবাদিকরা একটি হাইপোথিসিস তৈরি করেন। ফ্লাইট ট্র্যাকার্স ব্যবহার করে তাঁরা ধারণা পান, এই স্বর্ণগুলো কোথায় যেতে পারে। আর সোশ্যাল মিডিয়ায় খোঁজ করে তারা এই কোম্পানির কিছু জনসংযোগ কর্মকর্তাকে খুঁজে বের করেন। (এখান থেকে রিপোর্টাররা জানতে পারেন: আগে তারা বিভিন্ন অনিয়মের ঘটনা অস্বীকার করেছিল।) এই কর্মকর্তাদের সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টে পোস্ট করা কিছু সেলফি থেকে এয়ারস্ট্রিপ ও বিমানের স্পষ্ট ছবি দেখতে পান সাংবাদিকরা। এবং এতে করে, কোন বিমানগুলো ট্র্যাক করতে হবে, সে সংক্রান্ত আরো তথ্য পাওয়া যায়।

এভাবে অনলাইনে অনুসন্ধান ও গবেষণার মাধ্যমে আসা বিপুল পরিমাণ তথ্য তারা মিলিয়ে নিচ্ছিলেন মাঠপর্যায়ের সূত্রদের কাছ থেকে আসা তথ্যের সঙ্গে। বেশ কয়েকবার ভুল পথে চলে যাওয়ার পর শেষমেষ এক সূত্রের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তাঁরা অনুসন্ধানের পরিধি কমিয়ে আনতে পারেন। এবং তাঁদের মনোযোগ কেন্দ্রীভূত হয় ভারতীয় একটি পরিশোধনকারী কোম্পানির দিকে। এই কোম্পানিটি ছিল একটি আন্তর্জাতিক শিল্প-বাণিজ্য সেবা-ভিত্তিক গ্রুপের অংশ।

শেষপর্যন্ত, অনুসন্ধানী দলটির প্রয়োজন ছিল সেই খনির সঙ্গে এই কোম্পানির সংযোগের ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া। এবং যখন কোম্পানিটি একটি ইমেইলের জবাব দিয়ে সেটি নিশ্চিত করে, তখনই তারা প্রতিবেদন প্রকাশ করে ফেলার সিদ্ধান্ত নেন। কোম্পানিটিও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল: “আমরা যদি এমন যৌক্তিক প্রমাণ পাই যে, তারা মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে… তাহলে আমরা [এই খনির সঙ্গে] আমাদের সংযোগ ছিন্ন করব।”

এই সংযোগ নিশ্চিত করে ফেলার পর দেখা যায় বেশ কিছু বড় প্রযুক্তি কোম্পানি সেই একই পরিশোধন কোম্পানির কাছ থেকে খনিজ সংগ্রহ করে। এবং এই অনুসন্ধান প্রকাশের পর তারা তাদের সরবরাহ চেইন পূনর্বিবেচনা করার ঘোষণা দিয়েছে। অন্যদিকে, তানজানিয়ার সরকার সেই খনিগুলোর ওপর শাস্তি আরোপ করেছে।

 গুয়েতেমালায় দূষণ ও প্রতিবাদ

গুয়েতেমালার একটি খনিজ উত্তোলন কারখানা। ছবি: ফরবিডেন স্টোরিজ

২০১১ সালে, পূর্ব গুয়েতেমালার পাহাড়-বেষ্টিত দুর্গম গ্রামে এসে হাজির হয় একটি খনিজ ও ধাতু সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান। তারা এই অঞ্চলের একটি ফেরোনিকেল খনিতে খনন শুরু করে। এখান থেকে প্রাপ্ত লোহা ও নিকেলের এই মিশ্র ধাতু তারা বিক্রি করে ইস্পাত উৎপাদনকারী কয়েকটি আন্তর্জাতিক কোম্পানির কাছে। স্থানীয় একটি সহায়ক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এই খনির কর্মকাণ্ড পরিচালনা করত আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানটি।

তারপর থেকে, স্থানীয় একটি আদিবাসী গোষ্ঠী, “মায়া কি’কচি” অভিযোগ করতে শুরু করে যে, খনিতে খননের কারণে সেখানকার হ্রদগুলো দূষিত হয়ে যাচ্ছে এবং বনের গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। সেখানকার বাসিন্দারা বলছিলেন, একটা সময় যেখানে অনেক গাছ দেখা যেত, সেখানকার আকাশে এখন কমলা রঙের ধুলিমেঘ ভেসে বেড়ায়।

২০১৭ সালের ২৭ মে, খনিবিরোধী বিক্ষোভের সময় প্রতিবাদকারীরা পুলিশের দিকে পাথর ছোঁড়ে এবং স্থানীয় জেলে, কার্লোস মাজ গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। স্থানীয় এক সাংবাদিক, কার্লোস চোক একটি স্থানীয় ওয়েবসাইটে (প্রেনসা কমিউনিটারিয়া) মাজের প্রাণহীন নিথর দেহের ছবি প্রকাশ করেন। তা সত্ত্বেও গুয়েতেমালার কর্তৃপক্ষ কারো মারা যাওয়ার কথা অস্বীকার করেছিল।

সেই সাংবাদিক ঘটনাস্থল থেকে রিপোর্ট করেছিলেন। এবং পরবর্তীতে তিনি অনেক হুমকি পেতে থাকেন। তাঁর বিরুদ্ধে একটি অপরাধের তদন্ত শুরু হয় এবং তিনি পালিয়ে যান। (চোকের বিরুদ্ধে এখনো ফৌজদারি মামলা চলছে এবং গত এপ্রিলে তাঁর বাড়ি থেকে অনেক জিনিস চুরি করা হয়েছে। চোক মনে করেন, এটিও তাঁকে ভয় দেখানোরই একটি চলমান প্রক্রিয়া।)

চোকের সঙ্গে জোট বেঁধে, গ্রীন ব্লাড প্রজেক্টের সাংবাদিকরা দেখিয়েছেন: কিভাবে গুয়েতেমালার কর্তৃপক্ষ “বারবার মিথ্যা বলেছে” সেই জেলের মৃত্যু নিয়ে। পুলিশের যে ইউনিটটি গুলি চালিয়েছিল, তাদের নেতৃত্বে থাকা অফিসারকে চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল চোকের সেসব ছবি ও ভিডিও। সেদিনের সেই ছবি ও ভিডিওগুলো থেকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রমাণ পাওয়া যায়। অফিসারদের ইউনিফর্ম থেকে জানা যায় তারা কোন শাখার পুলিশ। এবং তাদের ব্যাজগুলো থেকে লাইন অব কমান্ড সনাক্ত করা যায়। একটি ছবি খুব ভালোভাবে খেয়াল করে বোঝা যায়, সেখানে এক পুলিশ অফিসার সরাসরি সেই জেলের দিকে বন্দুক তাক করে আছেন। অথচ কর্তৃপক্ষ দাবি করে আসছিল, সেদিন কোনো পুলিশ সদস্যের কাছে অস্ত্র ছিল না।

ওপেন সোর্স অনুসন্ধানী সাংবাদিক ইউরি ভন ডার ওয়েইডের সাহায্য নিয়ে তাঁরা পুনঃনির্মান করেন কার্লোস মাজের শেষ মুহূর্তগুলি। গ্রীন ব্লাডের ডকুমেন্টরি সিরিজ থেকে দেখা যায়, এই অনুসন্ধানী দল, তাদের সব ভিজ্যুয়াল প্রমাণ নিয়ে সেই পুলিশ কর্মকর্তার মুখোমুখি হয়েছে, আর তিনি সব অভিযোগ অস্বীকার করছেন।

সাংবাদিকরা সেই জনগোষ্ঠীর পরিবেশগত বিপর্যয় নিয়ে আশঙ্কার বিষয়টিও খতিয়ে দেখেছেন। তারা একটি এনভায়রনমেন্টাল সেন্সর ব্যবহার করে সেই খনির আশেপাশের বায়ুর বিশুদ্ধতা পরীক্ষা করেছেন এক মাস ধরে। সেখানে দেখা গেছে ক্ষতিকর ধুলিকনার পরিমাণ অনেক বেশি মাত্রায় আছে। কখনো কখনো সেটি পাওয়া গেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আদর্শ মানদণ্ডের চেয়ে ছয়গুন বেশি পরিমাণে।

এই অনুসন্ধান প্রকাশিত হওয়ার পর, গুয়েতেমালার সাংবিধানিক আদালত সেই খনিগুলোর সব কর্মকাণ্ড স্থগিত করার আদেশ দেয়। যদিও খনি পরিচালনাকারীরা পরিবেশের কোনো ক্ষতি করার কথা ধারাবাহিকভাবে অস্বীকার করে গেছে। খনি পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত একটি প্রতিষ্ঠান ফ্রান্সের দৈনিক লে মনডের বিরুদ্ধে মানহানির মামলাও করেছিল। তাদের দাবি ছিল: ফরাসি পত্রিকাটি প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে “ইচ্ছাকৃতভাবে ভুল  ও অনুমাননির্ভর তথ্য উপস্থাপন করেছে।”

ভারতের “বালু মাফিয়াদের” নিয়ে অনুসন্ধান

ভারতে, বালু মাফিয়া বলতে বোঝানো হয় ব্যক্তি, সংগঠন ও অপরাধী গ্রুপের জোটকে, যারা নির্মানকাজের জন্য অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের মাধ্যমে মুনাফা করে। দেশটিতে বালু উত্তেলন একটি বড় বাণিজ্য। সরবরাহের চেয়ে চাহিদা বেশি থাকায়, অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে অনেকে। আর এতে করে উপকূলবর্তী শহরগুলো ক্রমেই সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির মুখে অরক্ষিত হয়ে পড়ছে। বালু উত্তোলন নিয়ে কাজ করতে গিয়ে নানা রকম হুমকির মুখে পড়তে হয়েছে এনজিও কর্মী ও সাংবাদিকদের।

হিন্দি ভাষার একটি সংবাদমাধ্যমের অভিজ্ঞ অনুসন্ধানী সাংবাদিক জগেন্দ্র সিং একটি প্রতিবেদনে উন্মোচন করেছিলেন – উত্তর প্রদেশের এক জেষ্ঠ্য মন্ত্রী এই বালু উত্তোলন বাণিজ্যে জড়িত। এর জের ধরে ২০১৫ সালের জুনে তাঁর বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়। গুরুতর দগ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তির পর তিনি একটি ভিডিও বার্তায় বলেন যে, সেই রাজনীতিবিদের সমর্থকরা তাঁকে হত্যার উদ্দেশে বাড়িতে আগুন দিয়েছে। তিনি পরবর্তীতে মারা যান।

জগেন্দ্রর সেই ভিডিওটি থাকার পরও এই ঘটনাকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়া হয়। তাঁর শ্রাদ্ধের দিনে, জগেন্দ্রর পরিবার, হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্রের অভিযোগে একটি মামলা দায়ের করে। কিন্তু পরবর্তীতে তারা এই মামলাটি প্রত্যাহার করে নেয়।

সিংয়ের এই হত্যার সঙ্গে সেই মন্ত্রী ও তার সমর্থকদের কোনো সংযোগ আছে কিনা, তা খুঁটিয়ে দেখার জন্য ফরবিডেন স্টোরিজের এই অনুসন্ধানী দল জোট বাঁধে সন্ধ্যা রবিশংকরের সাথে। তিনি খুবই অল্প কিছু সাহসী সাংবাদিকদের মধ্যে অন্যতম, যারা এখনো “বালু মাফিয়াদের” নিয়ে অনুসন্ধান করছে।

এই অনুসন্ধানের প্রধান একটি বিষয় ছিল সিংয়ের পরিবার ও সাংবাদিকদের মধ্যে একটি আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলা। রবিশংকর জিআইজেএন-কে বলেছেন, “আমরা ভেবেছিলাম, আমাদের চেহারাগুলো দেখলে তারা আমাদের সঙ্গে কথা বলবে। ”

এটি সত্যিই কাজ করে এবং রবিশংকর যেমনটি বলেছেন, নিরবতার “বাঁধ ভেঙে যায়”। আন্তর্জাতিক সাংবাদিকদের এই জোটের কাছ থেকে সুরক্ষার আশ্বাস পেয়ে সিংয়ের পরিবার কথা বলে। তারা জানায়, মামলাটি প্রত্যাহার করে নেওয়ার বিনিময়ে তাদের ৩০ লাখ রুপি (প্রায় ৪০ হাজার ডলার) নগদ দেওয়া হয়েছিল।

কিন্তু এই অর্থ লেনদেনের কোনো কাগজপত্র না থাকায়, অনুসন্ধানী দলটি আরো অনেকের ভাষ্য সংগ্রহ করার দিকে মনোযোগ দেয়।

গোপন ক্যামেরা ব্যবহার করে সাংবাদিকরা সিংয়ের এক বন্ধুর সঙ্গে কথোপকথন রেকর্ড করেছেন। যিনি সেই হামলার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন এবং পরবর্তীতে নিজের ভাষ্য প্রত্যাহার করেছিলেন। সাংবাদিকরা কথা বলতে এসেছে জানতে পেরে সেই প্রত্যক্ষদর্শী নারী কোনো একজনকে ফোন করেন। যাকে তিনি বলছিলেন নিজের “বড় ভাই”। কিছুক্ষণ পর, রবিশংকর অন্য আরেকজন রাজনীতিবিদের কাছ থেকে ফোন পান। এবং তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয় যে, তিনি সেখানে কেন গিয়েছেন।

স্থানীয় পুলিশ স্টেশনের কর্মকর্তাদেরও মোকাবিলা করতে হয়েছে রবিশংকরকে। যেখানে কর্মকর্তারা তাঁকে সেই এফআইআর দিতে পারেননি। এই নথিটি সাধারণত কোনো তদন্ত শুরুর সময়ই তৈরি হয়।

সেই মন্ত্রী পরবর্তীতে সংসদ নির্বাচনে হেরে অবসরে চলে গেছেন। অনুসন্ধানের বিষয়ে মন্তব্যের জন্য যোগাযোগ করা হলেও সেই অনুরোধ ফিরিয়ে দিয়েছেন তাঁর মুখপাত্র।

তামিল নাড়ুর উপকূলবর্তী এক গ্রামের এই কৃষক বলেছেন, বালু মাফিয়াদের প্রভাবে তিনি সব কিছু হারিয়েছেন। ছবি: ফরবিডেন স্টোরিজ

বালিয়াড়ি কমতে থাকায়, সমুদ্র ক্রমেই ভারতের মূল ভূখণ্ডের দিকে এগিয়ে আসছে। রবিশংকর বলেছেন, “পানির মতো বালুও এখন দুস্প্রাপ্য হয়ে পড়ছে” এবং সাংবাদিকদের এই জোটবদ্ধ অনুসন্ধানের ফলে ভারতে এই বিষয়টি নিয়ে আরো সচেতনতা তৈরি হয়েছে।

রিপোর্টার হিসেবে এই অনুসন্ধানী প্রকল্পটি তাঁকে আরো সাহস ও স্বাধীনতা দিয়েছে নিজের কাজগুলো চালিয়ে যাওয়ার জন্য। তিনি বলেছেন, “আমি এখন নিজেকে অনেক সুরক্ষিত মনে করি। [বালু মাফিয়াদের নিয়ে রিপোর্টিং] করতে গিয়ে আমি অনেক উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় ভুগতাম। কিন্তু এখন আমি জানি যে, যদি খারাপ কিছু ঘটে যায়, তাহলে আমার হয়ে কথা বলার মতো আরো অনেক সাংবাদিক থাকবে।”


ফেদেরিকা মারসি একজন ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক। তিনি কাজ করেন মানবাধিকার ও পরিবেশগত ইস্যু নিয়ে। তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছে আল জাজিরা, ভাইস ইউকে, ওপেন ডেমোক্রেসি, মিডল ইস্ট ম্যাগাজিন ও উইয়ার্ডে। তিনি সাংবাদিকতার ডিগ্রি নিয়েছেন লন্ডনের সিটি ইউনিভার্সিটি থেকে।

লেখাটি পুনঃপ্রকাশ করুন


Material from GIJN’s website is generally available for republication under a Creative Commons Attribution-NonCommercial 4.0 International license. Images usually are published under a different license, so we advise you to use alternatives or contact us regarding permission. Here are our full terms for republication. You must credit the author, link to the original story, and name GIJN as the first publisher. For any queries or to send us a courtesy republication note, write to hello@gijn.org.

পরবর্তী

কেস স্টাডি সংবাদ ও বিশ্লেষণ

অবরুদ্ধ সাংবাদিকতা: অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে ভারত ও হাঙ্গেরির সম্পাদকদের পাঁচ পরামর্শ

গণতন্ত্রের বহিরাবরণের আড়ালে ক্রমেই স্বেচ্ছাচারী ও দমনমূলক হয়ে উঠছে ভারত ও হাঙ্গেরির মতো দেশগুলো, যেখানে ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা। এমন পরিবেশে সাংবাদিকেরা কীভাবে তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে পারেন এবং সংবাদমাধ্যম টিকিয়ে রাখতে পারেন— তা নিয়ে পাঁচটি কার্যকরী পরামর্শ পড়ুন এই লেখায়।

oscar nominated documentary features

সংবাদ ও বিশ্লেষণ

যা দেখবেন: ২০২৩ সালে অস্কার মনোনীত তথ্যচিত্র

রাশিয়ার বিরোধীদলীয় নেতা আলেক্সি নাভালনিকে হত্যাচেষ্টা, বন্যপ্রাণী ও মানুষের বন্ধুত্ব, আর্কটিক উপকূলে জলবায়ু পরিবর্তনের তাক লাগানো প্রভাব— বৈচিত্রপূর্ণ নানা বিষয় নিয়ে নির্মিত কয়েকটি তথ্যচিত্র মনোনয়ন পেয়েছে এ বছরের অস্কারের জন্য।

The Wire retracted story YouTube screenshot

পরামর্শ ও টুল সংবাদ ও বিশ্লেষণ

ভারতে প্রত্যাহার করা একটি অনুসন্ধান থেকে শিক্ষা: বানোয়াট প্রমাণ যেভাবে এড়াবেন

অনুসন্ধান করতে গিয়ে কোনো দিন হয়তো আপনিও এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে পারেন। দেখা গেল, কোনো সোর্স আপনাকে একটি জাল বা ভুয়া নথি ধরিয়ে দিয়েছে। অথবা আপনাকে ফাঁদে ফেলতেই, কোনো অপরাধের প্রমাণ হিসেবে একটি বানোয়াট কাগজ আপনার অফিসে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি এমন ফাঁদে পড়ে, একটি অনুসন্ধান প্রত্যাহার করে নিতে হয়েছে ভারতের স্বাধীন ও অলাভজনক গণমাধ্যম দ্য অয়্যারকে। পড়ুন, এমন ফাঁদ কীভাবে এড়াবেন।

সংবাদ ও বিশ্লেষণ সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা

‘হাতে কলম তোলাটাই ছিল, বৈপ্লবিক’: ভারতের প্রান্তিক, গ্রামীণ নারীদের গল্প বলা

মীরা জাতভ ভারতের পুরস্কারজয়ী তৃণমূল নারীবাদী সংবাদমাধ্যম, খবর লহরিয়ার সহ-প্রতিষ্ঠাতা। ভারতে লিঙ্গ-ভিত্তিক সহিংসতা ও বর্ণপ্রথা নিয়ে সাহসী অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জন্য তিনি প্রশংসিত হয়েছেন৷ এখানে থাকছে লন্ডনে সেন্টার ফর ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজমের গ্রীষ্মকালীন অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা সম্মেলনে তাঁর দেয়া বক্তৃতাটি। পড়ুন, আপনি অনুপ্রাণিত হবেন, সন্দেহাতীত।